বাংলা নববর্ষের ক্রমবিকাশ

পৃথিবীর সমস্ত দেশে সকল জাতির মধ্যেই পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নবীন বর্ষকে বরণ করে নেওয়ার প্রথা৷ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তাদের বিচারবুদ্ধি মতো বেছে নিয়েছে বিভিন্ন সময়কে৷ খ্রিস্টধর্মীরা তাদের ১২ মাসের সর্বাগ্রটির প্রথম দিনকে নির্দিষ্ট করেছে৷ ১লা জানুয়ারি তাই তাদের নববর্ষের সূচনা৷ এই দিনটি এখন সর্বত্র সর্বগ্রাহ্যভাবে স্বীকৃতি৷ এবং সরকরি নিয়ম মেনে ভারতবর্ষেও৷ ইসলাম ধর্মানুযায়ী চান্দ্রবর্ষ অনুসারে তাদের সংস্কার তিথি‍-ভিত্তিক হওয়ার কারণেমহরমবর্ষের প্রথম মাস হলেও নতুন বছরের শুরুর দিনটির নির্দিষ্টতা পায়নি৷ উদারমনস্ক ভারতবর্ষ, যা কিনা প্রাদেশিক বহুবিধ সংস্কারের হাত ধরে মহাদেশের ক্ষুদ্র সংস্করণস্বরূপ, তার ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করেনি৷ ভারতীয় জরথ্রুস্টপন্থীরা আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপ‍ক্ষের শেষ তিথিতে‍ [the day of Atonement] পালন করেন বর্ষারম্ভেরপটেটিউৎসব৷ মহারাষ্ট্রে হিন্দু নববর্ষানুষ্ঠানগুডি‍-পড্বাচৈত্রে, গুজরাটে কার্তিক মাসের দেওয়ালির সকালেলক্ষ্মীপূজা সঙ্গে, দক্ষিণে‍ ‘পোঙ্গল’, ‘ওনামইত্যাদি পালন করেন তামিল, কৈরালি অন্যান্যরা পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিনে৷ উত্তরে, পাঞ্জাবে, উত্তরপূর্বে এবং বাংলায় বৈশাখী, বিহু ১লা বৈশাখে মোটামুটি একই সময়ে নববর্ষের সূচনা করে৷

মানুষ যখন যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর বুকে বীজ বপন করে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করতে শিখল, তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার জীবন হয়ে উঠল কৃষিনির্ভর৷ কৃষিভিত্তিক সমাজ ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে নির্ভর করতে শুরু করল ফসল তোলার পর বিনিময় প্রথা ছেড়ে অর্থসংগ্রহের ওপর৷ তাই প্রবর্তিত অর্থবর্ষ শুরু হত শেষ শরৎ হেমন্তের সন্ধি‍ক্ষণে মার্গশীর্ষবা অগ্রহায়ণ মাস থেকে৷ কিন্তু প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে দোদুল্যমান সময় নির্দিষ্টতার গণ্ডি পেরিয়ে বারে বারেই স্থান বদল করতে বাধ্য হয়েছে৷ বৈদিক যুগে মুনি‍-ঋষিরা সামাজিক জীবনে সৌরজগৎকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন দিয়েছিলেন৷ তাঁরা সৌরবর্ষকে সূর্যের উত্তরায়ণ দ‍ক্ষিণায়নএই দুই ভাগে ভাগ করেহিমঅর্থাৎ শীত ঋতু থেকে বছরের সূচনা করেছিলেন৷ সৌরব‍র্ষের সূর্যের উত্তরায়ণের সঙ্গে সূচিত হত নতুন বছর৷ আর চৈত্রপূণিমার উত্তরায়ণসংক্রান্তিতে বসন্তোৎসবের মধ্য দিয়ে শুরু হত নববর্ষবরণ৷ ধরা যায় প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং অর্থবর্ষকে মিলিযে মিলিয়ে চিহ্নিত হয়েছিল চক্রবৎ বার্ষিক সূচনা সমাপ্তি৷ পরবর্তীকালেসূর্যের পথবৃত্তকে‍ ধারণা করে ৩৬০ দশমিক অংশে ধরে নিয়ে বছরকে ১২টি মাসে ভাগ করা হল৷ বৈদিক নামানুসারে তারা চিহ্নিত দেবতা, তেমনই শ্ৰেষ্ঠ মাস মাধব৷

মাধবসমমাসঃ, মাধবসম দেব৷

পোত হি দুরিতাম্ভোধৌ সজ্জমানজনস্য যঃ৷৷

অর্থাৎ মাধবের তুল্য মাস নেই, মাধবের তুল্য দেবতা নেই৷ পাপসাগরে মজ্জমান জনতার জন্য এরা পোতস্বরূপ৷ তাই

দণ্ডং জপ্তং হুতং স্নাতং সদ্ভক্তা মাসি মাধবে৷

তদক্ষয়ং ভবেদ্ভূপ পুণ্যং কোটিশতাধিক৷৷

মাধব মাসে দান, জপ, হোম, স্নান যাই ভক্তিসহকারে করা হয়৷ তাই অক্ষয় হয়ে শতকোটিরও অধিক পুণ্য হয়৷

বিষ্ণুপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, রঘুনন্দন কৃত্যতত্ত্ব তথা পঞ্জিকাতে মাধব মাস অর্থাৎ এখনকার বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া বা অক্ষয়তৃতীয়াকে সত্যযুগের আরম্ভ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে৷ তাই মাসের গুরুত্বও অমিত৷ পরবর্তী সময়ে গুপ্তরাজ বংশের শাসনকালে চতুর্থ শতকের আদ্যভাগে নক্ষত্র অনুসারে মাসগুলির নামকরণ করা হয়৷ তার ফলে,

বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে মাধব (৩০ ডিগ্রি‍) হল বৈশাখ;

জ্যৈষ্ঠা নক্ষত্রের নামানুসারে শুক্র (৩০৬০ ডিগ্রি‍) হল জ্যৈষ্ঠ;

পূর্বষাঢ়াউত্তরষাঢ়া নক্ষত্র অনুসারে শুচি (৬০৯০ ডিগ্রি‍) হল আষাঢ়;

শ্রবণার নামানুসারে নভস (৯০১২০ ডিগ্রি‍) হল শ্রাবণ;

পূর্ব উত্তর ভাদ্রপদ নক্ষত্রানুসারে নভস্য (১২০১৫০ ডিগ্রি‍) হল ভাদ্র;

অশ্বিনী নক্ষত্রের নামানুসারে ইষ (১৫০১৮০ ডিগ্রি‍) হল আশ্বিন;

কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামানুসারে উর্জ্জ (১৮০২১০ ডিগ্রি‍) হল কার্তিক;

মৃগশিরা নক্ষত্রের নামানুসারে সাহস (২১০২৪০ ডিগ্রি‍) হল মার্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ;

পুষ্যা নক্ষত্রের নামানুসারে সাহস্য (২৪০২৭০ ডিগ্রি‍) হল পৌষ;

মঘা নক্ষত্রের নামানুসারে তপস্(২৭০৩০০ ডিগ্রি‍) হল মাঘ;

উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রের নামানুসারে তপস্য (৩০০৩৩০ ডিগ্রি‍) হল ফাল্গুন;

চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে মধু (৩৩০৩৬০ ডিগ্রি‍) হল চৈত্র৷

বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা আবার তাঁদের নিজের মতো করে এদের নামকরণ করেছেন বিষ্ণুর দ্বাদশ নামকে অনুসরণ করে৷ তাঁদের কাছে বৈশাখ হল মধুসূদন, জ্যৈষ্ঠ‍-ত্রিবিক্রম, আষাঢ়বামন, শ্রাবণশ্রীধর, ভাদ্রহৃষীকেশ ইত্যদি৷

সপ্তাহের সাতটি বার সাতটি গ্রহের নামানুসারে নির্ধারিত হল৷ সূর্য বা রবির নামে শুরু হল সপ্তাহের প্রথমে রবিবার, সোম বা চন্দ্রের নামে সোমবার, মঙ্গলের নামে মঙ্গলবার, বুধের নামে বুধবার, বৃহস্পতি বা দেবগুরুর স্মরণে বৃহস্পতিবার বা গুরুবার, শুক্রর নামে শুক্রবার এবং সবশেষে শনিগ্রহের নাম শনিবার৷ তবে নতুন বর্ষ গণনা করা হত মাস দিয়ে নয়, ছয়টি ঋতুকে নির্ভর করে৷ প্রথমে মধু মাধব বা চৈত্র বৈশাখ নিয়ে বসন্ত; শুক্র শুচি বা জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় নিয়ে গ্রীষ্ম; নভস নভস্য বা শ্রাবণ ভাদ্র নিয়ে বর্ষা, ইষ উর্জ্জ বা আশ্বিন কার্তিক জুড়ে শরৎ, সাহস সাহস্য অর্থাৎ অগ্রহায়ণ পৌষ নিয়ে হেমন্ত এবং তপস তপস্য বা মাঘ ফাল্গুন নিযে শিশির অর্থাৎহিমবা শীত ঋতু৷ বৈদিক ঋষিরা প্রার্থনা করতেন যেন তাঁরা শতহিম জীবিত থাকেন৷ পৌরাণিক যুগে শরৎ থেকে বর্ষ গণনা করা শুরু হল৷ বৃহদ্ধর্মপুরাণ বলে, আশ্বিন মাস থেকেই শরৎ ঋতু দিয়ে সূচনা নববর্ষের৷ মাঘ মাসের প্রতিপদে সূর্যের উত্তরায়ণের সূচনা৷ এর আটমাস পর থেকে প্রতি মাসে একটি করে তিথি যোগ দিয়ে আশ্বিনের শুক্লপ‍ক্ষের অষ্টমী নবমী তিথির সন্ধি‍ক্ষণে ধরা হয়েছে শরৎ ঋতুর আবির্ভাব৷ অনেক গবেষকের মতে শারদোৎসব আসলে শরৎ ঋতু প্রবেশের উৎসবদুর্গোৎসব নয়৷দুর্গাপুজোর সময় ছিল আরও পরে, শিশির পেরিযে, বসন্তকালে৷ সেই হিসেবে ধরতে গেলে শারদোৎসবই নববর্ষ প্রবেশের উৎসব৷ পণ্ডিতরা বলেন, এই উৎসবের সূত্রপাত ছয় হাজার বছরেরও আগে৷ অষ্টমীর শেষে নবমীতে প্রবেশের সন্ধি‍ক্ষণে ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে নতুন বছরকে আলোকোজ্জ্বল করে তোলার প্রার্থনা করা হত৷ প্রথা আজও চলে‍ আসচে, তবে তা কালক্রমে হয়ে গেছে দেবীপূজার অঙ্গ৷ ক্রমশ এর সঙ্গে‍ একটা সময় যুক্ত হয়ে গিয়েছিল নবমীর দিনের বলিদানের শে‍ষে আরতির পর অশ্লীল গান গেয়ে উৎসর্গিত পশুর রক্ত কাদামাটি গায়ে মেখে নেচে বেড়ানো৷গৌঢ়বঙ্গ সংস্কৃতি লেখক হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেনকালিকাপুরাণেদেবীর বিসর্জনের সময় অশ্লীল শব্দ ব্যবহারের বিধি দেওয়া আছে৷ একে উল্লেখ করা হত শারদ নববর্ষে প্রবেশ উপলক্ষেহর্ষক্রিড়ানামে৷ বিশিষ্ট শি‍ক্ষাবিদ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানধি (১৮৫৯১৯৫৬ খ্রি.) তাঁর গবেষণামূলক পুরস্কারপ্রাপ্তপূজাপার্বণগ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন সারা বছরের হোমসত্র ইত্যাদি চালনা করার পরে ঋত্বিকরাহর্ষক্রিড়াউপভোগ করতেন৷ তাঁদের সামনে দাসদাসীরা এবং নিম্নস্তরের বারাঙ্গনারা কুৎসিত ভঙ্গিতে অশ্লীল নৃত্যগীত পরিবেশন করত৷ এই ধরনের বিনোদনের উল্লেখ কৃষ্ণযজুর্বেদেও পাওয়া যায়৷ সাধারণ বিশ্বাস ছিল অশ্লীলতা দেহমন দুই অশুচি করে৷ তখন তাকে স্পর্শ করতে যমেরও অরুচি হওয়ায় সে বছর মৃত্যু তাদের নিকটে এসে উপস্থি‍ত হয় না৷

 শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা রাজকৃষ্ণ দেব (১৭৩৩১৭৯৭ খ্রি.) এই অশ্লীলতাকে অন্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷পলাশির যুদ্ধের পর তিনি দুর্গোৎসবের সময় বাইনাচের ব্যবস্থা করে একই সঙ্গে অশ্লীলতা বর্জন ইংরেজ তোষণ করে জয়োৎসবের আয়োজন করলেন৷ এর অনুকরণে সমাজে সুপ্রতিষ্টিত বহু ধনী ব্যক্তি ওই বিশেষ উপলক্ষে বাইনাচ বিনোদনের ব্যবস্থা করতেন৷ ইংরেজ ললনা Fanny Parks কলকাতায় তাঁর স্বল্পকালীন বসবাসের সময় (১৮২২১৮২৬ খ্রি.) রাজা রামমোহন রায়ে‍র গৃহে ওইরকম উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন৷ তাঁর দিনপঞ্জিতে দেখতে পাই সেখানে তিনি তৎকালীন বিখ্যাত নর্তকী নিকির সৌন্দর্যে অপার্থিব সুরেলা স্বরে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন৷ ক্রমে বহু ভুঁইফোড় বা নব্য ধনী ব্যক্তি এবং সাবেকি বনেদি বংশের বেহিসাবী উত্তরাধিকারী মহাসমারোহে এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে তামসিকতাকে পোষণ করতে শুরু করলেন৷ পিতৃপিতামহের সঞ্চিত সম্পদ অপব্যয় করে প্রায় সর্বস্বান্ত হওয়ার কারণে সমাজ এদের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে উঠল৷ শরৎ নববর্ষের প্রথম দিনে বর্ষবরণ উৎসবে অশ্লীলতার লৌকিক ধারাকে প্রতিহত করতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব যে বাইনাচের প্রচলন করেছিলেন কালের গতিতে তাও সমালোচনার মুখে পড়ে হারিয়ে গেল৷ আর সেই সঙ্গে বাংলার শরৎনববর্ষ উদ্যাপনের সুপ্রাচীন প্রথাটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল৷

প্রাচীন ভারতে ছিল ভিন্ন ভিন্ন বহু জাতিগোষ্ঠী৷ শক্তিশালী রাজার অভিষেক, বিজয়োৎসব, জন্ম বা মৃত্যু অথবা বিশিষ্ট ধর্মপ্রচারকদের নির্বাণকে স্মরণীয় করে রাখতে নানা অব্দের প্রচলন হয়েছে৷ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় বিক্রমসম্বৎ, শকাব্দ, কল্যাব্দ, ভাস্করাব্দ, শঙ্করাব্দ, বুদ্ধাব্দ, মহাবীরাব্দ, চৈতন্যাব্দ, হিজরী সন, ঐস্লামিক বর্ষ ইত্যাদি৷ এর সঙ্গে যুক্ত হযেছে নব অর্থবর্ষ যার সময়সীমা ইংরেজি এপ্রিল থেকে পরের বচরের মার্চ মাস পর্যন্ত৷ তা হলে কবে থেকে শুরু হল বঙ্গাব্দ? নিয়ে আছে প্রচুর মতভেদ৷ সাধারণত বলা হয় বঙ্গদেশের রাজা শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রবর্তক৷ সঠিক সময়কাল জানা না গেলেও অনুমানের ভিত্তিতে ইতিহাসবিদরা মনে করে থাকেন রাজা শশাঙ্ক সম্ভবত ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে ৫৯৩ থেকে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের কোনও সময় সিংহাসন লাভ করেন৷ সেই সময় থেকে গণনা করলে বঙ্গাব্দের ১৪২০ সনের হিসেবটি মিলে যায়৷ কিন্তু এর প‍ক্ষে কোনও প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ নেই৷ অনেকে হিসেবের অজ্ঞতায় বাদশাহ আকবরকে এই মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন৷ কিন্তু আকবর দিল্লির মসনদে বসেছেন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে৷

