ভ্রমণ

বিষাণের প‍ক্ষে বাড়ির বাইরে পা রাখা মুশকিল হয়ে গেছে৷ মাসকাবারি বাজার করতে গিয়ে বা রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে যদি মব্‌ড হতে হয়, তাহলে কার ভাল লাগে? কিছুদিন আগেও এই পরিস্থিতি ছিল না৷ এর জন্য দায়ী বিষাণ নিজে৷ সে বিখ্যাত হতে চেয়েছিল৷

বিষাণ ফিল্মস্টার, খেলোযাড়, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, টেলি সিরিয়ালের অভিনেতা, মডেল, রাজনীতিবিদ বা ধর্মগুরু নয়৷ সে একজন চিত্রনাট্যকার৷ অতীতে মেগাসিরিয়ালের জন্য এলোমেলো ড্রামা লিখত, এখন বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখে৷ কিন্তু এই কারণে বিষাণ পপুলার নয়৷ জনপ্রিয়তার কারণ একাধিক এবং তারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত৷ বিষাণের ব্যাকগ্রাউন্ড জানলে বুঝতে সুবিধা হবে৷

কলেজে পড়াকালীন বিষাণের সাহিত্যচর্চার শুরু৷ কবিতা, মুক্ত গদ্য, গল্প, উপন্যাসের স্টেশান পেরিয়ে সে যখন চিত্রনাট্যের জংশনে ট্রেন দাঁড় করাল, তখন বয়স হয়ে গেছে আটত্রিশ৷ বিয়ে এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে মুক্ত পুরুষ৷

মেগা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ তাকে খ্যাতি না দিলেও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিয়েছে৷ আনোয়ার শাহ রোডে ফ্ল্যাট এবং গ্যারাজে দামি গাড়ি আছে৷ ব্যাঙ্কে লোন নেই৷ একেই তো সাফল্য বলে৷ তাই না?

টিভির সাফল্যে সন্তুষ্ট না হয়ে বিষাণ যোগাযোগ শুরু করল টালিগঞ্জ পাড়ায়৷ টিভির কারণে তার নাম সবাই জানে৷ এবার সে ছবির কাজ চাইতে শুরু করল৷

সাফল্যের প্রথম শর্তই হল ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে‍‍ যাওয়া৷ পেন ড্রাইভে স্ক্রিপ্ট নিয়ে ঘুরত বিষাণ৷ পঞ্চাশটা রিজেকশনের পরে একটা প্রোজেক্ট ব্যাটে‍-বলে হল৷ আর সেটাই বাংলা সিনেমা-ব্যবসার নিজস্ব ব্যাকরণ মেনে ‘হিট’৷ তারপর থেকে বিষাণকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি৷ প্রথম সিনেমা থেকেই সে ইয়ং আরবান অডিয়েন্সের পছন্দের মানুষ৷ শহরকেন্দ্রিক, ‘মিডল অফ দ্য রোড’ ছবির চিত্রনাট্য লেখার জন্য প্রযোজক এবং পরিচালকদের একমাত্র পছন্দ৷

সেখানেই না থেমে, গ্রাম বা মফস্‌সলের জন্য বানানো মেনস্ট্রিম কমার্শিয়াল ছবির জন্য বিষাণ কম্পিউটারের মাউস ধরল৷ তপন সাহার প্রযোজনায়, টালিগঞ্জের মহাতারকা এবং দুষ্টুমিষ্টি নায়িকার জুটির সেই ছবিও বাম্পার হিট৷ ব্যস! বাংলা বাজারে আর কেউ বিষাণের ধারেকাছে নেই!

টলিউডের সাফল্য বিষাণকে অল্প হলেও জনপ্রিয়তা দিল৷ বাকি কারণগুলো এবারে আসবে৷

প্রথমত বিষাণকে দেখতে খুব সুন্দর৷ আলুভাতে মার্কা বাঙালি পুরুষের মতো চেহারা নয়৷ টল, ডার্ক এবং হ্যান্ডসাম৷ দ্বিতীয় কারণ, সে বাংলা ছাড়াও হিন্দি, ইংরাজি, উর্দু এবং ফরাসি ভাষা পড়তে, লিখতে, বলতে এবং বুঝতে পারে৷ অগাধ পড়াশোনা আছে বলে যে কোনও বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে পারে৷ সময় বিশেষে আবার নিমগ্ন শ্রোতা৷ এবং সে নিজেকে গ্রুম করেছে খুব ভালভাবে৷ পোশাকে, ব্যবহারে এবং কেতায় একেবারে একশোয় একশো পাবে৷ ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বিষাণের সঙ্গে রিপ্‌ড্‌ জিন্‌স আর ফাঙ্কি টিশার্ট পরে ডিস্কে নাচতে থাকা বিষাণের কোনও মিলই নেই৷ কিন্তু দুটোই বিষাণ৷ কোনওটাতেই ফাঁকিবাজি নেই৷

