রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরাজি গীতাঞ্জলি রচনা লন্ডনে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসের পয়লা পুস্তকাকারে ম্যাকমিলান কোম্পানি প্রকাশ করে এবং তার সাত মাসের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা৷
১৯১২ সালের ১৬ জুন বিশ্বকবি ইংল্যান্ডে পৌঁছলেন জাহাজে৷ মালপত্র আগেই পৌঁছে গিয়েছিল৷ শিলাইদহে যে খাতাটিতে প্রথম ইংরাজি অনুবাদ করেন, সেটি লন্ডনে গিয়ে অবিলম্বে রোটেনস্টাইনকে সমর্পণ করলেন৷ এই খাতাটিতে ৮৭টি কবিতার অনুবাদ ছিল৷ প্রকাশিত গীতাঞ্জলিতে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সংখ্যা ছিল ১০৩৷ ৮৭টির মধ্যে ৯৩টি ‘রোটেনস্টাইন পাণ্ডুলিপি’ নামে পরিচিত৷ বাকি ২০টি কবিতা কবির দ্বিতীয় খাতা থেকে নেওয়া হয়েছিল৷ রোটেনস্টাইন তাঁর ‘Men and Memories’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডে লিখেছেন: ‘That evening I read the poems. Here was poetry of a new order which seemed to me on a level with that of the great mystics. Andrew Bradley, to whom I showed them, agreed… I sent words to Yeats, who failed to reply; but when I wrote again he asked me to send him the poems, and when he had read them his enthusiasm equaled mine.’
তাহলে দেখা যাচ্ছে— লন্ডনে গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদ প্রচারে রোটেনস্টাইন, ব্রাডলে এবং ইয়েটসের অবদান আছে৷ এটা প্রচারপর্ব৷ তখনও তিনি ওই কাব্যের ওপর নোবেল প্রাইজ পাননি৷ এ ছাড়া রোটেনস্টাইন Stopford Brooke-কেও এক কপি অনুবাদ পাঠান৷ তিনিও কাব্যের উৎকর্ষ বিষয়ে রোটেনস্টাইনের সঙ্গে সহমত হন৷ পরে ১৯৩২ সালের ২৬ জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথ রোটেনস্টাইনকে এক পত্র লিখেছিলেন, যাতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন— ‘Then came those delightful days when I worked with Yeats.’৷
রোটেনস্টাইনের গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি পেয়ে (তখন ইয়েটস দক্ষিণ ফ্রান্সে ছিলেন) ইয়েটসের অবস্থা কীরকম হয়েছিল দেখা যাক— ‘From poem to poem Yeats went from hour to hour, annotating, expatriating, rejoicing till we were all afire a new revelation of spiritual beauty.’
গীতাঞ্জলি (পাণ্ডুলিপি) পড়বার পর ফ্রান্স থেকে লন্ডনে ফিরলেন ইয়েটস, জুন মাসের শেষে৷ ১৯১২ সালের ২৭ জুন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার৷ এরপর ৩০ জুন তারিখে গীতাঞ্জলির কবিতা পাঠের আসর৷ স্থান— রোটেনস্টাইনের গৃহ৷ বিশিষ্ট শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আর্নস্ট রীজ, এলিস মেনেল, মে সিনক্লেয়ার, ইভলিন আন্ডারহিল, এজরা পাউন্ড, নেভিলসন, এন্ডরুজ৷ আবৃত্তিকার প্রথিতযশা ইংরেজ কবি ইয়েটস৷
সকলেই অভিভূত৷ মে সিনক্লেয়ার পরের দিনই এ বিষয়ে লিখেছেন: ‘It was impossible for me to say anything to you(Rabindranath)about your poems last night, because they are of a kind not easily spoken about, May I say now that as long as I live, even if I were never to hear them again, I shall never forget the impression that they made.’
১৯১২ সালের ১০ জুলাই ইন্ডিয়া সোসাইটির উদ্যোগে ‘ট্রোকোডেরো’ রেস্তোরাঁয় রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেওয়া হল৷ এই সভায় বিশিষ্টদের মধ্যে ছিলেন এইচ. জি. ওয়েলস, অধ্যাপক জে. ডব্লু. ম্যাকেল, ই. বি. হ্যাভেল, অধ্যাপক অ্যান্ডারসন আর বি. কানিংহাম গ্রেহাম, হার্বার্ট ট্রেক, টি. ডব্লু. রোলস্টোন প্রভৃতি জ্ঞানীগুণীরা৷ সভাপতিত্ব করেন স্বযং ইয়েটস৷ ১৩ জুলাই ‘The Times’ পত্রিকায় এর রিপোর্ট বেরলো৷ ইয়েটসের একটা উক্তি ওই পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছিল— ‘I know of no man in my time who has done anything in the English language to equal these lyrics. Even as I read them in those literal prose translations, they are as exquisite in style as in thought.’
ম্যাকমিলান কোম্পানি ১৯১৩ সালের ১ মার্চ ইংরাজি গীতাঞ্জলি প্রকাশ করেছিল, তা আগেই বলেছি৷ কিন্তু এর আগেও ১৯১২ সালের ১ নভেম্বর ইংরাজি গীতাঞ্জলির সাড়ে সাতশো কপির একটা সীমিত সংস্করণ প্রকাশ করে৷ তারপরই কবি আমেরিকায় যান এবং পাঁচ মাস কাটিয়ে লন্ডনে ফেরেন৷ ১৯১৩ সালের অক্টোবরের গোড়ায় কবি স্বদেশে ফিরে এলেন৷ তারপর এক মাসের মধ্যেই খবর এল রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন৷ ১৯১৩ সালের ১২ নভেম্বর স্টকহলম্ থেকে রয়টারের কেবল সারা বিশ্বে সুইডিশ অ্যাকাডেমির সিদ্ধান্ত ছড়িয়ে দিল৷ ১৪-১৫ তারিখের মধ্যে সংবাদটি বিশ্বের সর্বত্র লক্ষ লক্ষ সংবাদপত্রে উদ্ধৃত হল৷
কবিতার জন্য নোবেল প্রাইজ রবীন্দ্রনাথের পূর্বে সাত জন পেয়েছিলেন৷ রোটেনস্টাইনের কাছ থেকে এল প্রথমে একটি টেলিগ্রাম, পরে এল একখানা চিঠি (১৫ নভেম্বর ১৯১৩)— ‘I open the Times and a great shout comes from it— Rabindranath has won the Nobel Prize, I cannot tell you of the delight this splendid homage give me— the crown is now set upon your brow.’
কিন্তু নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর ইয়েটস ও এজরা পাউন্ড নীরব হয়ে গেলেন কেন? অথচ এই এজরা পাউন্ডই ১৯১২ সালের ডিসেম্বর সংখ্যার ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম প্রবন্ধে লিখেছিলেন— ‘The Bengali brings to us a pledge of a calm which he need overmuch in an age of steel and mechanics. It brings a quiet proclamation of the fellowship between man and the gods; between man and nature… There is a deeper calm and a deeper conviction in this eastern expression than we have yet attained.’
সেই এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরে নীরব কেন? আসলে ২৬ বৎসর বয়স্ক মার্কিন যুবক লন্ডনে এসে তখনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি কবি হিসেবে৷ আর রবীন্দ্রনাথ ধ্যারধেরে গোবিন্দপুর থেকে এসে আচমকা নোবেল প্রাইজ ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন৷ এটা পরশ্রীকাতরতা৷ আর তখন নোবেল প্রাইজের আর্থিক মূল্য ছিল ৭০০০ পাউন্ড৷
আর ইয়েটস নীরব হয়ে গেলেন কেন? প্রথমত, তাঁর নিজের নোবেল প্রাইজের আশা ছিল৷ পেলেন না৷ দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রচারে ও প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল৷ কিন্তু তাঁর নিজের নাম প্রচারের অন্তরালে চলে গেল৷ তৃতীয়ত, তাঁর ধারণা হয়েছিল, ম্যাকমিলান কোম্পানির পুস্তকে তিনি রবীন্দ্রনাথের ইংরাজি মার্জিত করে দিয়েছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন৷ এটা কিন্তু কেউ স্বীকার করছে না৷ চতুর্থত, London Royal Society-র একজন সর্ববাদিসম্মত ক্যান্ডিডেট ছিল, যার নাম ও পুস্তক পাঠানো হয়েছিল৷ কিন্তু তিনিও পেলেন না৷ তবে কার সুপারিশে রবীন্দ্রনাথের নাম ওপরতলায় গেল? এটা কেউই তখন বুঝতে পারেননি৷
আসলে স্টার্জ মুর ব্যক্তিগতভাবে সকলের অজান্তে রবীন্দ্রনাথের নাম ও পুস্তক পাঠিয়েছিলেন৷ সর্ববাদিসম্মত টমাস হার্ডির নাম হারিয়ে গেল৷ ইনিই ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি৷ অথচ নোবেল প্রাইজের জন্য (সাহিত্যে) সেই বছর প্রস্তাবিত নামের সংখ্যা ছিল ২৮৷ যে সব বিশেষজ্ঞ, ইংরাজি গীতাঞ্জলি সম্পর্কে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুইডিশ কবি ফের্নের ফন হাইডেনস্টাম (সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্য)-র নাম উল্লেখযোগ্য৷ তিনি এর তিন বছর পরে ১৯১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান৷ শুধু তিনি নন, সুইডিশ অ্যাকাডেমির সভাপতি অ্যান্ডারস অস্টারলিং লেখেন— ‘I was deeply moved when I read them (the Gitanjali poems) and I do not remember having read any lyric writing equal to them during the past twenty years or more. They gave me hours of intense enjoyment, it was like drinking the water of a fresh, clear spring.’ S Tagore and the Nobel Prize প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত)৷
এল ১৯২৩ সাল৷ ইয়েটস নোবেল পুরস্কার পেলেন৷ তারপর থেকে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করে দেখতে লাগলেন৷ বড় বড় লোকেরাও ইগোতে ভুগে থাকেন৷ এটা অদৃষ্টেরই নিষ্ঠুর পরিহাস৷ ইয়েটসের নিজের দেশ ডাবলিনেও জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো ঘটনা ঘটেছিল, যার প্রতিবাদ করেছিলেন বার্নার্ড শ (আইরিশ)৷ কিন্তু পেনশন যাওয়ার ভয়ে ইয়েটস ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করেননি৷
তারপর এল ১৯১৯ সাল৷ ডায়ার সাহেবের গুলিতে শত শত সাধারণ মানুষের মৃত্যু৷ রবীন্দ্রনাথের নিন্দা, নাইটহুড উপাধি ত্যাগ৷ আর ইংল্যান্ডের প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে চলে গেল৷ ব্রিটিশ সরকারের কোনও সমালোচনা তারা হজম করবে না৷
এল ১৯২৩ সাল৷ ইয়েটস নোবেল পুরস্কার পেলেন৷ তারপর থেকে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করে দেখতে লাগলেন৷ বড় বড় লোকেরাও ইগোতে ভুগে থাকেন৷ এটা অদৃষ্টেরই নিষ্ঠুর পরিহাস৷ ইয়েটসের নিজের দেশ ডাবলিনেও জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো ঘটনা ঘটেছিল, যার প্রতিবাদ করেছিলেন বার্নার্ড শ (আইরিশ)৷ কিন্তু পেনশন যাওয়ার ভয়ে ইয়েটস ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করেননি৷ ডাবলিনের হত্যাকাণ্ড ১৯১৬ সালের ঘটনা৷ আয়ারল্যান্ড তখন পরাধীন ছিল৷ ইংরেজ ছিল রাজা৷ প্রায় আটশো বছর আয়ারল্যান্ড পরাধীন ছিল৷ ভারত তো মাত্র দুশো বছর৷ ইয়েটসের আর একটা কথার ওপর আলোকপাত করা যাক— রবীন্দ্রনাথ ভাল ইংরাজি জানতেন না৷ তাঁর (ইয়েটস) লেখনীস্পর্শে ইংরাজি গীতাঞ্জলি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল৷ তার মধ্যে কিছুটা সত্যতা থাকলেও সম্পূর্ণ সত্য ছিল না৷ ‘চিত্রা’ কাব্যের অনুবাদ দেখে ওয়াল্টার ডি লা মেয়ার (ইংরেজ কবি) মন্তব্য করেন— ‘And ‘Chitra’ is only one more revelation of Mr.Tagore’s astonishing mastery of English. To win not only idiom, fluency, cadence, but also atmosphere in an alien tongue is neither the least nor, for us, the least fortunate, of his poet’s achievements. How many English writers, one may speculate, could return so grave and real compliments.’ (7th February 1914, Westminister Gazette)
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ৭৬ নম্বর কবিতা— ‘প্রতিদিন আমি, হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমার সম্মুখে’র ইংরাজি অনুবাদ হয়েছিল— ‘Day after day, O Lord of my life, shall I stand before thee face to face?’
প্রশ্নবোধক চিহ্ন ইয়েটস দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ আপত্তি করেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে ১৯১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি এক পত্রে রোটেনস্টাইনকে লিখেছিলেন— ‘An incident will show you how the award of the Nobel Prize has roused up antipathy and suspicion again me in certain quarters…’ যাই হোক, ইয়েটস যে কিছু উপকার করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তা স্বীকার করেন৷
ইয়েটসের প্রধান রাগ— ‘Tagore’s English was a foreigner’s English.’ এটা British English নয়৷ হতে পারে৷ ইয়েটস আয়ারল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে এসে দু’দিনেই কি British English-এ দক্ষ হয়েছিলেন? ইয়েটস আরও বলেছিলেন— ‘Tagore does not know English, no Indian knows English.’
এ সম্বন্ধে রোটেনস্টাইন কী বলেছিলেন? তিনি ‘Men and Memories’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন— ‘The original Ms. Of Gitanjali in English and in Bengali is in my possession. Yeats did here and there suggest slight changes, but the main text was printed as it came from Tagore’s hands…’
শনিবারের চিঠি, ৫১ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা