কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম সম্প্রীতির অগ্রদূত

পল্টন থেকে ফিরে এলেন এক হাবিলদার৷ কাজী নজরুল ইসলাম৷ কারণ রেজিমেন্ট ভেঙে গেছে৷ কাজী নজরুল ইসলাম পল্টনে থাকার সময়ই সাহিত্যচর্চা করতেন৷ কলকাতার সাময়িক পত্র-পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠাতেন৷ সাময়িক পত্র-পত্রিকাগুলির গ্রাহক ছিলেন৷ বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ভালোই যোগাযোগ ছিল৷ পল্টনে বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন৷ হাফিজ, রুমি এখানেই পড়েছিলেন৷ আর শিখেছিলেন গান৷ উস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধে‍ছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের৷ ছোটবেলায় লোটোর দলে গান শেখা, গান বাঁধা, গান গাওয়াটা তখন কাজে লেগে গেল৷ 

ফি‍রে এলেন কলকাতায়৷ বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দের মেসবাড়িতে উঠলেন৷একবেলার বেশি আশ্রয় হয়নি৷ কারণ তিনি মুসলমান৷ শৈলজানন্দকেও বিদায় নিতে হয়েছে৷ মাথার উপর উন্মুক্ত আকাশ নিয়ে কলকাতার রাস্তায় দুই বন্ধু৷ সাতঘাটের জল খেয়ে কাজী নজরুল খানিকটা থিতু হলেন আর এক পরিযায়ী কর্মী মুজফ্‌ফর আহমদের ঘরে৷ শৈলজানন্দ থাকতে গেলেন তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ি৷ কলকাতার জীবন শুরু হল কাজী নজরুলের৷ মোসলেম ভারত, সওগাত, বিজলী পত্রিকায় লিখছেন তখন৷ দেশে তখন অসহযোগ আন্দোলনের আবহাওয়া৷ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছে৷ বাংলার তরুণ সমাজ একটা আগুনের ফুলকির অপে‍ক্ষা করছে৷ তখন বাংলা সাহিত্য শাসন করছেন রবীন্দ্রনাথ৷ সঙ্গে আছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী৷ ইতোমধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন ‘শাত-ইল-আরব’-এর মতো কবিতা৷বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা শুনল এক হাবিলদার কবির কণ্ঠ৷ বিভিন্ন মহলে, আড্ডাখানায় নজরুল গানও গাইছেন তখন৷ তিনি গানের জন্যও জনপ্রিয় হচ্ছেন ক্রমশঃ৷

হাবিলদার বেশে নজরুল
হাবিলদার বেশে নজরুল

১৯২১ সালে, বছর শেষে তালতলা লেনের এক খুপরিতে বসে লিখে ফেললেন ‘বিদ্রোহী’৷ প্রথম শ্রোতা মুজফ্‌ফর আহমেদ৷ প্রকাশিত হল ‘বিজলী’ ও ‘মোসলেম ভারত’৷ সব কিছু পাল্টে গেল মুহূর্তে৷ সেই অগ্নিশলাকাটি নিক্ষিপ্ত হল বাংলার জাগরুক, উন্মুখ দেশপ্রেমীদের দিকে৷ মেতে উঠল বাংলা৷ 

কোনও কিছুই আর আগের মতো রইল না৷

‘আমি সেইদিন হব শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল অকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না৷’

অন্দোলনের অভিমুখ নির্দিষ্ট হয়ে গেল৷ নজরুলে মেতে উঠল বাংলা৷

পুরো নজরুল জীবন নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা নয়৷ তবে তাঁর মহান কীর্তির আরও কিছু বিবরণ দেওয়া দরকার৷ অজস্র কবিতা লিখেছেন৷ তা নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে৷ যেমন ‘বিদ্রোহী’ মানুষের মন জয় করেছে তেমনই সমালোচনার মুখেও পড়েছে৷ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছন্দ নিয়ে কথা উঠেছে৷ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ‘প্যারডি’ হয়েছে৷ মোহিতলাল মজুমদার তাঁর লেখার ‘কপি’ বলেছেন৷ মুসলমানরা ‘কাফের’ বলেছেন৷ কাজী নজরুল কোনও তোয়াক্কা করেননি৷ তবে সব বিতর্ক থেকে গেছে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে৷ আর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শতবর্ষ পেরিয়ে সমান সজাগ রয়েছে৷ 

3/4 সি তালতলা লেনের এই বাড়িতেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করা হয়েছিল
3/4 সি তালতলা লেনের এই বাড়িতেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করা হয়েছিল

একটা সময় কাজী নজরুল কবিতা লেখা ছেড়েই দিলেন৷ ডুব দিলেন সুরের সাগরে৷ গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ নিলেন৷ সেটাই তাঁর বাড়িঘর হয়ে উঠল৷ কাজী নজরুলের গান লেখা ও সুর দেওয়া প্রবাদে পরিণত হয়েছিল৷ কাননবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দিনদের গান শিখিয়েছিলেন৷ বন্ধু নলিনীকান্ত সরকারের অনুরোধে গান লিখে‍ছেন ও সুর দিয়েছেন অজস্র৷ তাঁর গানের যে অসমাপ্ত তালিকা তৈরি হয়েছে, তা-ই প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি৷ সব ধরনের গান সেখানে আছে৷ গানের দু’টি ক্ষেত্রে‍ কাজী নজরুলের অবদান বাঙালি চিরদিন মনে রাখবে৷ ইসলামি সঙ্গীত ও শ্যামাসঙ্গীত৷ নজরুলই প্রথম বংলায় ইসলামি গান লিখেছেন ও গেয়েছেন৷ সঙ্গে আছেন শিল্পী আব্বাসউদ্দিন৷ ইসলাম ধর্মে গান-বাজনা নিষিদ্ধ৷ কাজী নজরুলের মাথার উপর ফতোয়া আছে৷ কাফের৷ তবুও তাঁকে‍ দমানো যায়নি৷ 

‘ও মন, রমজানের ও রোজা শেষে এল খুশির ঈদ৷’

একসময় বাংলায় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে‍ দিয়েছিল৷ আজও দেয়৷ তিনিই প্রথম বাংলায় আল্লাহ ও নবী (স.)-এর প্রশংসা করে গান-কবিতা লেখেন, যা ‘হামদ’ ও ‘গ’ত’ হিসেবে বিখ্যাত৷

“আমিনার কোলে নাচে হেলে‍-দুলে৷

শিশু নবী আহমদ রূপের লহর তুলে‍

রাঙা মেঘের কাছে ঈদের চাঁদ নাচে‍—

যেন নাচে ভোরের আলো গোলাপ গাছে৷”

এখানেই আসেন রবীন্দ্রনাথ৷ গীতাঞ্জলির একটি গান—

‘কোন আলেতে প্রাণের প্রদীপ

জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো

সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো

পাগল ওগো, ধরায় আসো!’

প্রায় তিনশো’র কাছাকাছি শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন৷ 

১) বল মা শ্যামা বল

২) আমার হৃদয় হবে রাঙাজবা

৩) আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে‍

৪) আমার মা যে গোলাপ সুন্দরী

শ্রীশ্রী চৈতন্যলীলা, ঝুলন, বিজয়া দশমী, ঈদ, বকরিদ, বাঙালির প্রতিটি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়ে কাজী নজরুল অজস্র গান লিখেছেন৷ যেগুলো বাঙালির হৃদয় জয় করেছে৷ সঙ্গীত সৃষ্টির কাজে যখন তিনি রত, তখন বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনও জোরদার হচ্ছে৷ কাজী নজরুল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, এ কে ফজলুল হক, সুভাষচন্দ্র বসু’র খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন৷ সেই সময় এই জাতীয় নেতাদের সভাসমিতিতে কাজী নজরুলের গান ছিল অপরিহার্য৷ ফজলুল হকের একবার নির্বাচনী প্রতীক ছিল ‘লাঙল’৷ সেটাকে জনপ্রিয় করার জন্য কাজী নজরুল নতুন গান লিখে সারা বাংলায় প্রচার করেন৷ 

বাঙালি মুসলমানরাও যে উচ্চমানের বংলা লিখতে পারে, তার প্রমাণ দেন কাজী নজরুল ও মুজফ্‌ফর আহমদ ‘নবযুগ’ পত্রিকায়৷ কিন্তু বেশিদিন সেটা চলেনি৷ রাজরোষে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়৷ কিন্তু কাজী নজরুল বসে থাকার মানুষ নয়৷ ১৯২২ সালে প্রকাশ করলেন ‘ধূমকেতু’৷ রবীন্দ্রনাথকে আশীর্বাদ পাঠাবার অনুরোধ করলেন৷ একটু দেরিতে হলেও কবি আশীর্বাদ পাঠালেন ছোট কবিতা দিয়ে৷ পত্রিকায় সেটি প্রথম ছাপা হল৷

গান্ধিজীর চরকা আন্দোলন জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়৷ সবাই এই আন্দোলনে সহমত ছিলেন না৷ এমনকী দেশবন্ধু পর্যন্ত সন্দিহান ছিলেন৷ কিন্তু কাজী নজরুলের অন্তর এই ডাকে সাড়া দিয়েছিল৷ চরকার ঘরঘর শব্দে তিনি আলোড়িত হয়েছিলেন৷ ‘চরকা’ নিয়ে গান লিখে সভাসমিতিতে গাইতেন৷ গান্ধিজীর উপস্থি‍তিতেও গেয়েছেন৷ গান্ধিজী ও সুভাষচন্দ্র বসু- দু’জনেরই অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন কাজী নজরুল৷

সারাজীবন দারিদ্র ও বাসাবদলের মধ্যে কাটিয়েছেন কাজী নজরুল৷আমরা সবাই জানি ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন৷ সীমাহীন দারিদ্র৷ কাজ করেছেন পাউরুটির দোকানে৷ মাজার সংরক্ষণ, মসজিদের রক্ষণাবে‍ক্ষণ করেছেন৷ লোটোর দলে গান বেঁধে‍ সামান্য উপার্জন করেছেন৷ গান গাইতেন, বাজনা বাজাতেন৷ কিন্তু এভাবে জীবন যায়নি৷ চলে গেছেন সেনাবাহিনীতে৷ ফিরে কলকাতাকে আশ্রয় করেছেন৷ কপর্দকহীন৷ কিন্তু কাজী নজরুলের বন্ধুভাগ্য খুব ভালো৷ মুজফ্‌ফর আহমদ, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন, নলিনীকান্ত সরকার, হেমন্ত সরকার, আফজালুল হকদের মতো বন্ধু পেয়েছিলেন তিনি৷ তাঁরাই তাঁকে আগলিয়ে রাখতেন৷ পয়সার অভাব, ভাড়া দেবার ক্ষমতা নেই৷ একটার পর একটা বাসাবদল করেছেন৷ প্রায় চল্লিশবার বাসাবদলের নথি পাওয়া যায়৷ বাসা পাচ্ছেন না বলে চলে গেলেন হুগলি৷ সংসার বড় হয়েছে৷ স্ত্রী, শাশুড়ি, ছেলে মিলিয়ে বড় সংসার৷ সমানতালে বেড়েছে নজরুলের বেহিসেবীয়ানা৷ হুগলি থেকে গেলেন কৃষ্ণনগর৷ হেমন্ত সরকার নিয়ে গেলেন৷ গ্রেস কটেজ৷ এখানেই সবচাইতে বেশিদিন ছিলেন৷ প্রায় তিন বছর৷ ১৯২৯৷ এই সময় ‘সওগাত’ পত্রিকার সঙ্গে‍ তাঁর চুক্তি হয়৷ মাসিক বেতন ১২৫ টাকা৷ যাতায়াত ভাড়া৷ সপ্তাহে দু’দিন আড্ডা ও সওগাতে লখো৷ সেই সময় টাকাটা খুব ছোট নয়৷ নজরুল তখন লিখছেন অজস্র৷ গাইছেন৷ আড্ডা দিচ্ছেন৷ কাজী নজরুলের গান ছাড়া কোনও আড্ডা জমছে না৷ নিয়মিত ঢাকায় যাচ্ছেন৷ থাকছেন বন্ধু, ‘বুদ্ধি‍র মুক্তি’ আন্দোলনের নেতা কাজী মোতাহারের বাড়ি৷ গান শেখাচ্ছেন রানু সোমকে, আড্ডা দিচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু অথবা উমা মৈত্রদের বাড়ি‍৷ সেখানে‍ অন্য কাজের সঙ্গে খেলছেন দাবা৷ তৈরি হল অসাধারণ গল্প ‘শিউলি মালা’৷ কৃষ্ণনগরের বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে দু-তিন দিন পর ফিরবেন বলে আড়াই মাস কাটিয়ে দিলেন ঢাকায়৷ ‘বোহেমিয়ান’ আর কাকে বলে? নজরুলের এই কৃষ্ণনগর বাস বিখ্যাত হয়ে আছে ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে৷ সেই চিনাপাড়াটাও আছে৷ ‘সওগাত’ পত্রিকায় কাজ, গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করে সামান্য সচ্ছলতার মুখ দেখলেন কবি৷ কিন্তু সইলো না৷ সইবার নয়৷ কিনে ফেললেন বড় মোটরগাড়ি৷ তার টাকা মেটাতে প্রাণান্ত হলেন৷ তাঁর গানের রেকর্ড প্রচুর বিক্রি হচ্ছে দেখে নিজেই খুলে ফেললেন রেকর্ড বিক্রির দোকান৷মানুষ আসতে‍ শুরু করল তাঁর সঙ্গে দোকানে আড্ডা দিতে৷ রেকর্ড কিনতে নয়৷ প্রচুর ক্ষতি করিয়ে‍ দোকান তুলে দিতে হল৷ 

