বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের এক আদর্শ পীঠস্থান হয়ে ওঠা গড়পাড়ের রায়চৌধুরী পরিবারে জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়। যদিও ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর এবং বাবা সুকুমারের মতো যশস্বী মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি, তবু রক্তে ছিল সাহিত্য, সঙ্গীত, আর শিল্পচর্চার প্রতি এক অমোঘ ভালোবাসা। এই ভালোবাসার টানেই অর্থনীতির ডিগ্রিকে শিকেয় তুলে তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে গিয়ে ছবি আঁকা শিখলেন নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ আর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের কাছে। তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে ভারতীয় শিল্পকলার ঐতিহ্যকে বিজ্ঞাপন জগতে কাজে লাগানো। সেই মতো ১৯৪৩ সালে কলকাতার ডি যে কিমার কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে সত্যজিৎ শুরু করেন তাঁর পেশাদার জীবন। প্রায় একই সময়ে ছোটদের মৌচাক পত্রিকায় একটি সরস গল্প ‘অ্যাটাচি কেস’-এর সঙ্গে ছাপা হয় তাঁর সর্বপ্রথম ইলাস্ট্রেশন।
একেবারে আনকোরা অবস্থার কাজ হলেও এখানে কম্পোজিশন এবং বিভিন্ন চরিত্রের হাবভাবগুলোর মধ্যে যথেষ্ট সম্ভাবনার ছাপ রেখেছিলেন সত্যজিৎ। বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট প্রেসের সঙ্গে শুরু থেকেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এই পর্বে অবনীন্দ্রনাথের ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনি, সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু,খাই খাই কিংবা বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আম আঁটির ভেঁপু-এর মতো বাংলা সাহিত্যের কিছু সেরা লেখার সঙ্গে ছবি আঁকলেন সত্যজিৎ। এখানে বাংলা লোকশিল্পের মোটিফের ব্যবহার থেকে শুরু করে রাজপুত মিনিয়েচারের আদল, কমিক স্টাইল এমনকী লিনোকাট পদ্ধতিকে অনুসরন করে গ্রামবাংলার মেজাজকে ফুটিয়ে তোলা— সর্বত্র পাওয়া যায় এক আশ্চর্য মুন্সিয়ানার ছাপ। ১৯৫২ সালে শারদীয়া দেশ পত্রিকায় রস-সাহিত্যিক পরশুরামের ‘সরলাক্ষ হোম’ গল্পের সঙ্গে হেডপিস সমেত বেশ কয়েকটি ইলাস্ট্রেশন ছিল সত্যজিতের। মূল গল্পে আগাগোড়া প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকা স্যাটায়ারকে ছবির মধ্যে যে সূক্ষতার সঙ্গে তিনি প্রয়োগ করেছিলেন তা সত্যি মনে রাখার মতো। এরপর ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ সত্যজিৎকে এনে দেয় বিশ্বজোড়া সন্মান এবং ছবি আঁকার জগত থেকে সরে এসে তিনি পুরোপুরি চলচ্চিত্র বানানোর কাজে যুক্ত হয়ে যান। ঘটনাচক্রে ১৯৬১ সালে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। অন্তরঙ্গ বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি নতুনভাবে শুরু করেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রকাশনা।
একেবারে গোড়া থেকেই সন্দেশ-এর প্রতিটি সংখ্যার রঙচঙে প্রচ্ছদ নিজের হাতে এঁকেছেন সত্যজিৎ, যেখানে দেখা যায় ছোটরা খুশি হয়ে তাদের প্রিয় পত্রিকাটি পড়তে ব্যস্ত এবং সঙ্গে রয়েছে মাছ, ব্যাঙ, হনুমান, বাঘ, রোবট কিংবা প্রজাপতিদের নানা কান্ডকারখানা। শিশু-কিশোরদের জগতকে কতখানি গভীরভাবে চিনতেন সত্যজিৎ এই প্রচ্ছদগুলো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত এবং বহু বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া ছোটদের এই মাসিক পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব তাঁকে ফিরিয়ে আনে ইলাস্ট্রেশন এবং প্রচ্ছদ আঁকার কাজে। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রস্রষ্টা হিসেবে চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও জীবনের প্রায় শেষ দিন অবধি তিনি এই কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন অক্লান্তভাবে। সেই সঙ্গে এই পর্বের শুরু থেকেই তাঁর প্রতিটি আঁকার গঠন আর কলাকৌশলের মধ্যে দেখা যায় মনমাতানো বৈচিত্র। তা সে মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র-এর মতো লোককথাই হোক কিংবা মাকু বা টলিং–এর মতো সরস, আজগুবি কাহিনি। একেবারে গোড়া থেকেই সন্দেশ-এর প্রতিটি সংখ্যার রঙচঙে প্রচ্ছদ নিজের হাতে এঁকেছেন সত্যজিৎ, যেখানে দেখা যায় ছোটরা খুশি হয়ে তাদের প্রিয় পত্রিকাটি পড়তে ব্যস্ত এবং সঙ্গে রয়েছে মাছ, ব্যাঙ, হনুমান, বাঘ, রোবট কিংবা প্রজাপতিদের নানা কান্ডকারখানা। শিশু-কিশোরদের জগতকে কতখানি গভীরভাবে চিনতেন সত্যজিৎ এই প্রচ্ছদগুলো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। ছবি আঁকার পাশাপাশি কিছুটা অবধারিতভাবেই ছোটদের মনের মতো গল্প উপন্যাস লিখতেও শুরু করলেন তিনি যা ইলাস্ট্রেটর হিসেবে তাঁর কাজের মধ্যে এনে দিল এক অনন্য গভীরতা।
ফেলুদা সিরিজের আঁকায় যেমন রয়েছে ড্রয়িং আর কম্পোজিশনের অভিনবত্ব তেমনই প্রোফেসর শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির রঙিন ছবি যেন একেকটি ত্রিমাত্রিক রূপকল্প। পরবর্তীকালে দেশ আর আনন্দমেলার মতো বানিজ্যিক পত্রিকায় লেখক হিসেবে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেওয়ায় সুযোগ পেয়েছিলেন আরোও বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকার, যা সত্যজিৎকে পৌঁছে দিয়েছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, সব কিছু ছাপিয়ে শুধুমাত্র সন্দেশ-এর জন্যই তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর ইলাস্ট্রশনের সেরা সম্ভার। অন্তত বাংলা সাহিত্যে যার কোনও তুলনা পাওয়া অসম্ভব।
ছবি সৌজন্যে লেখক