দেবী চৌধুরাণী থেকে প্রফুল্ল

দেবী চৌধুরাণী থেকে প্রফুল্ল

ইংরেজি ১৮৮২ সাল৷ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন উড়িষ্যা রাজ্যের জাজপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরের পদে আসীন৷ জাজপুরে থাকাকালীন বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরাণী’ রচনা করেন৷ এটি তাঁর দ্বাদশতম প্রকাশিত উপন্যাস৷ ততদিনে ঔপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে খ্যাতির শীর্ষে৷ অগণিত বাঙালি পাঠক-পাঠিকা ও সাহিত্যরসিকরা উচ্ছ্বসিতভাবে তাঁর উপন্যাসগুলো প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন৷ কিছু কিছু বিরূপ সমালোচনা হলেও প্রশংসাই বেশি৷

“এক দিবস কর্মক্লান্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয় কার্যসমাপনান্তে তাঁহার জাজপুরের গৃহে আহারাদির পর অর্ধনিমীলিতনেত্রে শয্যায় শয়ন করিয়েছিলেন৷ মাত্র কিয়দ্দিবস পূর্বে তিনি তাঁহার নূতন উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরাণী’ রচনা সমাপ্ত করিয়াছেন৷ সেই উপন্যাসটির কথাই তিনি চিন্তা করিতেছিলেন৷ শয়নক‍ক্ষে একটি ম্রিয়মান বর্তিকা প্রজ্জ্বলিত ছিল৷ এইমত সময়ে কাহার মৃদুপদশব্দে মহাশয়ের তন্দ্রাভঙ্গ হইল৷ তিনি শয্যা হইতে অর্ধউত্থিত হইয়া দেখিতে পাইলেন দ্বারপ্রান্তে এক স্ত্রীমূর্তি৷ বর্তিকার মৃদু আলোতে আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃত অলংকারবিহীন স্ত্রীলোকটি দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছে৷’’

দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের প্রচ্ছদ
দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের প্রচ্ছদ

চমকে‍ উঠে বঙ্কিমচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে ওখানে দাঁড়িয়ে?’ নারীমূর্তিটি খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি প্রফুল্ল৷’

‘প্রফুল্ল কে?’ বঙ্কিমবাবু বলেন,‘এত রাত্তিরে আপনি এখানে কী চাইছেন?’

‘আমি সেই প্রফুল্ল, যাকে আপনি দেবী চৌধুরাণী বানিয়েছেন’, স্ত্রীলোকটি উত্তর দিল৷

‘দেবী চৌধুরাণী!’বিস্ময় প্রকাশ করেন বঙ্কিমচন্দ্র৷ ‘তা তুমি এখানে কেন? তোমাকে তো আমি ব্রজেশ্বরের সঙ্গে তোমার শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি৷’

‘আমি আপনাকে কিছু বলতে এসেছি’,প্রফুল্ল বঙ্কিমবাবুর আর একটু কাছে এগিয়ে এসে বলে৷

‘কী বলবে বল৷’

‘আপনি আমার প্রতি ন্যায়বিচার করেননি৷ আমি আপনার কাছে এটা আশা করিনি৷’

‘ন্যায়বিচার করিনি?মানে?তুমি কী বলতে চাইছ?’

‘আমি বলতে চাইছি আপনি আমার প্রতি অবিচার করেছেন৷’

এবার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মেজাজ হারিয়ে ফেলেন৷ তিনি বলেন, ‘তোমার সাহস তো কম নয়? আমার মতো একজন ম্যাজিস্ট্রেট, যে কোনওরকমের অন্যায় সহ্য করে না, তাকে তুমি বলছ অবিচার করেছেন?’

‘আপনি অনর্থক আমার ওপর রাগ করছেন,বিনীতভাবে প্রফুল্ল বলে‍—‘আপনি ভাল করে ভেবে দেখুন তো, আমাকে আপনি প্রকৃত নারীর সম্মান দিয়েছেন কি না? আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, কী উদ্দেশ্যে আপনি আমাকে আবার ভূতনাথ গ্রামে জমিদার হরবল্লভের বাড়িতে পাঠিয়েছেন?’

‘আচ্ছা কথা বলছ তো তুমি’,বঙ্কিমবাবু অবাক হয়ে বলেন—‘স্বামীকে পেয়ে তুমি কি সুখী হওনি?তোমার কি ইচ্ছা ছিল তুমি আজীবন ডাকাতদলের সরদারনি হয়েই থেকে যাবে?’

‘না, সেরকম ইচ্ছা আমার একেবারেই ছিল না৷’

‘তবে তুমি কী চেয়েছিলে?’

‘আমি চেয়েছিলাম, আমার নারীজীবন সার্থক করতে৷’

‘তাই তো আমিও করতে চেয়েছি৷’

‘কিন্তু আপনি তা করেননি৷’

প্রফুল্ল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘কিছু বলছেন না কেন? আপনি যা যা আমাকে দিয়েছেন, একজন নারীর জীবনে তাই কি একমাত্র কাম্য? ধন? ঐশ্বর্য? সম্পদ? ক্ষমতা? শ্রদ্ধা? এই কি সব? আর কোনও বাসনা কি তার থাকতে পারে না?’

প্রফুল্লর কথা শুনে বঙ্কিমচন্দ্র ক্ষুব্ধ হলেন৷ তিনি বললেন, ‘দেখ প্রফুল্ল, তুমি ছিলে গ্রামের দরিদ্রমায়ের পিতৃহীনা অশিক্ষিতা সন্তান৷ শ্বশুরবাড়িতে তোমার স্থান হল না৷ তারপর তুমি মাকেও হারালে৷ তোমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে ফুলমণি নাপিতানি তোমাকে শয়তান দুর্লভচন্দ্রের হাতে তুলে দেয়৷ আমি তার হাত থেকে তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাই বৃদ্ধ কৃষ্ণগোবিন্দ গোঁসাই-এর ভগ্ন অট্টালিকায়৷ তার মৃত্যুতে ওই বোষ্টমের সঞ্চিত বিপুল ধনরত্নের সন্ধান পেলে৷ তারপর তুমি সেই সম্পদের অধিকারী হয়েছিলে৷ তারপর কী করেছি? তোমাকে সকল রকমের শি‍ক্ষা দেওয়ার জন্য এনেছি ভবানী পাঠককে৷ ভবানী নিষ্ঠাভরে সে কাজ করেছে‍৷ ঈশ্বরপ্রদত্ত রূপ ছিল তোমার৷ সেই রূপ, ভবানীর শি‍ক্ষা আর তোমার প্রাপ্ত ধনরত্ন সব নিয়ে তুমি এক অসামান্যা নারীতে পরিণত হয়েছ৷ আরও আছে৷ এরপর তোমাকে দিয়েছি অসীম ক্ষমতা৷ সাধারণ এক গ্রাম্য নারী রূপান্তরিত হয়েছে অসামান্যা দেবী চৌধুরাণীতে৷ আর তুমি বলছ তোমার নারীজীবন সার্থক হয়নি?’

প্রফুল্ল মুখ নীচু করে সমস্ত কথা শুনে বলল,‘আপনি যা বলেছেন আমি তার বিরুদ্ধতা করছি না৷ কিন্তু এ সমস্ত কিছু কি আমার নারীজীবনকে সার্থক করেছে‍?’

‘কেন নয়?’ বঙ্কিমবাবু উত্তেজিত হয়ে বলেন—‘দশ হাজার লোক তোমার একটি ইশারায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত৷ তোমার পায়ের ধুলোর একটি কণা পেলে তারা তাদের জীবন ধন্য মনে করে৷ রঙ্গরাজের মতো এক দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল তোমার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে৷ এসব কি কিছু নয়?’

‘আপনি যা বলছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি’,প্রফুল্ল বলে‍—‘কিন্তু আপনিই বলুন, একজন নারীর জীবনে এর চেয়ে বেশি পাওয়ার কি কিছু নেই?’

“সাহিত্যসম্রাট এই স্ত্রীলোকটির বাক্য শ্রবণ করিয়া কিঞ্চিৎ ক্রুদ্ধ হইলেন৷ তিনি চিন্তা করিলেন স্ত্রীজাতির লালসার সীমা নাই৷ এত কিছু লাভ করিবার পরেও সে বলিতেছে ‘ইহার চাইতে অধিক আর কিছু পাইবার নাই?’ কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব স্থির করিলেন এই প্রগলভা স্ত্রীলোকটির সহিত বাক্যালাপ করিয়া সময়ের অপচয় করা বৃথা৷ তিনি নীরব হইয়া রহিলেন৷’’

প্রফুল্ল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘কিছু বলছেন না কেন? আপনি যা যা আমাকে দিয়েছেন, একজন নারীর জীবনে তাই কি একমাত্র কাম্য? ধন? ঐশ্বর্য? সম্পদ? ক্ষমতা? শ্রদ্ধা? এই কি সব? আর কোনও বাসনা কি তার থাকতে পারে না?’

বঙ্কিমচন্দ্র এবার একটু শান্ত হয়ে বললেন, ‘শোন প্রফুল্ল৷ আমি তোমার জন্য কি না করেছি? তোমার শ্বশুর হরবল্লভ অপমান করে তোমাকে তাঁর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ তুমি তার মধুর প্রতিশোধ নিয়েছ৷ তোমার স্বামী ব্রজেশ্বর বাবার ভয়ে ইচ্ছা থাকলেও তোমাকে বাড়িতে ডেকে আনতে পারেনি৷ শেষপর্যন্ত সেও তোমার হাতে‍-পায়ে ধরে পুনর্বিবাহের ছল করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছে৷ সেখানে গিয়ে তুমি সকলের প্রিয়পাত্রী হয়ে ঘরসংসার করেছ৷ তাও তুমি সন্তুষ্ট নও?’

প্রফুল্ল এবার হেসে ফেলে৷ সে বলে, ‘আপনার মতে আমার ঘরসংসার করা মানে সতীন নয়নতারার ছেলেদের দেখাশোনা করা, বাসন মাজা আর রান্না করা৷ তাই নয় কি?’

‘কী বলছ তুমি?’

‘তাহলে আপনি সাগরের মুখেই শুনুন, ‘যার হুকুমে দুই হাজার লোক খাটিত, এখন হরির মা, পারির মার খবরদারি কি তার ভাল লাগিবে?’’ সেই সাগরই নতুন বউকে দেখতে পেল “প্রফুল্ল পিছন ফিরিয়া বাসন মাজিতেছিল৷’’ আবার আপনি বলেছেন, “ব্রহ্মঠাকুরাণীও রান্নাঘরের কর্তৃত্ব প্রফুল্লকে ছাড়িয়া দিলেন৷’’ অর্থাৎ আপনার ভাষায় অসামান্য নারী দেবী চৌধুরাণী যার অধিকারে অতুল সম্পদ আর অসীম ক্ষমতা সে শ্বশুরবাড়ি ফিরে এল বাসন মাজতে আর রান্না করতে৷ আপনার মতে এটাই হল প্রফুল্লর সংসারজীবন৷বাসন মাজা, রান্না করা আর সতীনের ছেলেদের আদরযত্ন করা৷ তাই নয় কি?’

‘তুমি আমায় ভুল বুঝেছ প্রফুল্ল’, এবার বঙ্কিমবাবুর গলার স্বর কিছুটা নীচু৷

কী বার্তা দিল এই নারী? আমি কি সত্যিসত্যিই প্রফুল্লর প্রতি‍ অবিচার করিয়াছি? দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরিয়া আমি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ অলংকৃত করিয়া আছি অদ্যাবধি ঈদৃশ অপবাদ তো কেহ কখনও আমাকে দেয় নাই৷ আর এই সামান্য নারী প্রফুল্ল যথেচ্ছভাবে আমার ভুলভ্রান্তি প্রদর্শন করিতেছে?