পরিবারের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম
পরিবারের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম

একথার কোনও বিকল্প নেই বা অসমান্তরালভাবে সত্য যে, কাজী নজরুল দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি করেছেন৷ কিন্তু মনটা ভারী হয়৷ বি‍ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে যে, পুত্র বুলবুল প্রয়াত হয়েছে, তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য ১২৫ টাকার মতো দরকার৷ ঘরে একটা পয়সা নেই৷ প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরে কোনও টাকা জোগাড় করতে পারেননি৷ কেবলমাত্র ডি এম লাইব্রেরি কিছুটা সাহায্য করেছিল৷ এক প্রকাশক তাঁকে‍ সেই অবস্থায় বসে গান লিখে দেবার কথা বলেন৷ কোনও বিকল্প তাঁর সামনে নেই৷ তৈরি হল— ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে গানের বুলবুলি৷’ ‍প্রতিটি শব্দে ঝরে পড়েছে বেদনা৷ সেদিন কে কীভাবে এমন ঘটনায় কাজী নজরুলের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তার সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না৷ তবে দু’জন মানুষ তাঁর জীবনের প্রতিটি ওঠাপড়ায় পাশে থেকেছেন৷ মুজফ্‌ফর আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন৷ এঁরা না থাকলে কাজী নজরুল কোথায় ভেসে যেতেন৷ কাজী নজরুল যখন বাক্যহারা, তখনও তাঁর পরিবার কীভাবে অন্নসংস্থান করবে, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন মুজফ্‌ফর৷ প্রকাশকদের কাছে আবেদন করা, অর্থ সংগ্রহ করার কাজও তিনি করতেন৷ তবে কাজী নজরুলের ছন্নছাড়া জীবন অতিবাহিত করাটাও তাঁর সংসারে দুর্যোগ নেমে আসার কারণ ছিল৷ ইতোমধ্যে তাঁর স্ত্রী প্রমীলা নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ তবে প্রমীলা নজরুলের মা, কাজী নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা দেবী নজরুলের সংসার দু’হাতে সামলেছেন৷ বর্ধিষ্ণু, বদ্যিবাড়ির বিধবা বধূ, সমস্ত আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলমান ছেলের সঙ্গে কন্যার বিয়ে দিলেন এবং এক কথায় মেয়ের সংসারে জমে গেলেন৷ এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না৷ সেদিন তো এটা অকল্পনীয় ছিল৷ আজও তার পরিবর্তন কতটুকু হযেছে জানি না! এই ঘটনাবলীর পিছনে প্রধান শক্তি অবশ্যই ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম৷

কাজী সাহেব যতই প্রেমের গান বা কবিতা লিখুন না কেন—বুকের মধ্যে ছিল বিদ্রোহের আগুন৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন তিনি মেনে নিতে পারতেন না৷ সেই কারণে কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনই সংবাদ প্রকাশের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল৷ মুজফ্‌ফর আহমদ, এ কে ফজলুল হকের সহযোগিতায় প্রথম প্রকাশ করেন ‘নবযুগ’ পত্রিকা৷ এই পত্রিকাতে জাতীয় আন্দোলনের কর্তব্যগুলি বর্ণনা করা হয়৷ বিশ্বে যেসব সংবাদ গুরুত্বপূর্ণ তার সারসংক্ষেপ নজরুল নিজে করতেন এবং তা পত্রিকায় ছাপা হত৷ তার আগে কাজী নজরুল কোনও সংবাদপত্রে কাজ করা তো দূরের কথা, দরজায় পর্যন্ত যাননি৷ তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বড় বড় সম্পাদকীয় লিখতেন৷ বাঙালি মুসলমানরাও যে উচ্চমানের বংলা লিখতে পারে, তার প্রমাণ দেন কাজী নজরুল ও মুজফ্‌ফর আহমদ ‘নবযুগ’ পত্রিকায়৷ কিন্তু  বেশিদিন সেটা চলেনি৷ রাজরোষে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়৷ কিন্তু কাজী নজরুল বসে থাকার মানুষ নয়৷ ১৯২২ সালে প্রকাশ করলেন ‘ধূমকেতু’৷ রবীন্দ্রনাথকে আশীর্বাদ পাঠাবার অনুরোধ করলেন৷ একটু দেরিতে হলেও কবি আশীর্বাদ পাঠালেন ছোট কবিতা দিয়ে৷ পত্রিকায় সেটি প্রথম ছাপা হল৷ ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট ‘ধূমকেতু’ প্রথম প্রকাশিত হল৷ সপ্তাহে দু’দিন প্রকাশ হবে এই ঘোষণা দেওয়া হল৷ কবির সম্পাদনায় যা প্রকাশিত হল, সেটা বাংলার বিপ্লবী ভাবনার অন্যতম প্রচারক হয়ে‍ উঠল৷ আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে তিনি ছিলেন মূলত সশস্ত্র ভাবনার সমর্থক৷ ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধূমকেতু’র দ্বাদশ সংখ্যায় প্রকাশ হল কবির বিখ্যাত কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’৷ বাংলায় তখন আগমনীর সুর, কাশফুলের মেলা৷ আকাশে সাদা মেঘের ভেলা৷ পুলিশ খুঁজছে কবিকে৷ ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কবি কুমিল্লায়৷ সেখানে গ্রেপ্তার হলেন৷ পত্রিকা অফিসে পুলিশি হানা৷ দ্বিতীয় বাঙালি যিনি কবিতা লিখে জেলে গেলেন৷ প্রথম জন সিরাজগঞ্জের সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজি৷ তাঁর ‘অনল-প্রবাহ’ কাব্যের জন্য গ্রেপ্তার হন৷ নানা জেল ঘুরে কবি এলেন হুগলি জেলে৷ তাঁর সহবন্দীদের মধ্যে ছিলেন বিপ্লবী সতীন সেন (বরিশাল), বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় (কৃষ্ণনগর), রামসুন্দর সিং (গড়বেতা), মৌলভী আফসার উদ্দিন আহমদ (কুষ্ঠিয়া), খান মইনুদ্দিন, গোপাল সেন, মোক্ষদাচরণ সমাধ্যায়ী, সিরাজুদ্দিনের মতো রাজবন্দিরা৷ নজরুলের উপস্থি‍তিতে‍ গানে, কবিতায় আর হুল্লোড়ে জেলজীবনে যেন নবজীবন এল৷ হুগলির বিপ্লবীরা নানা কৌশলে বাইরে থে‍কে নানান খবর দেওয়া নেওয়া করতেন৷ অনেক খবর মানুষ এভাবেই জানতে পারেন৷তবে এই জেলের সুপার থার্সটন সাহেব ছিলেন খুব রুক্ষ মেজাজের লোক৷ বন্দিদের সঙ্গে‍ খারাপ ব্যবহার করতেন৷ বিভিন্ন ছলছুতোয় অত্যাচার করতেন৷নজরুলের সঙ্গে বেধে গেল গণ্ডগোল৷বন্দিদের অধিকার নিয়ে সচেতন নজরুল৷অত্যাচার মাত্রাছাড়া হওয়ার পর ১৯২৩, ১৫ এপ্রিল থেকে সদলবলে কাজী নজরুল অনশনে বসেন৷ প্রথমে অনশনে বসেন একুশ জন৷ সতীন সেন, গোপাল সেন, আফসারউদ্দিন তার মধ্যে ছিলেন৷ জেলের বাইরে এই খবর প্রকাশ হবার পর রাজবন্দিদের প্রতি সমবেদনা এবং ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জনরোষ জেগে ওঠে৷ কাজী নজরুলের শরীর ক্রমেই খারাপ হতে থাকে৷ জ্বর হতে থাকে৷ কবির শরীর খারাপ৷ তাঁর খবর জানতে হুগলি জেলের সামনে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ জমা হতে থাকে৷ কবি রবীন্দ্রনাথ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শরৎচন্দ্র, আচার্য প্রফুল্ল রায় তাঁর শরীর সম্পর্কে খোঁজ নেন৷ শরৎচন্দ্র তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে ব্যর্থ হন৷ নজরুলের হিতৈষী শরৎচন্দ্র পণ্ডিত লেখেন কবিতা—

‘কাজী নজরুল ইসলাম আরও কয়েকটি প্রাণী

হুগলির জেলখানাতে ছেড়েছে দানাপানী৷

কর্তাদের ব্যবহারে অন্ন ছেড়েছে তারা—

মতলবটা বেরিয়ে যাওয়া ভেঙে এই দেহ-কারা

***    ***    ***    ***    ***

সরকারের কি এসে যায় না খেয়ে মরলে কাজী?

এই জেলখানায় অনশন চলে ৩৯ দিন৷ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দু’টি৷ প্রথম রবীন্দ্রনাথ তাকে হুগলি জেলে অনশন ত্যাগ করার আবেদন করে টেলিগ্রাম করেছিলেন৷ বিশ্বকবির এই ব্যাকুলতা কাজী নজরুলের জীবনে এক আনন্দ আশীর্বাদ৷ দ্বিতীয় তাঁর মা জাহেদা খাতুনের জেলখানায় দেখা করতে আসা৷ তাঁর কথাতেও কাজী নজরুল অনশন ভাঙেননি৷ তিনি মাকে বলেছিলেন, “মা মনে রেখো, তুমি নজরুল ইসলামের জননী৷ তোমাকে বলছি দেশমাতার সম্মান ও গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য আমার জীবন সমর্পণ করেছি৷ তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো যেন আমি তোমার এই কান্নাভরা মুখে হাসি ফোটাতে পারি৷ কাজী নজরুল ইসলামের জননীর চোখে কান্না শোভা পায় না৷’’ কাজী নজরুল ইসলামের দেশপ্রেম এবং জাতির প্রতি তার দায়বদ্ধতা এতেই প্রমাণিত হয়৷ ঘটনা পরম্পরায় ৩৯ দিন পর বিরজাসুন্দরী দেবীর কাছ থেকে ফলের রস খেয়ে নজরুল অনশন ভাঙেন৷ বিরজাসুন্দরী দেবী ছিলেন নজরুলের বন্ধু বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের মা৷ যাঁকে কাজী নজরুলও ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন৷ এই বিরজাসুন্দরী দেবীর দেবর প্রয়াত বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের মেয়ের সঙ্গেই পরবর্তীকালে নজরুলের বিবাহ হয়৷

কাজী নজরুল ইসলাম বাঁশি বাজাচ্ছেন 

নজরুলের কবিতা গান তখন সারা বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে৷ হিন্দু-মুসলমানে সম্প্রীতি রচনায় তিনি অগ্রদূত৷ ‘হিন্দু না, ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?’ মানুষ যে মায়ের সন্তান, তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন৷একদিন মুসলমান বলে হিন্দুর মেস থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন৷৷ তিনি এবার লিখলেন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া’৷ তিনি তাঁর ভাষণে বলেছেন, তিনি টুপি আর টিকিকে এক করতে চান৷ তিনি গালাগালিকে গলাগালিতে পরিণত করতে চান৷ সারা বাংলা তিনি চষে ফেলছেন সম্প্রীতি প্রচারে৷ জেলায় জেলায় তাঁকে‍ সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে৷ সব জায়গায় তিনি সম্প্রীতির বার্তা দিচ্ছেন৷এই সময় কিছু মানুষ প্রস্তাব দিলেন, কবিকে কলকাতায় নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হোক৷ মূল দায়িত্ব পড়ল ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের উপর৷ একটি কমিটি গঠন হয়৷ সভাপতি এস ওয়াজেদ আলি৷ সহ-সভাপতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ (কল্লোল)৷ মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন (সওগাত)৷ দিন ঠিক হয় ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর৷ সারা বাংলা জুড়ে এই অনুষ্ঠানের প্রচার হয়৷ স্থান – এলবার্ট হল৷ 

এই সম্বর্ধনার নির্দিষ্ট দিনে এলবার্ট হল যে শুধু পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তা-ই না, কলেজ স্ট্রিটে একটা জনসভার আকার ধারণ করেছিল৷ সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়৷ বরাবর তিনি নজরুল অনুরক্ত৷ উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ তিনি ভাষণ দেবার সময় বলেন, “যুদ্ধ‍ক্ষেত্রে‍ নজরুলের গান গাওয়া হবে, কারাগারেও আমরা তাঁর গান গাইব৷’

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ভাষণে বলেন, “আধুনিক সাহিত্যে মাত্র দুইজন কবির মধ্যে আমরা সত্যিকারের মৌলিকতার সন্ধান পাইয়াছি৷ তাঁহারা সত্যন্দ্রেনাথ ও নজরুল ইসলাম৷ নজরুল কবি‍-প্রতিভাবান মৌলিক কবি৷’’ মানপত্রে বলা হয়—“তোমার অসাধারণ প্রতিভার অপূর্ব অবদানে বাঙালীকে চির ঋণী করিয়াছ তুমি৷ আজ তাহাদের কৃতজ্ঞতাসিক্ত সশ্রদ্ধ অভিনন্দন গ্রহণ কর৷ তোমার কবিতা বিচার-বিস্ময়ের উর্ধে- সে আপনার পথ রচনা করিয়া চলিয়াছে পাগলঝোরার জলধারার মতো৷ সে স্রোতধারায় বাঙালি যুগসম্ভাবনায় বিচিত্র লীলাবিম্ব দেখিয়াছে৷ আজ তুমি তাদের বিস্ময়মুগ্ধ কণ্ঠের অভিনন্দন লও৷’’ নজরুল দীর্ঘ প্রতিভাষণ দেন৷ তাতে তাঁর চিন্তাধারা কোন পথে প্রবাহিত তা বোঝা যায়৷ 

নজরুল বলেন, “কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের৷ আমি বলি ও দু’টোর কোনকিছুই নয়৷ আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি৷ সে হাতে‍-হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে তাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমায় গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে কোনও বেগ পেতে হবে না৷ কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আর একজনের আস্তি‍নে আছে ছুরি৷…’’

এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান বাংলার সাহিত্য সমাজে, বাংলার সামাজিক ক্ষেত্রে প্রবল প্রভাব ফেলে৷ এক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সাহিত্যের কাউকে এমন সম্বর্ধনা দেওয়া হয়নি৷

কাজী নজরুলের সাহিত্যজীবন ছিল মাত্র তিন দশক৷ সামান্যই৷ তার মধ্যেই তিনি যে সৃষ্টি করেছেন, তা অতুলনীয়৷ অসমান্তরাল৷ এবছর কাজী নজরুলের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী৷ সেই উপল‍ক্ষে এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন৷ প্রত্যাশা করি নজরুল চর্চা আরও গতিপ্রাপ্ত ও বিস্তীর্ণ হবে৷ আরও বড় কথা, কাজী নজরুলের চিন্তায় আমরা ভালবাসায় আবদ্ধ হব৷ সম্প্রীতিতে মিলিত হয়ে নতুন সমাজ গড়ব৷