বাঙালি জীবনে অন্য জাতির মতো নববর্ষ উদযাপন একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে বলা যায়। আগে নববর্ষ আবাহন হত অগ্রহায়ণে, পরে তা চলে আসে বৈশাখে। নতুন বছর নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা গুছিয়ে তোলার প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয়। বৈশাখ যেমন রুদ্ররূপে পুরাতন জীর্ণতাকে দূরে ফেলে দেয় নির্মোহ ভঙ্গিতে তেমনই সে সঞ্চয় করে নতুন সমিধ, নতুন বছরের স্বপ্ন, সাধ, কৃতিত্ব পরিমাপ করতে, বুঝতে শুরু করে।
রবীন্দ্রনাথের কাছে সাতই পৌষের মতন পয়লা বৈশাখও ছিল একটি অতি পবিত্র দিন। নববর্ষ ছিল তাঁর কাছে বিশ্বনাথকে প্রণাম করবার দিন। নিখিল ভুবনের চিরনবীনতাকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করার জন্য নববর্ষের এই দিনটিকে কবি একটি পরম শুভক্ষণ বলেই মনে করেছেন। নববর্ষকে তিনি তাঁর জীবনে গ্রহণ করেছিলেন অভিনব অভিলাষে।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যেমন তাঁর দীক্ষার মন্ত্রটি আশ্রমবাসীদের জন্য দান করে গেছেন, তেমনই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বমানবিকতার বাণীটি আমাদের সবার কল্যাণের জন্য রেখে গেছেন। রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালনও ছিল এই নববর্ষের অঙ্গ, বিশেষত শান্তিনিকেতনে। তাই এখনও রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কবিকে নিত্যনতুন আবিষ্কারে আমরা পাই নিত্যনতুন এক মাত্রা—যার তুলনীয় কিছু স্বদেশে বা বিদেশে নেই।
এমনই এক নববর্ষের দিনে রবীন্দ্রনাথ ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন—মানুষের নববর্ষ আরামের নববর্ষ নয়, সে এখন শান্তির নববর্ষ নয়—পাখির গান তার গান নয়, অরুণের আলো তার আলো নয়। তার নববর্ষ সংগ্রাম করে আপন অধিকার লাভ করে; আবরণের পর আবরণকে ছিন্ন-বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় ঘটে। প্রতিটি নববর্ষই সেই অভ্যুদয়ের আহ্বান নিয়ে আসে আমাদের কাছে। এই অভ্যুদয় হচ্ছে মনুষ্যত্ব লাভের দুঃসাধ্য সাধনা।
১৩০৯ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ আশ্রম বিদ্যালয়ে প্রথম নববর্ষ উৎসবের আয়োজনে হয়েছিল। নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত মন্দিরে উপাসনায় ভাষণ দেন কবি।
এমনই আর এক নববর্ষ উৎসবের দিনে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের পথে অতলান্তিক মহাসমুদ্রের ওপর জাহাজে ছিলেন। সেই তারিখটা ছিল ১৯১৩ সালের ১৪ এপ্রিল।
১৯১৩ সালের ১৭ এপ্রিল হাম্পস্টেডহিথে রোদেনস্টাইনের বাড়ি থেকে রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন—‘এবার আমার নববর্ষের প্রথম দিন এই সমুদ্রযাত্রার মাঝখানে এসে দেখা দিল। প্রত্যেকবার আমার চিরপরিচিত পরিবেষ্টনের মাঝখানে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নববর্ষের প্রণাম নিবেদন করেছি—কিন্তু এবার আমার পথিকের নববর্ষ, পারে যাবার নববর্ষ। এখানকার নববর্ষ যেন আমার কুল থেকে বিদায় নেবার হুকুম নিয়ে এল—আমাকে যাত্রার আশীর্বাদ দিয়ে গেল।’
১৯৩৬ সালের ১৫ এপ্রিল (১৩৪৩) নববর্ষের দিনেই কবির জন্মদিনের উৎসব প্রবর্তিত হল। এই দিন তিনি লিখেছিলেন—‘বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়া ঘাটে’। এই কবিতাটিকে জন্মদিনের কবিতা বলা যেতে পারে।
শান্তিনিকেতন আশ্রমে
নববর্ষে’র দিনে প্রথম জন্মোৎসবের অনুষ্ঠানে কবি তাঁর ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন—‘খ্যাতির কলরব মুখর প্রাঙ্গণে আমার জন্মদিনের যে আসন পাতা হয়েছে সেখানে স্থান নিতে আমার মন চায় না। আজ আমার প্রয়োজন স্তব্ধতায় শান্তিতে।… আজ ফুলের ঋতু যাক, ফলের ঋতুও শেষ হোক, আজ নির্বিশেষে, আপনাকে আপনার মধ্যে পূর্ণ করে তোলবার দিন।’
১৯৪১ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে কবির শেষ জন্মদিন—অশীতিতম জন্মোৎসব পালন করা হয়। কিছুদিন ধরেই কবির শরীর স্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছিল না। আশ্রমগুরুর অসুস্থতার খবরে সকলের মন ছিল বিষণ্ণ ও কাতর। কবির এই অসুস্থতার মধ্যেই আশ্রমে ধীরে ধীরে জন্মোৎসবের উদ্যোগ ও আয়োজন চলতে থাকে। আশ্রমবাসীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তাঁর শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ রেখেই যতটা সম্ভব অনাড়ম্বরভাবে জন্মোৎসব হবে। ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক থেকে আশ্রমিক সবাই ছিলেন শান্ত আর বেদনায় স্তব্ধ।
বিশিষ্ট লেখিকা, শিল্পী ও রবীন্দ্র-স্নেহধন্য রানী চন্দ’র লেখা ‘’আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’ বইটিতে এই দিনের একটি সুন্দর বর্ণনা দেখতে পাই।
রানী চন্দ লিখছেন—‘’আজ নববর্ষ। এবারে ১লা বৈশাখেই গুরুদেবের জন্মোৎসব হবে—আগে থেকে ঠিক করা হয়েছিল। ভোরবেলা কচি শালপাতার ঠোঙ্গায় কিছু বেল জুঁই কামিনী তুলে উদয়ন-এর দক্ষিণের বারান্দায় গুরুদেবের হাতে দিয়ে প্রণাম করলুম।
আজ অনেক আগে থেকেই গুরুদেব বারান্দায় এসে বসেছেন। ফুলের ঠোঙ্গাটি হাতে নিয়ে তা থেকে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ধীরে ধীরে বললেন—আজ আমার জীবনের আশি বছর পূর্ণ হল। আজ দেখছি পিছন ফিরে—কত বোঝা যে জমা হয়েছে। বোঝা বেড়েই চলেছে।’
১৯৪১ সালে, নববর্ষের দিন ভোরে কবির আবাসস্থল উত্তরায়নের বাইরে, বৈতালিক দল গান গেয়ে আশ্রমপথ পরিক্রমা করে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার (বর্তমানে পাঠভবনের অফিস)-এর সামনে এসে সবাই একসঙ্গে জড়ো হন।
নববর্ষ উপলক্ষে মানবের জয়গান গেয়ে রবীন্দ্রনাথ যে কবিতাটি লিখেছিলেন তাকে সংক্ষিপ্ত করে গানে রূপান্তরিত করলেন—‘ঐ মহামানব আসে’। সুর সংযোজন করেছিলেন গানে। এটাই ছিল কবির নববর্ষের গান। কবিকে নিয়ে এটাই যে তাঁর শেষ জন্মদিন, তা যেন তিনি নিজে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–
‘জন্মদিন মৃত্যুদিন দোঁহে যবে করে মুখোমুখি
দেখি যেন সে মিলনে
পূর্বাচলে অস্তাচলে
অবসন্ন দিবসের দৃষ্টি বিনিময়
সমুজ্জ্বল গৌরবের প্রণত সুন্দর অবসান।’
সেদিন সূর্যোদয়ের কিছু আগে মন্দিরে উপাসনা শুরু হয়েছিল। উপাসনা পরিচালনা করেন ক্ষিতিমোহন সেন। কয়েকটি গানের মধ্যে কবির সদ্যরচিত দুটি গান পরিবেশিত হয়। আশ্রমকন্যারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কবির পায়ের কাছে জন্মদিনের উপহারগুলি রাখেন। রবীন্দ্রনাথকে মালা দিয়ে ভূষিত করার পর আশ্রমকন্যারা তাঁর হাতে উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন নির্বাচিত বেদমন্ত্র উদ্ধৃত করে আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তি পাঠ করেন।
অতিশয় দুর্বল শরীর নিয়েও তিনি হেঁটে এসে সভার মধ্যে আসন গ্রহণ করলেন। উপবিষ্ট সকলেই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন। সেদিন সকলের চোখে-মুখে আশঙ্কা আর ব্যগ্রতার কোনও শেষ ছিল না।
নববর্ষ ও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রোগশীর্ণ ক্লান্ত দুর্বল কণ্ঠে অথচ স্বভাবসিদ্ধ স্বচ্ছন্দ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে যা বলেছিলেন, এটাই কবির আশ্রমবাসীদের প্রতি শেষ আশীর্বাদ।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—‘…আমার মতন সৌভাগ্য অতি অল্প লোকেরই আছে, শুধু যে আমার স্বদেশবাসীরাই আমাকে ভালোবেসেছেন তা নয়, সুদূর দেশেরও অনেক মনস্বী তপস্বী রসিক আমাকে অজস্র আত্মীয়তা দ্বারা ধন্য করেছেন। জানি না আমার চরিত্রে কর্মে কী লক্ষ করেছেন। সকলের এই স্নেহ মমতা সেবা আজ আমি অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করে প্রণাম করে যাই তাঁকে যিনি আমাকে এই আশ্চর্য গৌরবের অধিকারী করেছেন।’
একটা সময় এল যখন শান্তিনিকেতনে নববর্ষ আবাহন রবীন্দ্র প্রণতির সঙ্গে গেল যুক্ত হয়ে। জীবনের শেষ প্রান্তে, রবীন্দ্রনাথ পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানকে নববর্ষের দিনে পালন করতেন। কবি নববর্ষের প্রথম দিনটিকে সামগ্রিকভাবে মানব সমাজের জন্মদিন হিসেবে দেখতেন।
জন্মদিন আসে বারে বারে
পঁচিশে বৈশাখ শুধু রবীন্দ্রনাথের আত্মসমীক্ষার দিন নয়, আত্মসমীক্ষাকে কেন্দ্র করে কবির চোখে-দেখা বিশ্ববীক্ষার একটা তাৎপর্যময় দৃষ্টিকোণও বটে। আমাদের জাতীয় চেতনায়, মননে, ধ্যানধারণায় আর নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে তিনি সব সময়ই রয়েছেন। পঁচিশে বৈশাখ উদযাপনকে কেন্দ্র করে আমরাও আত্মসমীক্ষণের প্রেরণা পাই।
কবির জীবনে এই জন্মদিনই বারে বারে জন্মান্তর ঘটিয়েছে। রূপান্তর ঘটিয়েছে তাঁর অসামান্য সব সৃষ্টির। এই দিনটিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জীবনের এক বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত দিন হিসেবে মনে করতেন।
এই পঁচিশে বৈশাখকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ অনেক কবিতা, গান, প্রবন্ধ লিখে গেছেন। সেই সব রচনাগুলির কথা ভাবলে আমরা আজও বিস্মিত হই। এই সব লেখা ও কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে কবি কেবলমাত্র তাঁর জন্মদিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা বলেননি, তাঁর সামগ্রিক বিশ্বভাবনাও আমাদের কাছে খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জন্মোৎসবের গোড়ার কথা
রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালন করবার কৃতিত্ব দাবি করেছেন। স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের দুই কন্যা ও এক পুত্রের মধ্যে অন্যতমা সরলা দেবী সাহিত্য ক্ষেত্র ও দেশসেবার কাজে বিশেষ একটি পরিচিত নাম।
সঠিক সালটা নিয়ে কোনওরকম মতানৈক্য নেই। ১৮৮৭ সালের ৭ মে, ১২৯৪ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ জন্মদিনের উৎসবের সূচনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন ছাব্বিশ পূর্ণ করে সাতাশ বছর বয়সে পড়েছেন। সেই সময় তিনি ৪৯ নম্বর পার্ক স্ট্রিটে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের পরিবারে থাকতেন।
সরলা দেবীর দাদা জ্যোৎস্নানাথ জন্মদিনে একটি বই উপহার দেন কবিকে–‘THE POEMS HEINE’। এরপর পারিবারিক সীমারেখার মধ্যেই কবির জন্মদিন নিয়মিতভাবে পালিত হয়ে এসেছে। পরিজনের বাইরে, ১৮৯১ সালে কবি প্রিয়ংবদা দেবী তাঁকে একটা নোটবই উপহার দেন। পরবর্তীকালে, এই সুন্দর বাঁধানো নোটবুকে রবীন্দ্রনাথ ‘’সোনার তরী’’, ‘চিত্রা’ কাব্যের অনেকগুলি কবিতা লিখেছিলেন।
১২৯৮-এ কবির প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্রী সুরেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা রবিকার জন্মদিনে উপহার—সুরি ও বাবি, এইভাবে লিখে অনেকগুলি বইয়ের মূল্যবান সংস্করণ উপহার দিয়েছিলেন।
১৮৯৩ সালে কবির জন্মদিন কেটেছিল শিলাইদহের বোটে।
শান্তিনিকেতনে পঁচিশে বৈশাখ
১৯০২ সালের পঁচিশে বৈশাখে কবি ছিলেন শান্তিনিকেতনে। ততদিনে আশ্রমে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জন্মদিনের আনুষ্ঠানিক উৎসব পালিত হয়নি। তাহলেও কলকাতা থেকে অনেকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, কবিকে জন্মদিনের শুভকামনা জানাতে।
১৯১০ সালে (১৩১৭) কবির পরিবারের সীমার বাইরে শান্তিনিকেতন আশ্রমের নিভৃত শান্ত পরিবেশে ঘরোয়াভাবে পঁচিশে বৈশাখ উৎসবরূপে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
স্বজন পরিজনদের আবেষ্টনীর বাইরে এবার তাঁর প্রথম জন্মোৎসব। শান্তিনিকেতনের বাইরে অন্য বিশেষ কেউ এই উৎসবের কথা জানতে পারেননি। সেদিন কবির এই জন্মদিনের উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা আশ্রমে বিপুল সাড়া পড়ে গিয়েছিল। সকালের অনুষ্ঠানে অজিতকুমার চক্রবর্তী তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ’ পাঠ করেন। সন্ধ্যাবেলায় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মী-মাস্টারমশাই সবাই মিলে মঞ্চস্থ করেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক।
পরের বছর ১৯১১ সালের (১৩১৮) পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের বয়স পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। শান্তিনিকেতনে সবাই ভেবেছিলেন এবার কবির জন্মদিনটি আশ্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু কলকাতা থেকে অনেক রবীন্দ্রভক্ত মানুষজন প্রচণ্ড দাবদাহকে উপেক্ষা করে, কবির পঞ্চাশতম জন্মদিনের উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তাই এবারের জন্মোৎসব কেবলমাত্র শান্তিনিকেতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না—তা সর্বজনীন তথা জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল।
কবির পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠান অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। তাঁর সহযোগী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিতকুমার চক্রবর্তী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষচন্দ্র মজুমনদার, দ্বিজেন্দ্রনাথ বাগচী প্রমুখ তরুণের দল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, নেপাল রায় প্রমুখ প্রবীণ মানুষদের উৎসাহ একেবারে তরুণদের মতো টান-টান সমান-সমান।
প্রবাসী-সম্পাদক এবং রবীন্দ্র-বান্ধব রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দুই কন্যা শান্তা দেবী ও সীতা দেবী এই উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। কাটোয়া থেকে গরুর গাড়ি করে হীরালাল বসুর নেতৃত্বে একদল তরুণ প্রচুর পরিমাণে নানারকম ফলের বাজার করে ফিরলেন।
আম্রকুঞ্জে ভোর পাঁচটায় পঁচিশে বৈশাখের জন্মোৎসবের আয়োজন হয়েছিল। ছাত্র-ছাত্রী, মাস্টারমশাই, আশ্রমিক এবং অতিথিরা ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই অনুষ্ঠান ক্ষেত্রে এসে জড়ো হন। আশেপাশের গ্রাম থেকে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে দলে দলে মানুষজন এসেছিলেন। আম্রকুঞ্জের উৎসব মঞ্চ প্রাচীন ভারতীয় রীতি ও ঐতিহ্য সহকারে সুন্দরভাবে সজ্জিত। ‘সকল গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছাত্রদের নিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
তিনজন প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ পণ্ডিত আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন, বিধুশেখর শাস্ত্রী (ভট্টাচার্য) ও নেপালচন্দ্র রায় আচার্যের আসনে উপবিষ্ট হয়ে সভার কাজ পরিচালনা করেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় একটি অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন। আশ্রমবাসীর পক্ষ থেকে কবিকে অনেকগুলি উপহার প্রদান করা হয়। কবিবরকে অসংখ্য পুষ্পমাল্যে ভূষিত করা হয়েছিল। জন্মোৎসব উপলক্ষে সমাগত সম্মানীয় অতিথিবৃন্দকে মালা ও চন্দন দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল।
নেপালচন্দ্র রায় ছাত্রদের উদ্দেশে বললেন—‘’তোমরা সকলেই গুরুদেবকে ভক্তি কর, কিন্তু তাঁকে কখনও যেন ঈশ্বরের স্থানে বসিয়ো না।’
সংবর্ধনার জবাব দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—‘…আমাকে আপনারা যে উপহার দিলেন, সেগুলি পাবার আমি কতখানি যোগ্য তা যদি আমি মনে করতে যাই, তাহলে আমাকে লজ্জিত হতে হবে। কিন্তু একটা ক্ষেত্র আছে সেখানে মানুষের কোনও লজ্জা নেই, সেটা প্রীতির ক্ষেত্র। এইসব উপহার আমাকে আপনারা প্রীতির সহিত দিচ্ছেন, সেই জন্য এসব গ্রহণ করতে আমার কোনও বাধা নেই।’
১৯৩৯ সালের (১৩৪৩ বঙ্গাব্দের) পঁচিশে বৈশাখ কবি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। সেবারের জন্মদিন পালিত হলো খুব ঘরোয়া পরিবেশে, অনাড়ম্বর ভাবেই। এই বছরের জন্মদিনে কবির ‘পত্রপুট’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
১৯৪১ সালের (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের) পঁচিশে বৈশাখ শান্তিনিকেতনে কবির জীবনে শেষ জন্মদিন। আশ্রমে অনাড়ম্বর পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের আশি বছরের জন্মদিন পালন করা হয়। দিন তিনেক আগে কবি তাঁর জন্মদিনের শেষ গান রচনা করলেন—‘হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।’ এই গানে তিনি সুরও সংযোজন করেছিলেন।
সকালে বৈতালিক ও মন্দিরে উপাসনা হয়। এরপর সবাই মিলে সমবেত হন উদয়ন বাড়িতে, কবিকে প্রণাম জানাবার জন্য। কবি সন্ধ্যায় উদয়ন-এর বারান্দায়, একধারে আরামচৌকিতে বসলেন। কবির শরীর তখন বেশ অসুস্থ, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ‘বশীকরণ’ নাটকটি শেষ অবধি দেখেছিলেন।
সুদূর অতীতে, কবির ভাগ্নী সরলা দেবীর উৎসাহ ও উদ্যোগে যে পঁচিশে বৈশাখ উদযাপনের সূচনা ঘটেছিল, তা ক্রমে ক্রমে পরিব্যাপ্ত হয়ে বিশেষ সময় ও কাল পেরিয়ে বীজ থেকে বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
শনিবারের চিঠি, বাহান্ন বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা