বাংলা উপন্যাসের গোড়ার কথা ও বঙ্কিমচন্দ্র

গল্প শোনার বাসনা মানুষের চিরন্তন৷ যে অসভ্য জাতির সাহিত্য নাই তাহারাও গল্প শোনে৷ যাহাদের সাহিত্য আছে সে জাতিও যে সব সময়ে সাহিত্যের মধ্য দিয়া গল্প শোনার বাসনা চরিতার্থ করে তাহা নহে৷ মুখে শোনা গল্প আর সাহিত্যের মধ্য দিয়া পাওয়া গল্পের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে৷ মুখে শোনা গল্পে কাহিনীটাই মুখ্য, কাহিনী‍-চরিত্রগুলি শ্রোতার কল্পনাই জীবন্ত করিয়া লয়৷ সাহিত্যের গল্পে কাহিনীর সহিত চরিত্রসৃষ্টি অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্বদ্ধ; ইহাতে গল্পের চরিত্র পাঠকের সম্মুখে সমগ্রভাবে উপস্থাপিত হয়, পাঠকের কল্পনার বিশেষ অবকাশ থাকে না৷

প্রাচীন বাংলা ছিল একান্তভাবে ধর্ম্মমূলক, অর্থাৎ পুরাতন বাংলা সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল দেবতার মাহাত্ম্য-খ্যাপক অথবা লীলাকাহিনী-বর্ণনাত্মক৷ কিন্তু সেই সঙ্গে কোন কোন প্রাচীন কাব্যে তখনকার দিনের লৌকিক গল্প বা উপকথা কতক কতক দেবমাহাত্ম্যকাহিনীর মধ্যে প্রবেশ লাভ করিয়াছিল৷ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু-ফুল্লরার উপাখ্যান, ষষ্ঠীমঙ্গল, সরস্বতীমঙ্গল প্রভৃতি ব্রতকথা জাতীয় কাব্যের কাহিনী— এই সবের মূলে আছে প্রাচীন বাংলার গালগল্প৷ ধর্ম্মমঙ্গল কাব্যকে মূলত প্রাচীন রাঢ়ের উপকথা-সংগ্রহ বলিলে ইতিহাসের অমর্য্যাদা হইবে না৷

অনেকেরই ধারণা আছে যে, আধুনিক বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ কেরী এবং তাঁহার সহকারী পণ্ডিত এবং মুন্সীদের দ্বারা৷ এ ধারণা সর্ব্বাংশে যথার্থ নহে৷ বাংলা গদ্যের যথার্থ আরম্ভ পোর্ত্তুগীস ও বাঙালী রোমান ক্যাথলিক পাদ্রীদের দ্বারাও নহে৷ বাংলা গদ্যের প্রবর্ত্তন, পরিপুষ্টি এবং প্রতিষ্ঠা হয় ব্রাহ্মণপণ্ডিতদিগের দ্বারা৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে একাধিক ব্রাহ্মণপণ্ডিত ন্যায় এবং স্মৃতি গ্রন্থের বাংলা গদ্যে অনুবাদ করিয়াছিলেন, অনেক বৈদ্যও বৈদ্যকগ্রন্থের তরজমা করিয়াছিলেন৷ কথকদের পুঁথিতে‍ বাংলা গদ্যের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে৷

