ভদ্রলোকের দুর্ভাগ্য যে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মেঘনাদবধ কাব্য, এমনকী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের মতো উঁচু পর্দায় অবস্থান করেন না এখন৷ নইলে তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পূর্তিতে একটু হইচই করে নিতাম৷ তিনি সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস, জন্ম ১৮৬১, নদিয়ার নাথপুরে৷ চেনা যাচ্ছে না তো মানুষটিকে— তবে তাঁর পদমর্যদাটি জুড়ে দিই—কর্নেল, কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস৷ একটা তাজ্জব লাগানো জীবন৷
কলকাতায় লন্ডন মিশনারির এই ছাত্রটি পড়াশোনার চেয়ে গোঁয়ারগোবিন্দ হিসেবে এবং দাদাগিরির কারণেই খুব পরিচিত হয়ে পড়েছিলেন৷ বাবার সঙ্গে রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে বসলেন৷ ভাবলেন তিনি, ঘর যখন ছেড়েছি, তখন দেশে কেন থাকব! স্পেন্সর হোটেলে সামান্য একটা চাকরি জোগাড় করে সোজা রেঙ্গুনে চলে এলেন৷ চরম দুঃসাহসী সুরেশচন্দ্র সেখানে মগ ডাকাতদের হাত থেকে এক মহিলাকে বাঁচিয়ে সেখানকার মানুষজনের নজর কেড়ে নিলেন৷ কলকাতায় তারপরে ফিরে এলেন বটে, কিন্তু চাকরি হল না৷ অন্নচিন্তা চমৎকারা—পেটের ধান্দায় চলে এলেন ইংল্যান্ডে জাহাজের এক ক্যাপ্টেনের সাহায্য পেয়ে৷ বয়স মাত্র সতেরো— তখনও বাঙালির বুকে আঠারো নেমে আসেনি৷ তারপর কর্মজীবনের বৈচিত্র্যের তিনিই হিসেব রাখতে পারতেন কিনা জানি না৷ পড়াশোনা না করলেও বুদ্ধির কিছুমাত্র কমতি ছিল না৷ তাই ইতি-উতি চাকরির ফাঁকে রসায়ন, গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যায় বেশ দখলদার হয়ে উঠলেন৷ আর যেটা শিখলেন—তার নাম ম্যাজিক৷ বাকি জীবনটা এই জাদুর মায়াতেই জগৎকে বশীভূত করে রাখলেন৷ ওই জাদুতেই একজন নন, দু-দু’জন মহিলা তাঁর জীবনে ফসল ফলাতে এসে গিয়েছিলেন৷
সিংহের খাঁচার মধ্যে ঢুকে তার সঙ্গে কুস্তি করা! হাততালিতে সার্কাসের তাঁবু আলোড়িত হতে থাকল প্রতিটি শোয়ে৷ সুরেশ নিজের সাফল্যের কথা লিখে পাঠালেন দেশে কৈলাসকাকাকে৷ মায়ের অভাব এই দূরদেশে বসে তিনি খুব অনুভব করতেন৷
এর পরের জীবন সাপ্তাহিক মাইনের চুক্তিতে সার্কাস দলে চাকরি নেওয়া৷ একটা ছোটখাটো কালো বাঙালি যখন সার্কাসের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে সার্কাসে যোগ দিতে ইচ্ছে প্রকাশ করলেন—তখন তো তিনি ভিতরে ভিতরে হেসে কুটিকুটি৷ কিন্তু সুরেশ বললেন—তিনি ভিনি ভিসি ভিডি— এলাম, দেখলাম, জয় করলাম৷ এখন সুরেশের জীবন সার্কাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেল৷ জীবনেও দেখা দিল ট্রাপিজের খেলা৷ কেন্ট প্রদেশে আগত এই সার্কাস দলের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়ে গেল৷ তিনি যে হোটেলে থাকতেন, সার্কাসের লোকেরা সেখানে প্রায়ই গল্পগুজব, আড্ডা দিতে আসতেন৷ সেই সূত্ৰেই আলাপ জমে উঠল৷ সার্কাসের রোমাঞ্চকর জীবন তাঁকে হাতছানি দিতে লাগল৷ ফেরিওয়ালার চাকরি তাঁর আর ভাল লাগল না৷ বাইরের দিক থেকে দেখলে সার্কাসে যোগ দেওয়ার যোগ্যতা তাঁর ছিল না৷ কিন্তু নিয়মিত ব্যায়ামে তাঁর শরীরের গঠন লোহার মতো কঠিন এবং আঘাতসহ হয়ে উঠেছিল৷ সার্কাস দলের সবসেরা খেলোয়াড়ের কাছে তাঁকে পরীক্ষা দিতে হল৷ দু’জনে কুস্তি লড়লেন এবং দশ মিনিটের মধ্যে সুরেশ প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে দিলেন৷ অতএব সার্কাসের দলে যোগ দিতে তিনি আহূত হলেন৷ মাইনে ঠিক হল, সপ্তাহে পনেরো শিলিং তার উপরে খাওয়ার খরচ সব৷ অন্য খেলোয়াড়রা আরও বেশি মাইনে পেতেন৷ কিন্তু শুরুতে তা নিয়ে সুরেশ তর্ক না করে ঢুকে পড়লেন৷ সস্তায় এক ভারতীয়কে পেয়ে ম্যানেজার একটা দাঁও মেরে নিলেন৷ তিনি বিজ্ঞাপন দিলেন আর প্রতিদিন কাতারে কাতারে লোক খেলা দেখতে আসতে লাগলেন৷ কী সে খেলা? সিংহের খাঁচার মধ্যে ঢুকে তার সঙ্গে কুস্তি করা! হাততালিতে সার্কাসের তাঁবু আলোড়িত হতে থাকল প্রতিটি শোয়ে৷ সুরেশ নিজের সাফল্যের কথা লিখে পাঠালেন দেশে কৈলাসকাকাকে৷ মায়ের অভাব এই দূরদেশে বসে তিনি খুব অনুভব করতেন৷ এখন তাঁর মাইনে বেড়েছে, ভাল জামাকাপড় পরেন, ভদ্রসমাজে মেশেন—তাঁর এত সুখ যদি মা নিজের চোখে দেখতেন!
এখন সুরেশ যৌবনরসে ভরপুর৷ সার্কাস দলের মেয়েদের সঙ্গেও গল্পগুজব করেন৷ কিন্তু জার্মান মেয়েটি যেন একটু আলাদা সবার থেকে, ইংরেজিও বেশ ভাল বলেন৷ তাঁর সঙ্গে মনের কথা বলেন৷ দু’জনেই নিজের দেশ ছেড়ে দূরে—সুরেশ তাঁকে তাঁর দেশের কথা, বাবা-মা সবার কথা জিজ্ঞাসা করেন—কিন্তু ভিতরে কোনও ব্যথার কারণে তিনি কাউকেই নিজের কথা বলতে চাইতেন না৷ খুব গম্ভীর হয়ে উঠতেন৷ একটা মর্যাদাবোধ, একটা আভিজাত্য বালিকাটিকে ঘিরে থাকত৷ সুন্দরী তো অবশ্যই, কিন্তু তাঁর ঘনকৃষ্ণ চুল যেন সুরেশকে বেশি আকর্ষণ করত৷ তাঁরা শুধু দু’জনে যখন থাকতেন— তখন কিন্তু তাঁর চোখে প্রেমের স্বপ্ন উচ্চারিত হয়ে যেত৷ কিন্তু উচ্ছ্বাস দমন করতেন দু’জনেই৷ অবকাশ পেলেই সুরেশের মনে তাঁর কথাই বার বার ছবি হয়ে উঠত৷ প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে— কখন যে তাঁরা তাতে ধরা পড়ে গিযেছিলেন কেউ জানে না!
একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যাতে বালিকাটির পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ল৷ সুরেশ একদিন বাজার থেকে টুকিটাকি জিনিস কিনে এনে ঘরে রেখেছেন, জার্মান কিশোরীটি সেগুলির গুছিয়ে রাখতে গিয়ে দেখলেন একটি জিনিস একটি পুরনো খবরের কাগজে জড়ানো৷ সেটি বার করে রেখে সেই পুরনো কাগজটা পড়তে গিয়ে একটা বিজ্ঞাপনে তাঁর চোখ আটকে গেল৷তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী জননী নিরুদ্দিষ্টা কন্যাকে মৃত্যুর আগে একবার ফিরে আসার জন্য কাতর প্রার্থনা জানিয়েছেন৷ কাগজটি হাতে নিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে তিনি হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন৷ সুরেশ তা দেখে তাঁর হাত দুটি ধরে সপ্রেমে সান্ত্বনা দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন৷ তিনি আরও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তাঁর বুকে মুখ লুকিয়ে কাগজটি সুরেশের হাতে তুলে দিলেন৷ সেটি পড়ে বুঝতে পারলেন কিশোরী সার্কাসে যোগ দিতে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন৷
আর ওই কিশোরীটিকে কেউ আটকে রাখতে পারলেন না৷ সবার কাছে বিদায় নিয়ে তিনি মায়ের কাছে ফিরে গেলেন৷ সুরেশ, বিরহী সুরেশ— তাঁকে লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এগিয়ে গেলেন৷ বন্দরে পৌঁছে তাঁর চোখে বাঁধ না-মানা অশ্রুরাশি দৃষ্টিকে করে দিল অস্বচ্ছ৷ চোখের জলে স্নান করে জাহাজ ছেড়ে গেল জার্মানির উদ্দেশ্যে৷ দু’জনের বুকে তখন অশ্রুলবণাক্ত বিচ্ছেদের সমুদ্রতরঙ্গ৷ ঘর গড়ার স্বপ্ন সেই ঢেউয়ের আঘাতে খান খান হয়ে গেল৷
সুরেশচন্দ্র তখন জগদ্বিখ্যাত হয়ে পড়েছেন হিংস্র বনের পশুকে বশ মানানোর কসরতে৷ আফ্রিকার সিংহ দম্পতি তাঁর কাছে সারমেয়৷ তাঁর খ্যাতি গিয়ে পৌঁছল আর এক পশু বশকারী প্রোফেসর জামবাকের কানে৷ দু’জনে কাছাকাছি এলেন লন্ডন শহরেই৷ জামবাক তাঁকে আপন শিষ্য হিসেবে বরণ করে নিলেন৷ সম্পূর্ণ শিক্ষিত হয়ে সুরেশ আবার সার্কাসদলে যোগ দিলেন৷ এবার তাঁর খেলা আরও উত্তেজক, আরও লোমহর্ষক৷ঘুরতে ঘুরতে তাঁর দল জার্মানির হামবুর্গ শহরে হাজির৷ এমনিতে সুরেশ মন থেকে সেই জার্মান কিশোরীকে সরিয়ে রাখতে পারেননি৷ যদি আবার দেখা হয়ে যায়৷ সত্যিই দেখা হয়ে গেল একটি শহরে৷ একদৃষ্টে দু’জনে তাকিয়ে রইলেন, মুখে কোনও কথা নেই৷ শুধু দু’জনের হাত এগিয়ে সব কথা, না-জানানো হাজার প্রেমের বাণী বৃক্ষতলকে মথিত করতে লাগল৷ গভীর চুম্বনের আশ্লেষে দু’জনে হারিয়ে গেলেন সেদিনের বিদায়ক্ষণে৷
তারপর প্রায়ই দেখা৷ শেষ পর্যন্ত অভিসারিকা গোপনে প্রতিদিনই সুরেশের আবাসে আসতে থাকলেন—“দূতের পন্থা গমনে ধনী সাধয়ে মদিরে যামিনী জাগি৷’ এবং অনিবার্য পরিণাম ঘটে গেল৷ জার্মানিতেও কন্যার কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ব্যাভিচারিণী হিসেবে৷ যুবতীর পরিজনবর্গ সুরেশের প্রাণনাশের চেষ্টা করতে লাগলেন৷ সুরেশের আর জার্মানিতে থাকা সম্ভব হল না৷ শুধু জার্মানি নয়— গুপ্তহত্যাকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ইউরোপ থেকেই তাঁকে বিদায় নিতে হল৷ দূর আমেরিকায় তিনি চলে গেলেন৷ ঘর-বাঁধার স্বপ্ন এবারেও ছত্রখান৷ অতি বড় সুন্দরী আর বর পেলেন না৷
এত বাঘ-সিংহকে বশ করেছে যে অকুতোভয় হৃদয়, তিনি কি পরাজয় মেনে অন্তরালবর্তী হয়ে যাবেন? অতএব মেলামেশা দ্রুত বদলে যেতে লাগল বন্ধুত্বে, বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ঘনিষ্ঠতায়৷ ব্রাজিলে পুরুষদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা সেখানকার রমণীদের পক্ষে শোভন ছিল না— বাঁধভাঙা স্রোতে সব সামাজিক নিয়ম এলেমেলো হয়ে যেতে তাকল৷ পঞ্চশরের ক্রিয়া শুরু হল— শ্বেতবর্ণের ডেসডিমোনা এসে সুরেশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন৷
ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে— প্রকৃতি শূন্যতা পরিহার করে— নেচার এভরস ভ্যাকুয়াম৷ প্রেমও কি তাই করে! নিশ্চয়ই তাই করে৷ নইলে ইউরোপ ত্যাগ করে ঘুরতে ঘুরতে সুরেশচন্দ্র ব্রাজিলে এসে পৌঁছবেন কেন? এখন তিনি আগের সার্কাস দল ছেড়ে দিয়ে ওয়েল সাহেবের সুখ্যাত পশু প্রদর্শনীর দলে যোগ দিয়েছেন আর সেই দলের সঙ্গে আমেরিকায় এসে হাজির হয়েছেন৷ এখানেও তিনি চূড়ান্ত সম্মান পেতে লাগলেন৷ প্রায় সব কাগজের শিরোনামে তিনি৷ ঘুরতে ঘুরতে মেক্সিকো ঘুরে দক্ষিণ আমেরিকার সুপরিচিত ব্রাজিলে এসে উপস্থিত— এই প্রথম কোনও বঙ্গসন্তান এ দেশের মাটিতে পা রাখলেন৷ কালো-সাদা-মেটে মানুষের দেশে এসে তিনি খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলেন৷ শুধু পশু বশের খেলা দেখাতেন না— সুন্দর সুন্দর বক্তৃতাও করতেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি তাঁর ছিল না বটে, কিন্তু সমস্ত বিষয়ে তাঁর মতো শিক্ষিত মানুষ কদাচিৎ দেখা যেত৷ ইংরেজি ছাড়া জার্মান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, ইটালিয়ান, ড্যানিশ এবং ডাচ ভাষায় তাঁর অধিকার ছিল বিস্ময়কর৷ একদিকে দর্শন শাস্ত্র আর অন্যদিকে রসায়ন এবং গণিতে তাঁর অধিকর ছিল চমকপ্রদ৷ আর একটা কবিমনেরও অধিকারী তিনি৷ প্রেমিকমাত্রেই তো কবি৷
তাই ১৮৮৫ সালে ব্রাজিলে এসেই দেশটাকে একেবারে ভালবেসে ফেললেন৷ ঠিক করলেন বাকি জীবনটা এই সুন্দর দেশটাতেই কাটিয়ে যাবেন বাড়ি-ঘরদোর বানিয়ে৷ সুযোগও এসে গেল৷ ব্রাজিলের রয়্যাল পশুশালার পরিদর্শক ও রক্ষকের শূন্যপদে তিনি অধিষ্ঠিত হলেন৷ একদিন ঘটনাচক্রে ব্রাজিলের এক স্থানীয় সার্জেনের মেয়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়ে গেল৷ এবং যাকে বলে প্রথম দর্শনেই প্রেম৷ সুরেশ উচ্ছ্বসিত কিন্তু ব্রাজিল কন্যা খুবই সংযত৷ হিংস্র পশু তিনি পোষ মানাতে পারেন৷ কিন্তু পাখি পোষ মানানোর বিদ্যাটা এখনও বুঝি রপ্ত হয়নি৷ ধরা দেব-দেব করেও তিনি ধরা দিতে চান না— যদিও পথে-ঘাটে, গাড়িতে, নানা দোকানে, বন্ধুর বাড়িতে— সর্বত্র তাঁদের মেলামেশা চলছিলই৷ রোমান্সের ব্যাপারে সাধারণত মেয়েরাই এগিয়ে থাকেন৷ এই কুমারী কিন্তু গভীর এবং গম্ভীর৷ কিন্তু কৃত্রিম জলের বাঁধ আর কতদিন টিকে থাকবে? এত বাঘ-সিংহকে বশ করেছে যে অকুতোভয় হৃদয়, তিনি কি পরাজয় মেনে অন্তরালবর্তী হয়ে যাবেন? অতএব মেলামেশা দ্রুত বদলে যেতে লাগল বন্ধুত্বে, বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ঘনিষ্ঠতায়৷ ব্রাজিলে পুরুষদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা সেখানকার রমণীদের পক্ষে শোভন ছিল না— বাঁধভাঙা স্রোতে সব সামাজিক নিয়ম এলেমেলো হয়ে যেতে তাকল৷ পঞ্চশরের ক্রিয়া শুরু হল— শ্বেতবর্ণের ডেসডিমোনা এসে সুরেশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন৷ সুরেশের কাছে বসে তাঁর বীরত্বের কাহিনি শুনতে শুনতে ডেসডিমোনার হৃদয় তরঙ্গায়িত হতো, গণ্ডদেশ ক্ষণে ক্ষণে রক্তবর্ণ ধারণ করত, চোখ ক্রমাগত বিস্ফারিত হত— একটা দিব্য জ্যোতিতে সমস্ত আনন প্রোজ্জ্বল হয়ে হয়ে উঠত৷
একদিন কথায় কথায় সুন্দরী একটা আবদার করে বসলেন—তোমাকে আমি মিলিটারি পোশাক পরা অবস্থায় দেখতে চাই৷ একটা তিলের জন্যে বাবর সমরখন্দ বাজি রাখতে চেয়েছিলেন, আর এ তো সামান্য একটা পোশাকের আবরণ৷ এই আবদারেই সুরেশচন্দ্রের জীবনে আবার পরিবর্তন এল৷ তিনি সামরিক বিভাগে যোগদানের জন্য আবেদন করলেন৷ আবেদন মঞ্জুর হল— তিনি রাজকীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন৷ সাতটি ভাষায় পারঙ্গম এই সৈনিকটি ১৮৮৭ সালের মধ্যে সান্তাক্রুজে এক সেনাদলের নায়ক— কর্পোরাল পদে উন্নীত হলেন৷ সেকান থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শিতার জন্য রিয়ো-ডি-জেনেরোর হাসপাতালের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে৷ এর মধ্যে মিলিটারি নিয়মের তিন বছরের বন্ডের কার্যকাল শেষ হল৷ তবুও ওই বিভাগ ছেড়ে যেতে চাইলেন না এবং নাথেরয়-এর যুদ্ধে ব্রাজিলের অনিবার্য পতনকে রুখে তিনি বীরের সম্মান পেলেন৷
সুন্দরীর সঙ্গে এ সময় তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল— কিন্তু মনের তন্ত্রীতে প্রেমের সঙ্গীত নিত্য মূর্ছিত হত৷ এখন আর বাধা নেই৷ স্বাধীন ব্রাজিলে ব্রাজিল-কন্যাকে তিনি একান্ত করে আপন ঘরে পেলেন৷
তারপর তাঁদের সুখের সংসার আলো করে তিনটি পুত্র ও একটি কন্যার আবির্ভাব ঘটল৷ সংসার যখন উছলে পড়ার কথা, তখনই জীবনের এত আলো হঠাৎ করে নিভে গেল৷ ১৯০৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যখন সুরেশচন্দ্রের মৃত্যু ঘটল তখন তিনি মাত্র চুয়াল্লিশ৷ এই বয়সেই দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে গেল৷
ভারতে সুরেশচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ আসতে সময় লেগেছিল চুয়াল্লিশ মাস৷ জানি না শ্রীমতী বিশ্বাসের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন কিনা৷ কিন্তু আমরা অনুমান করি তাঁর প্রেমের বিশ্বাস চিরকালই অটুট ছিল৷
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪১৯