কাজী নজরুল ইসলামের কাছে গান শিখতে পারলে, তাঁর সুরে গান গাইতে পারলে একটা সময় গায়িকারা বর্তে যেতেন। নিউ থিয়েটার্সের ‘সাপুড়ে’ ছবির কাহিনিকার, সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সেখানে নায়িকা-গায়িকা কানন দেবীর গাওয়া গানগুলি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিখ্যাত লেখিকা প্রতিভা বসু যখন কুমারী জীবনে রানু সোম ছিলেন, তিনি তখন গান শিখতেন নজরুলের কাছেই। তেমনি এক নবাগতা গায়িকা নজরুলের কাছে গান শিখতে এসেছেন। নজরুল খেয়াল করলেন, গায়িকা ওপার বাংলার মেয়ে হওয়ার জন্য, তাঁর ‘র’ এবং ‘ড়’ – এর উচ্চারণে দোষ আছে। স্পষ্ট করে গায়িকাকে নজরুল বললেন, ‘আগে উচ্চারণ ঠিক করে এসো। তারপরে গান করবে’। অসম্মানিত বোধ করলেন গায়িকা। ঠিক করে নিয়েছিলেন পরবর্তীকালে যদি বড় গায়িকা হতেও পারেন তবুও নজরুলের গান তিনি গাইবেন না। পরবর্তীকালে সেই গায়িকা স্বনামধন্য গায়িকা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ৫০-৬০-৭০ -এর দশক জুড়ে তাঁর মোহময়ী কন্ঠের জাদুতে মুগ্ধ ছিলেন শ্রোতারা। সেই গায়িকা হলেন উৎপলা সেন। শিল্পীর জন্মের শতবর্ষ চলছে।
উৎপলার জন্ম ওপার বাংলার ঢাকা শহরে ১৯২৪ সালের ১২ মার্চ। গানের হাতেখড়ি তাঁর মা হিরণবালা দেবীর কাছে। পরে সঙ্গীতে তালিম নেন ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খানের কাছে।যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩, তখন ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে সংগীত পরিবেশন করেন। ৪০ এর দশকের গোড়ায় তাঁরা সপরিবারে চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতা কর্পোরেশনের পদস্থ অফিসার বেনু সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। শাশুড়ি এবং স্বামী গানের ব্যাপারে তাঁকে সর্বদাই উৎসাহ দিতেন। তাঁদের একটি পুত্র। নাম আশিস সেন। কলকাতার আকাশবাণীর সঙ্গে উৎপলার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। কলকাতায় সঙ্গীতশিক্ষা করেছেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে। গায়িকা হিসেবে বকুনিও জুটেছে পঙ্কজ মল্লিকের কাছে। কারণ চন্দ্রবিন্দু উচ্চারণটা ঠিকমতো করতে পারতেন না উৎপলা। পঙ্কজ মল্লিক নাক টিপে টিপে উৎপলার চন্দ্রবিন্দু উচ্চারণটাকে ঠিক করে দিয়েছিলেন।বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত বেনু সেনের হঠাৎ মৃত্যু হয়। হার্ট অ্যাটাক। সবকিছু যেন শূন্য হয়ে যায় উৎপলার কাছে। নিভৃতচারিণী হয়ে উঠেছিলেন। শাশুড়ি বৌমাকে সর্বদা আগলে রাখতেন।
এরকম ছন্নছাড়া জীবন থেকে উৎপলাকে মুক্ত করার জন্য প্রখ্যাত গীতিকার শ্যামল গুপ্ত উৎপলার বাড়িতে প্রখ্যাত গায়ক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এলেন। উৎপলাকে শূন্যতা থেকে উদ্ধার করার জন্য সতীনাথ সেদিন রাজ্যের গান শুনিয়েছিলেন উৎপলাকে। ক্রমে ধীরে ধীরে ধাতস্থ হতে শুরু করলেন উৎপলা। শাশুড়ি, বৌমাকে শূন্যতা থেকে উদ্ধার করার জন্য নিজে উদ্যোগী হয়ে উৎপলার সঙ্গে সতীনাথের বিবাহ দিলেন। এটি ১৯৬৮ সাল। এই সংগীত দম্পতিকে বলা যায় ‘জোড়ের কবুতর’। যেখানে সতীনাথ সেখানে উৎপলা, যেখানে উৎপলা সেখানেই সতীনাথ। একসঙ্গে রেকর্ড করছেন। একসঙ্গে ঘুরছেন। একসঙ্গে সিনেমা দেখছেন। উৎপলাকে সতীনাথ এতটা ভালবাসতেন, তার নমুনাও ছড়িয়ে আছে। এইচ এম ভি থেকে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ও উৎপলার রেকর্ড বেরতো পুজোর সময়। বেসিক রেকর্ড। একবার এইচ এম ভি কর্তৃপক্ষ সতীনাথকে জানালেন সেইবারের পুজোয় এইচ এম ভি থেকে সতীনাথের গানের রেকর্ড বার হবে, কিন্তু উৎপলার গান থাকবে না। সতীনাথ তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলেন যে, তিনিও তাহলে এইচ এম ভি থেকে রেকর্ড করবেন না।
এক রবিবার সন্ধ্যায় দুজনে সিনেমা দেখতে গেছেন। উৎপলা খেয়াল করলেন তাঁর পিঠে কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। বার ক’য়েক এমন হওয়ার পর উৎপলা সতীনাথকে ব্যাপারটা জানালেন। উৎপলা সতীনাথকে বলে রাখলেন এমনটা হলে তিনি সতীনাথকে চিমটি কেটে সতর্ক করবেন। সেই মতো সতীনাথ হাতেনাতে ধরলেন পেছনের সিটে বসে থাকা দর্শকটিকে। তিনি আর কেউ নন। তিনি বিলায়েত খান।
রান্নায় উৎপলা বরাবর পারদর্শী ছিলেন। মাছের নানান রকম মেনু তিনি তৈরি করতে পারতেন। একবার আকাশবাণী থেকে রেকর্ডিং করে বেরোচ্ছেন, তখন শুনলেন ‘মহিলামহল’ অনুষ্ঠানের যে শিল্পীর এসে রান্না শেখানোর কথা ছিল, তিনি আসেননি। উৎপলা শুনেই বললেন ‘কুছ পরোয়া নেহি’। তখনই তিনি সেই অনুষ্ঠানে ডাব চিংড়ি এবং ভাপা ইলিশ মাছ রান্নার প্রথার কথা শ্রোতাদের জানালেন। খুবই উপভোগ্য হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান।
বিদেশ থেকে বহুবার প্রোগ্রাম করতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ এসেছিল। কিন্তু প্লেনে চড়তে ভয় পেতেন বলে বিদেশযাত্রা হয়নি। তবে বাংলাদেশে একবার বিমানে চেপে যাতায়াত করেছিলেন। অত্যন্ত কটকট করে কথা বলতেন বলে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘কটকটি’। ছোটবেলা থেকেই তিনি আনন্দময়ী মায়ের স্নেহধন্য ছিলেন।‘হরিনাম লিখে দিও অঙ্গে’ এই গানটি আনন্দময়ী মা উৎপলাকে শিখিয়েছিলেন। বেসিক রেকর্ড এর উল্টো পিঠে ছিল ‘জাগোরে জাগো রে মন ঘুমায়ে থেকো না’। এই গানটিও আনন্দময়ী মা উৎপলাকে শিখিয়েছিলেন। উৎপলা শিল্পী হিসেবে বড় মাপের ছিলেন। তেমনি ছিল তাঁর উদার মন। পার্সি যুবক ভি. বালসারা তখন সদ্য কলকাতায় এসেছেন। তাঁকে একটি পিয়ানো উপহার দিয়ে উৎপলা সাহায্য করেছিলেন।
বেশ কিছু ছবিতে তিনি গান গেয়েছিলেন। ‘বাবলা’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘দুঃখের কাছে হার মেনেছি’ একদা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখত। এছাড়া তিনি গান গেয়েছেন ‘এক টুকরো আগুন’ ছবিতে ‘ও বিরহী সরে থেকো না’, ‘বিচারক’ ছবিতে ‘আমার মল্লিকা বনে’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে ‘বহুদিন পরে ভ্রমর এসেছে কুঞ্জবনে’, ‘সাগরিকা’ ছবিতে ‘আমরা মেডিকেল কলেজে পড়ি’, ‘বিলে নরেন’ ছবিতে ‘বিকেল হল ঘরে চলো’, ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবিতে ‘আবার নতুন সকাল হবে’ প্রভৃতি। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে গান গেয়েছেন ‘মায়াবিনী লেন’ ছবিতে ‘এ বেজায় ভারী শহর গাড়ির বহর’, ‘অতিথি’ ছবিতে ‘মাঝে নদী বহেরে ওপারে তুমি শাম এপারে আমি’, ‘ভাগ্যচক্র’ ছবিতে ‘ভাগ্যের চাকাটাতো ঘুরছে’ প্রভৃতি ।
উৎপলার বেসিক রেকর্ডের গানগুলির কথা বলা যাক। ‘একহাতে মোর পূজার থালা’, ‘বনফুল জাগে পথের ধারে’, ‘শুকতারা গো নিওনা বিদায়’, ‘গান যে আমার’, ‘গানের বলাকা ভেসে যায়’, ‘তুমি যে ভালোবেসেছিলে’, ‘সকরুণ বীণা বাজায়ো না’, ‘যদি ভুল ভেঙ্গে যায়’, ‘ময়ূরপঙ্খী ভেসে যায়’, ‘ঝিকমিক জোনাকির দীপ জ্বলে’, ‘প্রান্তরের গান আমার’, ‘এত মেঘ এত যে আলো এ জীবনে ছড়িয়ে আছে’, ‘মহুয়া বনে পাপিয়া’, ‘যে সুর বাজাতে চাই’, ‘রাতের কবিতা, পাখি আজ কোন সুরে গায়’, ‘পাখিদের এই পাঠশালাতে কোকিল গুরু শেখায় গান’, ‘জোনাকি দীপ জ্বালো আলো’, ‘সাত রঙের খেলা আকাশ পারে’ প্রভৃতি।
পেটে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। ২০০০ সালের ২০ জুন হয়েছিল অপারেশন। অপারেশন টেবিলে তোলার আগে ডাক্তার বিমলেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘যাঁর গান শুনে বড় হয়েছি তাঁর কাছ থেকে টাকা নেব কি? আপনি আমায় আমার প্রিয় গান ‘শুকতারা গো নিও না বিদায়’ গানটা শুনিয়ে দেবেন। তাতেই হবে’। উৎপলা সেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২০০৫ সালের ১৩ মে, কলকাতা এস এস কে এম হাসপাতালে। প্রতিটি মানুষের জীবনে মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু উৎপলা সেন তাঁর গানের যে ডালি সাজিয়ে রেখে দিয়ে গেছেন, তার জন্য তিনি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাঙালি শ্রোতাদের কাছে।জন্মের শতবর্ষে তাঁর উদ্দেশে রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।