অগ্রদূত-এর বিভূতি লাহা

আজ সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তাপসী ছুটে চলেছেন কুসুমপুরের দিকে৷ সেখানে তাদের বংশের ভিটে৷ দশ বছর আগে একদিন ভাগ্য তার সঙ্গে খেলেছিল নিষ্ঠুর প্রহসন৷ তখন তাপসী কুমারী মাত্র৷ সেখানে মৃত্যুপথযাত্রী জমিদারের কিশোর নাতির সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়৷ দেবপুত্রের মতো তার কান্তি৷ তাপসীর উগ্র আধুনিকা মা চিত্রলেখাদেবী এ বিয়ে মেনে নেননি৷ তার মেয়ের রূপ আছে, গুণ আছে, সুতরাং তার সঙ্গে বিয়ে হবে কোনও ধনী দুলালের, গ্রাম্য জমিদারের নাতি বুলুর সঙ্গে নয়৷ ইতিমধ্যে যুবতী তাপসীর জীবনে এসেছেন যুবক কিরীটি৷ এই পরিচয় যখন প্রণয়ের দিকে এগোচ্ছে তখন তাপসীর বারবার মনে হয়েছে কুসুমপুরে ফেলে আসা সেই পুতুল খেলার বিয়েকেই৷ আকর্ষণ আর বিকর্ষণের এক করুণ দোটানার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তাপসী৷ আজ কে দেবে তাকে পথের নির্দেশ? কুসুমপুরের জমিদার বাড়ির নাটমঞ্চে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আজ হাজির হয়েছেন তাপসী৷ শুনতে পাচ্ছেন সেই মন্ত্র, ‘যদিদং হৃদয়ং তব…’, এই মন্ত্র তাকে আলোড়িত করে তুলেছে৷ হঠাৎ তাপসী দেখতে পেলেন তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তার প্রণয়ী কিরীটি৷ এতদিনে তাপসী জানলেন, পুতুলখেলার সেই বুলু আর কেউ নয়, তার পরিচয়, তিনিই কিরীটি৷

অগ্নিপরীক্ষা ছবির একটি দৃশ্য

এই নিয়ে আশাপূর্ণা দেবীর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘অগ্নিপরীক্ষা’৷ এই কাহিনি নিয়ে নির্মিত হল এক ব্লকব্লাস্টার সিনেমা ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪)৷ এ ছবির নির্মাণ পর্বের শুরুতেই হল গণ্ডগোল৷ অগ্রদূত গোষ্ঠীর প্রধান বিভূতি লাহা এই উপন্যাস প্রযোজক মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়কে পড়তে দিলেন৷ সিঁথির মোড়ে একদা এক বিরাট স্টুডিও ছিল ‘এম.পি. স্টুডিও’৷ সেই স্টুডিওর কর্ণধার মুরলীধরবাবু৷ বহু বিশিষ্টজন স্টাফ হিসেবে সেখানে কাজ করেন৷ উপন্যাসটি পড়ে মুরলীধরবাবু অভিভূত৷ তিনি বিভূতি লাহাকে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে বললেন এবং স্টার কাস্টিং জানাতে বললেন৷ বিভূতি লাহা জানালেন কিরীটির চরিত্রে‍ উত্তমকুমার এবং তাপসীর চরিত্রে সুচিত্রা সেনকে তিনি চান৷ প্রযোজক বেঁকে বসলেন৷ তিনি চান কিরীটির ভূমিকায় বিকাশ রায় ও তাপসীর চরিত্রে অনুভা গুপ্তাকে৷ বিভূতি লাহা এম. পি. প্রোডাকসন্সের স্টাফ হয়েও স্পষ্ট করে জানালেন, তাঁকে‍ যদি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি করতেই হয়, তবে উত্তম-সুচিত্রাই থাকবেন কিরীটি ও তাপসীর চরিত্রে৷ প্রযোজক ও পরিচালকের মতান্তরের মধ্য দিয়ে এ ছবি নির্মিত হল৷ ফাইনাল প্রোজেকশন পর্যন্ত মুরলীধর বাবু দেখলেন না৷ অগ্নিপরীক্ষা ছবি মুক্তি পেল ১৯৫৪ সালের দুর্গাপুজোয়— উত্তরা, পূরবী, উজ্জ্বলতাতে৷ ছবি বাম্পার হিট৷ রাজকাপুর-নার্গিস-এর দুরন্ত সাফল্যের পাশে উত্তম-সুচিত্রার মতো এমন বাঙালি রোমান্টিক জুটির প্রয়োজন ছিল বইকি! দর্শকের সেই প্রত্যাশা পূর্ণ করলেন এই জুটি, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির মধ্য দিয়ে৷ যদিও ইতিপূর্বে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সাড়ে চুয়াত্তর, মরণের পরে, সদানন্দের মেলা মুক্তি পেযেছি‍ল বটে, কিন্তু এ‍ই ছবিগুলি এই জুটির সাফল্যের ক্ষেত্রে তেমন সহায়ক হয়নি৷ সেদিক থে‍কে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ বাংলা ছবির একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকবে৷

আমাদের মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে বিদেশে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ছবি৷ তা কিন্তু যথার্থ নয়৷ ১৯৫২ সালে কার্লোভিভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সামাজিক উন্নতির জন্য নিবেদিত ছবি’ বিভাগে পুরস্কৃত হয় অগ্রদূতের ‘বাবলা’৷

‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির আর এক প্লাস পয়েন্ট হল, এ ছবিতেই প্ৰথম সুচিত্রা সেনের লিপে‍ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান সংযুক্ত হল৷ সুচিত্রা-উত্তম জুটির পাশাপাশি সুচিত্রা-সন্ধ্যা জুটির জয়যাত্রা এই ছবি থেকেই৷ অনুপম ঘটকের সুরে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় সন্ধ্যা গাইলেন ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’, ‘কে তুমি আমারে ডাকো’, ‘যদি ভুল করে ভুল মধুর হল’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর আনে স্বপ্নভরা সম্ভাষণ’ প্রভৃতি৷ ছবির শিল্পী তালিকাটাও বিরাট; অভিনয় করলেন কমল মিত্র, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দ্রাবতী দেবী, সুপ্রভা দেবী, অনুপকুমার, যমুনা সিংহ, জহর রায়, শিখা বাগ প্রমুখ৷ এত বড় সাফল্যের কাণ্ডারি যিনি, তিনি হলেন বিভূতি লাহা; ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠীর প্রধান৷

তিনটি কারণের জন্য বাংলা ছবির জগতে বিভূতি লাহার নামটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ তার প্রথম কারণ ভারতবর্ষ যেদিন স্বাধীন হয় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দিনটিতে অগ্রদূত গোষ্ঠীর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘স্বপ্ন ও সাধনা’ মুক্তি পায় এবং অচিরেই ছবিটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ দ্বিতীয় কারণ, আমাদের মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে বিদেশে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ছবি৷ তা কিন্তু যথার্থ নয়৷ ১৯৫২ সালে কার্লোভিভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সামাজিক উন্নতির জন্য নিবেদিত ছবি’ বিভাগে পুরস্কৃত হয় অগ্রদূতের ‘বাবলা’৷ তৃতীয় কারণ, বাংলা ছবিতে সুচিত্রা-উত্তম জুটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন অগ্রদূত৷ সত্যি কথা বলতে কী, রোমান্টিক জুটি হিসেবে সুচিত্রা-উত্তমের কোনও বিকল্প তৈরি হল না আজও৷ ছ’ফুটের উপর লম্বা বিভূতি লাহার বাংলা ছবির জগতে অবদানের তালিকাও লম্বা৷