তবে বলা যেতে পারে পরোক্ষে আকবর অবশ্যই পয়লা বৈশাখেরহালখাতাউৎসবের প্রবর্তক৷ উদার-নীতিক আকবর তাঁর প্রধান ধর্মীয় উৎসবের তালিকায় ঐস্লামিক সবেবরাত, ঈদ ইত্যাদির সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন শিবরাত্রি, বিজয়াদশমী বা দশেরা, দীপাবলি বা দেওয়ালি ইত্যাদি হিন্দু অনুষ্ঠান৷ ভারতীয় সঙ্গীত, নৃত্য, বাদ্য, চিত্রকলা ভাষাচর্চা তাঁর সংস্কৃতিসম্পন্ন মনকে গভীরভাবে আকর্ষণ করত৷ ভারতীয় জ্ঞানচর্চা কৃষ্টি যেমন তাঁকে‍ অনায়াসে প্রভাবিত করেছিল, তেমনটাই আকৃষ্ট করেছিল পারস্য দেশের ভাষা সংস্কৃতি৷ পারসিক নববর্ষকে কেন্দ্র করে বসন্তকালীন উৎসব নওরোজকে তিনি তাঁর উৎসব তালিকায় স্থান দিলেন৷ শুরু করলেন পারসিক সময়সীমার অনুসরণে সন ইলাহি৷ হিন্দুস্থানে এই উৎসব চলত একনাগাড়ে দিন যা ক্রমশ ১৯ দিনের চেহারা পায়৷ সমস্ত শহর তথা জনসাধারণ সেজে উঠত নতুন চেহারায়৷ নতুন পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে মানুষ রাজপ্রাসাদে সম্মুখ প্রাঙ্গণে নওরোজ’-এর মেলায় যোগ দিত৷ হাজার পণ্যের পশরা নিয়ে তাদের অপে‍ক্ষায় থাকত দোকানিরা৷ আসত বাজিকর, জাদুকর জ্যোতিষীরা৷ অনাবিল আনন্দে আমোদপ্রমোদ ভোজ উৎসবে উদ্বেল হয়ে উঠত শহর৷ যথাযোগ্য ব্যক্তিরা লাভ করতেন বাদশাহ প্রদত্ত খেতাব৷ এরই সঙ্গে পর্দানশীন হারেমবন্দিনীদের জন্য এরপর আকবর সূত্রপাত করলেন খোশবাজার’, অনেকটা ফ্যান্সিবাজার’-এর ধরনে৷ সেখানে শুধুমাত্র অভিজাত বংশীয় রমণীরাই একত্র হওয়ার অধিকার লাভ করতেন, পুরুষরা নয়৷

আকবর প্রবর্তিতনওরোজঅনুষ্ঠান পুরুষানুক্রমে জাতীয় উৎসবের সম্মান পেয়ে গেল৷ বিশেষত, জাহাঙ্গির শাহজাহান এতে আরও আনন্দ উপভোগের ইন্ধন জুগিয়েছিলেন৷ জাহাঙ্গিরপত্নী নূরজাহানও এই উপলক্ষে সম্মানসূচক উপহার খেতাব বিতরণ করতেন কিন্তু কট্টরপন্থী আওরঙ্গজেব সিংহাসন লাভ করেই এই আনন্দোৎসবটির ইতি ঘটালেন এইনওরোজচলাকালীন কাকতালীয়ভাবে শুরু হত বৈশাখ মাসের সূচনা তিনি যেসন ইলাহি প্রবর্তন করেছিলেন তাতে এসে মিশে গিয়েছিল নওরোজকালীন ১লা বৈশাখ, যা পরে বাংলায়নববর্ষউদযাপনের দিন হিসেবে পালিত হতে শুরু করে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শস্যকর্তনের কালকে কেন্দ্র করে অকবরইফসলি সনপ্রচলন করেছিলেন বলে ভাবা হয়

প্রাচীন যুগেহলবা লাঙলকে হাতিয়ার করে কৃষি নিভর্র ভারতীয়রা খাদ্য উৎপাদন করতে শিখেছিল ক্রমে উৎপাদিত জিনিসের বিনিময়ে পারস্পারিক কৃষিনির্ভরতায় গড়ে তুলল কেনাবেচার জন্য নির্দিষ্ট বিপণি শ্রুতি স্মৃতিকে নির্ভর করে মুখের ভাষাকে লিপিতে রূপ দিতে শিখে দ্রব্যমূল্যের হিসেবনিকেশকে ধরে রাখার প্রয়োজন হয়ে পড়ল এরপর কালক্রমে স্থির করে নেওয়া হল নির্দিষ্ট একটি বিশিষ্ট বার্ষিক সময় সম্বৎসরের রাজস্ব আদায়, জমাখরচ, সওদাগরগ্রাহকের পাওনার আদানপ্রদান মিলিয়ে বছরের শেষে হিসেবনিকেষ চুকিয়ে পুরাতনহলপুঁথিটিকে তুলে রেখে নতুন পুঁথির অবতারণা করার জন্য বেছে নেওয়া হল প্রথম মাসের প্রথম দিন অর্থাৎ ১লা বৈশাখ এই প্রথা মেনে শাহেনশাহ আকবর ১লা বৈশাখকে মনোনীত করলেনপুণ্যাহবা পুণ্য দিন হিসেবে এই কারণে বহুজন এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন যে, আকবরই ১লা বৈশাখেরনববর্ষে প্রবর্তক ফারসি ভাষায়হালঅর্থেনতুনএবংখাতাঅর্থে লেখার জন্যবিশেষ পুস্তকমিলিয়ে উদ্ভাবন করা হলহালখাতা

পরবর্তীকালে ১৮শ শতকের প্রথম পর্বে সম্ভবত ১৭০২০৩এর মধ্যে কোনও সময় নবাব মুর্শিদকুলি খান এই পুণ্যাহের অনুকরণে নিজের প্রভুত্ব কায়েম রাখতে ১লা বৈশাখ বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনভূস্বামীবা তাঁদের দেওয়ান অর্থাৎ রাজস্বমন্ত্রীরা নৌকায় বা পালকি করে সে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসতেন সোনার মোহরনজরানার সঙ্গে রাজস্বের শেষ কিস্তি জমা দিয়ে তাঁরা লাভ করতেন খিলাৎ অর্থাৎ রাজকীয় জমকালো পোশাক কোমরবন্ধ শিরোপা বা মহার্ঘ পাগড়ি এরপরে কুশলী রাজনীতিজ্ঞ রণনীতিবিদ আলীবর্দি খান বাংলার মসনদ লাভ করে তাঁর রাজত্বকালে (১৭৪২১৭৫১ খ্রি.) এই ধারাটি বজায় রেখেছিলেন কথিত আছে আলীবর্দি খানের আমলে পুণ্যাহ উপলক্ষে পয়লা বৈশাখ নানা প্রান্ত থেকে রাজস্ব জমা দেওয়ার জন্য চারশোরও অধিক ভূস্বামী রাজকর্মচারীর সমাগম হত

বাংলার নবদ্বীপের কৃষ্ণনগরে সুবিখ্যাত রাজপরিবারে কিন্তু পয়লা বৈশাখকে বরণ করতে ১৫ শতক থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিলবারো দোলের মেলা সে সময় বিভিন্ন মন্দির থেকে ১২টি বিগ্রহ এনে এক মাসের জন্য স্থাপন করা হতো রাজপ্রাসাদে নহবতখানায় বেজে উঠত ভোরের সানাই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৮১০১৮৮২ খ্রি.) মাত্র ১৮ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করে শুরু করলেন পয়লা বৈশাখেরপুণ্যাহউপলক্ষে অভিনব কিছু অনুষ্ঠান তার মধ্যে প্রথমটি হলগোবন্দনাগোপসম্প্রদায়তাঁদের বৃত্তিমূলক নিয়মনীতি মেনে তাঁদের কর্তব্যকর্মের বিস্তারিত বর্ণনা সহকারেকপিলাগীতিগেয়ে পথ পরিক্রমা করতেন বহুদিনের সংস্কারকে মেনে সেই সম্প্রদায় আজও পয়লা বৈশাখের ভোরে গোয়ালঘরের মাটির উনুনে, মাটির ভাঁড়ে দুধ জ্বাল দিয়ে দিন শুরু করেন তাঁদের বিশ্বাস বছরের প্রথম দিনের শুরুতে উথলে ওঠা দুধ তাঁদের গৃহসুখের প্রাপ্তিকেও উপচে তুলবে সেদিন মন্দিরে চলত বিশালাক্ষী দেবীর পুজো পুজোর শেষে মহারাজ দর্শন দিতেন সাধারণ জনতাকে প্রজারা তাদের দেয় খাজনা জমা করত রাজকোষে তাদের জন্য আয়োজন হত ভোজের সারাদিন ধরে চলত পংক্তিভোজন দূরদূরান্ত থেকে ময়রাদের আনিয়ে তিন দিন আগে থেকে প্রাসাদ সংলগ্ন মাঠে সামিয়ানার নীচে তৈরি করানো হত নানান রকমের সুস্বাদু মিষ্টান্ন বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিল মোতিচুরের লাড্ডু আর সরপুরিয়া অন্যদিকে সমস্ত দিন জুড়ে চলত রন্ধন আর ভোজনপর্ব আর চলতআনন্দমেলা তরুণ কৃষ্ণচন্দ্র পুণ্যাহতে প্রচলন করেছিলেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রতিবছর সুসজ্জিত করা হত রাজপ্রাসাদ, অতিথিশালা, তোষাখানা, খাজাঞ্চিখানা, মহাফেজখানা সেরেস্তা আমপাতা দেবদারুপাতার সঙ্গে আস্ত নারকেল বেঁধে মালার মতো গেঁথে সাজানো হতো তোরণ আর খিলান খুঞ্চিপোষে ঢেকে রাখা কাটাফল আর মিষ্টান্নের প্রসাদ নিয়ে দাসদাসীরা রাজবাড়ি থেকে পাওয়া নতুন কাপড় পরে পূজাদালানে করত অবিরাম আনাগোনা মহারাজ স্বয়ং কস্তাপেড়ে নতুন ধুতি, মহার্ঘ মেরজাই আর মাথায় রেশমি সুরেঠা পরে উপস্থিত থাকতেন কৃষ্ণনগর তথা নদিয়ার ব্যবসায়ীকুল রাজবাড়ির পূজাদালানে তাঁদের নতুন বার্ষিক হিসাবখাতাখানি ছুঁইয়ে আনতেন পয়লা বৈশাখের আগের দিনটিতে প্রজাদের খাজনাখাতা বহু পুরাতন প্রথা মেনে লাটে তোলা হত সন্ধ্যার প্রাক্কালে শরবত মিষ্টান্ন সহযোগে শুরু হত কার্য সম্মেলন এরপর ভূরিভোজের পর আয়োজিত হত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর তাঁর এই সংস্কৃতি সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হয়ে আসতেন বহু রাজন্যবর্গ্য আগের দিনটিতে আমন্ত্রিতদের সসম্মানে বরণ করে নিত ছোট ছোট কুমারী কন্যার দল, তিলক মালার সজ্জায় আর দীপের আলোয় আরতি করে

