পর্ব-৩
মুক্তমনা পিরালি ব্রাহ্মণ দ্বারকানাথ
পিরালি ব্রাহ্মণেরা সকলেই নিজেকে উচ্চশ্রেণির সদাচারী ব্রাহ্মণরূপে প্রমাণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। ঠাকুরবাবুরা তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। দর্পনারায়ণ ঠাকুর ও গোপীমোহন ঠাকুর অবশ্য ভিন্ন পথে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। আর ব্যতিক্রম ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তাঁরও এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। কেবল ইংরেজ নয়, দরিদ্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে বা তাদের সঙ্গে মিশতে দ্বারকানাথের কোনও দ্বিধা ছিল না। দ্বারকানাথ যখন কলকাতা শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম একজন এবং ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে ধনীরূপে সুপরিচিত তখনকার সময়ের একটি গল্পের কথা লিখেছেন প্রাণকৃষ্ণ দত্ত।
প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখেছেন চিৎপুর রোড থেকে নিমতলা স্ট্রিটে প্রবেশ করে উত্তরদিকে বসুদের যে পুরনো বাড়ি ছিল সেই বাড়ির পূর্বদিকের বাড়িতে অভয়চরণ মিত্র নামে এক ব্যক্তি থাকতেন। অভয়চরণ ছিলেন দ্বারকানাথের বাল্যকালের সহপাঠী। একদিন অভয়চরণ তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে তামাক খাচ্ছিলেন। অভয়চরণের বাড়িটি ছিল রাস্তার ওপরে, সেই রাস্তা ধরে দ্বারকানাথ তাঁর জুড়ি গাড়ি চেপে যাচ্ছিলেন। দ্বারকানাথ গাড়ি থেকে বাল্যবন্ধুকে দেখতে পেয়ে অভয়চরণের কাছে যান। তখন অভয়চরণ ব্যস্ত হয়ে দ্বারকানাথের আসন আনতে যাচ্ছিলেন। দ্বারকানাথ তাঁর হাত ধরে বাধা দিয়ে বন্ধুর পাশেই বসলেন। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখেছেন ‘বন্ধু ব্রাহ্মণের হুঁকা আনিতে চাহিলে তাহাতেও বাধা দিয়া বলিলেন, কেন ভাই, আমি চলিয়া গেলেই ত তুমি হুঁকাটী ভাঙ্গিয়া ফেলিবে, আমার কি সে আক্কেল নাই, একটু কলাপাতা আন। পরে কলাপাতার ঠোঙ্গায় তামাক খাইতে খাইতে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত পরস্পরের কুশলাদি জিজ্ঞাসা ও গল্পগুজব হইয়াছিল।’
এই ছোট ঘটনাটি— যা প্রাণকৃষ্ণ দত্তের চোখে ‘পৌরাণিক আখ্যায়িকা’, তা পড়ে আমাদের বুঝতে বিন্দুমাত্র বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দ্বারকানাথের মনে পিরালি ব্রাহ্মণ হবার জন্য ক্ষোভ ছিল না। সেই সময় ব্রাহ্মণরা কায়স্থের বা অন্যদের হুঁকোয় ধূমপান করতেন না। তাঁদের জাত যাবার ভয় ছিল। তাঁরা পিরালি ব্রাহ্মণের হুঁকোও স্পর্শ করতেন না। দ্বারকানাথ যখন অভয়চরণকে কলাপাতা আনতে বলেন তখন আমরা দ্বারকানাথের ইঙ্গিত বুঝতে পারি। তিনি তাই বলেছিলেন তিনি চলে গেলেই তাঁর ব্যবহার করা হুঁকোটি তাঁর বন্ধু ভেঙে ফেলবে।
পর্ব-৪
দ্বারকানাথের ভৃত্যবৎসলতা
দ্বারকানাথের এক সামান্য কর্মচারী বহু কষ্টে কলকাতায় এক ক্ষুদ্র বাড়ি নির্মাণ শুরু করলে তা দেখে অপর এক পরশ্রীকাতর কর্মচারী প্রভু দ্বারকানাথকে খবর দিয়ে বলে, ‘মহাশয় অমুক ব্যক্তি আপনার নিকট সামান্য বেতন পায়, কিন্তু সে কলিকাতায় বাড়ি করিতেছে। নিশ্চয়ই সে আপনার বিষয় হইতে অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন করে, নতুবা তাহার পক্ষে বাড়ি করা অসম্ভব।’
দ্বারকানাথ একথা শুনে বিস্ময়ের ভাব প্রকাশ করে বলেন, ‘বটে, তবেত লোকটা বড় নষ্ট, আচ্ছা তুমি তার প্রতি লক্ষ্য রেখো।’ কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য দ্বারকানাথ একদিন প্রাতঃভ্রমণের সময় নিজেই কর্মচারীর বাড়ি গেলেন। প্রভুকে দেখে লোকটি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। দ্বারকানাথ তাঁর বাড়ির খোঁজ নিলেন। ক’টা ঘর, কতটুকু জায়গা, কতজন থাকে ইত্যাদি। দ্বারকানাথ তাঁকে বললেন, ‘তোমার এতগুলি পরিবারের জন্য এত অল্প জমিতে ঘর করিলে কুলাইবে কেন?’ কর্মচারী যখন জানাল সে দরিদ্র অক্ষম তখন দ্বারকানাথ তার বাড়ির পাশের আরও খানিকটা জমি কিনে দিয়ে নিজের রাজমিস্ত্রি পাঠিয়ে বাড়ি করে দিলেন এবং কথাটা গোপন রাখতে বললেন।
দ্বারকানাথের বদান্যতায় কর্মচারীটির বাড়ি হয়ে গেল ও সে দ্বারকানাথের নির্দেশমতো সবকিছু গোপন রাখলেন। তারপর সেই হিংসুটে লোকটি একদিন এসে দ্বারকানাথকে জানাল, ‘হুজুর লোকটা আরও জমি কিনিয়া বড় করিয়া বাড়ি ফাঁদিয়াছে এবং আপনারই মিস্ত্রীকে দিয়া বাড়ি প্রস্তুত করাইতেছে।’ দ্বারকানাথ আগের মত এবারেও কৃত্রিম বিস্ময় ও রাগ প্রকাশ করলেন। কিছুদিন পর কর্মচারীটির বাড়ি তৈরি শেষ হলে দ্বারকানাথ কর্মচারীকে ডেকে গৃহপ্রবেশে সবাইকে নিমন্ত্রণ করার আদেশ দিলেন। সবার সঙ্গে খেতে বসে দ্বারকানাথ হিংসুটে লোকটিকে বললেন, ‘দেখ, আজ আমার কী আনন্দের দিন। আমার নিকট কর্ম করিয়া আমারই একজন সামান্য কর্মচারী বাড়িঘরদুয়ার করিয়া আমাদের সকলকে খাওয়াইতেছে। আমরা আনন্দ করিয়া খাইতে বসিয়াছি। লোকে উহার যশ’ত করিবেই, সঙ্গে সঙ্গে ইহাতে আমাদেরও যশ কম হইবে না। লোকে বলিবে, যেমন মনিবের নিকট আছে, তেমনি উন্নতি করিয়াছে। বুদ্ধিবলে এ ব্যক্তি আমার ক্ষতি না করিয়া দু’পয়সা উপার্জন করিয়া এই বাড়িখানি করিয়াছে। ইহা কম প্রশংসার কথা নহে। আমার ইচ্ছা আমার সকল কর্মচারীই ইহার মতো উন্নতি করুক। তুমি কবে বাড়ি করিয়া আমাদের খাওয়াইবে বল?’
তখন হিংসুটে কর্মচারীটির কাছে সমস্ত ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হল, সে বুঝতে পারল কর্তার দয়াতেই এত কাণ্ড হয়েছে। সে তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে দ্বারকানাথের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১ এবং পর্ব ২ পড়তে হলে ক্লিক করুন।