রাজভোজ (প্রথম পর্ব )

সাল ১৬০৮। নৌ সেনাপতি William Hawkins-এর নেতৃত্বে ‘হেক্টর’ নামের জাহাজ পশ্চিম ভারতবর্ষের গুজরাট প্রদেশের প্রধান বন্দর সুরাটে এসে ভিড়ল। অতিথিপরায়ণ স্থানীয়

বণিকমহল এবং বাদশাহের অধীনস্থ রাজকর্মচারীরা নতুন আগন্তুকদের অভ্যর্থ’না জানাতে বিমুখ হলেন না। খাদ্য হিসেবে পরিবেশিত হয়েছিল পোলাও ও মাংসের দমপোক্ত। মোঘল প্রভাবে তখন দমপোক্ত রান্না হ’ত মাখনে বা ঘিতে সেদ্ধ করে নানা ধরনের আস্ত মশলা, জাফরান, বাদাম ও কিসমিশ দিয়ে এবং নুন ও চিনির সংমিশ্রণে মুখবন্ধ একটি পাত্রে। মশলার আধিক্য যে প্রথমটায় ব্রিটিশ অতিথিদের আশ্চর্য করে তুলেছিল এমনটা নয়। তাঁরা চমৎকৃত হয়েছিলেন খাদ্য পরিবেশনের জন্য সোনা ও রুপোর বাসনের আধিক্যে। এমনকী সোনার জগে মুখ ধোওয়ার জল এবং কুলকুচি করে ফেলার জন্য বিরাট পাত্রটিও তাঁদের আশ্চর্য করে তুলেছিল। ষোড়শ শতকের গোড়াতেও আরব বণিকদের সুবাদে মধ্যযুগীয় খাদ্যাভ্যাস অব্যাহত থাকায় ধনী পরিবারের রন্ধন তালিকায় মহার্ঘ গোলমরিচ, লবঙ্গ, জায়ফল, জিরে, আদা, দারুচিনির প্রাচুর্য’ ছিল। এর ১০০ বছরের মধ্যেই পর্তুগালের হাতে আরবের মশলা বাণিজ্যের একাগ্রতা খর্ব হওয়ায় এগুলি সাধারণের কাছে সুলভ হয়ে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ অপরিচিত স্বাদ বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি করলেও East India Company-এর প্রতিনিধিরা আপত্তি জানাননি। হয়তো বা কিছুটা ভদ্রতার খাতিরেও। ইউরোপ তথা ইংল্যান্ডে তখনও খাবার গ্রহণ করার জন্য কাঁটা চামচের প্রচলন হয়নি। মধ্যযুগীয় প্রথা অনুযায়ী রুটি ছিঁড়ে নিয়ে পরিবেশিত খাদ্যের মধ্যে ডুবিয়ে হাত দিয়ে খাওয়াটাই দস্তুর ছিল। সেই কারণে ভারতবর্ষের হিন্দু বা মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের অভ্যাসকে গ্রহণ করতে তাঁদের কোনও অসুবিধাতে পড়তে হয়নি।

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার আগে ভারতীয় রান্নায় ঝাল স্বাদ আনার জন্য লঙ্কার ব্যবহার জানা ছিল না। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লেখ আছে ‘আদ্রক’ বা আদা এর ‘রুচীর’ অর্থাৎ লবঙ্গ-এর। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজরা Calikat এবং  Cochin-এ লংকার প্রচলন করে।

মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর-এর কাছে দরবার করে রাজদূত স্যার টমাস রো লাভ করলেন বাণিজ্য সম্বন্ধপ্রতিষ্ঠার অনুমতি। সেই উপলক্ষে যে বিশাল আড়ম্বরপূর্ণ ভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল তারই বর্ণনা মেলে স্যার টমাসের সচিব এডওয়ার্ড টেরি (Edward Terry) লিখিত ‘A Voyage to the East India’ বইতে। বিশাল ও সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি তাঁবুতে তাঁদের আপ্যায়িত করা হয়েছিল। বিস্তৃত এবং কারুকার্যময় মহার্ঘ নরম গালিচার ওপর বিছানো সাদা ধবধবে চাদরের ওপর ত্রিকোণাকারে বসার ব্যবস্থা। মাঝে পঞ্চাশেরও বেশি থালিতে খাদ্যসম্ভার সাজানো। মস্ত বড় বড় থালায় রাখা চার রং-এর ভাত— সাদা, জাফরানি, সবুজ ও বেগুনী। মাংস দেওয়া পোলাও, অন্ততঃ ১৫/১৬ রকমের মুরগিসহ অন্যান্য পাখির মাংস, মোঘলাই রীতিতে রান্না করা। নাম না জানা অগুনতি মিষ্টান্ন, ফল এবং আর একটি বিশেষ চালের গুঁড়ো মেশানো দুধের তৈরি ঘন মিষ্টি (সম্ভবতঃ ফিরনি)। তাতে মেশানো ছিল মিশ্রী, গোলাপ জল, বাদাম, পেস্তা ও গোলাপ-পাঁপড়িও। সব থেকে চমৎকৃত হয়েছিলেন তিনি (টমাস রো) ভাত দিয়ে তৈরি ফলের আকারে রাখা একটি বিশেষ পদের স্বাদ পেয়ে। তাতে ছিল টুকরো করা মুরগির মাংসের সঙ্গে যাবতীয় রান্না করা শুকনো ফলের টুকরো।

Surat Factory বা সুরাটের বাণিজ্যকুঠিতেও খাবার ব্যবস্থাও ছিল না কিছু কম এলাহী। সকলের জলখাবারে জ্বলন্ত সোনার টুকরো ডুবিয়ে মদিরা (Burnt Wine) খাবার রীতি ছিল। মধ্যাহ্নভোজ ছিল দিনের প্রধান ভোজন পর্ব। সে তালিকায় রোজই থাকতো হালকা পোলাও, গুলাশ জাতীয় ‘ক্যাবোব’ (Cabob) নামের ঝোল, দমপোক্ত এবং নানা রকম চাটনি এবং আচার। বিশেষতঃ আমের আচার ছিল Factors বা Factory-র উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের প্রিয়।

মোঘল শাসনকালে শূকরের মাংস ছিল নিষিদ্ধ খাদ্য। যখন Captain Downten তার বদলে গোমাংস ভক্ষণের অনুমতি চাইলেন, হিন্দুদের অনুরোধে এবং ঘুষের বিনিময়ে তৎকালীন রাজ্যপাল সেটি নাকচ করে দিলেন। অতএব Surat Factory তথা প্রধান শহরের বাইরের অন্যান্য বাণিজ্যকুঠির Factor –দের (Factory-র উচ্চপদস্থ কর্মচারী)মুরগি বা ভেড়ার মাংস খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতো হল। অবশ্য মাঝেমধ্যে শিকার করা জীবজন্তু বা পাখির মাংস দিয়ে মুখ বদল করার সুযোগ মিলত।

ইতিমধ্যে ইউরোপীয় স্বাদের কাছাকাছি স্বাদ গ্রহণের জন্য নিয়োজিত হয়েছে ইংরেজ, পর্তুগীজ প্রভাবিত গোয়েনে এবং দেশজ রাঁধুনেরা। মিলেমিশে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রান্নার ধারা। যে সমস্ত পদের মধ্যে একটি হয়ে উঠেছিল বিশেষ উপাদেয়। তার নাম Burdwan Stew; তার মধ্যে থাকত তরকারি, মাছ, মুরগি এবং মটন বা ভেড়ার মাংসের টুকরো। মাখন, White wine, ঝলসানো পেঁয়াজ, গোলমরিচ এবং Oyster বা ঝিনুকের ভেতরের মাংসল অংশ। সবকিছু একসঙ্গে সেদ্ধ করে ঘন সুরুয়া মাখিয়ে লেবুর রস দিয়ে খাওয়া হত। এটি রান্না হত অনেক সময় নিয়ে এবং Dr. Riddel তাঁর বই The Indian Domestic Economy and receit Book (1850) লিখেছেন যে একমাত্র রুপোর পাত্রে রান্না হলেই এর যথাযথ স্বাদ পাওয়া সম্ভব হ’ত। রবিবার ও যে কোনও ছুটির দিনে ছিল বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা। সেদিন হরিণ, ময়ুর, খরগোশ ও বনমুরগি রান্না হ’ত। সঙ্গে থাকত প্রচুর পরিমাণে  খুবানী, আলু বোখরা, পেস্তা আর নানা ধরনের চেরী। আর এগুলি সহজে গলাধঃকরণ করার জন্য পরিবেশিত হ’ত পার্সীয়ান সিরাজী, Spanish Sack, British beer এবং দেশীয় পরিশুদ্ধ তাড়ির আরক। মিষ্টিসুখের ব্যবস্থাও থাকত। কোনও কারণে শিকারের মাংস অপর্যাপ্ত না হলে অধস্তন কর্মচারীদের শুধু জাফরানী পোলাও খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত। উর্ধ্বতনদের জন্য অভাব হত না অবশ্য। তবে Good Friday এবং Ash Wednesdayতে সকলের জন্য উপোস করাটা ছিল আবশ্যিক। সম্মিলিত প্রার্থনার পর সূর্যাস্তের শেষে অতি সাধারণ ও সামান্য পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে হ’ত।

মোঘল শাসনকালে শূকরের মাংস ছিল নিষিদ্ধ খাদ্য। যখন Captain Downten তার বদলে গোমাংস ভক্ষণের অনুমতি চাইলেন, হিন্দুদের অনুরোধে এবং ঘুষের বিনিময়ে তৎকালীন রাজ্যপাল সেটি নাকচ করে দিলেন। অতএব Surat Factory তথা প্রধান শহরের বাইরের অন্যান্য বাণিজ্যকুঠির Factor –দের (Factory-র উচ্চপদস্থ কর্মচারী)মুরগি বা ভেড়ার মাংস খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হল। অবশ্য মাঝেমধ্যে শিকার করা জীবজন্তু বা পাখির মাংস দিয়ে মুখ বদল করার সুযোগ মিলত। কলিকাতাবাসী ব্রিটিশদের কিন্তু বিভিন্ন প্রকারের মাংস খাওয়ার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। শূকরের মাংস বা Pork এবং গোমাংস, চাল বা সাবুর পুডিং পরিবেশন করতো। বেশির ভাগ সময় থাকত বিশুদ্ধ ব্রিটিশ রীতিতে তৈরি ব্রেড বাটার পুডিং। খাওয়া শেষ হতে ‘Second Toust’ এ নোনতা ভাজা জাতীয় কোনও পদ দিয়ে।

সত্যি কথা বলতে গেলে ‘Curry’ নামের পদটি ব্রিটিশ রসনাকে বোধহয় সবচেয়ে বেশি পরিতৃপ্তি দিতে পেরেছিল। মাংস, মাছ বা তরকারি সবই এই ‘Curry’ হিসেবে প্রস্তুত করা হ’ত এবং এটিই বোধহয় সর্বপ্রথম Anglo Indian পদ বা ফিরিঙ্গি খানা যা আজও পরিবেশিত হয়ে চলেছে। 

মধ্যাহ্ন ভোজের পর বিশ্রাম করার রীতি ছিল। ৪টে-৬টা পর্যন্ত দপ্তরের কাজ করে ফিরে আসার পর প্রার্থনা শেষে নৈশভোজে সাধারণ কিছু খাওয়া হত। তারপর বাগানে জলের ধারে দু-এক ঘণ্টা আরাম চেয়ারে বসে Wine-এর স্বাদ নেওয়ার পর যে যার রাতের মতো বিদায় নিতেন।

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার আগে ভারতীয় রান্নায় ঝাল স্বাদ আনার জন্য লঙ্কার ব্যবহার জানা ছিল না। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লেখ আছে ‘আদ্রক’ বা আদা এর ‘রুচীর’ অর্থাৎ লবঙ্গ-এর। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজরা Calikat এবং  Cochin-এ লংকার প্রচলন করে। সম্ভবতঃ  Latin America তথা West Indies থেকে। ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গোয়ার মাটিতে তিন রকমের লংকার প্রচুর ফলন হতে শুরু হয়েছিল। বম্বে অঞ্চলে তাই এগুলিরনাম রাখা হ’ল ‘গোয়াই মিরচি’। ১৬ শতকে পর্তুগীজ বণিকদের হাত ধরে আরও এল আনারস, পেঁপে, টমেটো এবং কাজুবাদাম। ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসে আসল বিপুল পরিবর্তন।

পর্তুগীজ পদার্পণের সময় বাণিজ্য উপলক্ষে স্থিতি আসার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মপ্রচারকরাও উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। দক্ষিণ ও পশ্চিম উপকূলে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় মানুষরা উচ্চবর্ণের অস্পৃশ্যতার কবল থেকে মুক্তি পেতে খ্রিস্টধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ধর্মান্তরিত হতে শুরু করেছিল। এই সব ধর্মপ্রচারকরা ছিলেন অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় সামান্য পুঁজিতে প্রাণধারণ করার মতই খাদ্য এঁরা খেতেন। East India Company-র আমলে প্রাথমিক পর্যায়েও এর ব্যতিক্রম ছিল না। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে নিবেদিত ধর্মপ্রাণ ওই সমস্ত ধর্ম প্রচারকরা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য জীবনযাপন করেছেন। দক্ষিণের তাঞ্জোরে এক ধর্মপ্রচারকের আত্মীয় তাঁদের সারাদিনের খাদ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ভোর ৫টায় শুরু হ’ত তাঁদের দিন। ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে breakfast-এ খাওয়া হতো খুব গরম এক জগ চা। একটা পাঁউরুটি টুকরো করে আধাআধি তারা ভাগ করে চায়ে ডুবিয়ে খেতেন। মধ্যাহ্নভোজ সারা হত আঞ্চলিক রীতিতে ভাত ও ‘কারি’ (curry) বা ঘন একটা broth দিয়ে। নৈশভোজের কথা উল্লেখ করা নেই। একমাত্র রবিবারে এক গ্লাস Wine খাওয়া হত।

কলকাতা তথা বাংলার চিত্রটি ছিল অবশ্য অন্যরকম। উন্নাসিক ব্রিটিশ ধর্মপ্রচারকরা চিকেন কারি-রাইস, সঙ্গে হ্যাম, পরিজ, স্বদেশ থেকে পৌঁছনো বিস্কিট দিয়ে ভোজ সারতেন। অনেকে আটার তৈরি চাপাটিতেও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। Bombay এবং Madras-এর পরিস্থিতির সঙ্গে East India Company-র কলিকাতার অমিল ছিল অনেকটাই। পর্তুগীজ প্রভাব ও ব্রিটিশ বিলাসিতার দৈনন্দিন চাহিদা ও অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রিত করেছে সম্পর্ণ বিপরীত পথে। রন্ধন প্রণালী বা মশলার ব্যবহার হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। তবে একটি যে বিশেষ পদ জাতি নির্বিশেষে সকলের রসনাকে তৃপ্তি দিয়েছে তা হল কারি (Curry)। কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অনেকেই স্বদেশে ফিরে গিয়ে এই বিশেষ পদটিকে জনপ্রিয় করার প্রয়াস করেছেন।

সত্যি কথা বলতে গেলে ‘Curry’ নামের পদটি ব্রিটিশ রসনাকে বোধহয় সবচেয়ে বেশি পরিতৃপ্তি দিতে পেরেছিল। মাংস, মাছ বা তরকারি সবই এই ‘Curry’ হিসেবে প্রস্তুত করা হ’ত এবং এটিই বোধহয় সর্বপ্রথম Anglo Indian পদ বা ফিরিঙ্গি খানা যা আজও পরিবেশিত হয়ে চলেছে।

১৮৭৬ সালে রাজশাসনের আমলে যে তিনটি readymade curry powderকে বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয় স্বাদের বিভিন্নতায় তাদের নাম Bombay Curry Powder, Madras Curry Powder এবং  Bengal Curry Powder, Madras Curry Powder এবং  Bengal Curry Powder. Henrietta Harvey ১৯০৮ সালে লেখা তাঁর Anglo-Indian Cookery at Home বইতে এগুলি তৈরি করার প্রণালীও লিখে গেছেন।

এদের মধ্যে Bengal Curry Powderকে Henrietta Harvey সবথেকে খরচসাপেক্ষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আখ্যা দিয়েছেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে লেখা Cookery for the Million…বইতে Harriet Lawrence নামে তাঁর পছন্দের Madras Curry Paste এর তৈরির পদ্ধতি জানিয়েছেন সেটি খুব সুস্বাদু বলে পরিচিত ছিল।