ক্রমে ক্রমেপুণ্যাহউপলক্ষেহালখাতা নবীকরণই সাধারণভাবে হয়ে উঠল নববর্ষের সূচনা যথার্থভাবে বলতে গেলেহালখাতা অনুষ্ঠানের সঙ্গেনববর্ষউদযাপনের সম্পর্ক খুব বেশি দিনের নয় হয়তো আড়াই বছর আগে এই রীতি প্রবর্তিত হয়েছে তাও সর্বভারতে নয়, একমাত্র বাংলায় আগে চৈত্রবৈশাখের বসন্তে পরে আশ্বিনকার্তিকের শরতে হত ভারতীয় নববর্ষের সূচনা তারও আগে মার্গশীর্ষ ছিল অগ্রহায়ণ মাস, ফসল তোলার পর

১৮ ১৯ শতকে বাঙালি হিন্দু সমাজনববর্ষউৎসব পালন করত সংস্কারের শুদ্ধাচারে, গভীর ধর্মীয় আবেগে সিক্ত হয়ে বিশেষ করে বাঙালি মধ্যবিত্ত গৃহস্থালি মাঙ্গলিক আচারঅনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিশ্বাস আশার আলোয় যেন উজ্জীবিত হয়ে উঠত অপরদিকে তথাকথিত উচ্চবংশীয় বা ধনী জমিদারকুল ভুঁইফোড় নব্যবাবু সম্প্রদায় ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীকে তোয়াজ করার উদ্দেশ্যে বেছে নিয়েছিল বর্ষের প্রথম দিনটিকেই ১লা বৈশাখ আয়োজন হত বাইনাচ খানাপিনার ফুর্তিভরা মজলিশের কিন্তু কোনওদিনই পয়লা বৈশাখ সর্বজনীন রূপ পায়নি যেমন পেয়েছিল তার আগের দিনটিতে সংক্রান্তির চড়ক উৎসব বা গাজন বহু অসাধারণ গুণসম্পন্ন জোড়াসাঁকোর জমিদারনন্দন কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০১৮৭০ খ্রি.) বিরচিত পয়সা দামের বটতলা থেকে প্রকাশিত ১৮৬১ সালের ১৬ পাতারহুতোম প্যাঁচার নকশাউপহার দিচ্ছে তারই এক ঝকঝকে ছবিচড়ক পার্বণনকশায় ইষৎ স্থুল ব্যঙ্গাচ্ছলে তিনি লিখছেন: ‘কলিকাতা শহরের চারদিকেই ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্ছে, চড়কীর পিঠ সড় সড় করছে, কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা বঁটি প্রস্তুত করছে সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নুপূর, মাথায় জরির টুপী, কোমরে চন্দ্রহার, সিপাই পেড়ে ঢাকাই শাড়ি মালকোচা করে পরা, তারকেশ্বরে চোবানো গামছা হাতে বিল্বপত্র বাঁধা সূতা গলায় যত ছুতোর, গয়লা, গন্ধবেনে কাঁসারির আনন্দের সীমা নাই, আমাদের বাবুদের বাড়ী গাজনহুতোমের চড়কের বর্ণনা শেষ হয়েছে নববর্ষের কথা বলে— ‘ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেননেশার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরানকে বিদায় দেন বাঙালিরা বছরটিকে ভালো রকমেই যাক আর খারাবেই শেষ , সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরানকে বিদায় দেন কেবলখাতাওয়ালারাই নতুন বৎরের মান রাখেনসংক্রান্তির চড়ক উৎসব বা গাজনকে ঘিরে প্রবল উত্তেজনা, উপবাস আত্মনিগ্রহমূলক অনুষ্ঠান করার পর ১লা বৈশাখের শুরু হত অবসাদের শেষে অনেকটাই গার্হস্থ্যভাবে সমস্ত প্রাদেশিক জাতিই নববর্ষের প্রারম্ভিক উৎসবে মেতে ওঠার আগে বাসস্থান মার্জিত পরিস্কৃত করে বাংলার মানুষ বছরের শেষ দিনে চৈত্র সংক্রান্তিতে এই কাজটি সম্পন্ন করত বহু গৃহে আজও করে বিংশ শতকেও এই দিনটি পুরোহিত সাধারণ মানুষের ধর্মীয় মাঙ্গলিক আচারঅনুষ্ঠান একই সূত্রে গ্রথিত ছিল নিজস্ব আঙিনায় বা দুয়ারের সামনে আলপনা, দুপাশে স্বস্তিক চিহ্ন দেওয়া জলভরা ঘটে আম্রপল্লবের বুকে সশীষ ডাব দিয়ে নববর্ষকে করা হত সাদর অভ্যর্থনা মধ্যবিত্ত পরিবারে বর্ষারম্ভের গ্রীষ্মের সকালে স্নান করে নতুন পোশাক পরে চিড়েদইবাতাসা, তিলকুটকদমার প্রাতরাশ ছোটদের জন্য চিনির পুতুলের বাড়তি আকর্ষণ দ্বিপ্রহরে নানারকম নিরামিষ মাছমাংসের নানারকম আমিষব্যঞ্জন, কাঁচা আমের স্ফটিক চাটনি দইমিষ্টির সুস্বাদু বিশুদা্ধ বাঙালি পারিবারিক ভোজের আয়োজন কোনও কোনও উচ্চবিত্ত পরিবারে নিকট আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করে ভূরিভোজের ব্যবস্থা অপরাহ্নে সুগন্ধি শরবত মরসুমি ফল খাওয়ার রেওয়াজ ছিল তৎকালীন সাহিত্য ধনীগৃহে ঘৃতপক্ক অন্ন ৫২ পদযুক্ত দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের আয়োজনের বিষয় উল্লেখ করলেও তা ছিল বিশেষ সামাজিক স্তরেই সীমিত অর্থনৈতিকভাবে সমাজের নীচু স্তরের নিজস্ব রীতিতে সাধ্যমতো নববর্ষ উদযাপনের ছবি এঁকেছে বটতলা থেকে প্রকাশিত ১৮৯৩ সালের কোনও এক অজ্ঞাতনামার রচনা

‘’… নববর্ষে নববস্ত্র পরিধান মত

বেটাবেটি হাসে খেলে আপনার মত।।

যে শাউড়ি বউ দুষে নিত্য মিথ্যা কাঁদে

সেও এসে সকালেতে নব অন্ন রাঁধে

সে অন্নের অনুষঙ্গ হিসেবে রাঁধা হয়েছে শাক, শুক্তানি, পলতার বড়া আর চাটনি শেষপাতে দুধকলা যা দিয়ে যত শিশু কান্না ভুলে উদর মানায় অর্খকষ্টের মধ্যেও নিবেদিতপ্রাণ আত্মজদের সুখভোগের চেষ্টায় জননী গৃহবধূ

এছাড়াও আছে অন্য ছবি নেশা বেশ্যাসক্ত স্বামীও এদিন কাজের শেষে সন্ধ্যাবেলা আপন ঘরে ফিরছে মিষ্টির হাঁড়ি, পঞ্জিকা সুগন্ধি তেল হাতে নিয়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সে সময় পঞ্জিকার আবশ্যকতা ছিল নিত্যকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যাত্রাঅযাত্রার শুভাশুভ, কালবেলা, উপবাস, পূজারম্ভের তিথি দেখা, রাশিফল, পূজানির্ঘন্ট ইত্যাদি নিয়ে বাঙালির ঘরে নিত্য প্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডার বিজ্ঞাপনদাতারাও এর সুযোগ নিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছনোর তাগিদে এই বিজ্ঞাপনগুলিতে থাকত শারীরিক সমস্যা, নানা রোগভোগের নিবৃ্ত্তি ও জীবনের পরিতৃপ্তির আশ্বাস দিশেহারা মানুষের জন্য দৈবমাদুলি, স্বপ্নাদিষ্ট তাবিজকবচের হাতছানি এই পঞ্জিকা থেকেই শুরু হয়েছিল ভোগবাদের সূচনা, আজকের consumerism প্রয়োজনীয় ছাড়াও শখের জিনিস সুলভে, সংগ্রহ বা প্রাপ্তির সুযোগ নিয়ে গুপ্ত আশাআকাঙক্ষা পূর্ণ হওয়ার হদিশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা মিথ্যে হলেও স্বপ্ন দেখাতে ভোলে না

উদযাপনের ধারায় পরিবর্তন এল বিংশ শতকের গোড়ার দিকে নান্দনিকতার ছোঁয়া লাগল রবীন্দ্রনাথের চেতনার মননশীলতার পথ বেয়ে শান্তিনিকেতনের নিভৃতে সঙ্গীত, নৃত্যকলা নাট্যাভিনয়ের পক্ষছায়ায় পয়লা বৈশাখেরপুণ্যাহপেল অনাবিল অভিনবত্ব অন্যান্য বৈভবশালী জমিদার পরিবারের ঐতিহ্য মেনে ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তায়পুণ্যাহঅনুষ্ঠিত হত প্রচুর সমারোহে খাজনা আদায়ের বিশেষ দিনটি নিয়মমাফিক বিষয়কর্ম, মাঙ্গলিক আচারঅনুষ্ঠান আর সংস্কারের মোড়কে হয়ে উঠেছিল পর্বদিন ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল, সেবারের পয়লা বৈশাখে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন সেদিন পুণ্যাহ উপলক্ষে ভোররাত থেকে সানাই সুর তাঁকে কেমন করে মোহিত করেছে সে সময়টায় সে বার তিনি চিলেন সাজাদপুরেসে দিন সবাই খুশী,যে খাজনা দেয় সে আর যে বাক্সবন্দী করে সে

বিংশ শতকের মধ্যভাগ পেরিয়ে আমরা শৈশবে নববর্ষ অনুষ্ঠানের সঙ্গে নাচগানের একটা গভীর সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করেছি তখন উচ্চবিত্ত সঙ্গীতানুরাগীরা ব্যক্তিগতভাবে বাড়িতে আসর বসাতেন বিখ্যাত শিল্পীরা আমন্ত্রিত হয়ে সুরমাধুরীতে অনাবিল আনন্দ বিতরণ করতেন সেখানে অবশ্য পুরাতনী, রাগপ্রধান এবং ধ্রুপদী সঙ্গীতের চল ছিল বেশি রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে বর্ষবরণের ঝোঁকও ছিল যথেষ্ট ধীরে ধীরে বেড়ে চলল বাংলা আধুনিক গানের জনপ্রিয়তা সিনেমার গান তথা রোম্যান্টিক গানের প্রবল জোয়ার অসাধারণ সব প্রতিভাবান গায়কগায়িকার কণ্ঠ বেয়ে ভাসিয়ে দিল আপামর বাঙালি হৃদয় যেমনই মনকাড়া লিপি, তেমনই বিভোর করা সুর

এর অনেক আগেই ১৯৩৮ সাল থেকেআকাশবাণী কলকাতা পরিবেশিত সঙ্গীত নাট্যানুষ্ঠান কথোপকথন প্রভূত সাফল্য লাভ করতে শুরু করেছিল শুনেছি, নববর্ষ উপলক্ষে গান রচনা করতেন স্বয়ং কবি কাজী নজরুল ইসলাম এছাড়াওমহিলামহল ছোটদের জন্যগল্পদাদুর আসর‘- প্রচারিত হত আকর্ষণীয় কার্যক্রম সে সময়টায় কলকাতায়হালখাতাকে উপলক্ষ করে সেদিন পুজো মিষ্টান্ন পরিবেশনের সঙ্গে কলের গানবাজিয়ে আপ্যায়ন করার একটা রেওয়াজ দেখা গিয়েছিল অনেক প্রখ্যাত সাবেকি বা লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ীহালখাতাঅনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন খ্যাতিমান গায়কগায়িকাদের নিয়ে বর্ষবরণের মজলিশ আলো ঝলমলে আসর উপচে পড়ত সুসজ্জিত মহিলা পুরুষদের ভিড়ে রজনীগন্ধা, জুঁই বেলফুলের গোড়েমালা আর রেশমি কাপড়ের খস, অগুরু আর আতরের রোমাঞ্চকর সুগন্ধে করত চতুর্দিক শিল্পীদের দরাজ গলা সুরের আবেশে মাতিয়ে দিত রাস্তায় ভিড় জমানো রবাহুতদেরও প্রবাসী বাঙালিরাও সঙ্গতি অনুযায়ী নানা জায়গায় বিশিষ্ট শিল্পীদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতেন নিজস্ব শহরের অনুষ্ঠানগুলিতে পাড়ায় পাড়ায় নিজেদের নাট্যাভিনয় বা বিচিত্রানুষ্ঠান হত বারোয়ারী দুর্গোৎসবের সন্ধ্যায় আর জনপ্রিয় শিল্পীদের নিয়ে জলসার আসরের জন্যসরস্বতী পূজা সন্ধ্যা বা শীতের সময়টাকেই বেছে নেওয়া হত

সেইসব উজ্জ্বল দিনগুলি এই একবিংশ শতকে অনেকটাই ম্রিয়মাণ সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে গেছে রুচি স্বাধীনতার আগে বাঙালির কাছে বাংলারনববর্ষবরণের জন্য পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি এখন বিশ্বায়নের যুগে বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইংরেজি সালতারিখের বাড়বাড়ন্ত তুঙ্গেফিউশন কালচার‘-এর জোয়ারে নব্য তরুণসমাজ যেন এক অস্থির পঞ্চমএর বিবর্তে পড়ে কিছুটা দিশেহারা সত্যি কথা বলতে গেলেহালখাতা রক্ষণাবেক্ষণকারীরাই নববর্ষঅনুষ্ঠানকে পুষ্টি জুগিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন কলকাতারবইমেলাকায়েম হওয়ার আগে পর্যন্ত নববর্ষে নতুন বই প্রকাশের চল ছিল সারা বছরের বকেয়া টাকা মিটিয়ে নতুন হিসাব শুরু করার জন্য নানা ধরনের দোকানে দোকানে স্বর্ণব্যবসায়ীদের উদ্যোগে গ্রাহকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টির প্যাকেট, ছোটখাট উপহার আর কোনও কোনও ক্ষেত্রে একটি বর্ষপঞ্জি দ্বারা আপ্যায়নের প্রচলন হয়েছে অনেক পুরনো গ্রাহকও এই সময় হাতে করে মিষ্টির বাক্স নিয়ে যান, এমনটা নজরে পড়েছে ধারে জিনিস কিনলে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে যে চাপা উদ্বেগের একটা টানাপোড়েন চলে, দিনটায় তারই হয় উপশম জনসংযোগ প্রচারমাধ্যম হিসেবেও এই প্রথাটি যথেষ্ট সহায়ক

কালের গতিতে পরিস্থিতির পরিবর্তন যাই হোক না কেন, হুজুগপ্রিয় খাদ্যরসিক বিশুদ্ধ বাঙালি যে কোনও উপলক্ষে রসনাতৃপ্তির সুযোগ খোঁজে পয়লা বৈশাখের পর্বদিনে সাধ মিটিয়ে খাওয়া হবে না? সেটা ভাবনারও অতীত আর তার জন্য চাই যত চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয় সমেত নিখাদ সাবেকি বাঙালি রান্নার সম্ভার কমলকুমার মজুমদারের ভাষায় বলতে গেলে—‘বাঙালি সত্যিই আমোদগেঁড়ে!’

শনিবারের চিঠি, বাহান্ন বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা