মা ও আমি

এমনও হয়েছে অনেকদিন, আমি

বাড়ি ফিরছি না।

মা আকাশে মুখ বাড়িয়ে রেখেছে

ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

রাস্তার ধুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।

সাইকেলের চাকার দাগ মিলিয়ে যাচ্ছে।

আমি আর কিছুতেই বাড়ি ফিরছি না।

মা ভাবছে, আমি যা বকমবাজ, হয়তো কারও সঙ্গে

বকবক করছি।

আর বন্ধুগুলোও হয়েছে সেইরকম।

অনেকদিনের পর অনেক কথা তো! পিঠে হাত রেখে

গল্প করছি কারও সঙ্গে।

একবার শেয়াল আসছে একবার কুকুর।

দু’জনেই শুঁকে যাচ্ছে আমাকে।

গল্প আর ফুরোয় না।

দেখতে দেখতে জলের গ্লাসে সর জমছে।

ছোট হতে হতে একসময় বিন্দু হয়ে যাচ্ছে

ভাতের থালা।

কুয়াশায় ভিজে যাচ্ছে রেললাইন, আমাদের

ছোট নদী, তার হাঁটুজল, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের

পোড়ো বাড়ি।

শূন্যে মায়ের দেখা অসীম।

কিছুতেই ফুরোতে চায় না।

একেকদিন এমনও হয়েছে,

আমি কিছুতেই বাড়ি ফেরার রাস্তা

খুঁজে পাচ্ছি না।

আমাদের গায়ে লাগছে জবাগাছের ডাল,

কলাগাছের পাতা।

কুয়াশায় আমরা দু’জনেই জবুথবু,

নিঃসীম লাগছে আমাদের,

প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা, একবার

শ্মশানে একবার গোরস্থানে,

একবার মাজারের পাশে একবার পীরের দরগায়।

একটা প্রান্তর শুঁকে যাচ্ছে আমাদের,

একটা মজা খাল।

একটা ডাহুক শুঁকে যাচ্ছে আমাদের,

একটা আধমরা শেয়াল।

পুকুরের জল তার মনে সন্দেহ,

বাঁশগাছের অন্ধকার তার মনেও সন্দেহ।

মা হাউমাউ করতে করতে জড়িয়ে ধরছে

সন্তানের আলো।

আমিও মায়ের ডালে পাতায় উড়ে উড়ে বসছি

জোনাকির মতো।

এত সুন্দর পৃথিবীর কোথাও কোনওখানে

বাড়ি ফেরবার মতো

একটুকরো সোজা সরল রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না!

এমনও হয়েছে, রাত্রিবেলা

এত নিশুতি, চাঁদ বাড়ি ফিরছে, গৃহস্রোত বাড়ি ফিরছে,

মা আর কিছুতেই বাড়ি ফিরছে না।

ডুমুরজলা বস্তির লণ্ঠন নিবে আসছে,

মা কোথায়?

মাথার উপর থেকে একটু একটু করে

নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ছাদ,

আমাদের বাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তস্কর,

পায়ের নিচে ভূমিকম্প নড়ছে, তারই আভাস।

মা দেখতে পাচ্ছে না আমার স্বপ্নে জড়িয়ে আসা

চোখ, মরা পেট, ফুলে ওঠা নাকের পাটা,

ঘুমন্ত মুখ আর আমার অর্ধসমাপ্ত শরীর।

আমার খিদে আমার তেষ্টা অন্ধকারে হাহাকার হয়ে

দরজায় দরজায় ধাক্কা খাচ্ছে।

আমার শোবার খাটে ওই একটু আগুনের শিখা,

দাউ দাউ করে জ্বলছে মশারি বালিশ!

 

শনিবারের চিঠি, একান্ন বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা

অঙ্কন : তরুণকান্তি বারিক