শান্তিনিকেতনে আশ্রমের প্রধান তোরণ—যেখানে উপনিষদের মন্ত্রটি লেখা, তার ঠিক পাশেই আছে ছোট্ট একটি কুটীর। উন্নতচূড় ঋজু একটি তালগাছকে ঘিরে খড়ে ছাওয়া তালধ্বজ গৃহ— সেই বলিষ্ঠ তালতরু “ঠিক তার মাথাতে গোলগোল পাতাতে” কবির যে ইচ্ছাটি মেলে আছে, আজ নিতান্ত প্রয়োজনে পড়ে সে কথাটি এখানে আলোচনা করব।
কবির বিষয়ে, বিশেষত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আজকাল কিছু লিখতে দ্বিধা আসে, কারণ দুঃখের সঙ্গে দেখছি এ নিয়ে একটা ‘Racket’ চলছে(‘Racket’ কথার উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাই না)। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে তাঁরই জবানীতে একটি ভ্রমাত্মক কাহিনী প্রচার হওয়ায় তিনি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন—“অনেক অমূলক খবরের মূল উৎপত্তি আমাকে নিয়ে, এও তার মধ্যে একটি। এইজন্য মরতে আমার সঙ্কোচ হয়। তখন বাঁধভাঙা বন্যার মত গুজবের স্রোত প্রবেশ করবে আমার জীবনীতে তাকে আটকাবে কে?” (৯।৭।৩৯) আজ এ কথার সত্যতা কিছু পরিমাণে বোঝা যাচ্ছে। তাঁকে অবলম্বন করে শ্রুত-অশ্রুত, বিস্মৃত-অর্ধবিস্মৃত নানা কাহিনী বিচিত্র ভাষায় কোটেশন-মার্কে ইতস্তত উদ্ধৃত হচ্ছে, তার মধ্যে সত্য-মিথ্যা ভুল-নির্ভুল যাচাই করা যায় কোন পন্থায়? একটিমাত্র উপায় আছে— ‘internal evidence’. কিন্তু সেই সাক্ষ্যই বা মিলিয়ে দেখে কে? কোন ভাষা, কোন আচরণ, কোন ভঙ্গী— সর্বোপরি কোন ভাব রবীন্দ্রচিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গত তা বুঝতে হলে রবীন্দ্রসাহিত্য ও জীবন সম্বন্ধে সবিশেষ ধারণা থাকা চাই। বর্তমানকালে বা ভবিষ্যতে তেমন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে ও আসবে। রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে, তাঁর সঙ্গসুধা পান করে দীর্ঘদিন যাঁরা সৌভাগ্যলালিত হয়েছেন এমন মানুষ আজও অনেকেই বেঁচে আছেন— ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করতে পারি সেই স্মৃতিচারণে তাঁদের কত আনন্দ, কত মাধুর্য বিকীরণ, তবুও এ কথা জোর করেই বলা যায় যে, তাঁর মৃত্যুর বিশ বৎসর পরে আমরা কেউই তাঁর কথা আজ আর কোটেশন চিহ্নে উদ্ধৃত করবার অধিকারী নই। সেই স্বর্ণঝংকৃত ভাষা আমাদের দুর্বল স্মৃতি থেকে অবশ্যই ভ্রষ্ট হয়ে গেছে, যা পড়ে আছে তা তার কঙ্কালমাত্র— কঙ্কালও দেহের অংশ বটে তবু সেখানে লাবণ্যময়ীকে খোঁজা যেমন মিথ্যা, বর্তমানের অনেকে স্মৃতিকথাই তেমনি মিথ্যা। স্মৃতির যাথার্থ্যই রচনার পূর্ণতা দেয় না— তথ্য যেমন অনেক সময়ই সত্য দিতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, কিছুদিন পূর্বে একটি রচনা পড়েছিলাম, কোন্য একটি ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক লিখছেন— “রবীন্দ্রনাথ চিৎকার করে উঠলেন—” আর একজন রবীন্দ্রনাথের অতি-পরিচিত ব্যক্তি লিখছেন—“কবি ‘খিলখিল’ করে হেসে উঠলেন।” এই দুটি প্রসঙ্গেই তেমন ভুল কিছু নেই, অসৎ উদ্দেশ্য তো নেই-ই। স্বাভাবিকের চেয়ে স্বর স্বল্প উত্তেজিত হলে তাকে চিৎকার করা হয়তো বলা চলে— আর ‘খিলখিল’ হচ্ছে ব্যাকরণ অনুযায়ী ধন্যাত্মক দ্বৈত শব্দ— মনের আবেগ প্রকাশ করতে তার ব্যবহার হয়ে থাকে। অতএব হাসিকে যদি কেউ ‘খিলখিল’ বলে বর্ণনা করে, তার মধ্যে তথ্যের কিছু ভুল নেই। তবু ভুল আছে, মারাত্মক ভুল। শোভন আচরণ রবীন্দ্রনাথের জীবনশিল্প— সেই ভুলের ত্রিশূলে ছিন্নভিন্ন হয়ে ভবিষ্যৎ মানুষের চোখে ঘটাবে সৌন্দর্যের চিরঅবলুপ্তি।
দেশে-বিদেশে, ঘরে ও বাহিরে বিচিত্র জনসমাগমে কবির কত বিচিত্র রূপ, আলোকিত মনোময় ভাষার বর্ণচ্ছটা তাঁর সঙ্গীদের মন প্রাণ সর্বদা ভরে রেখেছিল, আজ তা ধ্বনির তরঙ্গের মত সূক্ষ্ণ থেকে সূক্ষ্ণতর বলয়ে তাঁদের জীবন পরিক্রমা করে করে দূর থেকে দূরান্তরে অসীম শূন্যতার দিকে চলেছে। যা হারাবার যোগ্য ছিল না তা হারিয়ে গেল, কিন্তু বিধির বিধানে সেই তো জীবনধর্ম। বিধাতার এক পরম শিল্পরচনা আমাদের লুব্ধ মুষ্টির বন্ধন এড়িয়ে ভ্রষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু তাকে পুনর্বার সৃষ্টি করার ক্ষমতা আজ আর কারুরই নেই। বিশ পঁচিশ ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের শোনা কথায়, দেখা দৃশ্যে স্মৃতির ক্ষেত্রে লাঙন চালিয়ে অপটু ভঙ্গীতে অসংস্কৃত ভাষায় কবিবাক্য বলে নানা স্খলিত বচন কোটেশন-মার্কে উদ্ধত করা নিরর্থক। আজ কবির পরম আত্মীয়ও যদি সে চেষ্টা করেন তবে বলতে হয় ‘একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত সে আর ফিরাযে দেওয়া তব সাধ্যাতীত।’
মনস্তত্ত্বের যে ঘোরপ্যাঁচে পড়ে এই অসাধ্যসাধন প্রচেষ্টা হয়, তারই চূড়ান্ত পরিণতি বেশ কিছুদিন আগে একটি মাসিক পত্রিকায় পড়েছিলাম, সেখানে লেখক মিডিয়ামের সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাক্যালাপ করেছেন। বিদেহী রবীন্দ্রনাথ মিডিয়ামের মুখে তাঁর সঙ্গে রঙ্গরহস্য তো করেছেনই, এমনকী কবিতা ডিক্টেট করেছেন— সে কবিতাও ছাপা হযেছে এবং লেখকের ধারণা ওই কবিতা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ লিখতে পারে না।
যে কথায় শুরু করেছিলাম তার থেকে দূরে চলে এসেছি, তবুও তা একেবারে সূত্রচ্ছিন্ন নয়। কবির উক্ত বহু ছোটখাট কথা আজও কানে ভেসে আসে, বহু কথার অর্থ আজ বুঝতে পারি, অল্প বয়সের অনভিজ্ঞতায় যার তাৎপর্য তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু উপরোক্ত কারণে সেগুলি লিখতে ভরসা পাই না, বলতে সাহস হয় না। শুধু অশ্রুক্ষরিত বেদনায় মনে হয় কাছে থেকেও তিনি আমাদের থেকে কত দূরে ছিলেন আর আজ দূরে গিয়েও সেই কাছে থাকার নির্বাসন পার হল না।
তাই বহু দ্বিধাভরে ব্যক্তিগত পরিচয়ে একটি বিষয় মনে যেমন বুঝেছিলাম তা বলবার চেষ্টা করব। তাঁর মুখের ভাষা ব্যবহার করব না, দু-একটি শব্দমাত্র যা কানে আছে তাই শুধু আমার বক্তব্যকে প্রকাশ করবে। আর আমার বক্তব্যের আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য— তা যাঁরা আশ্রমবাসী আজও তাঁকে স্মরণে রেখেছেন তাঁরা মিলিয়ে বুঝবেন এ ভাবনা তাঁর ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গত কি না।
রবীন্দ্র-জন্ম-শতাব্দী উৎসব এগিয়ে আসছে, দেশব্যাপী ধুমধামের আয়োজন শুরু হয়েছে, দামামা বাজতে শুরু করেছে, নানা লোক নানা উদ্দেশ্যে জড়ো হয়ে একটা কিছু কাণ্ড করে তুলবেই— সে কাণ্ডটা কেমন হবে সভয়ে সশঙ্কচিত্তে অপেক্ষা করে আছি। কবির নিজেরও বোধ হয় কম সন্দেহ ছিল না, তাই লিখেছিলেন—
‘ভারতে ছিল না কভু হেন প্রথা খেয়ালের
কবি পরে ছিল ভার নিজ মেমোরিয়ালের।’
তিনি নিজের যে মোমোরিয়াল গড়ে গিয়েছেন, তাকে ধ্বংস না করে মানবচিত্তে তার প্রতিষ্ঠাই তো সর্বোত্তম প্রচেষ্টা হওয়া দরকার।
রবীন্দ্রনাথ গাছতলায় তাঁর আশ্রম গড়েছিলেন। বলা যেতে পারে ‘গ্রান্টস কমিশন’ও ছিল না, টাকাও ছিল না— তাই গাছতলাতেই আশ্রয়। কিন্তু শুধু কি তাই? এই অভাব কি তাঁর ভাবনায় অপরূপ ভাবমূর্তি নেয়নি? বস্তুকে বড় হয়ে উঠতে দিলে, আকাঙ্ক্ষার অতিকায় মূর্তিকে ক্রমাগতই আসন ছেড়ে দিলে মনুষ্যত্বের যে বিপদ ঘটে, সে কথা কত ভাবেই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা আশ্রমে তাঁর জীবনযাত্রা দেখেছেন, যাঁরা তাঁর ভাবধারার মূল কথাটি বুঝেছিলেন, তাঁরা জানেন তিনি আসবাবের প্রাবল্য বাড়িঘরের আতিশয্য ভালোবাসতেন না। নিরাভরণ ছোট ঘরে সামান্য আসবাব নিয়ে তাঁর দিন কেটেছে সরল সুখে। উপকরণের বাহুল্য, বস্তুর মোহ কখনও তাঁর চিত্তকে আক্রমণ করেতে পারেনি। দেশবিদেশের কত মানুষ এই বিশ্ববিখ্যাত কবির ‘দেহলী’র ছোট ঘরখানির বর্ণনা লিখেছে, দেখেছে সপ্রশংস মনে আড়ম্বরশূন্য জীবনে চিত্তশক্তির মোহমুক্তি। এ তাঁর বৈরাগ্যসাধনে নয়—মোহ আছে— তবে মনের বস্তুতেই তাঁর মোহ, জড়বস্তুতে নয়। ‘বাহিরে পাঠায় বিশ্ব, কত গন্ধ গান দৃশ্য’— কবির মন সাড়া দেয় তাতে কিন্তু চৌকি টেবিল দরজা জানলা ইটকাঠে নয়। শান্তিনিকেতনের এই তপোবন, এই আশ্রম যতদিন তাঁর আয়ত্তে ছিল, নানা বাড়িতে খড়ে ছাওয়া মাটির ঘরেতে জেগেছে সুরধ্বনিত আশ্রম-জীবনের আনন্দ। তখন প্রাসাদ তাঁকে মাটির সামীপ্য থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারেনি।
‘কবি যে ছোট বাড়ি ছোট ঘর ভালবাসতেন সে কথা সকলেই শুনেছেন, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে কবি বড় বাড়ি ভালবাসতেন না৷ বিশেষত আশ্রমে বড় বাড়ি তাঁর পরিকল্পনা নয়, তিনি তার বিরোধী৷ ঠিক যতটুকু নিতান্ত প্রয়োজন তার চেয়ে বেশী দেওয়াল তাঁর দরকার ছিল না৷ ঘরের চেয়ে বাহির, ছাতের চেয়ে আকাশই তাঁর প্রিয়— এ কথা যেমন তাঁর কাব্যে তেমনি তাঁর জীবনে ছিল সত্য৷ এবং এই সত্যেই আশ্রম-জীবনের মূল আছে৷ খোলা প্রান্তরে, গাছের ছায়ায়, মাটির ঘরে, খড়ের চালের নীচে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহাশ্রয়ে তৈরি হচ্ছিল সেই আশ্রয় ‘যত্রবিশ্বভবত্যেকনীড়ম্’ ৷’
ইদানীং কালে অর্থাৎ মৃত্যুর আঠারো-কুড়ি বছর পূর্ব থেকে উত্তরায়ণের প্রাঙ্গণে ছোট ছোট বাড়িতে দিন কাটিয়েছেন৷ আমাদের মনে পড়ে একটি দিনের কথা, তখন ‘বিচিত্রা’ মাসিক পত্রিকা সমারোহে প্রকাশিত হবে৷ কবি তারই জন্য ঋতুকাব্য লিখছেন ‘নটরাজ’৷ তখন উত্তরায়ণে ‘উদয়ন’ গৃহ এমন প্রাসাদোপম হয়ে ওঠেনি৷ একটি বড় ঘর ও দুটি ছোট ঘর সম্বল— সেখানে শিশুকন্যা পুপেকে নিয়ে পুত্র-পুত্রবধূ বাস করেন৷ আর এক কোণে ‘কোনার্ক’, ছোট ছোট নিতান্ত অপরিসর দু-তিনখানি ঘর, ছাত নীচু— কবি বাস করেন সেখানে৷ সামনের শিমূল তরু তখনও এমন বনস্পতির আকার নেয়নি৷ আর গৃহপাশের ‘নীলমণি’ লতা হয়তো ছিল তরুণী-পল্লবিনী৷ বাঁদিকের ছোট্ট ঘরটি জুড়ে টেবিল পাতা, কবি একাগ্রমনে লিখছেন আর গুনগুন করে গান করছেন, ‘মধ্য দিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি, হে রাখাল বেণু তব বাজাও একাকী’— আমি এসে নীরবে পিছনে দাঁড়িয়েছি, অমিয়বাবু সামনে এসে কোনও অতিথির আগমন-সংবাদ দিলেন৷ কবি কলম বন্ধ করে বারান্দায় যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন— সবিস্ময়ে দেখলাম ঘরের ছাত প্রায় মাথা ছুঁয়ে আছে৷ আমরা কলকাতাবাসী এত নীচু ছাত কখনও দেখিনি৷ কিন্তু তাঁর উপস্থিতিই এমন অপূর্ব যে ওই অতি ছোট অপরিসর সাধারণ শানবাঁধানো মেঝের ঘরটি কী সুন্দরই মনে হয়েছিল৷ এই রুক্ষ মরুপ্রান্তরে জলবিরল তপ্তভূমিতে ওই রকম নীচু চেপে-ধরা ছাতের নীচে গ্রীষ্মতপ্ত দিন কাটানো কত কষ্টকর হতে পারে সে কথা তখন মনে আসেনি৷ তিনি যেখানে যে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকেন তার চারপাশ সুন্দর হয়ে ওঠে, তিনি যে আকাশে নিঃশ্বাস নেন সে আকাশ তাঁর স্নেহাকাঙ্ক্ষীজনের নয়ন-মনের উপর জ্যোৎস্না মেলে থাকে— বারবার মনে হতে লাগল নীচু ছাত কি সুন্দর, সবাই কেন করে না!
কবি যে ছোট বাড়ি ছোট ঘর ভালবাসতেন সে কথা সকলেই শুনেছেন, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে কবি বড় বাড়ি ভালবাসতেন না৷ বিশেষত আশ্রমে বড় বাড়ি তাঁর পরিকল্পনা নয়, তিনি তার বিরোধী৷ ঠিক যতটুকু নিতান্ত প্রয়োজন তার চেয়ে বেশী দেওয়াল তাঁর দরকার ছিল না৷ ঘরের চেয়ে বাহির, ছাতের চেয়ে আকাশই তাঁর প্রিয়— এ কথা যেমন তাঁর কাব্যে তেমনি তাঁর জীবনে ছিল সত্য৷ এবং এই সত্যেই আশ্রম-জীবনের মূল আছে৷ খোলা প্রান্তরে, গাছের ছায়ায়, মাটির ঘরে, খড়ের চালের নীচে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহাশ্রয়ে তৈরি হচ্ছিল সেই আশ্রয় ‘যত্রবিশ্বভবত্যেকনীড়ম্’৷ সে কি শুধু অভাবে? তা নয়, সেই তার ভাব এবং সেখানেই তার মূলশক্তি— যে শক্তি অর্থের চেয়ে সম্পদকে, বস্তুর চেয়ে চিত্তকে বড় করে তুলতে চায়৷ সন্তোষই পরম সম্পদ, শান্তির উৎস আর সৌন্দর্যের মূল্যতেই মানুষের চরম সার্থকতা৷ তাই তাঁর সৃষ্ট আশ্রমের ছোটখাট ঘরবাড়ি প্রাঙ্গণ ও অঙ্গন, আচার-অনুষ্ঠান, ব্রত নিয়ম সমস্তই সৌন্দর্যের মূল্য দিয়ে পরম মূল্যবান করে তুলেছিলেন কবি, যাতে তালধ্বজ গৃহের সুন্দর সন্তোষ, আকাঙক্ষাক্ষুব্ধ স্কাইস্ক্রেপারের কাছে লজ্জিত না হয়৷ শুষ্ক বৈরাগ্য নয়, সুন্দরের ঐশ্বর্য৷
এই সৌন্দর্যবাণী, সন্তোষের নির্মলতা ধুয়ে দেবে আশ্রমবাসী বালক-বালিকার জীবন, ঈর্ষামুখর দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ শহর-জীবনের গ্লানি, ছোট-বড়র বোধ— যা কিছু বিরোধে বিচ্ছেদে কুশ্রী করে তোলে মন, তা সরিয়ে দিয়ে মানুষে মানুষে হবে পরিচয়৷
অনেকেও নিশ্চয় শুনেছেন যে তিনি বলতেন, মাটির ঘরে থাকতে আবার কষ্ট কি৷ ভারতবর্ষে শতকরা নব্বই জন মানুষই তো মাটির ঘরে বাস করে৷ আশ্রমে বড় বাড়ি তৈরি হলে তাকে বলতেন ‘Impertinence’৷ শুনেছি উত্তরায়ণের প্রতিস্পর্ধী কোন বড় বাড়ি হলে বলেছিলেন ‘প্রত্যুত্তরায়ণ’৷ ‘উদয়ন’ প্রাসাদ তৈরি হলেও তাই ‘শ্যামলী’ই তাঁর প্রিয় ছিল, প্রিয় ছিল একমাত্র কামরাযুক্ত ‘উদীচি’ গৃহ৷ এই ঘরবদল কবির খেয়াল শুধু নয়, কেবলই নয় পরিবর্তনের শখ, প্রধানতই এর মূল সেই দুঃখে— যে আশ্রমে তাঁর আপন ঘরটি হারিয়ে যাচ্ছিল৷ সে ঘর কোথায়? সে তো ওই পথের ধারে তালগাছের ছায়াহীন তলে খড়ে-ছাওয়া মাটির স্নিগ্ধতায়— তার পিছনে ওঠে মন্দিরের সৌরভ, লুব্ধ-ক্ষুব্ধ আকাঙক্ষা-চঞ্চল মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় ভারতবর্ষের চিরকালের বাণী, বলে সংসারের সমস্ত ঘাতপ্রতিঘাত কাড়াকাড়ি মারামারি যাতে উত্তপ্ত হয়ে না ওঠে সেজন্য অন্তত এক জায়গায় শান্তম্শিবম্অদ্বৈতমের শুদ্ধ ভাব জাগিয়ে রাখবার জন্য এই তপোবনে কবির আশ্রয় গড়ে উঠেছে সেই বিশেষ বাণীটি প্রকাশ করে— বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতি এ দুয়ের সঙ্গমে পূর্ণতার উপলব্ধি জাগিয়েছে৷
কবি তাই তালধ্বজের দিকে তাকিয়ে বলছেন—
“যা কিছু আসে যায় মাটির পরে
পরশ লাগে তারি তোমার ঘরে—
ঘাসের কাঁপা লাগে পাতার দোলা
শরতে কাশবনে তুফান-তোলা৷…”
মানুষের এই গৃহাশ্রয় তাকে প্রকৃতির সঙ্গ থেকে আকাশের আনন্দ থেকে আড়াল করে আনে না৷
“তোমার বাসখানি আঁটিয়া মুঠি
চাহে না আঁকড়িতে কালের ঝুঁটি
দেখি যে পথিকের মতই তাকে
থাকা ও না-থাকার সীমায় থাকে৷
ফুলের মতো ও যে পাতার মতো,
যখন রেখে যাবে যাবে না ক্ষত৷’’
কিন্তু তপোবনের অপসৃয়মান মূর্তির দিকে চেয়ে কবি ভাবেন এই পথে ও ঘরে মেশামেশি করে যে সহজ জীবন তিনি গড়তে চেয়েছিলেন তা হচ্ছে কই? পরিতাপের সঙ্গে তাই লিখেছেন—‘যেখানে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা থাকে সেখানে হয়তো যোগ্যতা থাকে না৷’
“কীর্তি জালে ঘেরা আমি তো ভাবি—
তোমার ঘরে ছিল আমারো দাবী;
হারায়ে ফেলেছি সে ঘূর্ণিবায়ে
অনেক কাজে আর অনেক দায়ে৷’’
নিউইয়র্কে ইঁট-কাঠের স্তূপ দেখিয়ে কবি বলেছিলেন— “ও-গুলো কি? মানুষের ঘর? তবে ঈশ্বরের আলো বাতাসকে বিশ্বপ্রকৃতিকে এমন আড়াল করছ কেন, আমাদের অতবড় বাড়ির দরকার কি? আমরা তো দৈত্য নই৷’’
আজ এতদিন পরে মুখের কথার সাক্ষ্য কানে শোনার সাক্ষ্য উদ্ধৃত করতে পারি না, কিন্তু কাব্যের সাক্ষ্য আজ চিরস্থির৷ আর নানা পত্রে প্রবন্ধে আলোচনায় তাঁর বাণী শব্দহীন ভাষায় আজও ঘোষিত— যদিও তা কেউ শোনে কেউ শোনে না৷ আজ রবীন্দ্র-শতাব্দীর উৎসবের আয়োজনে দেশজুড়ে যে ব্যাপার চলেছে, তাতে কবির সেই লাইন দুটি সত্যতাই প্রমাণ হচ্ছে—
“ভুলিব না ভুলিব না এই বলে চীৎকার
বিধি না শোনেন কভু বল তাহে হিত কার?’’
ভোলা তো শুরু হয়েছে, শুনছি কানে বিসর্জনের ঢাক-ঢোল, দামামা হাতে নিয়েছেন লাখপতিরা, স্মরণোৎসবের বাঁশি বাজবে জীবনসাধনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নয়, শেয়ারের বাজার ঘেঁষে পসার-প্রতিপত্তির হাঁকেডাকে৷
যদি সত্যই স্মরণোৎসবের রাগিণী বাজতে হয়, তবে তাকে বাজানো চাই জীবনে৷ তাঁর বাক্য, তাঁর মনন ও তাঁর নির্দিষ্ট শিক্ষাকে একটু স্থান দিতে হয় জীবনের ব্যবহারে কর্মে— তা না হলে এ খেলা কেন? তাঁর নাম করে এই নিরন্ন দুর্দশাগ্রস্ত দেশের লক্ষ লক্ষ টাকার ভেলকিবাজি কেন? যদি একটি একটি করে খতিয়ে দেখা যায়— মনে হয় না স্মৃতি-সভার, বা স্মৃতি-রক্ষার কোনও জায়গাতেই তিনি আজ জীবিত থাকলে তাঁর প্রসন্ন দৃষ্টি পড়তে পারত৷ তবে একটা কথাও মনে রাখতেই হয় যে তিনি তো জীবিত নেই৷ সেইটেই যারা ভুলে যায় তারা দুঃখ পায়, নয়তো যে-সব রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, সরকারের পোষক-পরিপোষক-পরিতোষক মিলে শতাব্দীসংঘ গঠন করেছন, তাঁরা তাঁদের পাকা মাথায় একথা নিশ্চয় স্মরণ রেখেছেন যে রবীন্দ্রনাথ জীবিত নেই৷
বড় বড় কথা ছেড়ে দিয়ে এখানে শুধু দু-একটি মাত্র বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক৷ কে না জানে আজকাল কয়েকটি প্রধান নর্দমা তৈরি হয়েছে— যে সব পথ দিয়ে দরিদ্র-জনসাধারণের মধ্যবিত্ত অর্থ অনায়াসে সাধারণ থেকে অসাধারণের খাতে পৌঁছতে পারে— তার মধ্যে প্রধান একটি হচ্ছে সরকারি কর্মে দেশে-বিদেশ চষা, সমারোহে নানা দ্রষ্টব্য দেখে বেড়ানো৷ ধরুন না কেন একই কটেজ ইন্ডাস্ট্রি দেখতে দল বেঁধে কয়েকবার জাপান ঘুরে আসা৷ বেতের টুক্রি বোনা দেখে আসবে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, তা নিয়ে ক্রমাগত দেশ-বিদেশে মন্ত্রণা করে বেড়াবে৷ সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টাকা বিদেশের এই সব দরকারি ভ্রমণে খরচ হবে৷ অথচ দেশে ওষুধ আসবে না, শিশুখাদ্যের ওপর কর বসবে, এক্সরে ছবি তোলবার ফিল্ম পর্যন্ত দুর্মূল্য হয়ে যাবে৷ সরকারি তহবিল উৎখাত না করে ব্যক্তিগত কারণে নিতান্ত প্রয়োজনেও কেউ বিদেসে যেতে পারবে না৷ লৌহযবনিকার অনুকরণের ব্যর্থপ্রয়াসে সাধারণ মানুষের পদচারণার স্বাধীনতাও থাকবে না৷
সরকারি অর্থকে অনর্থকরণের আর একটি পথ— কার্যক্রম স্থির হবার পূর্বেই আশ্রিতজনের সুব্যবস্থা উচ্চ-মহিমায় কর্মচারী নিয়োগ৷ আর তৃতীয় একটি খাত বাড়ি তৈরি— ইট-সিমেন্ট, লোহা-কংক্রিটের খাত বেয়ে কোটি কোটি টাকা চলেছে দেশের বৈতরণীর দিকে৷ বড় বড় নতুন তৈরি বাড়ির দেওয়ালে দেখেছি ফাটল৷ ফাটল স্বচক্ষে দেখেছি ভুবনেশ্বরের নব-নির্মিত প্রাসাদোপম গেস্টহাউসের দেওয়ালে, ফাটল দেখেছি আকাশবাণীর কলকাতার সৌন্দর্য-মূর্তিভবনের ভিতরের দেওয়ালে, সেই ফাটল ভাকরা-নাঙ্গালের দুর্গপ্রাচীর ভেদ করে দেশের মর্ম ছিন্ন-ভিন্ন করে দিল৷ তবু প্রাসাদ চাই৷ তলার পরে তলা— লোহার গাঁথা কংক্রিটের যন্ত্রপুরী না হলে কোনও কর্মই সিদ্ধ হবে না৷ এমনকি যদি বাড়ি থাকে তবে তা ভেঙে ফেলে আবার নতুন করে বাড়ি খাড়া করতে হবে, তবে অন্য কাজ৷
এখন রবীন্দ্র-জন্মোৎসবের সমস্ত গঠনমূলক কার্যের আরম্ভে এই কটি ছিদ্রই খোলা হয়ে গেছে৷ সরকারি কর্মচারী দেশ-বিদেশ পরিভ্রমণ করে এসেছেন, শুনছি সেখানে কমিটি তৈরি করে এসেছেন৷ বলাবাহুল্য বিদেশে রবীন্দ্রসাহিত্য প্রচারের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই, এমনকী এ কাজ এতদিন কিছুই হয়নি বলেই আমাদের অনুতাপ৷ বিশ্বমানবের উদ্দেশ্যে উৎসারিত তাঁর বাণীর অমৃতে সকল মানুষের পূর্ণ অধিকার৷ আমাদের কর্তব্য সেই সম্পদ বিশ্বের সামনে বারবার নৈবেদ্যরূপে উপস্থিত করা৷ কিন্তু দু-একজন মানুষ গলাবন্ধ কোট পরে দেশবিদেশে চক্কর দিয়ে টোকিওতে দু-রাত্রির, প্যারিসে তিন ও নিউইয়র্কে পাদস্পর্শ করে এলেই তা সফল হয়ে উঠবে না৷ তাতে যা খরচ তার দাম পোষায় না, অন্তত এই দারিদ্র্যহত ভারতবর্ষের সে শক্তি নেই৷ যদি রবীন্দ্রনাথের জীবনসাধনাকে আমরা কোনও মূল্য দিই, নিশ্চয়ই দিই, কারণ, নইলে তো জন্মোৎসবের কোনও অর্থই হয় না, তাহলে দেশে এবং বিদেশে তাঁর সেই জীবন-সম্পদের উদ্ঘাটন করাই প্রকৃত কৃত্য, জাঁকজমকের আড়ালে তাকে আবৃত করা নয়৷
আমাদের বিদেশের অভিজ্ঞতা আমরা অন্যত্র পুঙ্খানুপুঙ্ক্ষ আলোচনা করেছি৷ দেখেছি পশ্চিম ইউরোপে তাঁকে একেবারে বিস্মৃত হয়েছে৷ অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী আমাদের জানিয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত নিরুৎসাহের জন্য সেখানে রবীন্দ্র-শতাব্দী-উৎসবের কমিটির স্ট্যাম্পের টাকা জোটাও ভার৷ ওই কমিটির সেক্রেটারি শ্রীযুক্ত মুখার্জীও সেই রকম কথা আমাদের লিখেছিলেন ইংল্যান্ডেও আমাদের অভিজ্ঞতা অনুরূপ৷আমাদের উৎসাহ ছাড়াই, এমনকী আমাদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টির সামনে রাশিয়া আট ভল্যুম রবীন্দ্ররচনা-সংগ্রহ বাংলা থেকে সরাসরি নিজ ভাষায় অনুবাদ করেছে৷ কেউ কেউ বলেন এ আসলে কাব্যানুরাগ নয়— চালাকি, পলিটিক্স ইত্যাদি৷ তবে সেরকম চালাকি পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ তো নয়ই, ভারতবর্ষের অন্য কোনও প্রদেশও আজ পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি৷ এ প্রসঙ্গে আমাদের যা করা উচিত ছিল তা হচ্ছে এই যে ওই অনুবাদগুলি যথাযথ হয়েছে কিনা, ভ্রমপূর্ব কিনা তা মিলিয়ে দেখা৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই সে কাজ করতে এগিয়ে এল না৷ যে কাজে পরিশ্রম ধৈর্য ও অনুশীলন প্রয়োজন সে কাজে কারও উৎসাহ নেই— ব্যক্তিগতভাবেও নয়, প্রতিষ্ঠানগতভাবে তো নয়ই৷ বিশেষত কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলি তো তার মূর্তিমান বাধা৷ যে রবীন্দ্রসদনের জন্য প্রথমেই বহু অর্থব্যয়ে (শুনেছি পাঁচলক্ষ টাকা)এখনই আর একটি বাড়ি তৈরি হবে, সেখানে জ্ঞানের যে অমূল্য ভাণ্ডার আছে তার দিকে দৃষ্টিপাত করবার সাধ্য স্থানীয়-দু-চারজন কর্মচারী ছাড়া আর কারও নেই৷ সেই জ্ঞানমন্দিরের দরজায় কড়া পাহারা বসে সরস্বতীকে গ্ল্যামার গার্ল সাজিয়ে রেখেছে৷ সেখানে রবীন্দ্র-চিন্তা-অনুশীলনকারীর কোনও স্থান হতে পারে না৷ রবীন্দ্র-সাহিত্য প্রচার, তাঁর চিন্তার পুনঃপ্রকাশ করতে হলে তাঁর জীবনসাধনার গভীরতম সত্যগুলি উপলব্ধি করে নিতে হয়৷ কিন্তু সে দিকে কারও চেষ্টাই নেই৷ রবীন্দ্রনাথের মিশনারি কি অমনি হবে? তার জন্য দেশ-বিদেশে যাওয়া প্রয়োজন বইকি৷ কিন্তু সম্পদ নিযে যেতে হবে, শুধু ট্রাভেলার্স চেকবই নয়৷
কেবল একটিমাত্র কাজে এদেশের মনীষীবৃন্দ পরিশ্রম করতে উৎসাহ পান— বাড়ি তৈরি করা৷ নিশ্চয়ই এর কোনও গভীর সদুদ্দেশ্য আছে যা আমরা জানি না, তবে আমরা এও জানি না যে বাড়ি কী করে রবীন্দ্রোৎসবের প্রধান ব্যয়ের ছিদ্র হল৷ বস্তু কী করে ভাবের চেয়ে বড় হল— অন্তত রবীন্দ্রনাথকে উপলক্ষ করে? শুনেছি কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িও তের লক্ষ টাকায় কেনা হবে৷ অপব্যয়ের তো কতই সুন্দর সুন্দর ব্যবস্থা আছে, ছোটখাট এটা-ওটা থেকে দণ্ডকারণ্য পর্যন্ত৷ আবার রবীন্দ্রনাথের নাম করে কেন— যাতে রূঢ়তম রসনাও সসম্ভ্রমে চুপ করে থাকে৷ জাতীয় উৎসবের এই কি আকৃতি যাতে ক্ষুদ্রতম অধিকারও উচ্চতম স্বরে ‘পাউণ্ড অফ ফ্লেশ’ দাবি করবে? যার কাছে যেটুকু সম্পত্তি আছে তারই জন্য নিলামের ডাক চড়তে থাকবে৷ দুঃখের কথা এই যে আজ সমাজের কোন স্তরের কোন ব্যক্তিই সরকারি টাকাকে সাধারণের সম্পত্তি বলে মনে করেন না— সরকারী তহবিল থেকে যা আদায় করে নেওয়া যায় তা নিংড়ে নিতে স্ট্রাইকওলা থেকে শুরু করে সংস্কৃতিওলা পর্যন্ত কারও দ্বিধা নেই৷ এ বিষয়ে দক্ষিণ ও বামের সমভাব৷ সংশয় আসে আজ এদেশের শিক্ষিত সমাজ মনে করে বসে আছেন যে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীও একটা ‘প্রজেক্ট’, একটা ‘প্ল্যান’— যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পন্ন হয়ে দেশের ভাগ্য উতরে দেবে! নইলে জাতীয় উৎসবের এই কি রূপ? ব্যবসায়ীর মুনাফার উচ্ছিষ্টভাগী হবার জন্য তাঁদের পরিচালনার কেন্দ্রে স্থান দিতে হবে, সরকারী তাঁবেদারীতে এই সংগঠনমূলক মহোৎসব পরিচালিত হবে৷ সংগঠনটা করবে কে? টাকা থাকলে বা টাকা দিলেই কি এসব কাজের অধিকারী হওয়া যায়? রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রম গঠনের জন্য ধনী রাজা-মহারাজার দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি পেতেছিলেন, তাই বলে ক্ষিতিমোহন সেন বা বিধুশেখর শাস্ত্রীর মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে কোনও রাজা-মহারাজা আসতে পারেননি৷ অর্থবান বিত্তবানেরা দেশের সৎকর্মে অর্থদান করবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তাঁরাই যদি সেজন্য কর্মচালনারও ভার নেন তা হলে সে সৎকর্মের আকৃতি-প্রকৃতি কোনদিকে যাবে তা বলা বাহুল্য৷ সব কাজেরই অধিকারীভেদ আছে৷
দেশের সাহিত্যিক, চিন্তাশীল, শিল্পী, সমাজকর্মীবিশেষে যাঁরা রবীন্দ্র-চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত এমন বহু মানুষের সচেষ্ট সকর্মক উৎসাহ ব্যতীত রবীন্দ্র-শতাব্দী-উৎসব একটি জাতীয় উৎসবের প্যারডি হয়ে দাঁড়াবে৷ বিশেষ করে আমরা আশা করেছিলাম উৎসাহী তরুণেরাই এ কাজে এগিযে আসবেন, হাল ধরবেন৷ যে কথা দিযে শুরু করেছিলাম সেই কথা দিযে শেষ করি৷ রবীন্দ্রচিন্তাধারার সঙ্গে আত্মিক অপরিচয় বা তার প্রতি গূঢ় অবিশ্বাস থাকলে বা স্বার্থসাধনের মাহিনা অর্জনের উপায়রূপে এ কাজ কখনও সার্থক হতে পারে না৷ কজন লোক আজ দেশে রবীন্দ্রসাহিত্য অনুশীলনের উৎসাহ পাচ্ছে? কজন লোক চেষ্টা করছে তাঁর চিন্তাধারার প্রাণদায়িনী রস দেশে দেশে নতুন করে পৌঁছে দিতে? এমনকী জন্মদিবসকে জাতীয় উৎসবের দিনরূপে ছুটি দিতেও এখনও সকলে একমত হতে পারেনি৷ কিন্তু সৌধ গঠনের দিকেই ঝোঁকটা পড়েছে প্রবল হয়ে৷ যে সৌধ সাজানো থাকবে রূপকথার রাজ্য হয়ে, ভবিষ্যৎ বংশের বিভ্রম ঘটিয়ে৷ তাদের দেখিয়ে বেড়াবে শৌখিন সজ্জাঘর—দিল্লীর প্রাসাদে যেমন শাজাহানের স্নানের ঘর দেখানো হয়৷ আশ্রমবাসী কে না জানে যে রবীন্দ্রনাথের সম্র্রাটোচিত আকৃতি, রাজবৎ উন্নতধ্বনি ও রাজকীয় ভঙ্গীর মধ্যে অতি সরল বিলাসশূন্য জীবন নির্মল আনন্দে পূর্ণ ছিল৷ যে আশ্রমে সানন্দে তিনি মাটির ঘরে বাস করেছেন সে আশ্রমে কোন প্রাসাদ তাঁর যথার্থ স্মৃতি বহন করতে পারবে না, শুধু তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে৷
আমরা ভারতবাসী চিরকাল প্রতীকে বিশ্বাসী৷ আমাদের জীবনে যুগ যুগ ধরে বড় বড় সত্য জীবন থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পুতুল হয়ে ওঠে৷ আবার সেই ফেটিশ তৈরি করি না কেন৷ রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন তার প্রতীকই তৈরি করি এবং আমরা— তাঁর ভক্তরা সেখানে শঙ্খঘণ্টা বাজিয়ে দেশের ঐতিহ্য রক্ষা করি৷
শনিবারের চিঠি, ৫৩ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা।