পুলিশ কলোনির চৌরাস্তার মোড়ে দাঁতের ডাক্তার দেখিয়ে ফেরবার পথে অন্য দিনের মতন সেদিনও পুতুল ফুটপাথের একেবারে মধ্যিখানে থেমে গিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল ওই দশতলা বাড়িটার দিকে। বাড়ি মানে ফ্ল্যাটবাড়ি, তার আবার বাহারে নাম ‘স্বর্ণকমল’। আর এই স্বর্ণকমল যে কী জাদুকমল সে পুতুল বাদে আর কে-ই বা জানে? হাতের মুঠোয় সত্যিকারের সোনার পদ্মফুল পেলেও সে তেমনটা দেখবে না, যেমনটা দেখবে এই বাড়িটাকে।
বড় রাস্তার ভিড়ভাট্টা, লরি, ট্রাক, একদিকে কাঁচা নালার পাড়ে সব্জি বাজার। তার পরেই রোল-মোল, ঘুগনি চাটের ঝুপড়ি, তদুপরি সাইকেল রিক্সার প্যাঁক প্যাঁক, ডিজেলের ধোঁয়া… এসবের মধ্যেই একটু পাঁচিলের আড়াল তুলে এই বাড়ির গণ্ডি। এমন কিছু আহামরি ব্যবস্থাও নয়। এ-ই একটু পার্কিং লট, নামমাত্র সামান্য ঘাস, তাতেই দুটো লাল-নীল দোলনা-মোলনা, দুটো লিফট আছে, খানকতক দারোয়ান গোছের লোক… যেমনটা হয় আজকাল চারিদিকে– তার এর মধ্যে এমন অবাক বিস্ময়টা আসে কোথা থেকে কে জানে! বিরক্তির এক শেষ।
এই চৌরাস্তা থেকে সিকি মাইল সরু গলি পেরিয়ে পুতুলদের চালতাবাগানের সুভাষ কলোনি। এটুকু পথের জন্য রিক্সা নেওয়ার মতন বাবুয়ানি তাদের মানায় না বটে, তবে ছুঁচ ফুঁটিয়ে বউয়ের কষের কাঁচা দাঁত তোলায় গালের একধারটা অবশ, তায় দু’রাত নাকি যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারেনি, ফলে সমীর বেছে বেছে গোবেচারা গোছের একটা রিক্সাওয়ালা খুঁজে প্রাণপণে দরদাম করছিল। শেষে মনমতন রফা হওয়াতে খুশি হয়ে পেছন ফিরে ডাকতে গিয়ে হঠাৎ দেখে বউ নেই। বোঝ!
প্রাইভেটের প্রাইভেট নামেমাত্র অফিস তাদের। সেখান থেকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বেরিয়ে আসা অত চাট্টিখানি কথা নয়, তায় চৈত্র মাসের এই পিচ গলানো গরমে অতখানি পথ উজিয়ে এসে চাটুকুও না খেয়ে দাঁত তোলাতে ছোটা– পয়সার শ্রাদ্ধের কথা না হয় ছেড়েই দিল, শরীরের ক্লান্তি বলেও তো একটা কথা আছে? ব্যথার জন্য যদি আইসক্রিম খেতে বায়না করত অথবা কোল্ডড্রিঙ্ক—সে-ও খুশি মনেই মেনে নিত, কিন্তু এ কী!
কখন থেকে মনে হচ্ছিল কতক্ষণে বাড়ি গিয়ে তোলাজলে বেশ করে গা রগড়ে স্নান করে একটু কিছু দিয়ে জম্পেশ করে চা খাবে। তা না, দেখ বউয়ের কাণ্ড! ফোলা গালে হাঁ করে আদেখলার মতন কেমন পরের বাড়ির দিকে চেয়ে আছে!
সমীর রিক্সা ফেলে প্রথমে রক্তবর্ণ চোখে বউকে প্রায় ভস্ম করে নিয়ে তারপর বাসস্ট্যান্ডের একপাল লোকের সামনেই প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে শেষে হনহনিয়ে গলির পথে পা বাড়াল। থাক, রাতভর একঠায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখুক ওই ইন্দ্রপুরীর শোভা। মানুষের মাথা যে কত রকমের খারাপ হয়!
তবে যাকে নিয়ে এত কথা তার কিন্তু সেবে ভ্রূক্ষেপও নেই। স্বামীর পিছু পিছু প্রায় ছুটতে ছুটতে অবশ মুখে জড়িয়ে মড়িয়ে বলতে লাগল—‘উঁচুর দিকে ফ্ল্যাটগুলোই বেশি ভাল, মশা-মাছি, ধুলোটুলোও কম– তাই না গো?…’
গত দু’বছরে অর্থাৎ বিয়ের প্রায় পর থেকেই ওই ‘স্বর্ণকমল’-এর হাজাররকম গুণপনার সুবর্ণ সুবিধে আর আরামে বিরামের সবিস্তার বর্ণনা শুনতে শুনতে কানের পোকা নড়ে গিয়েছে সমীরের। তা বলে পুতুল কিন্তু ও বাড়ির ভেতরে তো দূরের কথা, পাঁচিলের ভেতরেও কখনও ঢোকেনি! কেবল দূর থেকে উঁচুর দিকে চেয়ে চেয়ে কল্পনার বিজ্ঞাপন। প্রথম দিকে অবশ্য তেমন গা করেনি সমীর। বরং ভালই লাগত। ফুটফুটে সুন্দর মুখখানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওপর দিকে চেয়ে কিছুটা সোচ্চার চিন্তা ভাবনা করে যেত, বাকিটা বাস্তবের ধারাবিবরণী। ‘ওই দ্যাখো, পূব দিকের ফ্ল্যাটে কেমন রোদ এল। এখন দশ, নয় আর আটতলা পর্যন্ত এল তো, সাত মিনিটের মাথাতেই পাঁচতলা পর্যন্ত ভরে যাবে’। ‘দক্ষিণের ফ্ল্যাটের জানলা খুলল, খুব হাওয়া খেলবে এই বেলা।…’
তা রোজ রোজ আর কাঁহাতক এই একবগ্গা উপাখ্যান শোনা যায়? মানুষের চেহরার সঙ্গে সঙ্গে তো সম্পর্কও পুরনো হয় আর তৎসহ অতি অবশ্যই ধৈর্যও!
তা, এ তো গেল তবু সমীরের কথা, কিন্তু বাড়ির অন্য সদস্যরা? তারা তো নতুন বউয়ের সুন্দর মুখখানা দেখে ছেড়ে কথা কইবে না? একে ছেলেমানুষ কাজকর্মে অপারগ, তায় চেহারা দেখে পাওনা গণ্ডায় ছাড় পেয়েছে মারাত্মক। ফলে তার ওই অবান্তর আখ্যান শুনে তারা গা ঠেলেঠেলি করে, মুখ বেঁকায়, ঠেস দিয়ে কথা বলে ইত্যাদি ইত্যাদি…। কেবল ওর বোকাসোকা শাশুড়ি বসে বসে এই সব হাবিজাবি গল্পে তার নিজের মতন করে একটু আধটু যোগ বিয়োগ করে তাল দিতে থাকেন– অন্তত সময় তো কাটে! নয়তো হাঁদা গোদা আটপৌরে শাশুড়িদের আজকালকার কালে সংসারে বড় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য…। এবং বলাই বাহুল্য, এসবে সমীরেরই মাথা গরম হয় সব চাইতে বেশি আর স্বভাবতই রাগটা গিয়ে পড়ে বউয়ের ওপর।
সুভাষ কলোনিতে সমীরদের কি তেমন কিছুর অভাব আছে? দাদুর জবরদখল জমিতে উঠোন কাঠান নিয়ে একতলা পাকা বাড়ি, নিজের টিপকল, তা বাদে লাইনের জল, রোজগেরে তিন ভাই, বোনেরা পাত্রস্থ, তার উপরে বাবা এখনও দোকানে বসেন…। বেশ তো ছিল তারা? কী অলুক্ষুণে বাড়িটা যে হল চোখের সামনে মাটি ফুঁড়ে, আর তাতেই দিল সব মাটি করে।
“কী সুন্দর তারা ভরা নিশুত রাত, ঘন কালো শাড়িতে যেন জরির বুটি তোলা। তেঁতুলগাছের ডালগুলো এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে চারিদিক দিয়ে ঘন হয়ে তাকে ঘিরে। তবে একটু যেন মেঘ মেঘ আছে। একটা মেঘ তো কেমন ভেলার মতো ভেসে যাচ্ছে ওপর দিয়ে– সজনে ফুলের গন্ধ নাকি? কী সুন্দর সুবাস”
ফলে সেদিন সন্ধেয় বাড়ি ফিরে এসে একটু বেশি রকমই মাথা গরম করে ফেলেছিল সমীর। একে ওই আগুন গরম, তায় সারাদিনের ক্লান্তি, অফিসের চিন্তাই কি কম নাকি?… ছোট সাহেবকে বলে বেরিয়েছে। কিন্তু বড় সাহেব কাল শুনে কী করেন কে জানে, রেগেমেগে হয়তো গোটা দু’দিনের পাওনা ছুটিই কেটে বসে থাকল। তাছাড়া দাঁতের ডাক্তার তো নয়, সাক্ষাৎ জল্লাদ। দোকানে ঠান্ডা মেশিন লাগিয়ে দিয়ে ছুরিতে শান দিচ্ছে গলা কাটার…। আজকাল হয়েছেও এই রকমই, সাদাসিধে আটপৌরে ডাক্তার বদ্যি তো সব উবেই গিয়েছে দুনিয়া থেকে…। সর্বোপরি একটা গ্লানিও নিশ্চয়ই রাত্রি দিন খোঁচায় তাকে। বউ যদি নীচু বাড়িতে বসে বসে উঁচু বাড়ির দিকে চেয়ে থাকে হাঁ করে…। সে অবশ্য উঁচুতে থেকে নীচুর দিকে চাইলেও হত, অর্থাৎ অন্যদিকে চাইলেই…, তা সে যাই হোক। এ রকমই হাজার চিন্তা থেকে রাগ-টাগ তো হতেই পারে, খুবই স্বাভাবিক। এ সব কিছু ছেড়ে দিলেও একশো ভাগ পুরুষ মানুষ বলে কথা, তা যদি এমন হালুম হুলুম রাগ, রগ ফুলিয়ে কটুকথা ইত্যাদি ইত্যাদি না থাকে তবে তার মানসম্মানই বা থাকে কোথায়?
এ সমস্ত মিলেমিশেই সেদিন একতরফা একজোট হয়ে খুব এক চোট হল আর কী। একজোট মানে সমগ্র শ্বশুরকুল। তিন জা সর্বাগ্রে, সামান্য হাল্কার ওপর ভারসাম্য বজায় রেখে, ভাসুররাও অলক্ষে। শ্বশুরমশাই আজকালকার মেয়েদের লোভ-টোভের কথা উল্লেখ করে মিনমিনিয়ে ঘ্যানরঘ্যানর করলেন খানিক। ‘নিজেদের বাড়ি ভাড়া গুনতে হয় না মাসে মাসে, উঠোনে দাদাশ্বশুরের নিজের হাতে লাগানো তেঁতুল, সজনে, পেয়ারা, চালতাগাছ, শহরে ক’টা বাড়িতে হয়…’ইত্যাদি।
এ তো খাঁটি কথাই। সে তো তার বাপের বাড়ি সমেত পুতুল নিজেও একশোবার মানবে। একি একটা বলবার কথা? তবে মজার কথা হল, শাশুড়িও কিন্তু তখন বউদের তাল মিলিয়ে হাজার হাবিজাবি ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করবার চেষ্টা করতে থাকলেন। অবশ্য তিনি বেচারা আর কী-ই বা করবেন। বিবেচনাহীন মানুষদের তো যা হোক সময় কাটানো নিয়েই কথা। পুতুল তাঁর কথা তেমন গায়ে মাখেনি, মেখেছিল সমীরের কথা।
অল্প পরিচয় বটে, তবে দায়বদ্ধ সম্পর্কসূত্রে কাছের মানুষ তো, সে কিনা নির্দ্বিধায় জনসমক্ষে উঠোনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে পরের পর বলে যাচ্ছে তার এত দিনের সমস্ত নিভৃত গোপন কৌতূহল আর আব্দারের প্রশ্নগুলো সুসংবদ্ধ বিবরণ? তারপর শ্বশুরমশাইয়ের ওই তেঁতুলগাছের উল্লেখ কানে যেতেই বলল যে, পুতুলদের প্রাণনাথ সাহা লেনের এক ঘরের খুপরি ভাড়াবাড়িতে একাট গোটা তেঁতুলগাছ তো দূরের কথা, তার পাতাটিও কোনওদিন চোখে দেখেনি, হুঁ…।
পুতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার সম্বন্ধে সবার জড়ো করা হাজার অনুযোগ অভিযোগ শুনল খানিক। সত্যি বলতে কী, শুনে শুনে লজ্জাই লাগছিল বেশ। তবে ওই বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ির ব্যাপারটা ধরতে পারছিল না ঠিক করে। কারণ কতটা মাত্রা পর্যন্ত স্বাভাবিক আর তারপর কোথা থেকে অস্বাভাবিকতার গণ্ডি পেরোয়, সে কি আর সবাইকার বোঝবার ক্ষমতা থাকে! থাকলে তো তার চারপাশের মানুষজনের আচার ব্যবহার, আদবকায়দা থেকে টুকে টুকেই নিজের জীবনে ব্যবহার করতে পারে। ব্যস, তাহলেই ল্যাটা চকে যায়! সংসারে আর কোনও অশান্তিই নেই!
তা সে যাই হোক, অন্যরা আড়ে-ঠারে আর সমীর একেবারে সরাসরি তার বাপের বাড়ি-টাড়ি নিয়ে অমন সব অপমানজনক কথা বলাতে লজ্জা ভুলে গভীর দুঃখেই ঘরে এসে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল পুতুল।
সত্যি, সমীর সেদিন বড্ড বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কেবল ওই কথাই তো নয়, আরও এমন এমন সব কথা বলেছে, যা শুনলে পরে মনে হবে এমন ডাকসাইটে সৎপাত্রের সন্ধান পেয়ে ওর মা-বাপ যেন বস্তা ভরে হাত-পা ভাঙা, নাকমুখ থ্যাবড়ানো, কাটা ছেঁড়া, ছোবড়া বেরনো এক ডলপুতুলকে কোনওক্রমে ভুলিয়ে ভালিয়ে এই জামাইয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চম্পট দিয়েছেন।
কথাটা যে কত বড় মিথ্যে সে সমীরও কি জানে না? অত সুন্দর আর সরল সতেজ পাত্রী দেখে দাস বাড়ির তর সইছিল না, হুড়োহুড়ি করে দিনক্ষণ স্থির করে কানাকড়িটিও ছাড় দিয়ে কেবল বিশুদ্ধ শাস্ত্রমতে রেশমি শাড়িতে মুড়ে টড়ে নিয়ে এল তাকে, তাহলে? কুটিলা ঝগড়াটে হলে এসবকথা তো পুতুল নিজেই বলতে পারত পাল্টা গলা ফুলিয়ে। বলল না। কারণ ও কিনা নিপাট ভালমানুষ, তাই তার মনেও পড়েনি। পড়েনি তার বোধ হয় আরও একটা কারণ হচ্ছে, সুন্দর মুখশ্রী, সুশীলা, সরলা– এসব তো লাগে সংসারের ঘরকন্নার কাজে অর্থাৎ স্বয়ংবরে স্বয়ম্ভরে তো নয়? আর সে সংসারেরই যখন তা কোনও কাজে লাগল না বরং অকাজের বোঝাই বাড়ল তাহলে তাতে আর কাজ কী?
আসলে কাজ কিছুতেই নেই, সবাই অকাজ। নয়তো সমীরই আজ হঠাৎ এসে বলে নাকি? সত্যি বলতে সে-ও তো মানুষ মোটেই খারাপ নয়, না তো ক্ষেত্রমোহনবাবুর গোটা পরিবার। সামান্য দোষত্রুটি, খটাখটি কোথায় না থাকে? কিন্তু সেদিন কী যে হল, দুর্ভাগ্য বললে দুর্ভাগ্য, অদৃষ্ট বললে তাই, বা এ ক্ষেত্রে গ্রহের ফেরও বলা যায়– কে জানে।
একা একা অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে কী যে মন খারাপ হচ্ছিল, সে আর বলবার নয়। লজ্জা, দুঃখ, অনুশোচনা সব মিলেমিশে যেমন মনের অবস্থাটা হয় আর কী! আলোটা নিভিয়েছিল কিন্তু পাখা চালায়নি। এত গরম, কিন্তু তাও একবার উঠে চালিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না। ক’দিন থেকে দাঁতে ব্যথার জন্য গলা গলা ফ্যান ভাত বানিয়ে নিচ্ছিল নিজের জন্য– সেও আর বানাল না। কেউ ‘খেলে না কেন’ বললে হয়তো খিদে নেই অথবা ‘শুয়ে আছ কেন’ বললে ভেবেছিল বলবে, ‘দাঁত কনকন করছে।’ — কিন্তু কেউ কিচ্ছুটি জিজ্ঞেসও করল না। যাকগে যাক, কিছুটা ব্যথা তো ছিলই, বাকিটা ক্লান্তি, দু’রাত ঘুম হয়নি মোটে, তায় ব্যথার কড়া কড়া ওষুধ, দাঁত তোলার ঝক্কি…। ফলে ব্যথা, ক্লান্তি, আলসেমি আর অভিমানে খানিক বাদে ঘুমিয়েই পড়ল পুতুল। ঘুম মানে গভীর ঘুম। আর সে যখন ভাঙল তখন দেখে গভীর রাত।
সেই সন্ধে রাত থেকে ঘুমোচ্ছে বলে তখন আর তো ঘুম আসে না! আসে কেবল রাজ্যের দুঃখ। সারা জীবনের নানা দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, বেদনা, হতাশা, নিরাশা সব যেন জোট বেঁধে ধেয়ে এসে আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরল তাকে…। হায়রে, এত কষ্ট ছিল বুঝি তার? সেই দুঃখে, গরমে, খিদেতে, তৃষ্ণায় বিশ্ব যখন নিদ্রামগন তখন জামার ওপর একটা দোপাট্টা জড়িয়ে পা টিপেটিপে উঠোনে এসে বসল। বাইরেটা বেশ ঠান্ডা, হালকা হাওয়াও দিচ্ছে। মাথায় মুখে জলের ছিটে দেওয়ার জন্য কলতলায় যেতে পশ্চিম দিকের আকাশছোঁয়া বাড়িটার দিকে চাইল। কৃষ্ণপক্ষের মধ্যরাত, তায় কোনও ঘরের কোনও আলোর রেশ জানলায় পড়েনি, ফলে গোটা বাড়িটা একটা বেঢপ ফ্যাকাশে দেওয়ালের মতো নিশ্ছিদ্র অনড় দেখাচ্ছে– ধুর! এর জন্য এত লাঞ্ছনা?
সোনা গয়না নয়, শাড়ি জামাও না। বাড়ি গাড়ি অন্য শৌখিনতা, এমনকী সিনেমার কোনও হ্যান্ডসাম হিরোও না। এই একটা ইট-কাঠের তৈরি প্রাণহীন ঢ্যাঁপোশ বাড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে দুটো খণ্ডকথা বলা যদি এত দোষের হয় তো হোক। পুতুল তেঁতুলতলায় রাখা শ্বশুরমশাইয়ের লোহার চেয়ারটা গ্যাঁট হয়ে বসল।
কী সুন্দর তারা ভরা নিশুত রাত, ঘন কালো শাড়িতে যেন জরির বুটি তোলা। তেঁতুলগাছের ডালগুলো এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে চারিদিক দিয়ে ঘন হয়ে তাকে ঘিরে। তবে একটু যেন মেঘ মেঘ আছে। একটা মেঘ তো কেমন ভেলার মতো ভেসে যাচ্ছে ওপর দিয়ে– সজনে ফুলের গন্ধ নাকি? কী সুন্দর সুবাস…।
পুতুল আকাশপানে চেয়ে মনে মনে বলল, ‘ইশ, পরের জন্মে যদি একেবারে দশতলার পুব দিকের ওই ফ্ল্যাটেই থাকতে পারতাম?’ মানে, জন্মাতামই? আর এই এক গুচ্ছের কুচুটে কুঁদুলে মানুষজনের মধ্যে না, বেশ একা একা? ওপর থেকে চালতাবাগানের ক্ষেত্রদাসের বাড়ির দিকে সারাটা দিন হাঁ করে চেয়ে থাকলেও কেউ তো তাহলে বলতে পারবে না যে, এত বড় বানিতে জন্মেও দেখ টালির বাড়ির দিকে আদেখলের মতো চেয়ে আছে– মেয়ে মানুষের লোভ…।’
এই সব হাজার কথা ভাবতে ভাবতে পুতুলের সে রাতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। তার যেন কোথাও কেউ নেই কোনওখানে। বাপ-মা বিয়ে দিয়ে বেড়াল পার করল, শ্বশরবাড়িও তো এই! চিরটাকাল কেবল ঘাড়ের বোঝা হয়েই প্রাণ ধারণ… লাঞ্ছনা গঞ্জনা! এ একটা জীবন? ঠাকুর, পরের জন্মে পায়ের তলায় একটু মাটি দিও, নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্ত জমি, আর প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার মতন প্রচুর আলো বাতাস…।
এই না বলে ওড়নাটা নিয়ে পুতুল অন্ধকারে উঠে দাঁড়াল।
হায়রে, ছেলেমানুষ তো অভিমান হলে মাথাটা স্থির থাকে না, তার উপর দাঁতের যন্ত্রণাও বোধ হয় পুরোদমে ফিরে আসছিল, সঙ্গে পেট মুচড়ে খিদে আর তৃষ্ণাও ছিল নিশ্চয়ই, জল খায়নি তো বহুক্ষণ? মুহূর্তের বেদনাটাই যেন ছেয়ে ফেলে গোটা জীবনটা… তখন আর অগ্রপশ্চাৎ চিন্তাই থাকে না, হায় ঈ-শ্ব-র!
সেই দিন সেই মধ্যরাতে পুতুল যখন তাদের চালতা বাগানের ক্ষেত্রমোহন দাসের বাড়ির উঠোনে তারা ভরা ঘোর অন্ধকারে মনের দুঃখে একা একা আকুল করা হাজার চিন্তা ভাবনার মধ্যে তার অন্তরের অন্তিম বাসনাটি আকাশের দিকে চেয়ে জানাচ্ছিল, সেটি ছিল আসলে বাসনা পূরণের একেবারে মাহেন্দ্রক্ষণ– চৈত্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের মধ্যযামিনী। সে খবর অবশ্য বলাই বাহুল্য পুতুল জানত না। কিন্তু ঠিক সে সময়েই দাসবাড়ির দুঃখী ছোট বউমার একেবারে মাথার ওপর দিয়েই যে ইচ্ছেঠাকুর একটুকরো ইচ্ছেভেলায় ভেসে বেড়াবেন, তা কি কারুর জানবার কথা? তা বাদে, ওটা হয়তো তার রোজকার যাতায়াতের রুটও নয়। সারাদিনের দাবদাহের পর ধরিত্রী শীতল হতেই একটু ফুরফুরে মনে তিনি শর্টকাট নিচ্ছিলেন।
নিবিড় আঁধারে, অস্ফুট ক্ষীণালোকে অনেক নীচের খাপছাড়া সব আধখামচা বাড়িঘর, পানাপুকুর, আবর্জনার ডাঁই আর এবড়ো-খেবড়ো পথঘাটের ওপর দিয়ে ভেলা নিয়ে ভেসে বেড়াতে গিয়ে ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছের নীচে ছোট্ট প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝমধ্যিখানে একাকী নিঃসঙ্গ, দুঃখী, রূপসী মেয়েটির আন্তরিক প্রার্থনাটুকু কানে যেতেই যেমন সচরাচর সব ভগবানই করেন বলেই জন্মাবধি সবাই জেনে আসছে, তেমনই ইনিও অত্যন্ত দয়াপরবশে এতটুকুও অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ‘তথাস্তু’ বলে দিয়েছিলেন। মধ্যরাতে তাঁর আশীর্বাদী হাতের ছায়াটা পড়েছিল একেবারে পুতুল দাসের মাথার ওপর, ফলে তৎক্ষণাৎ প্রার্থনা মঞ্জুর…।
সেই সতেজ সুন্দরী কিশোরীর তার বিস্ময়ের ওই আকাশছোঁয়া, পাঁচিল ঘেরা দশতলা বাড়ির একেবারে ওপর তলাতেই জন্ম হল…। হল, তবে সে মানবজন্ম নয়। কল্প রাজ্যের সিঁড়ি পেরিয়ে, নিরালা, নিঃসঙ্গ ছাদ ডিঙিয়ে, পুবদিকের বড় বড় জলের ট্যাঙ্কের ধার ঘেঁষে যে মাটি জমে থাকে, সেই শক্ত মাটিতে কার্নিশের গায়ে লেগে জন্মাল– রোদে, আলোতে দোল খাওয়া একাকী ছোট্ট একটা সতেজ সুন্দর কচি এবং ঘন সবুজ অশ্বত্থ গাছের চারা হয়ে…।
শনিবারের চিঠি, শারদসংখ্যা, ১৪১৯
অঙ্কন : সুমন্ত সেন