এ যেন অচেনা এক দেশ৷ বাইরের পৃথিবীর কলরোলের প্রভাব সহজে পৌঁছয় না৷ সাদামাটা মানুষদের শান্ত জীবনযাত্রা৷ যেন কাজ কী বাইরের জগৎ নিয়ে ভাবনায়? নিজেদের গোষ্ঠী এবং জীবনযাত্রাকে সযত্নে আগলে রেখেই যেন ওদের চলা৷ ওরা থাকে জলপাইগুড়ি জেলার ভারত-ভুটান সীমান্তের দক্ষিণ প্রান্তে ভুটান পাহাড়ের গায়ে এলিয়ে থাকা দুর্গম এক জনপদে৷ নাম টোটোপাড়া৷ জনগোষ্ঠীগতভাবে ওদের পরিচিতি টোটো৷
টোটোপাড়া থেকে উত্তরে ভারত-ভুটান সীমান্তে ৩ কিলোমিটার পেরোলেই ভুটানের তাদিং পাহাড়৷ ১১ কিলোমিটার দূরে ভুটানের ফুন্টশলিং৷ দক্ষিণে পাহাড় বেয়ে সমতলের দিকে ১৬ কিলোমিটার এগোলে সবুজ চা-গাছের গালিচা মোড়া লঙ্কাপাড়া চা-বাগান৷ ওদের জনপদের একদিক থমকে দাঁড়িয়েছে ঘন তিতি অরণ্যের প্রান্তসীমায়৷ নদী, জঙ্গল, পাহাড়, ঝোরা, টিলা, ঝর্ণা বেষ্টিত প্রায় ২ হাজার একরে আবদ্ধ অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া টোটোপাড়া যেন শিল্পীর তুলির টানে ফোটানো শৈল্পিক রূপের দৃষ্টিনন্দন এক ল্যান্ডস্কেপ৷ যেন প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর মোহময় অংশের একটি টুকরো ছিঁড়ে এসে পড়েছে এখানে৷ জলপাইগুড়ি জেলার মাদারিহাট ব্লকে এর অবস্থান৷ মাদারিহাট থেকে নদীর বুক ও খাড়া পাহাড়ি পথে ২৩ কিলোমিটার এগোলে টোটোপাড়া৷
অতীতের সন্ধানে
বিবিধের মাঝে মিলনের দেশ ভারতবর্ষ৷ বহিরাগত বিভিন্ন ভাষাভাষী ও জনগোষ্ঠীর মানুষ সুদূর অতীতে এদেশে এসে ভারতকে করে নিয়েছে নিজেদের স্বদেশ৷ হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বহিরাগত এসব জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বতন্ত্রতা নিয়ে এক একটি ফুল হয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গনে রচনা করে আছে গুচ্ছ ফুলের দৃষ্টিনন্দন রূপ৷ বহিরাগত এসব জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি৷ মূলত এরা চার ভাগে চিহ্নিত৷ আর্য, দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক্স এবং মঙ্গোলয়েড৷ হিন্দু সভ্যতার ধারক বলে চিহ্নিত হলেও এদের মধ্যে অস্ট্রিক্স ও মঙ্গোলয়েডের কিছু ক্ষুদ্র ধারা হিন্দুত্বের বাইরে থেকে নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেছে৷ যেমন বিহারের খেড়োয়ারী এবং দ্রাবিড়ীয়া৷ হিমালয়ের পাদদেশে অসম ও উত্তরবঙ্গে এমন বেশ কিছু ক্ষুদ্র জনজাতি হিন্দুত্বের বাইরে বা প্রান্তসীমায় অবস্থান নিয়ে এই দেশকে করেছে স্বদেশ৷ মঙ্গোলয়েড শ্রেণীর এমন একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হল টোটো৷ যারা বিভিন্ন জনজাতির বেষ্টনীতে আবদ্ধ থেকেও ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বংশানুক্রমে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে বসবাস করছে৷ মঙ্গোলয়েড শ্রেণীভুক্ত টোটোরা কখন থেকে এখানে বসবাস করছে তার হদিশ নৃতাত্ত্বিক বা প্রত্নতাত্ত্বিকরা দিতে পারেননি৷ মঙ্গোলয়েডদের মধ্যে কোন ধারার তাঁরা প্রতিনিধি, তাও রহস্যে মোড়া৷ স্বাভাবিকভাবেই কোন সময়ে কোথা থেকে কোন পথে তাঁদের আগমন এসব প্রশ্নেরও উত্তর নেই৷ টুকরো টুকরো প্রাপ্ত কিছু তথ্যের ভিত্তিতে নৃতাত্ত্বিক ড: চারুচন্দ্র সান্যাল মনে করেন, হিমালয় সংলগ্ন অসম ও উত্তরবঙ্গে আর্যদের প্রবেশের কিছু আগে এই এলাকায় তিব্বতি মঙ্গোলয়েড শ্রেণির কিছু জনগোষ্ঠী পায়ে হেঁটে এসেছিল৷ এরা বসতি স্থাপন করে নেপাল, ভূটান ও সিকিম পাহাড়ে৷ একই সময়ে অসম বর্মী শ্রেণীর কিছু মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠী অসম ও উত্তরবঙ্গে ঢুকেছিল৷ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ অসমের বোড়ো গোষ্ঠী৷ এই দুই গোষ্ঠী প্রায়ই পাহাড় সমতলে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংঘর্ষে লিপ্ত হত৷ অসম ও ভুটান পাহাড়ে এরা আধিপত্য বিস্তার করেছিল৷
এদের কোনও একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আজকের টোটো৷ ১৮ শতাব্দীতে ভুটান ও কোচবিহার রাজ্যের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষ লেগেই থাকত৷
টোটো জনজাতি গোষ্ঠী প্রথমে হিমালয় সংলগ্ন অসমে বসেছিল৷ কিন্তু কোনও কারণে তাঁদের অসম থেকে চলে যেতে হয় ভুটানে৷ সেখানেও তাঁরা স্বস্তি পায়নি৷ ভুটানে তাঁদের পরিণত করা হয়েছিল ক্রীতদাসে৷ সেখানে তাঁদের মোটবাহকের কাজ করানো হত৷
১৭৭২ সালের ভুটান কোচবিহার যুদ্ধে পরাজিত কোচবিহারের দখল নেয় ভুটান৷ কোচবিহার রাজ সেসময় সাহায্যের জন্য দ্বারস্থ হন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির৷ ১৭৭৩ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও কোচবিহার রাজ্যের মধ্যে চুক্তির বলে কোম্পানি কোচবিহারের সাহায্যে এগিয়ে আসে৷ কোম্পানির সেনাপতি ক্যাপ্টেন জান্স বক্সা ও ডালিমকোট যুদ্ধে পরাজিত করে ভুটানকে৷ ১৭৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল কোম্পানি ও ভুটান রাজার মধ্যে সন্ধি চুক্তি হয়৷ এতে কোচবিহার রাজা ফিরে পান সিংহাসন৷ ভুটানিরা পায় জলপাইগুড়ি ও নিম্ন অসমের দুয়ারগুলির অধিকার৷ ভারত ও ভুটানের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ছিল এমন ১৮টি দুয়ার বা দরজা৷ যেমন বক্সাদুয়ার, অলিপুরদুয়ার ইত্যাদি৷ কিন্তু কিছুদিন পরেই ভুটানিরা আবার জলপাইগুড়ির ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স ও অসমের ইস্টার্ন ডুয়ার্সের ওপর আক্রমণ হানতে শুরু করে৷ দুই ডুয়ার্সের কিছু মানুষকে ভূটানে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাসে পরিণত করে৷ শুরু করে লুঠতরাজ, জমিদখল, নারী অপহরণ৷ প্রতিকারে ইংরেজরা আবার শুরু করে ভুটানের বিরুদ্ধে অভিযান৷ ১৮৬৪ সালের ভারত-ভুটান যুদ্ধে পরাজিত হয় ভুটান৷ ১৮৬৫ সলের ১১ নভেম্বর ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তিপত্রে সই করে ভুটান৷ চুক্তির শর্তে ভুটানকে চলে যেতে হয় বক্সাদুয়ার পাহাড়ের ওপারে৷ ১৮৬৬-৬৭ সালে ভারত-ভুটান সীমারেখা নতুন করে চিহ্নিত হয়৷ এই চিহ্নিতকরণে পাহাড়ের সবগুলি দুয়ার এবং পুরো ওয়েস্টার্ন ও ইস্টার্ন ডুয়ার্স চলে আসে ভারতে৷ টোটোপাড়ার ভূখণ্ডও তখন থেকে এদেশের৷ অনেকেই মনে করেন, টোটো জনজাতি গোষ্ঠী প্রথমে হিমালয় সংলগ্ন অসমে বসেছিল৷ কিন্তু কোনও কারণে তাঁদের অসম থেকে চলে যেতে হয় ভুটানে৷ সেখানেও তাঁরা স্বস্তি পায়নি৷ ভুটানে তাঁদের পরিণত করা হয়েছিল ক্রীতদাসে৷ সেখানে তাঁদের মোট বাহকের কাজ করানো হত৷ টোটো ভাষায় একে বলে হুই হাওয়া৷ ৬ মাস এই হুই হাওয়া এবং বাকি ৬ মাস নিজেদের চাষাবাদ নিয়ে থাকত টোটোরা৷ ভারতভুক্তির পর এই হুই হাওয়া থেকে মুক্তি পায় টোটোরা৷
অস্তিত্বের সন্ধানে
ভারতের বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসা অতি ক্ষুদ্র আদিম টোটো জনজাতি গোষ্ঠীর অস্তিত্বের কথা ১৮৯৪ সালের আগে জানা যায়নি৷ ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্সের (জলপাইগুড়ি জেলার অংশ) জমি জরিপের দায়িত্বে ছিলেন ডি সান্ডার৷ তিনিই প্রথম ৭ পাতার একটি নোট লিখে টোটো জনজাতি গোষ্ঠীর সন্ধান দেন৷ এরপর ১৯০৬ থেকে ১৯১৬-র মধ্যে দ্বিতীয় জরিপের সময় জে মিলিগান টোটোদের নিয়ে দু’পাতার একটি নোট দেন৷ ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫-এ তৃতীয় জরিপে বি মুখার্জি টোটোদের পরিচয় দেন আট পৃষ্ঠায়৷ টোটোদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত প্রথম পাওয়া যায় ১৯৫১-র আদমসুমারী দায়িত্বপ্রাপ্ত এ মিত্রের রিপোর্টে৷ তখন টোটোদের মোট জনসংখ্যা ৩২৫৷ সারা দেশে আদিম জনজাতি গোষ্ঠীর সংখ্যা এখন ৭৪টি৷ ১৯৩৫ সালের সংরক্ষণ তালিকায় রাখা হয় দেশের ৬২টি তপশিলি জাতি ও ১৪টি উপজাতিকে৷ অস্তিত্বের সন্ধান না থাকায় তখন তালিকায় স্থান পায়নি টোটোরা৷ ১৯৫০-এর তালিকাতেও বাদ থেকে যায় টেটোরা৷ ১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর টোটোরা অন্তর্ভুক্ত হয় সংবিধানের সপ্তম তপশীলের সংরক্ষিত উপজাতিদের তালিকায়৷ সারা দেশে এখন একই জায়গায় আবদ্ধ চারটি অনুন্নত তপশীলি আদিম উপজাতি গোষ্ঠী রয়েছে৷ এরা হল কেরলের কাদার চোলা এবং নেইকনস, উত্তরপ্রদেশের রাজীশ এবং পশ্চিমবঙ্গের টোটো৷ রাজ্যে এখন তিনটি জনজাতিকে আদিম মানবগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এরা হল বীরহোড়, লোধা এবং টোটো৷ জনসংখ্যার দিক থেকে এদের মধ্যে সবচেয়ে সংখ্যালঘু টোটোরা৷ জে মিলিগানের রিপোর্ট অনুসারে ১৯০১ সালে টোটোদের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৭২ জন৷ ১৯৬৫ সালে ছিল ৪৪৭ জন৷ ১৯৭৫-এ ছিল ৬১৪ জন৷ ১৯৮৫-তে ছিল ৭৯৫ জন৷ ১৯৯৫-তে বেড়ে হয় ১০১১ জন৷ ২০০৫-এ হয় ১৯৮২ জন৷ বর্তমান জনসংখ্যা ১৪০২ জন৷
টোটোদের রয়েছে লিপিহীন নিজস্ব কথ্য ভাষা৷ এই ভাষাতেই তারা কথা বলে৷ ভাষাবিদ গিয়ার্সন ১৯০৯ সালে প্রথম টোটোদের নিজস্ব ভাষার ওপর আলোকপাত করেন৷ টোটোরা তাঁদের ভাষাকে বলে দিয়্যঁ এক্যা৷ টোটো কথ্য ভাষায় শব্দ সংখ্যা খুব কম৷ টেটো ভাষার সঙ্গে একমাত্র ধীমাল উপজাতিদের ভাষার কিছুটা মিল রয়েছে৷ অন্যান্য উপজাতি ভাষার সঙ্গে টোটো ভাষার কোন মিল নেই৷
একবার ঘুরে আসা
জলপাইগুড়ি জেলার চা বলয় ডুয়ার্সের মাদারিহাট থেকে টোটোপাড়ার দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার৷ সামান্য এই পথটুকু পাড়ি দিতে গেলে সময় কিন্তু লেগে যায় প্রায় দু’ঘণ্টার ওপর৷ দুর্গম পথে রোমাঞ্চকর যাত্রা৷ একবার গেলে ভোলা কঠিন৷ ২৩ কিলোমিটার পথ যেতে পার হতে হয় ৫টি নদী৷ সমতল এবং খাড়া পাহাড়ি পথে পড়ে লহ্কাপাড়া, হান্টাপাড়া, চা-বাগানের চা গাছের সবুজ গালিচা৷ ঘন তিতি জঙ্গল৷ প্রাকৃতিক নান্দনিক রূপ উপভোগ করে পৌঁছতে হয় টোটোপাড়া৷ যে ৫টি নদী পেরোতে হয় তাদেরও রয়েছে বিচিত্র চরিত্র৷ নদীগুলি হল তিতি, বাংরি, ঝুড়ি, হাউরি এবং বড় হাউরি৷ নদীগুলিতে সেতু নেই৷ অধিকাংশ সময় নদীতে জলও থাকে না৷ জানা না থাকলে বোঝাই যাবে না যে এগুলি বড় বড় নদী৷ টোটোপাড়া যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে দেখা যায় অনেকটা শুকনো জায়গা জুড়ে বিছানো রয়েছে বালি, পাথর, বোল্ডার৷ এগুলোই নদীর বুক৷ এর ওপর দিয়েই চলাচল করে গাড়ি৷ চলে পায়ে হাঁটা৷ বিশেষত বর্ষায় হঠাৎ নদীগুলিতে নেমে আসে অনেকটা উঁচু ভয়ঙ্কর স্রোতের ভয়াবহ জলের ঢল৷ শুকনো নদীর বুক তখন থাকে সংহার মূর্তিতে৷ দু-তিন ঘণ্টা আবার কখনও কখনও টানা আট-দশ দিন নদী নিয়ে থাকে এমন ভয়ঙ্কর রুদ্র রূপ৷ পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রচণ্ড স্রোতের নদী পারাপার তখন অসম্ভব৷ টোটোপাড়া তখন বহির্জগৎ থেকে হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন৷ একটা সাঁই সাঁই আগাম বার্তায় এলাকার মানুষ বুঝতে পারে নদীতে জল আসছে৷ সতর্কতার বার্তা ছড়াতেই টোটোপাড়া যাওয়ার রাস্তা শুনশান৷ ইংরেজ আমলে দক্ষিণ দিক থেকে হাসিমারা সেতু পেরিয়ে তোর্সা নদী ও তিতি অরণ্যের মাঝ দিয়ে রেলের ট্রলি লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া যেত টোটোপাড়া৷ ১৬ কিলোমিটারের এই রাস্তা ও ট্রলি লাইন বহু বছর ধরে বন্ধ৷ ১২০০ ফুট উচ্চতার টোটোপাড়ার আয়তন ১৯৯৭ একর৷ উত্তরে ভুটান পাহাড়৷ ৩ কিলোমিটার দূরে পাহাড় চূড়ায় ভুটানের তাদিং পাহাড়ি গ্রাম৷ পূর্বে তোর্ষা নদী৷ টোটো ভাষায় যে নদীর নাম মেরিম তি৷ দক্ষিণে ঘন তিতি অরণ্য৷ ১৬ কিলোমিটার দূরে সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন হাসিমারা৷ উত্তর থেকে দক্ষিণে জমির ঢালের টোটোপাড়ায় রয়েছে ৬টি গ্রাম৷ পঞ্চায়েত গাঁও, মণ্ডল গাঁও, সুব্বা গাঁও, মিত্রাং গাঁও, দুমসি গাঁও ও পোঁয়ার গাঁও৷ ৬টি বড় নদী বয়ে চলেছে টোটোপাড়া দিয়ে৷ এছাড়া ভুটান থেকে নেমে টোটোপাড়ার ভেতর দিয়ে তির তির করে বয়ে গিয়ে হাউরি ও তোর্ষাতে মিশেছে আরও ১২টি ছোট ছোট নদী৷ এগুলি হল গোঁয়াতি, নামসিতি, দীপ্তি, চুয়াতি, নিতিংতি, জৈতি, উদিংতি, কিতিংতি ইত্যাদি৷ টোটোপাড়ায় রয়েছে ৪টি পাহাড়৷ এগুলি পদুয়া, ইম্পা, দাম্পি এবং দ্রপুংলাকা৷ পাহাড়, টিলা, ঘন অরণ্য নদী ঝোরা ঘেরা টোটোপাড়ার জনসংখ্যা এখন ২৯৭টি পরিবারের ১৪০৭ জন৷ এদের মধ্যে পুরুষ ৭৪৮ এবং মহিলা ৬৫৯ জন৷ টোটোরা ১৩টি গোষ্ঠীতে ভাগ করা৷ ১৯০১ সালে টোটোদের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৭২ জন৷ ১৯৯৩ সালে ছিল ৯০৪ জন৷ বিলুপ্ত হওয়ার প্রবণতা রুখতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সরকারি নানা উদ্যোগে টোটোদের জনসংখ্যা এখন বাড়ছে৷ এই জনজাতি গোষ্ঠীর সকলেরই বাস টোটাপাড়ায়৷ ব্যতিক্রমের সংখ্যা খুবই সামান্য৷ দূর অতীতে মাল-এর টটগাঁও, ধূপগুড়ির তোতাপাড়া, আলিপুরদুয়ারের টটপাড়া, ফালাকাটার টোটোপাড়ায় টোটোদের সন্ধান মিলেছিল৷ এখন এসব জায়গায় একজনও টোটো নেই৷
টোটো নামটি কেন এবং কীভাবে এসেছে এ তথ্যও অজানা৷ বাংলায় টোটো বলে একটা শব্দ আছে৷ কিন্তু বাঙালিদের সঙ্গে টোটোদের মিশ্রণ অনেক পরে৷ ভুটানিদের ভুটিয়া ভাষাতেও আছে টোটো শব্দ৷ যার অর্থ অবয়ব৷ লিম্বু ভাষায় রয়েছে টেটো-ফংগ নামে একটি শব্দ৷ যার অর্থ ঝলসানো মাংস৷ যা লিম্বুদের মতো টোটোদেরও একসময় ছিল অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য৷ রাভা জনজাতির রয়েছে তাপ্ত নামে শব্দ৷ যার অর্থ দ্রুত৷ আবার টোটো ভাষায় রয়েছে টোটোওয়াং নামে একটি শব্দ৷ যার অর্থ তাড়াতাড়ি আসা৷ মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর এসব জনজাতির সঙ্গে টোটোদের মিশ্রণ স্বাভাবিক৷ হয়তো এসব জনজাতির ব্যবহৃত শব্দ থেকে টোটো নামের উৎপত্তি৷
দেহ বল্লরী আবরণ
টোটোদের উচ্চতা মাঝারি৷ কালো রংয়ের সোজা লম্বা চুল৷ মুখের গড়ন অনান্য মঙ্গোলয়েড শ্রেণিদের মত৷ ছোট চোখ৷ চোখের ওপরের পাতা একটু ঝোলানো৷ নাক সরু৷ কিছুটা চ্যাপ্টা৷ ঠোঁট পুরু৷ গায়ের রং হলদে তামাটে৷ চোখের রং কালোর কাছাকাছি ঘন খয়েরি৷ টোটো ছেলেদের পোষাককে বলে ওয়াংদুদা৷ এটির দুটো ভাগ৷ একটি কাপড় কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে জড়ানো থাকে শরীর৷ কোমরে থাকে কাপড়ের বন্ধনী৷ অনেকে এর ওপর আর একটি লম্বা কাপড়ের অংশ ব্যবহার করে৷ এটি কাঁধের দু’পাশ দিয়ে কাঁধ ও বুক ঢেকে নেমে আসে কোমর পর্যন্ত৷ গলায় একটি ফেট্টিতে শক্ত করে বাঁধা থাকে এই কাপড়৷ টোটো ভাষায় মেয়েদের পোশাককে বলে জুয়াংওয়া৷ এটির তিনটি অংশ৷ কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত জড়ানো থাকে একটি কাপড়ে৷ বিজিং নামে আর একটি কাপড় থাকে কোমরে জড়ানো৷ টুম্বা নামের কাপড়ের টুকরোয় জড়ানো থাকে বুক ও পিঠ৷ অনেক মেয়ে মাথায় বাঁধে ফেট্টি৷ এর নাম পারি৷ ছেলে ও মেয়েরা হাতে পরে রুপো বা অন্য কোনও সস্তা ধাতুর বালা৷ ছেলেদের থাকে এক হাতে৷ একে বলে ইরিং৷ ইদানিং মেয়েরা পরেছে কাচের চুড়ি৷ এর নাম বোতাল৷ সামর্থ থাকলে মেয়েরা গলায় পরে মালা (তিশে)৷ আঙ্গুলে আংটি (কেই)৷ কানে দুল (নারসি)৷ ওরা ব্যবহার করে বাঁশের তৈরি চিরুনী (বিদা)৷ উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে টোটোদের প্রথাগত পোষাক বিদায় নিচ্ছে৷ এখন ছেলেরা পরে প্যান্ট শার্ট৷ মেয়েরা সালোয়ার কামিজ এবং শাড়ি৷
ক্রমশ …
পরবর্তী অংশ ২ জুলাই 2024 প্রকাশিত হবে