ঠাকুরবাড়ির মহাকাব্যে উপেক্ষিত এক মহাকাব্যিক চরিত্র হলেন দ্বারকানাথ। তাঁর অতিমানবীয় কাজকর্মের জন্য তিনি রক্ত মাংসের চরিত্র থেকে রূপকথার নায়কে পর্যবসিত হয়েছেন। এই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রকে ঘিরে অসংখ্য গল্প আছে, যেগুলো পড়লে রূপকথার গল্প পড়ছি বলেই মনে হয়। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনীকারেরা নির্দিষ্ট করে বলেননি তাঁকে ঘিরে কত গল্প আবর্তিত আছে। তবে তাঁদের জীবনীগ্রন্থে কিছু গল্পের হদিস মেলে। আমি ব্যক্তিগত অনুসন্ধান করে দ্বারকানাথের জীবনের সঙ্গে জড়িত আছে এমন অসংখ্য গল্প উদ্ধার করেছি এবং তা ‘গল্প হলেও সত্যি’ কিনা খুঁজে পেয়েছি। এখন আপাতত এই গল্পগুলো কয়েকটি পর্বে তুলে ধরব যা পড়ে পাঠক সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন, দ্রাবকানাথ রূপকথার নায়ক না রক্ত মাংসের এক বহুমাত্রিক চরিত্র।
পর্ব–১
দ্বারকানাথের বন্ধুপ্রীতি
বিনয় ঘোষ মনে করেন, ‘দ্বারকানাথের জীবনটা মনে হয় একটা রপকথার মতো।’ বস্তুত দ্বারকানাথের জীবন উষালগ্ন থেকে গোধূলি পর্যন্ত ঘটনাময় এবং ঘটনার সাথে রটনা মিলেমিশে তিনি রক্ত মাংসের মানুষের পরিবর্তে হয়ে উঠেছেন রূপকথার রাজপুত্র।
অসামান্য এই মানুষটি এমন কিছু করেছেন, যা সেকালের মতো একালেও অসমসাহসিক। তাঁর অতিমানবীয় কাজ তাঁকে রোমহর্ষক চরিত্রের প্রিন্স করে তুলেছে। প্রিন্স বলে তিনি পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন দায়িত্ববান পিতা, স্বামী ও সর্বোপরি ভালো বন্ধু। আমরা দেখব বন্ধু হিসেবেও তিনি ছিলেন অন্য ও অনন্য। প্রিন্স হলেও তিনি কতটা অতীতচারী, কতটা সাদামাটা সেটাই এই গল্পের নীতিকথা। একদিন প্রিন্স তাঁর নিজের ব্যাঙ্কের অফিসে বসে কাজ করছেন, এমন সময় এক কর্মচারী এসে উপস্থিত। তিনি প্রিন্সকে হিসেবের খাতা সই করাবেন কিন্তু বলতে ইতস্ততঃ করছেন। প্রিন্স তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার নিজের কাজে ডুব দিলেন। কর্মচারী তখনও দণ্ডায়মান। প্রিন্স বললেন, ‘ওহে আমার ব্যাঙ্কে চাকরি করার আগে থেকে কি তুমি আমাকে চেনো? আমার তোমাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছে।’ কর্মচারীটি করজোড়ে বললেন, ‘হুজুর, আমার আপনার সঙ্গে এক পাঠশালায় পড়বার সৌভাগ্য হয়েছে।’ কথাটা শুনে প্রিন্সের মনের আকাশে যেন বিদ্যুতের ঝলক দেখা দিল এবং সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো অতীত বর্তমান এসে হাজির হল। প্রিন্সের সবকিছু মনে পড়ে গেল। বন্ধুকে আলিঙ্গন করে বললেন, ‘বন্ধু তুমি আমার সহপাঠী হয়ে এতদিন নিজেকে আত্মগোপন করে রেখেছিলে কেন? আর আমার সহপাঠী হয়ে এই সামান্য পনেরো টাকা বেতনের চাকরি করা তোমার শোভা পায় না।’ এও বললেন, আর তাকে এই পনেরো টাকা বেতনের চাকরি করতে হবে না। সেদিনই তার বেতন ধার্য হল একশো টাকা। বেতন বৃদ্ধির সাথে সমান্তরালভাবে বন্ধুত্বের গভীরতাও বৃদ্ধি পেতে লাগল। প্রিন্স বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানালেন, যেন প্রতি মাসে দু-একদিনের জন্য তাঁর বাড়িতে চলে আসে, তাহলে দু’জনে ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করে সময় কাটাবে। কথামতো কর্মচারীটি একদিন দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়িতে এসে দেখলেন যে বৈঠকখানার বাড়ি তথাকথিত বড়ো বড়ো সাহেবে পরিপূর্ণ। কর্মচারীটি যখন ফিরে যেতে অগ্রসর হলেন তখনই প্রিন্সের দৃষ্টি পড়ল তাঁর উপর। প্রিন্স তাঁকে ঘর ভর্তি সাহেবের মধ্যে ডাকলেন এবং সাহেবদের বললেন, ‘আজকে আমার বাল্যবন্ধু এসেছেন। বন্ধুর সঙ্গেই সমস্ত দিন কাটাব। অতএব আজকে আপনারা আমাকে মার্জনা করবেন। আপনাদের সঙ্গে অন্য একদিন কথা বলব’। সাহেবরা দ্বারকানাথের বন্ধুর মলিন চেহারা ও বিবর্ণ পোশাক পরিচ্ছদ দেখে বিস্মিত হয়ে ফিসফিস করতে করতে বিদায় নিল। আর কর্মচারীটি তাঁর সহপাঠীর অকৃপণ আন্তরিকতা দেখে, বিস্ময়ে অপলক চোখে তাঁর বর্তমান প্রভু এবং বন্ধুটির দিকেতাকিয়ে রইলেন শুধু।
আর আমরা উপলব্ধি করলাম তিনি কেবলমাত্র বিলাস, বৈভবে প্রিন্স নন, হৃদয়ের দিক থেকেও তিনি ছিলেন প্রিন্স।
পর্ব–২
দ্বারকানাথের শিক্ষক
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাগুরু নিয়ে দিস্তে দিস্তে লেখালেখি হয়েছে। বইপত্র বা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে। আমরা সেই চেনা পথে হাঁটব না। আমরা এক অর্বাচীন পথের পথিক হব- আমরা নোবেলজয়ী কবির পিতামহের শিক্ষক নিয়ে আলোচনা করব। দ্বারকানাথের শিক্ষা আরম্ভ হয় পাঠশালাতে। তখনকার দিনে রেওয়াজ ছিল ধনীগৃহের পাঠশালাতে তাদের যে সন্তান-সন্ততি পড়ত, তারা নিজস্ব ‘বাটী’ ছেড়ে বাইরের পাঠশালায় পড়তে যেত না। গুরুমশায় চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়ায় বসে পাঠ নিতেন। দ্বারকানাথের জোড়াসাঁকোর নিজবাটীতে দ্বারকানাথের বিদ্যারম্ভ হয়। সেকালে পাঠশালার চিত্র পাওয়া যায় শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখাতে। পাঠশালা পরিদর্শন করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এক রোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন। বেন্টিঙ্কের রিপোর্টে দেখা যায় পাঠশালায় গুরুমশায়ের চৌদ্দ রকমের শাস্তি প্রণালী। তার মধ্যে কয়েকটি হল—‘বালক মাটিতে বসে নিজের একটি পা নিজের কাঁধে চাপিয়ে থাকবে, নিজের হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে ব্যাঙের মতো করে বসতে হবে, নাহলে তার পা হাত বেঁধে পশ্চাতে বিছুটি পাতা দেওয়া হবে অথচ সে চুলকাতে পারবে না। দ্বারকানাথকে তাঁর বড় ভাই রাধানাথ ঠাকুর রাজকার্যের উপযোগী করে তুলতে আরবি-ফারসি শিখতে মৌলবির কাছে এরূপ ভীতিজনক নরকে একবার ভর্তি করেছিলেন। এই দুই ভাষায় দ্বারকানাথের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের খবর পাওয়া না গেলেও তিনি যে এই দুই ভাষাতেই কথা বলতে পারতেন তার প্রমাণ আছে। সমাচার দর্পণে এক পত্রলেখক উল্লেখ করেছেন যে, নিমকি বিভাগের দেওয়ানী করবার সময়ে দ্বারকানাথ দলিলে ফারসিতেই সই করতেন। দ্বিতীয়বার বিলাত যাবার সময় মিশরের খেদিব মহম্মদ আলির সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন অ-মিশরীয়দের মধ্যে একমাত্র দ্বারকানাথই দোভাষীর সাহায্য বিনা কথাবার্তা বলেন।
ইংরেজি শিক্ষালাভের জন্য দ্বারকানাথ এরপর ভর্তি হন শেরবোর্ণ সাহেবের স্কুলে। রাজকার্যের উপযোগী রাজাদের ভাষা পরবর্তীকালের প্রিন্সকে আয়ত্ত করতে ‘Enfield’s Spelling’, ‘Reading Book’, “Tooteenamah or Tales of the parrot”, ‘universal letter writer’, ‘Complete Letter Book’, ‘Royal English Grammar’ পড়তে হয়েছিল। ইংরাজী ভাষা দ্বারকানাথ খুব ভালোভাবেই শিখেছিলেন। মুষ্টিমেয় যে কয়জন ভারতীয় সে যুগে ভাল ইংরাজী লিখতে পারতেন, দ্বারকানাথ তাঁদের একজন। রিকার্ডো সাহেব তাঁর ‘ফ্যাক্টস অ্যাবাউট ইন্ডিযা’ বইয়ে ইংরাজী শেখায় ভারতবাসীর ব্যুৎপত্তির উদাহরণস্বরূপ রামমোহন রায় ও রাধাকান্ত দেবের চিঠির সঙ্গে দ্বারকানাথের লেখা চিঠিও উদ্ধৃত করেছেন। এ শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন পাদ্রী অ্যাডাম এবং হেয়ার সাহেবের কাছে। বিদ্যালয় ত্যাগ করে দ্বারকানাথ এই পাদ্রী সাহেবের কাছে ইংরাজি পড়তেন এবং এঁরই সাহায্যে অল্পবয়স থেকেই তিনি সম্ভ্রান্ত ইংরেজদের পরিচিত ও বন্ধু হন বলে অনুমান করা হয়।
আমরা শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শন করি, দ্বারকানাথও করেছিলেন। যতদিন শেরবোর্ণ সাহেব বেঁচেছিলেন দ্বারকানাথ তাঁকে মাসোহারা দিয়েছেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনে বড় শিক্ষক ছিলেন তাঁর পালিতা মাতা অলকাসুন্দরী দেবী। নেপোলিয়ান বলেছিলেন, তুমি আমাকে একজন ভালো মা দাও আমি তোমাকে ভালো নেশন দেবো। একজন সন্তানের প্রথম শিক্ষাগুরু তার মা-বাবা আর প্রথম পাঠশালা হল গৃহ। অলকাসুন্দরী দ্বারকানাথকে ‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে’ তৈরি করেছিলেন। মা মেনকার মৃত্যুর পর অলকাসুন্দরী তাঁকে মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। নিজের বুকের দুধ খাইয়ে প্রকৃত মায়ের স্নেহ মাধুর্যে তিনি দ্বারকানাথকে ভরিয়ে তুলেছিলেন। দ্বারকানাথের চরিত্র গঠনে অলকাসুন্দরীর ছিল নিঃশব্দ সেবার ডালি। স্বামী রামলোচনের মৃত্যুর পর অলকাসুন্দরী খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে নাবালক দ্বারকানাথের শিক্ষাদীক্ষা, ধর্ম ও সুনীতি শিক্ষা পরিচালনা করেন। দ্বারকানাথের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার বীজরোপণ করেছিলেন অলকাসুন্দরী দেবী। অলকাসুন্দরী ছিলেন কুসংস্কারমুক্তা, তাঁর চিত্তের স্বাধীনতা ছিল। দ্বারকানাথের শিক্ষা লাভের সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কারবর্জিত মানসিক গঠনও তৈরি হয়েছিল অলকাসুন্দরীর সান্নিধ্যে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে দ্বারকানাথকে গড়ে তোলার পিছনে এই মহীয়সী নারীর ছিল একক প্রচেষ্টা। মাতা শিক্ষকের প্রতি দ্বারকানাথ মাতৃভক্তির নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমরা দ্বারকানাথের মাতৃভক্তিতে দেখতে পাই।
ক্রমশ…