মুসলমান রাজদরবারের মারফত বাংলা সাহিত্যে উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে প্রচলিত লৌকিক কাহিনী বা adventure tales প্রথম আমদানি হইল৷ এই শ্রেণির কাহিনীর মধ্যে বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যানই প্রথম আসে৷ যতদূর জানা গিয়াছে, বাংলা ভাষায় প্রথম বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচিত হয় ১৫৩৪ খ্রীষ্টাব্দে কিংবা তাহার দুই চারি বৎসর পূর্ব্বে৷ এই কাব্যের কবি শ্রীধরের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন গৌড়ের সুলতান নসীরু-দ্-দীন লুসরৎ শাহের পুত্র যুবরাজ আলাউ-দ্‌-দীন ফীরূজ শাহ্‌৷ বিদ্যাসুন্দর-কাহিনীকে ধর্ম্মের মোড়ক পরাইয়া কালিকা-মঙ্গলরূপে উপস্থাপিত করা হইয়াছিল বলিয়া এই কাহিনী পুরাতন বাংলা সাহিত্যের অবনতির সময়ে অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমে ভাগীরথীর তীরবর্ত্তী অঞ্চলে যেখানে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের নাগরিক সভ্যতা ও বিলাসিতার সর্ব্বাধিক প্রসার ছিল সেই অঞ্চলে বিশেষ সমাদর লাভ করিয়াছিল৷ আরাকান রাজসভার মারফত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সেই সব adventure tales-এর আমদানি হইল, সেগুলি ধর্ম্মকুঞ্চকাবৃত না থাকায় একেবারেই প্রসার লাভ করিতে পারে নাই৷ কেবল চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সব কাহিনী কিছু কিছু সমাদৃত হইয়াছিল৷

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে বিক্রমাদিত্যের কাহিনী এবং অনুরূপ আখ্যায়িকা বিশেষ জনপ্রিয় হইয়া পড়ে৷ উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিক্রমাদিত্যের কাহিনী ছাড়া শুকসপ্ততি, গোলেবকাওলী, চাহার দরবেশ, হাতেম তাই ইত্যাদি সংস্কৃত, হিন্দি এবং ফারসী উপাখ্যান এবং বিদ্যাসুন্দরের অনুকরণে লেখা চন্দ্রকান্ত, কামিনীকুমার ইত্যাদি গুপ্তপ্রণয়কাহিনী বাঙালী পাঠকের গল্পপিপাসা মিটাইতে লাগিল৷ ইংরেজি হইতে অনূদিত আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপাখ্যান ইত্যাদি কাহিনীও বিশেষভাবে আসর জাঁকাইয়া তুলিল৷

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলা সাময়িকপত্রের প্রবর্ত্তন হইল৷ ইহা হইতেই আধুনিক বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূত্রপাত৷ অনেকেরই ধারণা আছে যে, আধুনিক বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ কেরী এবং তাঁহার সহকারী পণ্ডিত এবং মুন্সীদের দ্বারা৷ এ ধারণা সর্ব্বাংশে যথার্থ নহে৷ বাংলা গদ্যের যথার্থ আরম্ভ পোর্ত্তুগীস ও বাঙালী রোমান ক্যাথলিক পাদ্রীদের দ্বারাও নহে৷ বাংলা গদ্যের প্রবর্ত্তন, পরিপুষ্টি এবং প্রতিষ্ঠা হয় ব্রাহ্মণপণ্ডিতদিগের দ্বারা৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে একাধিক ব্রাহ্মণপণ্ডিত ন্যায় এবং স্মৃতি গ্রন্থের বাংলা গদ্যে অনুবাদ করিয়াছিলেন, অনেক বৈদ্যও বৈদ্যকগ্রন্থের তরজমা করিয়াছিলেন৷ কথকদের পুঁথিতে‍ বাংলা গদ্যের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে৷ সত্য বটে যে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ হইতেই রোমান ক্যাথলিক পাদ্রীদের বাংলা গদ্যে (এবং সম্ভবত পরেও) খ্রীষ্টানী বাংলার চর্চ্চা অব্যাহতভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধ অবধি চলিয়া আসিয়াছিল৷ কিন্তু এ কথা ভুলিলে চলিবে না যে, বাঙালী জনসাধারণ এই খ্রীষ্টানী সাহিত্যের সহিত পরিচিত হওয়া দূরে থাকুক, ইহার অস্তিত্বের বিষয়েও সচেতন ছিল কি না গভীর সন্দেহের বিষয়৷ খ্রীষ্টানী বাংলা সাহিত্যের ধারার সহিত মূল বাংলা সাহিত্যের সংস্রব কখনও ঘটে নাই৷

তেমনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শি‍ক্ষকদিগের রচিত বাংলা গদ্য-পাঠ্যপুস্তকও কোনদিন সাহিত্য হিসাবে গৃহীত হয় নাই৷ এবং এই পাঠ্যপুস্তকের গদ্যও সংস্কৃত এবং উন্নত হইয়া কোনদিন বিদ্যাসাগরী সাধুভাষায় পরিণত হয় নাই৷ বিদ্যাসাগর যে গদ্য পাইয়া সংস্কৃত এবং বাংলা শক্তিশালী করিয়া তুলিয়াছিলেন, তাহা ফল্গুস্রোতোবাহিনী ব্রাহ্মণপণ্ডিতের গদ্য এবং তাহা বাংলা সাময়িকপত্রের গদ্য৷

বঙ্কিমের লেখার ভাষা ভাবের উপযোগী এবং অনুগত; ভাষা কোথাও ভাবকে ছাড়াইয়া স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ করে নাই৷ এই কারণে বঙ্কিমের লেখায় ব্যাকরণগত অসঙ্গতি থাকিলেও কুত্রাপি তাহা দোষ বলিয়া প্রতীয়মান হয় নাই৷ বিদ্যাসাগরের সৃষ্ট বাংলা সাধুভাষার গদ্যে বঙ্কিম নমনীয়তার সঞ্চার করিয়া তাহাকে সকল বিষয়, ভাব এবং রসের বাহন হইবার উপযুক্ত করিয়া তুলিলেন৷ মুখের ভাষা মনের ভাষা হইয়া গেল৷

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে বাঙালী পাঠকসাধারণ যাহাতে অবিমিশ্র সাহিত্যরস পাইত, তাহা হইতেছে সে যুগের সাময়িকপত্র— প্রধানত সমাচারদর্পণ, সমাচারচন্দ্রিকা, সংবাদপ্রভাকর, বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ৷ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আরম্ভ, বিকাশ এবং পরিণতি হইয়াছে সাময়কিপত্রের পৃষ্ঠায়৷ সমাচারচন্দ্রিকায় ভবানীচরণ, সংবাদপ্রভাকরে ঈশ্বর গুপ্ত ও তাঁহার শিষ্যবর্গ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্ত ও বিদ্যাসাগর মহাশয়, বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহে রাজেন্দ্রলাল, বিচারক ও অবোধবন্ধুতে বিহারীলাল এবং কৃষ্ণকমল, মাসিক পত্রিকায় প্যারীচাঁদ— ইত্যাদি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকগণ সে যুগের সাময়িকপত্রে লেখনী পরিচালনা করিতেন৷ মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দঃ প্রথম আবির্ভূত হয় সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায়; তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যের প্রথম প্রকাশ ঘটে বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহে৷

বিদ্যাসাগরের যুগের সংবাদপ্রভাকর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ, মাসিক পত্রিকা, বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ, রহস্যসন্দর্ভ, বিচারক, অবোধবন্ধু ইত্যাদি,– বঙ্কিমের যুগে বঙ্গদর্শন, বান্ধব, সাধারণী, নবজীবন, প্রচার, বঙ্গবাসী, হিতবাদী, সঞ্জীবনী ইত্যাদি,— এবং বর্ত্তমান রবীন্দ্রনাথের যুগে ভারতী, সাধনা, সাহিত্য, বঙ্গদর্শন (নবপর্য্যায়), প্রবাসী, সবুজপত্র, নারায়ণ, ভারতবর্ষ ইত্যাদি সাময়িকপত্র বাংলা সাহিত্যের অপরিসীম পৌষ্টিকতা করিয়াছে৷

বাংলা সাময়িকপত্রের সৃষ্টিকাল হইতেই কিছু কিছু কৌতুকরচনা ও ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হইতে থাকে৷ স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারেও একাধিক ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হইতে লগিল৷ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবুবিলাস এই ধরনের একটি চমৎকার বই৷ পরবর্ত্তী কালের অনেক ব্যঙ্গরচনায় নববাবুবিলাসের প্রভাব সুস্পষ্ট পরিল‍ক্ষিত হয়৷ এমন কি প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালে এবং দীনবন্ধুর একাধিক নাটকে নববাবুবিলাসের কয়েকটি motif অনূকৃত অথবা পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে দেখা যায়৷ এক হিসাবে বলিতে গেলে, এই ব্যঙ্গচিত্রের মধ্যেই আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের সূচনা রহিয়াছে৷ গল্প-উপন্যাসের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হইতেছে‍— বাস্তব অথবা বাস্তববৎ প্রতীয়মান জীবন্ত চরিত্রসৃষ্টি৷ এই লক্ষণ কিছু পরিমাণে এই ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে আছে৷

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শকুন্তলা, সীতার বনবাস, তারাশঙ্করের কাদম্বরী, রামগতির রোমাবতী, প্যারীচাঁদের আলালের ঘরের দুলাল, কৃষ্ণকমলের দূরাকাঙক্ষের বৃথা ভ্রমণ ও পৌলবর্জ্জিনী ইত্যাদি উৎকৃষ্ট কাহিনী থাকিলেও বাংলা উপন্যাসের সৃষ্টি হইয়াছিল একেবারে স্বাধীনভাবে৷

১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশ করিলেন৷ ইংরেজীর অনুসরণ হইলেও এ হইল সম্পূর্ণ নূতন এবং স্বাধীন সৃষ্টি৷ বাঙালী পাঠকসাধারণ এবং সাহিত্যরসিকের নিকট মহোৎসবের ভাণ্ডারদ্ধার মুক্ত হইল৷

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস

উপন্যাস-রচনার প্রধান অঙ্গ তিনটি‍— বিষয়বস্তু বা প্লট, রচনারীতি বা style, এবং বাস্তবকল্প চরিত্রসৃষ্টি বা characterization৷ শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্রের এই তিন বিষয়ের কৃতিত্ব বিচার করিয়া দেখি৷ বলিয়া রাখি, এই বিচারে বঙ্কিমের উপন্যাসের সাধারণ ধর্ম্ম লইয়াই বিচার করিব, কোন বিশেষ শ্রেণীর অথবা কোন নির্দ্দিষ্ট একটি উপন্যাসের কথা বলিব না৷

বাহ্যদৃষ্টিতে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির যে ভাবে শ্রেণীবিভাগ করি না কেন, সবগুলিই একটি সাধারণ শ্রেণীতে পড়ে; বঙ্কিমের সব উপন্যাসই মূলত রোমান্টিক নভেল৷ ঘটনাপ্রবাহের দ্রুতগতিতে এবং নাটকোচিত ঘাতপ্রতিঘাতে প্লট সর্ব্বত্রই ঘোরাল৷ প্রধান রসের যোগান দিয়াছে নারীপ্রেম; শেষের কয়েকটি উপন্যাসে তাহার সঙ্গে দেশপ্রেমের প্রবাহ মিশিয়াছে৷ সঙ্গে সঙ্গে নায়িকা অথবা উপনায়িকার অব্যক্ত প্রেমের অচরিতার্থতা করুণ সুর বা tragic element ধ্বনিত করিয়া প্লটের মোহকারিতা সমধিক সৃষ্টি করিয়াছে৷

রচনারীতি বা style-এ বঙ্কিমচন্দ্রের মৌলিকতা অপূর্ব্ব৷ বঙ্কিমের পূর্ব্বে বাংলা সাহিত্যে যে ব্যঙ্গচিত্র বা আখ্যায়িকা ছিল, তাহাতে গ্রন্থকারের ভূমিকা ছিল মধ্যস্থ (impersonal) বক্তার বা কথকের৷ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে লেখকের ভূমিকা হইল বিশ্রদ্ধ (intimate) বন্ধুর৷ এখানে গল্প বা কাহিনীটা যেন তেন প্রকারেণ বর্ণনা করাটাই একমাত্র উদ্দেশ্য নহে, পাঠকের পরিচর্য্যা বা entertainment করাই মুখ্য উদ্দেশ্য৷ ইংরেজীতে বলিতে গেলে যাহা intimate style, বাংলা ভাষায় ও সাহিত্যে বঙ্কিম তাহাই প্রবর্ত্তন করিয়াছেন৷ বঙ্কিমের লেখার ভাষা ভাবের উপযোগী এবং অনুগত; ভাষা কোথাও ভাবকে ছাড়াইয়া স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ করে নাই৷ এই কারণে বঙ্কিমের লেখায় ব্যাকরণগত অসঙ্গতি থাকিলেও কুত্রাপি তাহা দোষ বলিয়া প্রতীয়মান হয় নাই৷ বিদ্যাসাগরের সৃষ্ট বাংলা সাধুভাষার গদ্যে বঙ্কিম নমনীয়তার সঞ্চার করিয়া তাহাকে সকল বিষয়, ভাব এবং রসের বাহন হইবার উপযুক্ত করিয়া তুলিলেন৷ মুখের ভাষা মনের ভাষা হইয়া গেল৷

তাহার পর চরিত্রসৃষ্টির কথা৷ প্রথমে বলিয়া রাখি যে, সাহিত্যে বাস্তবতা বলিলে বস্তুতন্ত্রতা বা realism নাও বুঝাইতে পারে৷ যে বস্তু (অর্থাৎ বিষয়, ব্যক্তি বা ভাব) ইতিহাসে সত্য নহে, তাহার ভাবের দিক দিয়া সত্য হইতে কোন বাধা নাই৷ বস্তুনিরপে‍ক্ষ ভাব বা আদর্শগত বাস্তবতা অর্থাৎ idealism সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য৷ বস্তুসাপে‍ক্ষ বিষয় বা ভাবকে সাহিত্যের‍ উপযোগিতা লাভ করিতে হইলে সাহিত্য-প্রতিভার পুটপাকে জারিত হইয়া সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে যাহা “রস’’ বলে তাহাতে পরিণত হইতে হইবে৷ তখন আর ইহা সাধারণ অর্থে বাস্তব বা realistic থাকিবে না, বস্তুসাপে‍ক্ষ হইয়াও বস্তুনিরপে‍ক্ষ আদর্শগত বাস্তবতা লাভ করিবে৷

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্র সবই বাস্তব,— এই অর্থে যে, ইহাদের মধ্যে বাঙালী মানুষের স্বভাবগত দোষগুণ জীবন্ত মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া “রস’’ বা অনির্ব্বচনীয় মাধুর্য্যে রূপায়িত হইয়া উঠিয়াছে৷ বঙ্কিমের অধি‍কাংশ উপন্যাসেই প্রতিনায়ক আছে, কিন্তু ইংরেজীতে যাহাকে বলে villain ঠিক সেই চরিত্র নাই বলিলেই হয়৷ প্লটের ঘটনাপ্রবাহে আবর্ত্ত তুলিয়াছে নায়িকা বা প্রতিনায়িকারা, প্রতিনায়কেরা নহে৷

বঙ্কিমচন্দ্র হইতে আরম্ভ করিয়া প্রায় সকল বাঙালী ঔপন্যাসিকের লেখাতে দেখা যায় যে পুরুষ অপে‍ক্ষা নারীচরিত্রই ফুটিয়াছে ভাল; প্লটে তাহাদেরই প্রাধান্য, পুরুষচরিত্রের নহে৷ ইহার কারণ বাঙালীর মানসিক জীবনের মধ্যেই মিলিবে৷ বৃহত্তর জীবনের সহিত বাঙালীর যোগ জাতি‍-হিসাবে নাই বলিলেই চলে; তাহার কল্পনা ঘরগৃহস্থালী ছাড়িয়া অল্প দূরই বিচরণ করিতে পারে৷ সুতরাং বাঙালী ঔপন্যাসিকের লেখনীচিত্রে যে আমাদের “সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী’’-রাই স্ফুটতর বিকাশ ও বর্ণসুষমা লাভ করিবে তাহাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত৷

(বানান অপরিবর্তিত)

শনিবারের চিঠি, ৫৩ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা