সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ যে বছরে মুক্তি পেল, সে বছরই মুক্তি পেল আর এক পরিচালকের প্রথম ছবি ‘রাতভোর’। সে ছবিতে নায়ক উত্তমকুমার। বিপরীতে নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। উত্তমকুমার থাকা সত্ত্বেও ছবিটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই মুখ থুবড়ে পড়ল। পরিচালক আর পরবর্তীকালে তাঁর অন্য কোন ছবিতে উত্তমকুমারকে নেননি।এমনকী পরিচালককে দিয়ে যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘নীল আকাশের নিচে’ ছবিটি করাচ্ছেন, তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চেয়েছিলেন উত্তমকুমার চিনা ফেরিওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করুক।কিন্তু পরিচালকের তাতে আপত্তি থাকায় সেই ভূমিকায় অভিনয় করলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।।ছবিতে গানের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পরিচালকের আপত্তি ছিল। কিন্তু তবু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ওই ছবিতে দুটি গান ব্যবহার করা হয়েছিল। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেই গান দুটি গেয়েছিলেন। গান দুটি হল ‘ও নদীরে একটি কথাই শুধাই শুধু তোমারে’ এবং ‘নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী’।‘নীল আকাশের নিচে’ ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ধন্য হয়েছিল। প্রস্তাবনায় যে পরিচালকের কথা বললাম, তিনি হলেন মৃণাল সেন। তাঁর জন্মশতবর্ষ সদ্য অতিক্রান্ত হল।
১৯২৩ সালের ১৪ মে, মৃণাল সেনের জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুরে।বাবার নাম দীনেশ সেন।মা হলেন সরযুবালা সেন। পড়াশুনা করার জন্য তিনি চলে এলেন কলকাতায়।কলকাতায় তার দুটি জিনিস অত্যন্ত আকর্ষণ করত। তার একটি চলচ্চিত্র, অপরটি রাজনীতি। বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সহজে যুক্ত হয়ে যান। নিজেকে তিনি সর্বদাই মার্কসিস্ট বলতেন।
তিনি প্রথম গুরুত্ব দিলেন যে ছবিকে, সে ছবির নাম ‘আকাশ কুসুম’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অপর্ণা সেন অভিনীত এই ছবিটিকে কেন্দ্র করে সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের মধ্যে চিঠির যে চাপানউতোর হয়েছিল তা একসময় পাঠক দর্শকদের অত্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
সমগ্র চলচ্চিত্র জীবনে মোট ২৮ টি ছবি তৈরি করেছেন ১৯৫৫ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে। তার মধ্যে কুড়িটি ছবি বাংলা। যার মধ্যে রয়েছে– রাতভোর, নীল আকাশের নিচে, বাইশে শ্রাবণ, পুনশ্চ, অবশেষে, প্রতিনিধি, আকাশ কুসুম, ইচ্ছাপূরণ, ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১,পদাতিক, কোরাস, পরশুরাম, একদিন প্রতিদিন, আকাশের সন্ধানে, চালচিত্র, খারিজ, মহাপৃথিবী, অন্তরীন, আমার ভুবন। একটি ওড়িয়া ছবি করেছেন ‘মাটির মানুষ’।একটি তেলেগু ছবিও তিনি করেছেন, ‘ওকা উরি কথা।’ ছটি হিন্দি ছবি তিনি পরিচালনা করেছেন। সেই তালিকায় রয়েছে ভুবন সোম, এক আধুরে কাহানি, একদিন আচানাক, মৃগয়া, খান্ডাহার, জেনেসিস। দিল্লি দূরদর্শনের জন্য তিনি করেছিলেন ১৩ টি পর্বের একটি সিরিয়াল যার নাম দিয়েছিলেন ‘কাভি দূর কাভি পাস’। হিন্দিতে একটি টেলিফিল্ম করেছিলেন ‘তসবির আপনি আপনি’।
মাধুরী নামের যে নায়িকা ছবির জগতে প্রবেশ করেছিলেন তাঁকে মৃণাল সেন যখন ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে নায়িকা করলেন তখন তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখলেন মাধবী। সেই পরিচয় নিয়েই মাধবী মুখোপাধ্যায় এখনো আছেন আমাদের মধ্যে। গোড়ার দিকের ছবিগুলোকে মৃণাল সেন তেমনভাবে গুরুত্ব দিতে চাননি। তিনি প্রথম গুরুত্ব দিলেন যে ছবিকে, সে ছবির নাম ‘আকাশ কুসুম’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অপর্ণা সেন অভিনীত এই ছবিটিকে কেন্দ্র করে সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের মধ্যে চিঠির যে চাপানউতোর হয়েছিল তা একসময় পাঠক দর্শকদের অত্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি একসময় নির্মাণ করেছিলেন কলকাতার ট্রিলজি। সেই তিনটি ছবি হল ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১ এবং পদাতিক।
মৃণাল সেনের ছবিতে প্রথম অভিনয় করেছেন এমন শিল্পীর সংখ্যা কম নয়। যার মধ্যে রয়েছেন রঞ্জিত মল্লিক, মিঠুন চক্রবর্তী, মমতাশঙ্কর, অঞ্জন দত্ত, গীতা সেন, এন বিশ্বনাথন, শ্রীলা মজুমদার প্রমুখ। হিন্দি ছবির তারকাদেরও তিনি বাংলা ছবিতে অভিনয় করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। সেই তালিকায় রয়েছেন সিমি গারোয়াল, স্মিতা পাতিল, ডিম্পল কাপাদিয়া। বহু বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সাহিত্যের চিত্ররূপ আমরা পেয়েছি তাঁর হাতে। সেই তালিকায় রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বনফুল, সুবোধ ঘোষ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ কুমার সান্যাল, সমরেশ বসু, প্রেমচাঁদ, রমাপদ চৌধুরী, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ।অন্য পরিচালকদের জন্যও তিনি চিত্রনাট্য লিখেছেন। সেই তালিকায় রয়েছে কানামাছি, জোড়ার দীঘির চৌধুরী পরিবার, রাজধানী থেকে, কাঁচকাটা হীরে প্রভৃতি ছবিগুলো।
সারা জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি নানান জায়গায়। ভারত সরকার তাঁকে দিয়েছেন ‘পদ্মভূষণ’। তিনি ভারতের সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান” দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার -এ সম্মানিত হন ২০০৫ সালে। ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ আইনসভা রাজ্যসভার সদস্য তিনি ছিলেন ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। বিদেশে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে কান, বার্লিন, ভেনিস, মস্কো, লন্ডন, শিকাগো প্রভৃতি চলচ্চিত্র উৎসবে। তিনি বিদেশে বহু চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি সদস্য হয়েছিলেন। তাঁর বহু চিত্রনাট্য পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তিনি লিখেছেন অনেক গ্রন্থ। যার মধ্যে রয়েছে ‘সিনেমা: আধুনিকতা’, ‘স্বপ্ন আপাতত বাতিল’, ‘তৃতীয় ভুবন’, ‘আমার চ্যাপলিন’, ‘মাই চ্যাপলিন’, ‘অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত’, ‘আমি ও আমার সিনেমা’ প্রভৃতি।
নিজের স্ত্রীকেও তিনি নিয়ে এসেছিলেন চলচ্চিত্র জগতে। গীতা সেন প্রথমে ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। এই ছবিতেই তৃপ্তি মিত্রকে সত্য বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রীর চরিত্রের জন্য মৃণাল সেন নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু তৃপ্তি মিত্র নিজে অভিনয় করতে রাজি হননি বলে গীতা সেনকে তিনি নিয়ে এলেন ওই চরিত্রে এবং পরবর্তীকালে অনেকগুলি ছবিটি গীতা সেন অভিনয় করেছিলেন। তাঁর মতো বিরাট মাপের মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে যান ২০১৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। জন্ম শতবার্ষিকী বছরান্তে তাঁর উদ্দেশে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ভক্তি ও প্রণাম।