“মেয়েদের মানভঞ্জন করতে কী ভাল যে লাগে! ইনফ্যাক্ট মেয়েদের ব্যাপারে বিষাণ এতটাই পোক্ত যে সে বলে থাকে, ‘আমি তো কালো বোড়ে৷ সাদা রানির চালের ওপর আমার মুভমেন্ট নির্ভর করে৷’ সুতরাং আধঘণ্টা পরে ওদের দু’জনকে যে একটি নামি ক্যাফেতে ক্যাপুচিনো পান করতে দেখা গেল, এতে বিষাণের কোনও ভূমিকা নেই৷ দিশা প্রস্তাব করেছে এবং বাধ্য ছেলের মতো সে ঘাড় নেড়েছে৷”

অন্তিম কারণ, বিষাণ মেয়েদের বিষয়ে‍ খুব আগ্রহী৷ সহজ বাংলায় এদের ‘মেয়েবাজ’ বলা হয়৷ বিষাণের প‍ক্ষে মেয়ে পাওয়া খুবই সহজ ব্যাপার৷ ‘কাস্টিং কাউচ’ কথাটি তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি! কিন্তু বিষাণ বেছেবুছে মেয়ে তোলে৷ মেয়ে পছন্দ করার ব্যাপারে তার এক নম্বর মানদণ্ড হল, সে কথা বলতে পারে কি না৷ শুতে তো সবাই পারে, ওটা গুরুত্বপূণ’ নয়৷ আলাপচারিতায় দড় তো? জীবনানন্দ বা নিৎশে বোঝে? বাদল সরকার বা বাখ? নোয়া হারারি বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনেছে?

হ্যাঁ, আজও চমৎকার সব মেয়ে পাওয়া যায়৷ তাদের সঙ্গে সময় কাটায় বিষাণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্দোষ বন্ধুত্বের ছবি আপলোড করে৷ সঙ্গে জুড়ে দেয় জুতসই কোটেশন৷ কখনও ফ্রয়েড, কখনও মিশেল ফুকো, কখনও দেরিদা৷ বাকিটা বুভুক্ষু ফলোয়াররা বুঝে নেয়৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজের পেজ থ্রি বা কেচ্ছার পাতায় বিষাণের রাসলীলা বেরোয় নিয়মিত৷ হাই ব্রাও অ্যাকাডেমিকসের সঙ্গে বস্তির কেচ্ছার ককটেলের যুগলবন্দিই তাকে বিখ্যাত করেছে৷ বাঙালি ছেলেরা তাকে ঈর্ষা করে, বাঙালি মেয়েরা, কামনা৷

বিষাণ নিজেকে বলে ‘সিরিয়াল মনোগ্যামাইজার’৷ সে যখন যে মেয়েটির সঙ্গে থাকে, তার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা ব্যয় করে৷ অন্য মেয়েদের দিকে ঘুরেও তাকায় না৷

গত পরশুর কথা৷ টালিগঞ্জের এক বুড়ি নায়িকার মেয়ের সঙ্গে চারমাসের ঝোড়ো সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল৷ মা আর মেয়ে, দু’জনেই সরেস মাল৷ মেয়েকে বিষাণের বিছানা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মা বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েটা ট্যালেন্টেড৷ হিরোইন মেটিরিয়াল৷ তুমি একটু দেখো৷’

বিষাণ দেখেছিল৷ প্রযোজক তপন সাহা আর পরিচালককে বলে তার লেখা ছবিতে মেয়েটিকে সহনায়িকার রোল পাইয়ে দিয়েছিল৷ ছবি চললেও সহনায়িকার কেঠো অভিনয়ের নিন্দে হয়েছে৷ এর পরে সম্পর্ক শেষ হবে না তো কী হবে? বিষাণ এখন সিঙ্গল৷ অ্যান্ড রেডি টু মিঙ্গল৷

বিষাণ কাজের ব্যাপারে খুব সিনসিয়ার৷ সকাল ন’টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে দশটার মধ্যে ল্যাপটপের সামনে বসে যায়৷ সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত একটানা লেখালিখি চলে৷ একসঙ্গে সে অনেকগুলো প্রোজেক্টে কাজ করতে পারে৷ দুপুরের খাওয়া আর বিকেলের চা-পানের সময়টুকু বাদ দিলে লেখা, লেখা আর লেখা৷ সন্ধেবেলা রোজই একাধিক জায়গায় নেমন্তন্ন থাকে৷ বিষাণ বুঝেশুনে পা বাড়ায়৷ পেজ থ্রি‍-র ফোটো অপরচুনিটি যেখানে আছে সেখানে যায়৷ ভাল খাবার আর ভাল পানীয় থাকলে তো যেতেই হয়৷