‘আমি ভুল বুঝিনি’,প্রফুল্ল বলে‍—‘আপনি নিজে একথাও লিখেছেন, “প্রফুল্ল সংসারে আসিয়াই যথার্থ সন্ন্যাসিনী হইয়াছিল৷’’ কিন্তু আমি তো সন্ন্যাসিনী হতে চাইনি! রান্না করতে, বাসন মাজতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই৷ সন্ন্যাসিনী হতে যাব কেন? সেজন্য তো আমি স্বামীর হাত ধরে তাঁর ঘরে আসিনি? সন্ন্যাসিনী যদি হব তবে ডাকাতদলের সরদারনি হয়ে থাকতে দোষ কী ছিল? আমার মনে হয় আপনি দেবী চৌধুরাণীকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রফুল্লকে খুব হালকাভাবে নিয়েছেন৷ আপনি নিজেই একবার বলেছিলেন যে, দেবী চৌধুরাণী চরিত্রসৃষ্টির মূল লক্ষ্য ছিল অনুশীলনতত্ত্বের জয়গান৷ বেশ তো, সেটা না হয় মেনে নিলাম৷ তাহলে আপনি প্রফুল্লকে টানাহ্যাঁচড়া না করে দেবী চৌধুরাণীকে দিয়ে শুরু করে দেবী চৌধুরাণীতেই শেষ করতে পারতেন৷’

‘হুঁ, বুঝলাম’,বঙ্কিমবাবু এবার গম্ভীর গলায় বলেন, ‘তুমি স্পষ্ট করে বল দেখিনি তুমি কী চাইছিলে?’

‘আমি আগেই আপনাকে বলেছি’, প্রফুল্ল বলে‍—‘আমি চাইছিলাম সংসারধর্ম পালন করে আমার নারীজন্ম সার্থক করতে৷ আমি চেয়েছিলাম স্ত্রী হতে, গৃহিণী হতে, সন্তানের জননী হতে৷ আমি প্রশংসা চাইনি, চেয়েছিলাম প্রেম, ভালবাসা, সোহাগ৷ আর আপনি কী করলেন? রক্তমাংসের প্রফুল্লকে সংসারে এনেও বসিয়ে দিলেন দেবীর আসনে, দোষেগুণে নারীরূপে নয়! আপনি বললেন, “এসকল অন্যের প‍ক্ষে আশ্চর্য বটে, কিন্তু প্রফুল্লর প‍ক্ষে আশ্চর্য নহে, কেন না প্রফুল্ল নিষ্কামধর্ম অভ্যাস করিয়াছিল৷ প্রফুল্ল সংসারে আসিয়াই যথার্থ সন্ন্যাসিনী হইয়াছিল৷ তাহার কোন কামনা ছিল না৷’’ এসব কথা লেখার আগে কি আপনি প্রফুল্লর মনের ভেতর প্রবেশ করেছিলেন? আপনি কী করে জানলেন যে প্রফুল্লর কোনও কামনা ছিল না৷ প্রফুল্ল যতই নিষ্কামধর্মের অভ্যাস করুক সে তো একজন রক্তমাংসে গড়া নারী৷ তার মাতৃস্নেহের ধারাকে আপনি ঠেলে দিলেন সতীন নয়নতারার ছেলেদের দিকে৷’

‘এ কথা বলছ কেন তুমি?আমি তো প্রফুল্লকে পুত্র-পৌত্র সব দিয়েছি৷’

‘তা দিয়েছেন বটে, তবে সেটা দায়সারা ভাবে৷ প্রফুল্লর সংসারজীবন বিবৃত করেছেন একটিমাত্র লাইন দিয়ে, “যথাকালে পুত্রপৌত্র সমাবৃত হইয়া প্রফুল্ল স্বর্গারোহণ করিল৷’ ব্যস!প্রফুল্লকে স্বর্গে পাঠিয়ে আপনি আত্মতুষ্টি লাভ করিলেন৷’

এবার বঙ্কিমবাবুর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোয় না৷ তিনি চুপ করে থাকেন৷ প্রফুল্ল বলে, ‘আমি চেয়েছিলাম স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখে ঘরকন্না করব৷ আর দশজন মেয়ের মতোই সুখে‍-দুঃখে দিন কাটাব৷ আর আপনি কী করলেন? আমাকে একেবারে অবতার বানিয়ে দিলেন, “পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্‌৷ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে৷’’

ভাবলাম এক আর হল অন্য’, কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রফুল্ল ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷

“সাহিত্যসম্রাট তখন চক্ষুমুদ্রিত করিয়া চিন্তা ক‍রিতেছিলেন৷ প্রফুল্লর প্রস্থান তাঁহার দৃষ্টিগোচর হয় নাই৷ চিন্তা করিতে করিতে তাঁহার চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিল৷ কী বার্তা দিল এই নারী? আমি কি সত্যিসত্যিই প্রফুল্লর প্রতি‍ অবিচার করিয়াছি? দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরিয়া আমি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ অলংকৃত করিয়া আছি অদ্যাবধি ঈদৃশ অপবাদ তো কেহ কখনও আমাকে দেয় নাই৷ আর এই সামান্য নারী প্রফুল্ল যথেচ্ছভাবে আমার ভুলভ্রান্তি প্রদর্শন করিতেছে? কিঞ্চিৎ চিন্তা করিয়া তিনি ঈষৎ চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখিলেন প্রফুল্ল নাই৷ সে চলিয়া গিয়াছে৷ তিনি মনে মনে চিন্তা করিয়া দেখিলেন যে, এই রমণী যাহা বলিয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে কিয়দংশ সত্যতা আছে৷ এই কথাটা তিনি অস্বীকার করিতে পারেন না যে, প্রফুল্লকে পুনর্বিবাহ করিয়া ব্রজেশ্বর যখন গৃহে প্রত্যাবর্তন করিল তখন তিনি ঘটনাবিন্যাসের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিনিক্ষেপ না করিয়া দ্রুত বিষয়টির সমাপ্তি ঘটিয়েছেন৷ স্বামীগৃহে আগমনের পর প্রফুল্লর নারীসত্তা বিকাশের সুযোগ না দিয়াই তাহাকে স্বর্গারোহণে প্রেরণ করিয়াছেন৷ তবে কি সত্যিই তিনি প্রফুল্লর নারীজীবন সার্থকতার পথে অন্তরায় হইয়াছেন৷ এইমত ভাবিয়া সাহিত্যসম্রাট বিচলিত হইয়া পড়িলেন৷ ইহা যে তাঁহার উজ্জ্বল ম্যাজিস্ট্রেট জীবনে কলঙ্ক হইয়া থাকিবে! তিনি কী করিবেন স্থির করিতে না পারিয়া পুনরায় আরম্ভ হইতে সমাপ্তি পর্যন্ত উপন্যাসটির পর্যালোচনা করিতে আরম্ভ করিলেন৷ তাঁহার চিত্তে কতিপয় ভাবনার উদয় হইল৷ স্থির করিলেন যে উপন্যাসটির অন্তভাগে কতক পরিবর্তন করিবেন৷ এইমত চিন্তা করিতে করিতে তাঁহার স্মরণ হইল যে, দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসটির মূল পাণ্ডুলিপি তাঁহার নিকট নাই৷ রচনাটি সমাপ্ত হইবামাত্র তিনি উহা তাঁহার অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্রের নিকট কলিকাতায় প্রেরণ করিয়াছেন৷ ইহাও বঙ্কিমচন্দ্রের স্মরণ হইল যে মাত্র কিয়দ্দিবস পূর্বে অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র পত্রদ্বারা তাঁহাকে অবগত করিয়াছন যে, উপন্যাসটি অতীব উত্তম হইয়াছে এবং বঙ্গদর্শন পত্ৰিকায় প্রকাশের নিমিত্ত তিনি পাণ্ডুলিপিটি ছাপাখানায় দিয়াছেন৷ অচিরাৎ পত্রিকাটি‍ ছাপাখানা হইতে ছাপার অক্ষরে নির্গত হইয়া আসিবে৷’’

সাহিত্যসম্রাট এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন৷ বেচারি প্রফুল্ল!

 

শনিবারের চিঠি, ৫৩ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা