রবীন্দ্রনাথের ছবি‍

শব্দের ধ্বনি ও ছন্দ নিয়ে সারাজীবন খেলা করে ৬৭ বৎসর বয়সে রবীন্দ্রনাথ নিঃশব্দ রেখার ছন্দ নিয়ে খেলা শুরু করেন৷ যখন শব্দের জগতে লীলা করছিলেন তখন শব্দ তার অর্থ দিয়ে কবির সচেতন মনের নজর দাবি করছিল৷ তাই অর্থের দিকে নজর দিয়ে শব্দ চয়ন করছিলেন কবি৷ কবিতা শুধু অর্থহীন কথার সমষ্টি নয়, শুধু ধ্বনি নয়, অর্থবান শব্দের ধ্বনিময় সমষ্টি৷

রেখার নিঃশব্দ জগতে অর্থ নেই, ধ্বনি নেই৷ রেখা স্বয়ংসম্পূর্ণ, রূপ ছাড়া আর তার কোনও অর্থ নেই৷ নীল আকাশে আলসভরে ভেসে-যাওয়া শরতের মেঘের যে রূপ, তার সৌন্দর্য ছাড়া আর কি কোনও অর্থ আছে? রূপ অর্থ-হারা, তাই শব্দহীন রেখা অর্থ প্রকাশ করে না, শুধু রূপ ধরে দেয় চেখের সামনে৷ তাই রেখার জগতে, রূপের জগতে সচেতন মনের খবরদারির প্রয়োজন নেই৷

রবীন্দ্রনাথের আঁকা: ‘উওম্যান ফেস’

মনের যে মহল থেকে মহাকবির কাব্যগুলি বের হয়ে এসেছিল আমাদের জগতে, সে মহলটি ছিল সচেতন মনের মহল, সেখানে শব্দের বাছাই ছিল, অর্থ-সচেতনতা ছিল৷ শিল্পী রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলি তাঁর অন্তরের যে মহল থেকে এল সেই অবচেতন মনের মহলে কোন চেতন-বাছাই নেই, সচেতন মনের রুচির শাসন নেই৷ তাই রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও রবীন্দ্রনাথের ছবি‍— এ দুটির জন্ম তাঁর অন্তর্লোকের দুটি সম্পূর্ণ আলাদা মানস-মৃত্তিকা থেকে৷ সে কথা কবি নিজে বলেছেন, ‘শেষ সপ্তকে’র দুটি কবিতায়৷ তিনি বলছেন—

“পড়েছি আজ রেখার মায়ায়
কথা ধনী ঘরের মেয়ে,
অর্থ আনে সঙ্গে করে,
মুখরার মন রাখতে চিন্তা করতে হয় বিস্তর৷
রেখা অপ্রগল্‌ভা, অর্থহীনা,
তার সঙ্গে আমার যে ব্যবহার সবই নিরর্থক৷
কথা আমাকে প্রশ্রয় দেয় না, তার কঠিন শাসন;
রেখা আমার যথোচ্ছাচারে হাসে,
​ তর্জনী তোলে না৷’’
আর একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবির সম্বন্ধে বলছেন—
“ঘটনার ডাক-পিওনগিরি করে না সে৷
নিজেরই সংবাদ সে নিজে৷
জগতে রূপের আনাগোনা চল্‌ছে‍
সেই সঙ্গে আমার ছবিও এক-একটি রূপ,
অজানা থেকে বেরিয়ে আসছে জানার দ্বারে৷
​ সে প্রতিরূপ নয়৷’’

কবিতা নিয়ে দিগ্‌নাগাচার্যয়ানা করতে সঙ্কোচ হয়, তবু এই কটি লাইনের মধ্যে রূপসৃষ্টির মূল তত্ত্ব এমন করে ধরে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ যে সেটা মেলে না ধরে মন রেহাই দিচ্ছে না৷

কবির আত্মপ্রতিকৃতি

শিল্পী রবীন্দ্রনাথ অসংশয়ে সকলকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁর ছবি ঘটনার মোট বহন করে জায়গায় জায়গায় সেটা পৌঁছে‍ দেয় না৷ তাঁর ছবি ঘটনার মুটেগিরি করে না৷ ঘটনার মুটেগিরি করে সমাজতত্ত্ববিদ্‌, রাজনীতিবিদ্‌ কিন্তু রস-স্রষ্টা কখনও না৷ রস-স্রষ্টার সৃষ্টি ঘটনার মোট নামিয়ে দিয়ে আসে না এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে৷ রস-স্রষ্টার অন্তরের রস-সিঞ্চনে সে সৃষ্টি অনন্য, একটি সামান্য ঘটনাকেও সে অসামান্য করে তোলে৷ ঘটনাটি সৃষ্টির পক্ষে উপলক্ষমাত্র, রূপের সার্থক প্রকাশই আসল কথা৷ রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তাঁর ছবি সে প্রতিরূপ নয়৷ একটি রূপকে সে দেখল আর হুবহু তার নকল করল, ফোটোগ্রাফির এই নকলনবিসিয়ানা তাঁর ছবি করে না৷ তাঁর ছবি এই পৃথিবীর অসংখ্য রূপের মধ্যে একটি রূপ৷ তার নিজের রূপের অর্থাৎ সার্থক প্রকাশের দ্বারাই সে আমাদের স্বীকৃতি সহজেই দাবি করে ও পায়৷ রূপই হচ্ছে একমাত্র সংবাদ যা ছবি বহন করে আর সে সংবাদ তার নিজের রূপের সংবাদ, আর কোনও সংবাদ নয়৷

নিজের রূপের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত এই যে ছবি, সে ছবির উৎস অন্তরের কোন্‌ স্তরে? যেখানে বুদ্ধি তার বিচার ও বিশ্লেষণের বুনুনি রচনা করছে সেখান থেকে কি ছবি আসছে? না, আদপেই নয়, ছবি আসছে অবচেতন মনের মহাসমুদ্র-তল থেকে৷ সেখানে রূপ আছে, কিন্তু নেই বুদ্ধির খেলা, বিচার কিংবা সংস্কারের শাসন৷
তাই ছবির উৎস সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বললেন, শিল্প হচ্ছে প্রত্যক্ষ অনুভূতি, অবচেতন ও প্রয়োজনাতিরিক্ত লোকের বাসিন্দে৷ Art belongs to the region of intuition, unconscious, the superfluous.

রবীন্দ্রনাথের আঁকা: ‘ডান্সিং উওম্যান’

তিনি বললেন, রূপের ছন্দময়তাতেই রূপের চরম প্রকাশ— the rhythmic significance of form which is ultimate.

রূপই রূপের উদ্দেশ্য, তার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই৷

বিশেষ কতকগুলি আঙ্গিকের কারাগারে ভারতীয় শিল্পকে বন্দী রাখাতে যারা গর্ব অনুভব করে ও সেই অনড় অচল স্থাণুত্বকে ভারতীয়তা বলে জাহির করে, তাদের সেই মৃত সংস্কারবদ্ধতাকে আঘাত করে শিল্পীদের বললেন রবীন্দ্রনাথ: “আমি জোরের সঙ্গে বলবো আমাদের শিল্পীদের যে তাঁরা যেন এমন কিছু সৃষ্টি করবার বাধ্যবাধকতা অস্বীকার করেন যাকে ‘ভারতীয় শিল্প’ বলে লেবেল দেওয়া যায়৷ দাগ-মারা জন্তুদের মতো একই খোঁয়াড়ে বন্দী হতে এই শিল্পীরা যেন গর্বের সঙ্গে অস্বীকার করেন— “I strongly urge our artists vehemently to deny their obligation carefully to produce something that can be lebelled as Indian art according to some old world mannerism. Let them proudly refuse to be herded into a pen like branded beasts.” (The meaning of Art)

রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি

কতকগুলো বাঁধা-ধরা ছন্দের কারাগার থেকে যিনি কবিতাকে মুক্তি দিযেছেন, ছবির বেলায় তিনি কতকগুলো বাঁধা-ধরা আঙ্গিক ও রূপ-লক্ষণের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত ছবিকে মুক্তি না দিয়ে পারেন কি করে?

সৃষ্টির ক্ষেত্রে রসের শাসন ছাড়া তিনি আর সব ভাটপাড়াগিরিকে অস্বীকার করেছেন৷ শিল্পে জাতীয়তাবাদ তেমনি বর্জনীয় যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে বর্জনীয়৷ আঙ্গিক আসবে রূপের ধারণা থেকে, আঙ্গিক বিচিত্র হবে, শিল্পী সৃষ্টির প্রয়োজনে যেমন উপাদান সংগ্রহ করবে সারা পৃথিবী থেকে তেমনি সৃষ্টির প্রয়োজনে আঙ্গিকও গ্রহণ করবে বিশ্বের শিল্পজগৎ থেকে৷ ভৌগোলিক সীমানার দ্বারা মনকে আল দিয়ে বেঁধে‍ রাখা বিংশ শতাব্দীতে মধ্যযুগের অস্তিত্বের পরিচয় দেয়৷ রবীন্দ্রনাথ মনের আল ভাঙার নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর সাহিত্যে ও শিল্পে৷ ভবিষ্যতে যে‍-সব শিল্পী আসবেন তাঁরা সাহস পাবেন রবীন্দ্রনাথের এই বাঁধ-ভাঙা নির্দেশ স্মরণ করে৷

প্রায় তিন হাজার ছবি রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন৷ অবচেতনের উৎস থেকে ছবিগুলি রেখার ঝরনার মতো বের হয়ে এসেছে৷ কিন্তু সৃষ্টির জন্য উপকরণ যে কত সামান্য হতে পারে আর সেই সামান্য উপকরণগুলি যে অসামান্য শিল্প-সৃষ্টির প‍ক্ষে যথেষ্ট, রবীন্দ্রনাথ তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন৷

কলম, আঙুলের ডগা, কাপড়ের এক টুকরো— এই হল তাঁর শিল্প-সাধনার যন্ত্র৷ আর কালি, কিছু রঙ, যেমন-তেমন কাগজ— এই ছিল তাঁর শিল্পের উপকরণ৷ দামি তুলি ও রঙ তাঁর ছবি আঁকার রঙমহলে প্রবেশ করেনি কখনও৷ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে উপকরণের বহুলতা সৃষ্টির লাবণ্যকে অবগুণ্ঠিত করে দেয়৷ সাধারণ লোক উপকরণের চটকেই মুগ্ধ হয়ে যায়, সৃষ্টির মনোহারিত্ব সরে যায় দৃষ্টির সামনে থেকে৷ তাই সহজ হবার সাধনা শিল্পীর প‍ক্ষে কঠিনতম সাধনা৷ শিল্পী রবীন্দ্রনাথ এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন৷
(বানান অপরিবর্তিত)

শনিবারের চিঠি, 53 বর্ষ, 4র্থ সংখ্যা