এক নজরে দেখে নেওয়া যেতে পারে কী কী ছবি তিনি পরিচালনা করেছেন: স্বপ্ন ও সাধনা (১৯৪৭), সঙ্কলন (১৯৪৮), সহযাত্রী (১৯৫১), বাবলা (১৯৫১), আঁধি‍ (১৯৫২), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), অনুপমা (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), ত্রিযামা (১৯৫৬), পথে হল দেরি (১৯৫৭), সূর্যতোরণ (১৯৫৮), লালু ভুলু (১৯৫৯), কুহক (১৯৬০), খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন (১৯৬০), অগ্নিসংস্কার (১৯৬১), বিপাশা (১৯৬২), নবদিগন্ত (১৯৬২), উত্তরায়ণ (১৯৬৩), বাদশা (১৯৬৩), অন্তরালে (১৯৬৫), সূর্যতপা (১৯৬৫), তাপসী (১৯৬৫), নায়িকা সংবাদ (১৯৬৭), কখনো মেঘ (১৯৬৮), চিরদিনের (১৯৬৯), মঞ্জরী অপেরা (১৯৭০), ছদ্মবেশী (১৯৭১), সোনার খাঁচা (১৯৭৩), সেদিন দুজনে (১৯৭৫), দিন আমাদের (১৯৭৭), সূর্যসাক্ষী (১৯৮১) এবং অপরাহ্নের আলো (১৯৮৯)৷ এর মধ্যে অধিকাংশ ছবিই আজকের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় সুপার ডুপার হিট৷ অধিকংশ ছবির কাহিনি সাহিত্যনির্ভর৷

উত্তমকুমারের রোমান্টিক ইমেজ ভেঙে দিয়ে বিভূতি লাহাই প্রথম ক্যারেক্টার রোলে তাঁকে‍ প্রতিষ্ঠা দিলেন৷ প্রভুভক্ত রাইচরণের চরিত্রে উত্তমকুমারের মেকআপ ও অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা পেল অকৃপণভাবে৷

বিভূতি লাহা বিশ্বাস করতেন দর্শকরা ছবিতে গল্প পেতে চান৷ যাঁদের উপন্যাস থেকে ছবি করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণা দেবী, প্রতিভা বসু, ডা. নীহারর্জন গুপ্ত, সুবোধ ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু প্রমুখ৷ সমরেশ বসুর ‘কুহক’ দিযেই লেখকের গল্পের চিত্ররূপের শুরু৷ যখন তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এর স্ক্রিপ্ট তৈরি করছিলেন, তখন একদিন উত্তমকুমার বিভূতি লাহাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খোকাদা এখন কোন ছবির স্ক্রিপ্ট করছেন?’ (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিভূতি লাহার ডাকনাম খোকা)৷ বিভূতি লাহা বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন-এর’৷ উত্তমকুমার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাইচরণের চরিত্রে কাকে ভেবেছেন?’ বিভূতি লাহা বললেন, ‘কালী ব্যানার্জিকে ভেবেছি ওই চরিত্রে৷’ উত্তমকুমার আবদার করলেন, ‘ওই চরিত্রটা আমায় দিন৷’ বিভূতি লাহা বললেন, ‘তোমাকে তো অনেক টাকা দিতে হবে৷’ উত্তমকুমার স্পষ্ট করে জানালেন, ‘আমি টাকা চাই না, ওই রোলটা চাই৷’ সেই রোল অবশেষে‍, করলেন উত্তমকুমার৷ উত্তমকুমারের রোমান্টিক ইমেজ ভেঙে দিয়ে বিভূতি লাহাই প্রথম ক্যারেক্টার রোলে তাঁকে‍ প্রতিষ্ঠা দিলেন৷ প্রভুভক্ত রাইচরণের চরিত্রে উত্তমকুমারের মেকআপ ও অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা পেল অকৃপণভাবে৷

বিভূতি লাহার প্রিয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তারাশঙ্করের তিনটি উপন্যাসের (বিপাশা, উত্তরায়ণ, মঞ্জরী অপেরা) চিত্ররূপ দিয়েছেন তিনি৷ সেই সময় বিভূতি লাহা থাকতেন শ্যামপুকুর স্ট্রিটে৷ তারাশঙ্করের বাড়ি টালাপার্ক৷ তিনটি উপন্যাসের সময়েই স্ক্রিপ্ট তৈরি হয়ে যাওয়ার পর বিভূতি লাহা যেতেন তারাশঙ্করের বাড়িতে৷ তারাশঙ্কর একটি কাগজ পেন নিয়ে বসতেন৷ যদি কোথাও কোনও ফাঁক থাকে, সেই জন্য৷ তিনবারেই কাগজে কিছু না কিছু দাগ কেটেছেন৷ স্ক্রিপ্ট সম্পূর্ণ শোনার পর সেগুলি তারাশঙ্কর নিজেই কেটে দিযেছেন৷ সম্মতি দিয়েছেন এই স্ক্রিপ্টগুলিতে৷ এসব তথ্য বিভূতি লাহার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম, যখন ‘প্রবাস’ আনন্দবাজারে’র তরফ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, সেই সময়ে৷ তিনি নিজে কৃতী চিত্রগ্রাহক ছিলেন বলে, ‘উত্তরায়ণ’ ছবিতে প্রবীর ও রতন এই দ্বৈত চরিত্রে উত্তমকুমারকে পর্দার বুকে একই সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখালেন, সেক্ষেত্রে তিনি প্রসেস ফটোগ্রাফির সাহায্য নিয়েছিলেন (সালটা মনে রাখতে হবে ১৯৬২-৬৩)৷ যাঁরা তাঁর সহকারী চিত্রগ্রাহক ছিলেন পরবর্তীকালে তাঁরা স্বনামধন্য চিত্রগ্রাহক হয়ে ওঠেন৷ সেই তালিকায় আছেন বিজয় ঘোষ, বৈদ্যনাথ বসাক প্রমুখও৷ সহকারী পরিচালক হিসাবে যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্বনামধন্য পরিচালক হয়ে উঠেছিলেন৷ সেই তালিকায় আছেন সরোজ দে (অগ্রগামী), অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, সলিল দত্ত প্রমুখ৷

বাবলা ছবির পোস্টার

বিভূতি লাহার কয়েকটি স্মরণীয় ছবির কথা আলাদা করে বলতে হয়৷ শব্দযন্ত্রী যতীন দত্ত একদিন বিভূতি লাহাকে একটি গ্রন্থাবলির কয়েকটি পাতা এনে পড়তে দিলেন৷ পড়তে পড়তে বিভূতি লাহা কেঁদে‍ ফেললেন৷ সেটি ছিল সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বাবলা’৷ কোনও বড় কথা নেই৷ অথচ একটা মানবিক আবেদন আছে গল্পটিতে৷ এম.পি. প্রোডাকশনের ব্যানারে নির্মিত হল ‘বাবলা’৷ মুক্তি পেল উত্তরা, পূরবী, উজ্জ্বলায়৷ গোড়ার দিকে অগ্রদূতের অধিকাংশ ছবি যেমন নির্মি‍ত হয়েছিল এম.পি. প্রোডাকসন্সের ব্যানারে, ঠিক তেমনি অধিকাংশ ছবিও মুক্তি পেত এই উত্তরা, পূরবী, উজ্জ্বলায়৷ তেমন নামকরা শিল্পীর ভিড় নেই (শোভা সেন, প্রভা দেবী, মাঃ বীরেন প্রমুখ) অথচ ছবিটি অসাধারণ জনপ্ৰিয়তা লাভ করল৷ দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত হল ‘বাবলা’৷ সহকারী পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় একদিন বিভূতি লাহাকে পড়তে দিলেন ড. নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা ‘লালু-ভুলু’ উপন্যাসটি৷ পড়েই মুগ্ধ হলেন, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এক অসাধারণ গল্প৷ সে ছবিও সুপারহিট৷ ছোটদের জন্য ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করলেন ‘বাদশা’ ছবিটি৷ কুকুর-বাঁদর-ছাগল নিয়ে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড৷ বাঁদর কি সহজে কুকুরের পিঠে উঠতে চায়? শটের পর শট টেক করার পর একটা টেক হয়তো তাঁর মনের মতো হল৷ তবু বিভূতি লাহা হাল ছাড়েননি৷ সে ছবিও সুপারহিট৷

একটা কথা চালু আছে যে, রিমেক ছবি চলে না৷ বড়দিদি, প্রিয় বান্ধবী, প্রতিশ্রুতি, মানময়ী গার্লস স্কুল সহ অসংখ্য দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে৷ বিভূতি লাহা সেক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম৷ ১৯৪৪ সালে নির্মিত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত জহর গঙ্গোপাধ্যায়, পদ্মাদেবী অভিনীত ‘ছদ্মবেশী’ সেই সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল৷ বিভূতি লাহা ঝুঁকি নিয়ে সেই ‘ছদ্মবেশী’র রিমেক করলেন ১৯৭১ সালে৷

বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ রঙিন ছবিটি হল ‘পথে হল দেরি’ (কাহিনিকার প্রতিভা বসু)৷ যদিও ছবিটির কালার প্রিন্ট নষ্ট হয়ে গেছে, এখন আমরা সাদা-কালোতেই দেখি ছবিটি৷ বিভূতি লাহার ছবির সংলাপ কতখানি কালজয়ী হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ ‘সবার উপরে’ ছবিটি৷ উত্তম-সুচিত্রা তো ছিলেন‍ই, সে সব ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে রইল ছবি বিশ্বাসের অভিনয়৷ সন্তান (উত্তমকুমার) যখন আদালতে পিতাকে (ছবি বিশ্বাস) নির্দোষ প্রমাণিত  পেরেছেন, সেই সময়ে ছবি বিশ্বাসের সেই আবেগঘন সংলাপ, সংলাপ – ‘ফিরিয়ে দিতে পারো আমার হারানো সেই বারোটা বছর’, আজও দর্শকদের অভিভূত করে রেখেছে৷ চিত্রনাট্যকার অবশ্যই বিভূতি লাহা৷

ছদ্মবেশি ছবির একটি দৃশ্য

একটা কথা চালু আছে যে, রিমেক ছবি চলে না৷ বড়দিদি, প্রিয় বান্ধবী, প্রতিশ্রুতি, মানময়ী গার্লস স্কুল সহ অসংখ্য দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে৷ বিভূতি লাহা সেক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম৷ ১৯৪৪ সালে নির্মিত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত জহর গঙ্গোপাধ্যায়, পদ্মাদেবী অভিনীত ‘ছদ্মবেশী’ সেই সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল৷ বিভূতি লাহা ঝুঁকি নিয়ে সেই ‘ছদ্মবেশী’র রিমেক করলেন ১৯৭১ সালে৷ নায়ক-নায়িকা উত্তমকুমার, মাধবী মুখোপাধ্যায়৷ সে ছবিও সুপার ডুপার হিট ছবি৷ ওই ছবিতে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বিকাশ রায়, অনুভা গুপ্তা, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, তরুণ কুমার, শমিতা বিশ্বাস, জহর রায়, বঙ্কিম ঘোষ প্রমুখ শিল্পী৷ এ ছবির গানগুলি কোনওদিন ভোলবার নয়৷ আমি কোন পথে যে চলি, বাঁচাও কে আছো মরেছি যে প্রেম করে, আমার দিন কাটে না, আরো দূরে চলো যাই প্রভৃতি গানগুলি বারবার শোনার মতো৷

ছবিতে গানের সঠিক ব্যবহারে বিভূতি লাহা সম্ভবত সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন৷ কিছু কালজয়ী গানের উল্লেখ করতেই হয়;জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া, ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা (সবার উপরে‍), প্রাণ ঝরণা জাগলো (লালু ভুলু), এ শুধু গানের দিন এ লগন গান শোনাবার, তুমি না হয় রহিতে কাছে (পথে হল দেরী), বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই (কুহক), লাল ঝুঁটি‍ কাকাতুয়া, শোন শোন শোন মজার কথা ভাই, এই মজার মজার ভেল্কী দেখো (বাদশা), কি মিষ্টি দেখো মিষ্টি, কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল (নায়িকা সংবাদ), তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, তুমি কি এমন করে থাকবে দূরে, ঠুন ঠুন ঠুন কাঁকনে যে কি সুর (অন্তরালে‍), মানুষ খুন হলে পরে, তুমি আমার চিরদিনের সুর, আমি অভিসারে যাবো, লাল নীল সবুজেরই মেলা বসেছে (চিরদিনের), আমার জীবনে নেই আলো (সূর্যতোরণ), আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি মোর নিশীথ বাসর শয্যায় (বিপাশা), সব দুষ্টু ছেলেরাই লক্ষ্মী (কখনো মেঘ),আজ হোলি খেলব শ্যাম(মঞ্জরী অপেরা), বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি এ কোন অপরূপ সৃষ্টি, কে জানে ক’ঘণ্টা, ওরে আমার মন (সোনার খাঁচা)— এ সব গান সময়কে হার মানিয়েছে অনায়াসে৷ সুরে বৈচিত্র্যে আনার জন্য তিনি বিভিন্ন ছবিতে সুরকার হিসাবে ব্যবহার করেছেন অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ প্রমুখ সুরকারদের৷

এবার আসি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে৷ সেই সময়ে বিভূতি লাহা হন্যে হয়ে শিশুশিল্পী খুঁজছেন তাঁর নির্মীয়মাণ ‘বাদশা’ ছবির জন্য৷ প্রোডাকশন কন্ট্রোলার রমেশ সেনগুপ্ত বহু শিশুশিল্পী নিয়ে এসেছিলেন, কাউকেই বিভূতি লাহার পছন্দ হচ্ছিল না৷ আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে বিভূতি লাহা আমায় দেখতে পেয়ে বাবার কাছে প্রস্তাব রাখলেন, ‘আপনার ছেলেকে সিনেমায় নামাবেন?’ বাবা বিনয় কুমার ঘোষ তো শুনে অবাক৷ সিনেমায় নামা মানে তো অধঃপাতে যাওয়া৷ আমি বরাবর পড়াশুনাতে ভালই ছিলাম৷ সিনেমায় নামলে গোল্লায় যাবার সম্ভাবনা তাকে৷ তাই বাবা আপত্তি প্রকাশ করলেন৷ বিভূতি লাহা বাবাকে বোঝালেন, ‘দেখুন আপনার ছেলে তো শিশুশিল্পী হিসাবেই নামবে৷ শিশুশিল্পীর সঙ্গে সর্বদাই গার্জিয়ানরা থাকেন শ্যুটিংয়ের সময়৷ তাছাড়া রোজ তো শ্যুটিং থাকবে না৷ বিকালের মধ্যে প্যাক আপ হয়ে যাবে৷ আউটডোর শ্যুটিং নেই৷ তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?’ এত সুন্দর করে বাবাকে বোঝালেন যে বাবার পক্ষে অসম্মতি জানানো সম্ভব হল না৷ সেই বিভূতি লাহার হাত ধরেই ছবির জগতে আমি প্রবেশ করি৷

বাদশা ছবির একটি দৃশ্য, প্রতিবেদক নিজেই যেখানে অভিনেতা

প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ের আগেই ঘটল এক অঘটন৷ কুকুর, বাঁদর, ছাগল নিয়ে প্র্যাকটিস করছি, গানের রিহার্সাল দিচ্ছি ওই রাধা ফিল্মস স্টুডিওতে৷ এমনি একদিন বাঁদরের সঙ্গে একটু বাঁদরামি করলাম; ‘এই বাঁদর কলা খাবি’ বলে বারংবার বাঁদরটাকে উত্যক্ত করছিলাম, হঠাৎ ঝপ করে বাঁদর লাফ দিয়ে এসে ডান গালের কানের নীচের অংশে বসিয়ে দিল কামড়৷ রক্ত আর রক্ত৷ সবাই হতচকিত৷ বিভূতি লাহা তৎক্ষণাৎ ট্যাক্সি ধরিয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে পাঠালেন৷ তখন আমরা বেলেঘাটায় থাকি৷ বাড়ির ডাক্তার ভৌমিকের চিকিৎসায় সুস্থ হলাম৷ গালের দাগ শুকলো৷ বিভূতি লাহা কিন্তু আমার জায়গায় অন্য কাউকে নিলেন না৷ বিকাশ রায়, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতবরণ, সন্ধ্যারানী, তরুণকুমার সহ নামী শিল্পীদের ডেট নেওয়া, তবু তিনি আমার জন্যই শ্যুটিং স্থগিত রাখলেন৷ আমি সুস্থ হবার পর শ্যুটিং শুরু হল৷ নারকেল ফাটানোর মহরৎ দৃশ্যটিতে আমি প্রথম ক্যামেরার মুখোমুখি হই, সঙ্গে শিল্পী বিকাশ রায়৷ তাঁকে‍ আমি বলছি, ‘ডাক্তারবাবু এখনই চলুন৷ বাপির খুব অসুখ৷’ চোখ দুটি ছলছল করছে৷ ক্যামেরাতে বিভূতি লাহা, একবারে ‘ওকে’৷ বিভূতি লাহা ক্যামেরা থেকে বেরিয়ে এসে কোলে তুলে একবার ঘুরপাক খেলেন৷ ফ্লোরের সবাই অবাক৷ কারণ বিভূতি লাহার মতো রাশভারী মানুষ এমন স্নেহশীল হতে পারেন, তা অনেকেই জানতেন না৷

এরপর যতদিন গেছে, সম্পর্কের গভীরতা বেড়েছে, বিভূতি লাহার সঙ্গে আর কাজ করা হয়নি ঠিকই,তবে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল৷ তাঁর শ্যামবাজারের বাড়িতে যেতাম৷ তাঁকে‍ আমি জ্যেঠু বলতাম, ফলে তাঁর স্ত্রী আমার জ্যেঠিমা৷ তিনি নিউ আলিপুরে বিরাট বাড়ি করে উঠে গেলেন৷ সেই বাড়িতেও একাধিকবার গিয়েছি৷ আমার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলাম৷ উনি একা এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে বৌভাতের দিন দুপুরে৷ খাওয়াদাওয়া করেই গেছিলেন৷ আমার মেয়ের মুখেভাতেও তাঁকে‍ সপরিবারে বলেছিলাম৷ উনি একাই এসেছিলেন৷ কী যে ভাল লেগেছিল৷ নিউ আলিপুরের বড় বাড়ি বিক্রি করে নিউ আলিপুরেই একটা ফ্ল্যাট কিনে উঠে এলেন৷ সেই ফ্ল্যাটেও গেছি৷ তখন শরীর ভেঙে গেছে৷ সিঁড়ি‍ ভাঙতেও কষ্ট হচ্ছে৷ একেবারে শেষ জীবনে নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাট বিক্রি করে ঠাকুরপুকুরের ডায়মন্ড পার্কে ছেলের কাছে সস্ত্রীক চলে গিয়েছিলেন৷ সেই বাড়িতে আমার যাওয়া হয়নি৷ সেই মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জুন৷ ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণ করেছি, সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় ২৮ জুন সংখ্যায় (১৯৯৭)৷

মানুষ নশ্বর, কিন্তু তাঁর কীর্তি অবিনশ্বর৷ তেমনভাবেই বিভূতি লাহা তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়েই চিরজীবী হয়ে থাকবেন৷ তাঁর জীবদ্দশায় রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কোনও পুরস্কার বা স্বীকৃতি তিনি পাননি৷ তবে রজতজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী সপ্তাহ চলা তাঁর ছবিগুলিতে দর্শকদের যে অফুরন্ত ভালবাসা তিনি পেয়েছেন, তা যে কোনও পুরস্কারের থেকেও অনেক মূল্যবান৷

প্রয়াণ মাসে বিভূতি লাহার স্মরণে পুনঃপ্রকাশিত হল৷

শনিবারের চিঠি, এপ্রিল-জুন, ১৪২৪