রঙ্গিন রঙ্গারুণ

আমজনতার পছন্দসই নামী ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর ভিড়ভাট্টা   এড়াতে অফবিট জায়গার খোঁজে ঘুরে বেড়ান অনেকেই। এক্ষেত্রে থাকার মতো সুবিধেজনক হোটেল পাওয়া তাঁদের কাছে প্রায়ই দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যার সমাধান করতে আজকাল পাহাড়ি ছোট ছোট গ্রামগুলোতেও স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের বাড়ির লাগোয়া আরামদায়ক সব কটেজ বানিয়ে দিয়েছে ট্যুরিস্টদের জন্য, যাকে বলা হয় হোম স্টে।  আমরাও ইদানিং দার্জিলিংয়ের প্ল্যান করলে, আগে এই ধরনের কিছু জায়গাকে দিব্যি জুড়ে নিই। এখানে স্থানীয় মানুষের দিলখোলা ব্যবহার আর ঘরোয়া সুস্বাদু রান্না চুটিয়ে উপভোগ করা যায়, মনে হয় ঠিক যেন কোনও পরিবারের   অতিথি হয়ে রয়েছি। শীতের শুরুতে রঙ্গারুন টি এস্টেট-এ গিয়ে বলা যায়, এমনই এক হোম স্টে’তে দু’দিন দিব্যি আরামে কাটল আমাদের।

তাসি শেরপা

সকাল সাড়ে ন’টায় এন.জে.পি স্টেশনে পৌছে চেপে বসলাম নিলয়ের গাড়িতে। বছর ক’য়েক হল এদিকে এলে ওকেই আমরা ডেকে নিই। কার্শিয়াংয়ের স্কুলে পড়া অতি ভদ্র, মার্জিত ছেলে। বউ স্কুল টিচার, তার ওপর পদবিও ‘দেব’, ব্যস, আর কী চাই। রোহিনি’তে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা ধীরে ধীরে ঊর্দ্ধমুখী হলাম। কার্শিয়াংয়ের আগে পড়ল সেই বিখ্যাত চায়ের দোকান (পোষাকি কথায় লাউঞ্জ) ‘মার্গারেট’স ডেক’। সামনের তিন দিক খোলা, বারান্দায় বসে পাহাড় দেখতে দেখতে এদের মহার্ঘ চায়ে চুমুক দিয়ে স্বর্গসুখ অনুভব করেন অনেকেই। নিলয় বলল, নামবেন নাকি?

সুধা রাই

তা, আমাদের সেই লাটসাহেবি মেজাজ কোথায়, যে নামব? জোড়বাংলো থেকে পেশক রোড ধরে থার্ড মাইল এসে একটা রাস্তা গেছে লামাহাট্টার দিকে। অন্যটা অনেক নিচে নেমে গিয়ে পৌঁছেছে গিয়ে রঙ্গারুণয়ে। চশমা পরা রোগা-পটকা এক ছোকরা গাড়ি থামাল। ওই হল তাসি শেরপা। ওদেরই ‘তাসি ডেলেক হোমস্টে’তে আমরা থাকব। ফোনে বুকিং করার সময় ওকে আপনি আপনি করেছিলাম। এখন সোজা তুমিতে চলে এলাম। প্রতিদিনের হইহট্টগোল এড়িয়ে দু’দিন এদের পাহাড়ের ধারে একতলা নিরিবিলি কটেজে দিব্যি কাটল। সামনের পাহাড়ের মাথায় দার্জিলিং শহরটা আর ডান পাশে তাকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমরা খাটে বসে পর্দা সরিয়ে দেখতাম। এখানকার চা বাগান প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো, প্রথম দিন সকালেই পাহাড় বেয়ে নেমে গেলাম দেখতে। চা প্রসেস করার কারখানা, বাতিল হওয়া বিশাল যন্ত্রপাতি, অফিসবাড়ি, সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। চা পাতা তোলার জন্য পিঠে ঝুড়ি নিয়ে বাগানে চলেছে একদল মেয়ে, ছবি তুলতে দেখে মুখ লুকিয়ে প্রায় দৌড় লাগালো। এদিকের পাহাড়ে কিছুটা ঘরবাড়ি আর বাকিটা শুধু চা বাগানে ঘেরা। চা তোলা হচ্ছে এমন ছবি আঁকার জন্য ‍সরু আলপথ বেয়ে বাগানের মধ্যে নেমেও এদের ধারে কাছে যাওয়া গেল না। দেখলাম সবাই আরও অনেক গভীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অগত্যা একটা বড় পাথরের ওপর বসে দূরে বাড়িগুলোর স্কেচ করলাম।

বাড়ির লাগোয়া হোম স্টে

একটু বেড়িয়ে  ফিরে  ঘরের সামনে খোলা জায়গাটায় চেয়ার টেবিল পেতে বসি, রোদ আটকাতে মাথার ওপর ছাতা লাগিয়ে দেয় তাসি। ছেলেটা ভারি শান্ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়েছে। এখন চাকরি করবে না পারিবারিক ব্যাবসাতেই থাকবে, ঠিক করতে পারছে না। ওর বাবা একটু অলস গোছের আর মায়ের চোখের সমস্যা, মাসি সুধা রাই নিচে থাকে, রোজ এসে ও-ই রান্নাবান্না করে দেয়। তাসিকে বললাম তোমার চাকরি করে কাজ নেই হোমস্টেটা-ই বরং সামলাও। তাসি নামটা এদিকে খুব শোনা যায়, মানেটাও তাসিই বলল— ভগবানকে প্রণাম জানানো। যতক্ষন থাকত সুধাই বেশি গল্পগুজব করত, ওর বর চা-বাগানের অফিসে কাজ করে। দু’জনের খুব সখ কলকাতায় গিয়ে কালিঘাটের মন্দিরে পুজো দেওয়ার। আমাদের ঘরের সামনে টানা একফালি বারান্দায় সন্ধেবেলা কর্তা-গিন্নি মুড়িসুড়ি দিয়ে বসতাম। সামনে পাহাড়ের গায়ে ঝিকমিক করছে দার্জিলিং শহরের আলো। মনে হত যেন একমুঠো হিরের কুচি ছড়ানো। এরা বারান্দা জুড়ে নানা রঙের আলোর মালা ঝুলিয়ে ডিস্কো এফেক্ট তৈরি করতে চায়, গিয়ে বলতে বাধ্য হলাম আলো-আঁধারির মধ্যে প্রকৃতির এই নীরবতাকে কিঞ্চিৎ উপভোগ করতে দাও না বাপু। দেখতে দাও হঠাৎ নিচ থেকে মেঘেরা দল বেঁধে উঠে এসে চারদিক কেমন ঝাপসা করে দিচ্ছে। কাঁপুনি দেওয়া ঠান্ডার মধ্যেও দু’জনে বারান্দায় বসে থাকি যতক্ষণ না তাসির মা এসে সবিনয়ে জানাচ্ছে— ‘খানা তৈয়ার হ্যায়’।

 

চা বাগানে বসে করা স্কেচ

অলঙ্করণঃ দেবাশীষ দেব