১ পাউন্ড ধনের দানা

১/৪ পাউন্ড জাফরান

১০ আউন্স শুকনো লংকা

৪ আউন্স গোলমরিচ

৪ আউন্স সরষে দানা

২ আউন্স শুকনো আদার গুঁড়ো

৪ আউন্স রসুন কোয়া

৮ আউন্স নুন

৪ আউন্স   আস্ত জিরে

২ আউন্স মেথি দানা

১/২ পাঁইট English Vinegar

১/২ পাঁইট গাওয়া ঘি

শুকনো পাত্রে আলাদা করে সব মশলা কড়া করে ভেজে ঠান্ডা হলে মিহি গুঁড়ো করে ছেঁকে নিতে হবে। তারপর সেই ছেঁকে নেওয়া গুঁড়ো ঘি ও Vinegar-এ মিশিয়ে কাঁচের বয়ামে মুখ বন্ধ করে রাখলে বহুদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে।

সকালে Breakfast-এ ১৯শ শতকের দিনগুলিতে(কারি ভাত) বা Curry Rice খাওয়ার কারণ ছিল ভালো মানের  Bread-এর অভাব। এই প্রথা অনেকদিন চলেছিল, এমনকী জাহাজে সফরকালীন ও প্রত্যেকদিন খাবার টেবিলে ভিন্ন ভিন্ন Curry পরিবেশন করা হ’ত। অবশ্য তার আগে থাকতো পরিজ, বেকন এবং ডিমের কোনও পদ।

Company-এর আমলের প্রাথমিক পর্যায়ে কর্মচারীদের প্রচুর ভ্রমণ করতে হত। প্রত্যন্ত অঞ্চল কিছুই প্রায় সহজলব্ধ ছিল না। সাময়িক বাসস্থান ছিল Camp.সঙ্গে খানসামা এবং কুলীরা বয়ে নিয়ে যেত রান্নার সরঞ্জাম, পাত্র, ন্যূনতম কাঁচা মাল এবং প্রাত্যহিক ব্যবহারের জিনিসপত্র। চা, কফি, শুকনো ফল, ময়দা, চিজ, আঁচার, সস, জ্যাম, সঙ্গে থাকলেও হিন্দু গ্রামগুলোর থেকে সংগ্রহ করা হ’ত দুধ, জল, ফল, লংকা এবং তরকারি। মুসলিম গ্রামগুলো যোগাত ডিম, মুরগি বা তাজা মাংস। তবে সবকিছুই যে সব জায়গায় পাওয়া যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না।

জলপথে ভ্রমণকারীদের জন্য ততদিনে গঙ্গাবক্ষে ১৯শ শতকের বজরার (budgerows) বিকল্প হিসেবে steamer চলতে শুরু করেছে। সুন্দরভাবে সাজানো (sitting room) বসার ঘর, ভোজন কক্ষের টেবিলে কেতাদুরস্ত বাসনপত্র, চিনেমাটি ও রুপোর ভোজনপাত্র যার প্রত্যেকটিতে কোম্পানির প্রতীক চিহ্ন খোদাই করা যথাযথভাবে সাজানো থাকত। 

১৮৪০ সালের পর Camp-এর জীবন সহজ হয়ে গেল। ভারতের প্রায় সব প্রদেশের বিভিন্ন কোণে ‘ডাক’ (Dak) বাংলো তৈরি করা হ’ল। সাধারণ শক্তপোক্ত একতলা বাড়ী, চারিদিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা। গাছপালা ভরা জমির মধ্যে জংলি পশুর উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে কাঁটাতার ও ঘন ঝোপের বেড়া। মোটামুটি প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রে সাজানো, বিছানা ও খাদ্যবস্তুর যথাযথ আয়োজনের জন্য ছিল কোম্পানির মাইনে করা রাঁধুনি, বাজার সরকার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ঝাড়ুদার, মালী এবং শশালচী। রোজ খাদ্য হিসেবে Breakfast বা চায়ের সঙ্গে পাওয়া যেত মাখন মাখানো সেঁকা পারুটি। মধ্যাহ্নভোজ বা dinner ও থাকত mutton-এর কোনও পদ এবং সবশেষে সাধারণত Caramel custard.

জলপথে ভ্রমণকারীদের জন্য ততদিনে গঙ্গাবক্ষে ১৯শ শতকের বজরার (budgerows)বিকল্প হিসেবে steamer চলতে শুরু করেছে। সুন্দরভাবে সাজানো (sitting room) বসার ঘর, ভোজন কক্ষের টেবিলে কেতাদুরস্ত বাসনপত্র, চিনেমাটি ও রুপোর ভোজনপাত্র যার প্রত্যেকটিতে কোম্পানির প্রতীক চিহ্ন খোদাই করা যথাযথভাবে সাজানো থাকত।

Lord Auckland ১৮৩৭ সালে সপার্ষদ সুন্দরবনে Steamer ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাঁদের দেখাশোনা করার জন্য ১৪০ জন দেশীয় ভৃত্য এবং ২ জন French Chef সঙ্গে ছিল। তবে সাধারণভাবে এতটা বিলাসিতার অবকাশ ছিল না। ১৮৬০ সালে ব্রহ্মপুত্র নদে আনন্দ ভ্রমণের সময় টিনের মাছ ও অন্যান্য শুকনো খাদ্যবস্তুর ওপরই নির্ভর করতে হত। অবশ্য তাজা রুটি বানিয়ে দেবার জন্য খানসামা ছিল। তাজা দুধের ব্যবস্থাও কোনওক্রমে হয়ে যেত। ফলমূল সঙ্গে না নিয়ে গেলে পাওয়া ছিল দুর্লভ।

ততদিনে দেশীয় খাদ্যসম্ভারের সঙ্গে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ আভিজাত্যের একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছে। জন্ম নিয়েছে সুস্বাদু Anglo Indian ওরফে ফিরিঙ্গী খানা। তবে এই মেলবন্ধনের সূত্রপাত ঘটে গেছিল বহু আগেই।

কোম্পানি শাসন পত্তন হওয়ার আগে ও পরে বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী তথা অধিকর্তা সস্ত্রীক নির্দিষ্ট কালের জন্য সফরে এসেছেন তাঁদের কর্মসূত্রে। মেয়াদ শেষ হ’লে ফিরেও গেছেন। এঁরা অনেকেই যাওয়ার আগে সমাজের উন্নতিকল্পে রেখে গিয়েছেন তাঁদের স্বর্ণময় সমস্ত সাক্ষর। স্বামীরা যখন কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থেকেছেন, অজানা পরবাসে স্ত্রীরা তুলে নিয়েছেন সংসার নির্বাহের বিপুল ভার। যে নবাবী (চাল) ধারা তাঁরা ভারতের মাটি থেকে গ্রহণ করেছেন পরবাসে তার ভার সামলাতে হয়েছে এই বিদেশিনী মহিলাদেরই। বিশাল ভৃত্যবাহিনীর পরিচালনা, হিসেব রক্ষা এবং সামাজিক সম্বন্ধ বিনোদনের জন্য সকলকে নিয়ে আয়োজন করেছেন স্বদেশের রেওয়াজ অনুযায়ী বনভোজনের। বা সম্পর্ককে সুদৃঢ় রাখতে তাঁদের সদা সচেষ্ট থাকতে হয়েছে। রোজকার খাদ্যতালিকা স্থির করার পাশাপাশি আয়োজন করতে হয়েছে ভোজসভার। তাঁদের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচ্ছন্নতায় দীক্ষিত হয়ে দেশীয় রাঁধুনি বা মুসলমান বাবর্চীরা ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ সহ মিশ্রিত প্রভাবযুক্ত খাদ্য প্রস্তুতিতে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠতে পেরেছিল। ১৮৬৯ সালে স্যুয়েজ ক্যানাল খুলে যাওয়ায় স্বদেশের সঙ্গে নবলব্ধ ভারতের দূরত্ব অনেকটাই কমে গেল। তার ফলে পণ্যের আমদানি-রপ্তানিও হ’ল অনেক সহজসাধ্য। অবিবাহিত পুরুষদের আকর্ষণে ইংরেজ বিবাহযোগ্যা কন্যারা শীতের সময় বিশেষ করে ভিড় জমাতে শুরু করল, আত্মীয়-বন্ধুদের অতিথি হয়ে। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে আর ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনই থাকত না।

রাজভোজ (দ্বিতীয় পর্ব)