আজ পার্ক স্ট্রিটের নামি পুস্তক বিপণিতে কর্পোরেট লেখক সায়ন সেনের ভ্রমণকাহিনির উদ্বোধন করতে যেতে হবে৷ সেখানে না আছে জমাটি খাওয়া, না আছে ফোটো অপরচুনিটি৷ কিন্তু এক ঘণ্টার উপস্তিতির জন্য দশ হাজার টাকা অ্যাপিয়ারেন্স মানি সায়নের কাছ থেকে নেওয়া হয়ে গেছে৷

৷৷ ২৷৷

বই উদ্বোধনের সময়েই মেয়েটি চোখে পড়েছিল বিষাণের৷ একদম পিছনের সারিতে বসে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ সঞ্চালক আর সায়নের বকর বকর শেষ হওয়ার পরে ঘড়ি ধরে দশ মিনিট বক্তব্য রাখল বিষাণ৷ সায়নকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিল৷ একপ্রস্থ হাততালির পরে সায়নের অনুরোধে, ভ্রমণকাহিনি থেকে খানিকটা পড়ল৷ পড়া শেষ করে বিষাণ দেখল, মেয়েটি এখনও তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ চোখের তারা ঝিলমিল করছে৷ কী কন্ট্যাক্ট লেন্স ইউজ করেছে কে জানে!
মেয়েটি পরে আছে সরু নীল পাড়ের তাঁতের শাড়ি৷ কাঁধে শান্তিনিকেতনি পাশঝোলা, চুলে হাতখোঁপা করা, মুখে এক ফোঁটা মেকআপ নেই৷ কপালে ছোট্ট কালো টিপ৷ আজকের জমানার কলেজ স্টুডেন্টরা এই পোশাক পরে না৷ বিষাণের অভ্যস্ত চোখ বলছে মেয়েটি সত্তর দশকের ফ্যাশান ট্রেন্ড ফলো করে সেজেছে৷

প্রশ্নোত্তর পর্বের সময় মেয়েটি মাইক হাতে নিয়ে বলল, ‘আমার নাম দিশা সাহা রায়৷ আমার প্রশ্ন হল, ভ্রমণ মানে কি শুধু একটা জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া্, এছাড়া আর কোনও ভ্রমণ হয় না?’

সায়ন এই প্রশ্নের উত্তরে কিছুক্ষণ বাজে বকল৷ তারপর টুকটাক দু-একটা প্রশ্নের শেষে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল৷ মোবাইলে সময় দেখল বিষাণ৷ এক ঘণ্টা হতে আরও দশ মিনিট বাকি৷ এই সময়টা সেল্‌ফির অনুরোধে পাত্তা না দিয়ে কাজের কাজ করা যাক৷

সে সোজা দিশার কাছ গিয়ে বলল, ‘অন্যরকম ভ্রমণ বলতে আপনি কি মানস ভ্রমণ বলতে চেয়েছিলেন?’

‘কী করে বুঝলেন?’ মৃদু হাসল দিশা৷

‘কারণ আমি আদ্যন্ত কুঁড়ে‍ মানুষ৷ বিছানা থেকে উঠে ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু’ দেখার কথা ভাবলেও গায়ে জ্বর আসে৷’

দিশা খিলখিল করে হেসে বলে, ‘আপনি খুব মজার কথা বলেন তো!’

‘তা বলি?আরও শুনতে চান? তা হলে কিন্তু আমার সঙ্গে কফি খেতে হবে৷’

‘আমার আপত্তি নেই’, শ্রাগ করে দিশা, ‘কিন্তু আপনি তো বেরোতে পারবেন না৷ কত লোক আপনার সঙ্গে সেল্‌ফি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷’

‘আমাকে পাঁচ মিনিট দিন প্লিজ৷’ দিশাকে দাঁড়াতে বলে ভক্তবৃন্দের মধ্যে মিশে গেল বিষাণ৷ জল বিনে মাছ বাঁচে না৷ ফ্যান বিনে বিষাণ৷

সেল্‌ফি পর্ব ও পাবলিক রিলেশন চুকিয়ে বিষাণ দিশার কাছে এল পনেরো মিনিট পরে৷ দিশার মুখ গম্ভীর৷ চোখের তারা অবশ্য ঝিলমিল করছে৷

মেয়েদের মানভঞ্জন করতে কী ভাল যে লাগে! ইনফ্যাক্ট মেয়েদের ব্যাপারে বিষাণ এতটাই পোক্ত যে সে বলে থাকে, ‘আমি তো কালো বোড়ে৷ সাদা রানির চালের ওপর আমার মুভমেন্ট নির্ভর করে৷’

সুতরাং আধঘণ্টা পরে ওদের দু’জনকে যে একটি নামি ক্যাফেতে ক্যাপুচিনো পান করতে দেখা গেল, এতে বিষাণের কোনও ভূমিকা নেই৷ দিশা প্রস্তাব করেছে এবং বাধ্য ছেলের মতো সে ঘাড় নেড়েছে৷ এর মধ্যে ওরা পরস্পরকে ‘তুমি’ বলতেও শুরু করেছে৷

কফিপানের পর ওদের দেখা গেল রেস্তোরাঁ থেকে ডিনার প্যাক করতে আর অফ শপ থেকে বিয়ারের ক্যান কিনতে৷ তারপরে দেখা গেল ক্যামাক স্ট্রিটের একটি পুরনো ম্যানসনের দোতলায়, দিশার ফ্ল্যাটে৷ এগুলো সবই দিশার ইচ্ছেয় হয়েছে৷ বিষাণ শুধু ঘাড় নেড়েছে৷

ফ্ল্যাটে ঢুকে অবাক হল বিষাণ৷ ক্যামাক স্ট্রিটের মতো জায়গায়, এই রকম পশ ম্যানসনের মধ্যে টিপিক্যাল নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির পরিবেশ৷ বসার ঘরে কয়েকটা কাঠের টুল পাতা রযেছে৷ একটা ডিম্বাকৃতি সেন্টার টেবিল৷ তার ওপরে ক্রুশের কাজ করা ঢাকনা৷ রান্নাঘরে উনুন, খেতে বসার জন্য পিঁড়ি‍, খাবার জল রাখার জন্য কুঁজো দেখে বিষাণ বলতে বাধ্য হল, ‘কী ব্যাপার? তুমি কি টেকনোলজি পছন্দ করো না?’

দিশা হেসে ফেলেছে, ‘আমার মাঝেমধ্যে উল্টোপাল্টা হয়ে যায়৷ তুমি কিছু মনে কোরো না, প্লিজ!’

কুলুঙ্গিতে রাখা সেজবাতির পলতে বাড়িয়ে কমিয়ে বিষাণ বলল, ‘তুমি কি সিনেমার প্রপ সাপ্লায়ার? আমাকে তা হলে বলতে পারো৷ টালিগঞ্জের স্টুডিয়োয় কাজ পাইয়ে দেব৷’

রেডিওতে গান হচ্ছে ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণা’৷ গান শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হাতে বিয়ারের ক্যান খুলে একটা ক্যান বিষাণের হাতে ধরিয়ে দিশা বলল, ‘আমি কাজ পাব, সেই জন্যে তুমি লোককে রিকোয়েস্ট করতে যাবে কেন?’

‘কারণ তোমাকে আমার ভাল লেগেছে৷’

‘এই পিক আপ লাইনটা বড্ড পুরনো৷ এখন এই সব চলে না৷’ হাসছে দিশা৷

‘এই পরিবেশে গত শতকের পিক আপ লাইনই বেস্ট৷ তখন অবশ্য ‘পিক আপ লাইন’ শব্দটাই চালু হয়নি৷

‘তাহলে তখন কী বলা হত?’ জিজ্ঞাসা করল দিশা৷

এই প্রশ্নের সূত্র ধরে চলে এল নরনারীর সম্পর্কের ইতিহাস৷ কী ভাবে শতক থেকে শতকে, দশক থেকে দশকে বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের ধারণা৷ ডিনার সেরে বিষাণ যখন বেরোচ্ছে, রাত দশটা বাজে৷ দিশাকে একবারের জন্যেই স্পর্শ করেনি সে৷ শুকনো চুমু বা গাঢ় আদর তো অনেক পরের কথা৷

ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে বিষাণ ভাবছিল, এইরকম তার আগে কখনও হয়নি৷ দিশা প্রথম আলাপেই বাড়িতে ডাকল এবং বিয়ার খাওয়ার প্রস্তাব দিল৷ চোখের ঝিলমিলে ইশারায় বোঝা যাচ্ছিল, আরও এগোতে আপত্তি নেই৷ পিছিয়ে এসেছে বিষাণ স্বয়ং৷ কেন?

মানুষের ঘরে ঢুকে রক্তের স্বাদ না নিয়ে কেন বেরিয়ে এসেছে মানুষখেকো? নিজেকে বারবার জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর পেল না বিষাণ৷ ফ্ল্যাটের গ্যারেজে গাড়ি ঢোকানোর সময় নিজেকে বলল, ‘কালই এর হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব৷’

পরের দিন অবশ্য ওদের দেখা হল না৷ কারণ বিষাণের কাজের চাপ৷ তার পরের দিনও না৷ একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিষাণকে চলে যেতে হল অসমে৷ এক সপ্তাহ বাদে ফিরে, পড়ে থাকা কাজ চুকোতে লাগল আরও একটি সপ্তাহ৷

এর মধ্যে ফোনে কথা বলা বা হোয়াটসঅ্যাপে টুকটাক চ্যাট হয়েছে৷ দিশা নিজের থেকে‍ একবারও ফোন করেনি‍৷ কালো বোড়ে নিজেই সাদা রানির দিকে এক-পা দু-পা করে এগিয়ে গেছে৷

বিষাণ যেদিন ফাঁকা হল, সেদিন থেকে দিশাকে আর ফোনে পাওয়া গেল না৷ হোয়াটসঅ্যাপ খুলে বিষাণ দেখল, আগের রাতে দিশা মেসেজ করেছে ‘আমাকে একটু বাইরে যেতে হচ্ছে৷ ফোনে পাবে না৷ ফিরে এসে আমিই যোগাযোগ করে নেব৷’

যোগাযোগহীনতার সময়ে বিষাণ আসল কথাটা বুঝতে পারল৷ সে বিচ্ছিরিভাবে দিশার প্রেমে পড়েছে৷ যাকে বলে ল্যাজেগোবরে অবস্থা৷ এই রকম বোকাটে, যুক্তিহীন প্রেমের সিচ্যুয়েশান তার চিত্রনাট্যে থাকে৷ যা দেখে সবাই আহা-উহু করে৷ ওই ফিল্মি ঘটনা তার জীবনে ঘটে যাবে, এটা জাস্ট বুঝতে পারেনি বিষাণ৷

দিশার ফোন এল এক সপ্তাহ পরে৷ তখন বিষাণ প্রযোজক তপন সাহার সঙ্গে মিটিং-এ ব্যস্ত৷ মিটিং থামিয়ে ফোন ধরে সে বলল, ‘কী ব্যাপার? তুমি না বলে কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিলে? আমাকে বলে গেলে কী ক্ষতি হত? এমন কোথায় গিয়েছিলে যে ফোন করা সম্ভব ছিল না? দুশ্চিন্তার চোটে আমার পাগল হওয়ার জোগাড়৷ তোমার কি মায়াদয়া নেই?’

দিশা খিলখিল করে হাসছে৷ ‘এত কথার উত্তর ফোনে হয় না৷ এখন কী করছ?’

‘মিটিং-এ আছি৷ আমি আসছি তোমার কাছে৷ জরুরি কথা আছে৷’

‘আমি কিন্তু আর ক্যামাক স্ট্রিটে নেই৷ ফিরে এসে বাসা বদল করেছি৷’ রহস্যময় গলায় বলে দিশা৷

‘কোথায় উঠেছ?’

আনন্দ পালিত রোডের ঠিকানা আওড়ে দিশা বলল, ‘ফ্ল্যাটের পাঁচতলায়৷ কখন আসবে বলো৷ আমি কফি করছি৷’

‘এক ঘণ্টা৷’ ফোন কাটল বিষাণ৷

বছর ষাটেকের তপন তার দিকে তাকিয়েছিলেন৷ এবার বললেন, ‘বিষাণ!আর ইউ ইন লাভ?’

বিষাণ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল৷

‘আরে বাহ্!আমাদের গ্রেট উয়োম্যানাইজার ব্লাশ করছে!’ খ্যাকখ্যাক করে হাসছেন তপন, ‘তোমার আগের প্রেমিকারা জানতে পারলে মারতে আসবে তো৷’

বিষাণ ভুরু কুঁচকে বলে, ‘আমরা মিটিংটা আবার শুরু করি?’

‘মিটিং-এ মারো গুলি!এটা তো টলিউডের গ্রেট স্কুপ৷ বিষাণ ইজ ইন লাভ!’

‘প্লিজ তপনদা!এই বোকাটে আলোচনাটা থাক না৷’

‘প্রেমে পড়া ব্যাপারটাই খুব বোকাটে ভায়া!’ হাসলেন তপন, ‘আমিও একদিন প্রেমে পড়েছিলাম৷ বোকার মতো কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে‍ থাকতাম৷ বোকার মতো রোজ প্রেমপত্র লিখতাম৷ একটা কথা মনে রেখো, প্রেমে পড়া মানে কিন্তু ভালনারেব্‌ল হয়ে যাওয়া৷’

বিষাণ শ্রাগ করে বলে, ‘মিটিং তাহলে মুলতুবি হয়ে গেল?’

তপন প্রসঙ্গ বদলাতে আগ্রহী নন৷ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেয়েটা কে? ভাল করে চেনো? নাকি ল্যাজে খেলাচ্ছ? অন্যগুলোর সঙ্গে যেমন করো৷ ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড?’

অন্যদিন হলে এইসব কথার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিতে এক মুহূর্তও লাগে না বিষাণের৷ উত্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে অপমানের হুল৷ প্রশ্নকর্তা এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলার সাহস পান না৷

আজ ওই পথে হাঁটার কথার মনেই হল না৷ বিষাণ বলল, ‘দিশার সঙ্গে এর আগে একদিনই দেখা হযেছে৷ ফোনে কথাবার্তা হয়৷ আজ দ্বিতীয়বার দেখা হবে৷’

‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’,হাসলেন তপন৷‘তা হলে তো আরও ডেঞ্জারাস কেস৷ তোমাদের জেনারেশনে এসব হয় নাকি? আর ইউ সিয়োর, এটা প্রেম? কাম নয়?’

‘উফ্!’বিরক্ত হয়ে চেয়ার ঠেলে উঠল বিষাণ, ‘আমাকে কি ভেবেছেন বলুন তো? সেক্ট টয়? সুইচ অন করলেই ঘ্যার্‌র্‌র করে লিঙ্গপ্রহার শুরু করব?’

‘তাই নয়?স্যরি!আমার ভুল ধারণা ছিল৷আসলে আজকাল মিডিয়া শুধু মিথ্যে কথা বলে৷’

সযত্নে তৈরি করা ইমেজ এইভাবে বাঁশ দেবে, ভাবতেও পারেনি বিষাণ৷ সে তেতো হেসে বলল, ‘আমি একটা মানুষ৷ আমারও প্রেম পায়৷ বিয়ে এবং সংসার করতে ইচ্ছে করে৷’

তপন সিরিয়াস মুখে হাত জোড় করে বললেন, ‘প্রেম মানুষকে বদলে দেয়– এটা জানতাম৷ এতটা বদলে দেয়, জানতাম না৷ বেস্ট অফ লাক৷’

৷৷৩৷৷

আনন্দ পালিত রোডের ফ্ল্যাটের পাঁচতলা ফ্ল্যাটের কলিং বেল টেপে বিষাণ৷ আজ সে তৈরি হয়ে এসেছে৷ টেক অ্যাওয়ে ডিনারের প্যাকেট আর ওয়াইন তো আছেই৷ সঙ্গে আছে কার্নেশানের তোড়া এবং হিরের আংটি৷ প্রেম নিবেদন আজই সেরে ফেলা যাক৷ সুযোগ পেলে বিবাহ প্রস্তাবও দেবে৷

দরজা খুলেছে দিশা৷ পরে আছে‍ থ্রি‍ কোয়ার্টার প্যান্ট আর কুর্তি৷ পায়ে ফ্লিপফ্লপ৷ মাথার চুল এর মধ্যে ছোট করে কেটে ফেলেছে৷ ঘাড়ে একটা ট্যাটুও করিয়েছে৷ নাকে নোজপিন৷ এত বদলের মধ্যেও চোখের তারার ঝিলমিলটা যায়নি৷

বিষাণ বেদম অবাক হয়ে বলল, ‘চেহারায় এত বদল? সত্তরের দশক থেকে নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশক? কী ব্যাপার বল তো?’

‘কিছুই না!’ খিলখিল করে হাসছে দিশা, ‘নতুন জায়গায় এসে নতুনভাবে সাজতে ইচ্ছে হল৷ ফ্ল্যাটটাও সুন্দর করে সাজিয়েছি৷ দেখবো এসো৷’

ফ্ল্যাটে ঢুকে মন ভরে গেল বিষাণের৷ দেওয়ালে সমসাময়িক শিল্পীদের আঁকা চিত্রকলা, ঘরের কোণেই ইনস্টলশোন আর্ট, জানলার সামনে রাখা টবে দেশিবিদেশি ফুলের সংগ্রহ, কেজো আসবাবপত্র নিয়ে সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট৷ জোনাল লাইটিং-এ আলো-আঁধারির মাঝে ডাইনিং টেবিলে খাবারের প্যাকেট, ওয়াইনের বোতল আর কার্নেশানের তোড়া রাখল বিষাণ৷ জিজ্ঞাসা করল, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

‘আমি বনলতা সেন নই৷ তাই নাটোরে ছিলাম না৷’ হাসল দিশা৷ ‘আসলে আমার এমন একটা পরিস্থিতি যে মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়তে হয়৷ ওপরওয়ালার হুকুম না মেনে উপায় নেই’

আকাশের দিকে তোলা দিশার তর্জনি দেখে বিষাণ বলল, ‘তোমার বাবা-মা কোথায়?’

‘কেউ নেই৷ সংসারে আমি একা৷’ দিশার চোখে বিষণ্ণতা৷

‘দুঃখের কথা থাক’,দিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বিষাণ,‘ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটটার কী হল?’

‘ওটা ছেড়ে দিলাম৷ আমারই দোষ৷ হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল৷’

‘এটা কিনলে? নাকি এটাও ভাড়া?’

‘কাজের জন্যে এখানে কিছুদিন থাকতে হবে’, প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিষাণের বুকে মাথা রেখেছে দিশা, ‘আমি অনেক পাপ করেছি গো৷ এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করছি৷ আরও অনেকদিন করতে হবে৷ আমার নাম শুনে বুঝতে পার না? দিশা সাহা রায়৷ সাহারা মরুভূমিতে আমি দিশা খুঁজছি৷’

দিশার চুলে বিলি কেটে বিষাণ বলল, ‘আমিও তোমার মতো উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম৷আমারও কোনও দিশা ছিল না৷অবশেষে দিশা খুঁজে‍ পেয়েছি৷’

‘তাই?’ দিশার চোখে কৌতূহল৷

‘এই নাও!’ কার্নেশানের তোড়া এগিয়ে দিয়েছে বিষাণ, ‘আমার তরফ থেকে তোমাকে অফিসিয়ালি প্রেম নিবেদন করলাম৷’

ফুলের তোড়া নিয়ে দিশা ম্লান হেসে বলল, ‘আমি জানতাম এই ঘটনা ঘটবেই৷ তোমাকে আমার প্রেমে ফেলাটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল৷ আমি সেই টাস্কে সফল হয়েছি৷ আমাদের সোশ্যাল সিস্টেম সব দেখেছে৷’

দিশার অসংলগ্ন কথা শুনে ঘাবড়ে না গিয়ে হাতজোড় করে বিষাণ বলে, ‘আমি খুব খারাপ ছেলে দিশা৷ এতদিন মেয়েদের কমোডিটি হিসেবে দেখতাম৷ যাকে পছন্দ হত, তাকে ব্যবহার করে তারপর ছুঁড়ে‍ ফেলে দিতাম৷ এবং আমার ক্যাসানোভা ইমেজ পাবলিকলি ফ্রন্ট করতাম৷’

‘আমাকেও কি তুমি ব্যবহার করতে চাও?’ টিউলিপ গ্লাসে ওয়াইন ঢালছে দিশা৷

‘ওকথা বোলো না প্লিজ!’ দিশার হাত ধরেছে বিষাণ৷ কী ঠান্ডা আর মসৃণ হাত! মনে হচ্ছে ধাতুর তৈরি৷ ‘তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মধ্যে একটা চেঞ্জ এসেছে৷ ওই ক্যাসানোভা লাইফস্টাইল আর ভাল লাগছে না৷ এবার থিতু হতে ইচ্ছে করছে৷ প্রিয় মানুষের জন্য রান্না করতে ইচ্ছে করছে৷ বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি জান আমি খুব ভাল চিলি পর্ক বানাতে পারি?’

‘প্রেম?’টিউলিপ গ্লাস বিষাণের হাতে তুলে দিয়ে দিশা বলে, ‘আমার মধ্যে তুমি কি দেখলে যে প্রেমে পড়ে গেলে? তুমি প্রতিভাবান, বিত্তবান, বিখ্যাত৷ আর আমি জাস্ট নোবডি৷ হোয়াই মি, বিষাণ?’

‘বিকজ ইউ হ্যাভ গট আ গোল্ডেন হার্ট৷’দিশার সঙ্গে চিয়ার্স করে বলে বিষাণ,‘আমি আজ জাপানি খাবার এনেছি৷ সুশি খেতে তোমার অসুবিধে নেই তো?’

দিশা চুপ৷ প্যাকেট থেকে খাবার বের করে টেবিলে রাখার সময় বিষাণ দেখল, দিশা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে৷

বিষাণ বলল, ‘ওরকম করে কী দেখছ?’

দিশা হঠাৎ বলে, ‘তুমি কী করে জানলে যে আমার গোল্ডেন হার্ট?’

বিষাণ ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তোমার কথার মানে বুঝতে পারলাম না৷ ইলিশ মাছকে বলা হয় জলের রুপোলি শস্য৷ তার মানে কি ইলিশ মাছ রুপো দিয়ে তৈরি? এটা উপমা৷ কথার কথা৷’

‘কথার কথা নয়৷ আমার হৃদয় সত্যিই সোনা দিয়ে তৈরি৷’ এক চুমুক ওয়াইন পান করে দিশা৷তার চোখের তারা আগের থেকে অনেক বেশি ঝিলমিল করছে৷ তার শীতল, ধাতব হাত থেকে বিদ্যুতের ঝলক বেরিয়েই নিভে যাচ্ছে৷ দিশা বলছে, ‘আমি এসেছি অন্য গ্রহ থেকে৷ আমাদের সময় ও দূরত্বের ধারণার সঙ্গে তোমাদের সময়ের হিসেব অনুযায়ী গত তিনশো বছর ধরে এই গ্রহে আছি৷ এটা আমার শাস্তি৷’

‘এই প্লটটা পুরনো!’এক চুমুকে ওয়াইন শেষ করে টিউলিপ গ্লাসে আবার ওয়াইন ঢেলেছে বিষাণ৷ মুচকি হেসে বলছে, ‘কোন অপরাধের জন্য শাস্তি পেলে? এলিয়েন প্রধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলে?’

‘গাঁজাখুরি গল্প না বিষাণ৷ যা বলছি, সত্যি বলছি৷ আমাদের সোশ্যাল সিস্টেম থেকে একজনের সঙ্গে মেটিং করতে বলেছিল৷ সেই নির্দেশ না মেনে আমি অন্য একজনের সঙ্গে মেটিং করেছিলাম৷ তার ফলে আমার পারসোনাল সিস্টেমে ভাইরাস ঢুকেছে৷ আমার চিপ করাপ্ট হয়ে গেছে৷’

‘সোশ্যাল সিস্টেম!পারসোনাল সিস্টেম!মেটিং!ভাইরাস!চিপ!এসব কী বলছ তুমি?’

‘আমাদের সোশ্যাল সিস্টেম অ্যান্টি‍-ভাইরাস সফ্‌টওয়ার দিয়ে আমাকে স্ক্যান করছে৷ আমার টাস্ক হল মোট সাঁইত্রিশবার তোমাদের গ্রহের বিভিন্ন টাইম জোনের ছেলেদের আমার প্রেমে ফেলতে হবে৷ প্রেম, মাইন্ড ইট৷ নট মেটিং৷ তোমাদের শরীর থেকে লাভ হরমোন বেরোচ্ছে কিনা আমাদের সোশ্যাল সিস্টেম মনিটর করছে৷’

‘আমাকে মনিটর করা হচ্ছে?’নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না বিষাণ৷ দু’গ্লাস ওয়াইন পান করে তার নেশা হয়ে গেল নাকি?

দিশা বলল, ‘যারা আমার প্রেমে পড়বে, তাদেরকে আমার করাপ্ট চিপ দিতে হবে৷ ‘অরিয়াম’ বা গোল্ড মেটাল দিয়ে তৈরি চিপটা হার্ট শেপেড ডিভাইসে রাখা আছে৷ সাঁইত্রিশবার এই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে গেলে আমার চিপ থেকে ভাইরাস ডিলিট হয়ে যাবে৷’

ওয়াইন পান বন্ধ করে, পকেট থেকে আংটির বাক্স বার করে বিষাণ বলে, ‘গপ্‌পো কথা বাদ দাও৷ উইল ইউ ম্যারি মি, দিশা?’

‘যা বলছি, মন দিশে শোনো৷ আমাকে একই সঙ্গে বিভিন্ন টাইম জোনে থাকতে হয়৷ কখনও আমি কলোরাডোতে ১৯২০ সালের রিটা, তার চার ঘণ্টা পরে ১৮০০ সালের বাগদাদের ফরিদা, তার তিনঘণ্টা পরে ১৯৭০ সালের কলকাতার দিশা৷ একই সঙ্গে স্থান কাল আর ভ্রমণ করতে গিয়ে অনেক সময় গুলিয়ে যায়৷ একবার তো বাগদাদে রিটা হয়ে চলে গিয়ে মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল৷ সোশ্যাল সিস্টেম আমাকে বাঁচায়৷ টাইম আর স্পেসের গণ্ডগোলের জন্যই তোমাকে প্রথম আলাপে সত্তর দশকের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ ওখানে নকশাল নেতা অনিমেষকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল৷ এইবার আর ভুল করিনি৷ ঠিক ফ্ল্যাটে ঠিক লোককে নিয়ে এসেছি৷’

বিষাণ ভেবলুর মতো দিশার দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ কিটকিট করে ধাতব হেসে দিশা বলল, ‘তুমি হলে আমার বত্রিশ নম্বর প্রেমিক৷ তোমার প্রেম আমার করাপ্ট চিপকে আর একবার স্ক্যান করেছে৷ আর মাত্র পাঁচজনকে দিয়ে স্ক্যান করাতে পারলেই আমার সিস্টেম ভাইরাস ফ্রি হয়ে যাবে৷ তখন সোশ্যাল সিস্টেম আমাকে ফিরিযে নেবে৷ এই নাও সেই করাপ্ট চিপ! এবার আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে৷’

বিষাণ এক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে৷ জোনাল লাইটিং-এর মায়ার মধ্যে ধীরে ধীরে কুর্তি খুলল দিশা৷ ম্যানিকিনের মতো মসৃণ এবং চড়াই-উৎরাই বিহীন শরীর থেকে নীল বিদ্যুতের ঝলক বেরচ্ছে৷ নিজের বুকের বাঁ দিকে হাত রেখে দিশা একটি ছোট্ট দরজা খুলল৷ বিষাণ দেখল সেখানে রাখা রয়েছে একটি হৃদয়৷ বায়োলজি বইতে যে হার্ট আঁকা থাকে সেরকম নয়৷ এই হার্ট ইমোজির মতো দেখতে৷ কিউপিডের বর্ণনায় আঁকা তিরবিদ্ধ হৃদয়৷

স্লট থেকে করাপ্ট চিপ বার করে বিষাণের হাতে তুলে দিয়ে দিশা বলে, ‘এই নাও৷ আর একটা কথা মনে রেখো৷ ভ্রমণ মানে শুধুমাত্র একটা জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া নয়৷ এছাড়া আরও অনেক রকম ভ্রমণ হয়৷’

তারপর বিষাণের চোখের সামনে সহস্র আলোকণা টুকরো টুকরো হয়ে মিলিয়ে গেল৷

শনিবারের চিঠি,শারদ সংখ্যা, ১৪২৬

অঙ্কন: দেবাশীষ দেব