রবীন্দ্রনাথ ও অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল

অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল রচিত শরৎচন্দ্রের টুকরো কথা বইটি কথাশিল্পীকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণে তুলে ধরেছে পাশাপাশি রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ এসেছে ঘটনাধারার নিজস্বগতি বজায় রেখেএই রচনায় সে সম্বন্ধেই কিছু আলোকপাতের চেষ্টা হয়েছে

অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল। জন্ম: ১৩০৫ বঙ্গাব্দ, মৃত্যু: ৩.১২.১৩৮২। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের (১৯২২) পর কথাশিল্পীর ‘মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত’ (১৯৩৮) সেই সম্পর্ক-সান্নিধ্য নানা উত্থান-পতনের মধ্যে টিকে ছিল। যদিও গবেষকগণ অবিনাশচন্দ্রের অনেক তথ্যের ওপরেই প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সাল-তারিখের অভাব, স্মৃতির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা (যদিও সাধারণ সভায় শরৎচন্দ্রের প্রথম(?)সভাপতিত্ব বিষয়ে যে তিন-চার ঘণ্টাব্যাপী আলাপটি হয়, তা ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বরে সাপ্তাহিক ‘স্বদেশী-বাজার’ পত্রিকায় বিস্তৃতভাবে প্রকাশিত হয়— যা পড়ে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন: অবিনাশ, তোমার স্মৃতিশক্তি অদ্ভূত— এ তো প্রায় হুবহু লিখেছ)— মনে হয় সেই ত্রুটির একদিক। শরৎচন্দ্রের তিপ্পান্ন বছর উপলক্ষে ইউনির্ভাসিটি ইনস্টিটিউটে জয়ন্তী উৎসবের অয়োজন হয়। দিনেশ দাস (‘কল্লোল’ সম্পাদক), গোপাল সান্যাল এবং অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল ছিলেন এর উদ্যোক্তা। আর এই দায়িত্ব নিয়েই তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি এসেছিলেন। পূর্ব পরিচয়হীন তরুণ অবিনাশচন্দ্রের সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ হয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকোতেই। সভাপতিরূপে কবিকে আমন্ত্রণ জানানোই উদ্দেশ্য ছিল।

অবিনাশচন্দ্র সেদিনটির কথা উল্লেখ করেছেন গ্রন্থে। অবশ্যই কথাশিল্পীকে দেওয়া সেই দিনটির বিবরণ প্রসঙ্গে। আশি বছরের দীর্ঘ কর্মময় জীবনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বহু দেশি-বিদেশির পরিচয়-আত্মীয়তা ঘটেছে। সেখানে অবিনাশচন্দ্রের সামান্য তিনটি দিনের স্মৃতি-সম্পদ অমূল্য না হোক, মূল্যবান তো বটেই। বিশেষত এমন একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যা বিশ্বকবি সম্বন্ধে আমাদের ধারণার পরিপন্থী। সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি।

উদ্যোক্তাদের অন্য দুইজন আপত্তি জানালেও অবিনাশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি করার বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তাই ‘সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই আমার মনে হ’লো, আচ্ছা, কবির কাছে একবার গিয়েই দেখা যাক না।’ সেই ইচ্ছা থেকে চলে আসা। আর অতি সঙ্কোচে ঘরে ঢুকে দেখলেন প্রকাণ্ড হলঘরের দক্ষিণপ্রান্তে একটি সিংহাসনের উপর পূর্বদিকে মুখ করে কবি অর্ধ-নিমীলিত চোখে বসে আছেন। উদ্দেশ্য জানানোর পর দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মিনিটের স্তব্ধতা। তারপর অমোঘ একটি বাক্যে মতামত প্রকাশ— ‘শরতের তো বেশি বয়স হয়নি, এর মধ্যে ওঁর জয়ন্তী করছ কেন? জয়ন্তী তো সবশেষে করতে হয়।’ কবি কিন্তু প্রস্তাব ‘না’ করে দেন। যদিও ‘অসুস্থতা’র অজুহাতে বিষয়টিকে দু’দিক থেকে সামাল দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর অবিনাশচন্দ্র প্রত্যুত্তরে যুক্তি দেন: ‘আপনার তো সত্যি অসুখ করবে না, তাহলে এটা তো মিথ্যা বলা হবে। এর জন্যে বিশ্বকবিকে আমি মিথ্যাবাদী করতে চাই না।’ স্বভাবতই অস্বস্তি কাটাতে রবীন্দ্রনাথ শেষটায় মহারাজা জগদীন্দ্রনাথের নাম সুপারিশ করেন। চিঠিও লিখে দেন মহারাজাকে উদ্দেশ করে।

শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর দিন (১৬ জানুয়ারি) শোকে মূহ্যমান কবির বক্তব্য অথবা তার দুদিনের মধ্যে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর উপাচার্য শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে শোকসভা সেই শ্রদ্ধাকেই আরও স্থায়ী করে প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, অধ্যাপক গুরুদয়াল মল্লিক সেই সভায় গুরুদেবের নির্দেশ মতো ঘোষণা করেন, ‘পরলোকগত মহাত্মার প্রতি সম্মানের নিদর্শনস্বরূপআগামী সোমবার প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকিবে

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অবিনাশচন্দ্রের সেই দিনের সাক্ষাৎটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কবির সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই অবিনাশচন্দ্র যে আচরণ বা কথাবার্তার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে যে ঔদ্ধত্যের ভাব ছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না। শরৎচন্দ্রের প্রতি অতিরিক্ত পরিমাণে ঝুঁকে থাকা (দোষের নয়) অবিনাশচন্দ্র তাঁর ব্যবহারেও সূক্ষ্ণভাবে সেটি প্রকাশ করে ফেলেছেন। তাই বর্ণনা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথকেই কিছু ম্রিয়মাণ মনে হবে পাঠকদের। এমনকী যাঁকে তিনি এ-ঘটনার কথা বলছেন, সেই শরৎচন্দ্র আশ্চর্য হয়েছেন। অথচ বাংলা সাহিত্য ও দেশের দুই দিকপাল প্রতি ক্ষেত্রেই একে অপরকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। মতান্তরকে কখনওই মনান্তরে টেনে নিয়ে যাননি। অসুস্থ শরৎচন্দ্রের চিকিৎসা শুরু হলে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ একটি পত্র লেখেন। ‘শরৎ, রুগ্নদেহ নিয়ে তোমাকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলুম। তোমার আরোগ্যলাভের প্রত্যাশায় বাংলাদেশ উৎকন্ঠিত হয়ে থাকবে।’ এমন এক সম্পর্কের মাঝখানে অন্য কোনও ভাবনা আমাদের চিন্তাকে গ্রাস করতে চায় না। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর দিন (১৬ জানুয়ারি) শোকে মূহ্যমান কবির বক্তব্য অথবা তার দু’দিনের মধ্যে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর উপাচার্য শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে শোক-সভা সেই শ্রদ্ধাকেই আরও স্থায়ী করে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, অধ্যাপক গুরুদয়াল মল্লিক সেই সভায় গুরুদেবের নির্দেশ মতো ঘোষণা করেন, ‘পরলোকগত মহাত্মার প্রতি সম্মানের নিদর্শনস্বরূপ…আগামী সোমবার প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকিবে।’

অবিনাশচন্দ্রের এই প্রথম সাক্ষাৎ (সাল, তারিখবিহীন) মান্যতা পেলেও কবির অংশগ্রহণের অনিচ্ছা সঠিক অর্থে প্রকাশ পায়নি। এখানে অবিনাশচন্দ্র যেন কিছু অসহিষ্ণু, কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার মনোভাব নিয়ে উপস্থিত। না হলে বিশ্বকবির সঙ্গে সাক্ষাতের এমন একটি ঘটনা তিনি কীভাবে শরৎচন্দ্রকে না বলে থেকেছিলেন,— ‘এ-ব্যাপারে কবির সঙ্গে তোমার যে-সব কথাবার্তা হয়েছিল তা তুমি আমায় কোনওদিন বলোনি।’ (শ:টু:ক:)। তাহলে কি এটাই ধরে নেব যে কবিকে গুরুত্ব (সম্মান রেখে) দেওয়ার ক্ষেত্রে অবিনাশচন্দ্র কিছু দ্বিধায় ছিলেন। নাকি ব্যর্থতা (সভাপতি না হওয়া) তাঁকে একরকম আড়াল তৈরি করে দিয়েছিল এই সম্পর্কে।

এই সাক্ষাতের পরদিনও তিনি কবির সঙ্গে দেখা করতে যান। উদ্দেশ্য, মহারাজা জগদীন্দ্রনাথের রাজি হওয়ার খবর দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ খুশি হন। কিন্তু সেদিন এমন একটি ঘটনা ঘটে যা থেকে রবীন্দ্র-গবেষকরা রবীন্দ্র-মানসিকতার অন্য একটি দিক খুঁজে পাবেন। ঘরে দ্বিতীয় একজনের আসার শব্দে কবি অবিনাশচন্দ্রের কাছে জানতে চান, সে কে। নাম বলতেই রবীন্দ্রনাথ ‘ফিস ফিস করে… বললেন, তুমি যেও না— মানুষটি বড় ঝগড়াটে— তুমি থাকলে বেশীক্ষণ থাকবেন না।’ এই ঘটনার কথা অবিনাশচন্দ্রের কাছে শুনে শরৎচন্দ্র প্রাথমিকভাবে বিস্ময় এবং সন্দেহ প্রকাশ করেন। যদিও অবিনাশচন্দ্রের যুক্তি ছিল, ‘আমার বাজে কথা বলার প্রয়োজন কি বলুন’, শুনে শরৎচন্দ্র সবটাই মেনে নেন। প্রসঙ্গত গোপালচন্দ্র রায় ‘শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থে অবিনাশচন্দ্রের এ সমস্ত লেখা (অন্য প্রসঙ্গে) যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন।

কবির সঙ্গে তৃতীয় সাক্ষাৎ টাউন হলে। শরৎচন্দ্রের তিপ্পান্ন বছরের জন্মজয়ন্তীর কয়েকদিন পরেই। (এই বিষয়টির দিকে প্রশ্ন ছুড়েছেন গোপালচন্দ্র)। আমরা অবিনাশচন্দ্রের বক্তব্যকে স্বীকার করে নিলে যেটা পাই তা একজন মানুষের মনোভাব পাল্টে যাওয়ার ইতিবৃত্ত। মিনিট পনেরো শরৎচন্দ্র সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন সার্বভৌম কবি। অথচ এই ভাষণের কোনও অনুলিপি রাখা হয়নি। ইতিহাসেও উপেক্ষিত এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। অনুষ্ঠান শেষে রবীন্দ্রনাথ ‘অবিনাশ ঘোষাল’কে খুঁজলেন, তিনি ভিড় সরিয়ে কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, নিজের ভাষণ সম্বন্ধে কবি জানতে চাইলেন এবং অবিনাশচন্দ্রকে বোলপুরে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।

ঘটনার শেষ এখানেই। আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কবি হয়তো অবিনাশচন্দ্রকে কাছে টানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ‘বাতায়ন’ পত্রিকার সম্পাদক, বেশ কিছু গ্রন্থের প্রণেতা (‘ঝড়ের পরে’, ‘সব মেয়েই সমান’, ‘নগ্নতার ইতিহাস’, ‘থেরেসা’) অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল যে কারণে আইন-ব্যবসা পরিত্যাগ করে সাহিত্যের অঙ্গনে পা দিয়েছিলেন, সেই কারণেই নিজস্ব মনোভাবকে সম্মান স্বীকৃতি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নন, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রকেই গ্রহণ করেছিলেন আগ্রহ সহকারে।

গ্রন্থঋণ:

১। শরৎচন্দ্রের টুকরো কথা— অবিনাশচন্দ্র ঘোষাল
২। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান(চতুর্থ সংস্করণ)প্রথম খণ্ড
৩। রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ৩— চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৪। শরৎচন্দ্র (জীবনী)— গোপালচন্দ্র রায়।

শনিবারের চিঠি, ৫৩ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা