রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ (পর্ব-৫, ৬)

পর্ব -৫

জজ সাহেবের উদ্ধারকর্তা দ্বারকানাথ

দ্বারকানাথের প্রথম জীবনীকার কিশোরীচাঁদ মিত্র তাঁর  ‘ Memoir of Dwarkanath Tagore ‘ গ্রন্থে দ্বারকানাথের অসাধারণ ঔদার্য ও সকলকে বিশ্বাস করার সহজ প্রবণতা বিষয়ে অনেকগুলি ঘটনার উল্লেখ করেছেন ।কিশোরীচাঁদ মিত্র বাংলা দেশের কোনো এক জেলার জজসাহেবের একটি কাহিনীর কথা লিখেছেন । জজসাহেব অসুস্থ হয়ে দীর্ঘ অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন।তিনি বিলাত পাড়ি দেবার পথে সস্ত্রীক কলকাতায় স্পেন্সেস্  হোটেলে এসে অবস্থান করেন ।এই সময়ে তিনি প্রায় লক্ষ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়েছিলেন ।কলকাতায় তাঁর পাওনাদারেরা শাসায়,যদি তিনি তাঁর কর্জের এক লক্ষ টাকা না দিতে পারেন, তাহলে তাঁর বিলেত যাওয়া বন্ধ করে তাঁকে পাঠাবে দেনদারদের কয়েদখানায়। স্বাস্থ্যের সংকটজনক  অবস্থায় বায়ু- পরিবর্তনে নিরাময় হবার আশা ত্যাগ করে জেলখানায় পচা মানে নিশ্চিত মৃত্যু ।এই দুভার্বনায় তিনি কাতর হয়ে পড়লেন ।কোন উপায় স্থির না করতে পেরে তিনি স্থির করলেন দ্বারকানাথ কে সমস্ত বিষয়টা জানাবেন ।  যখন এই ঘটনা ঘটে, তখন দ্বারকানাথের পরোপকারের কথা এবং তাঁর মহানুভবতার কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, তখন দ্বারকানাথের ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কাজ প্রবলবেগে চলছে, তিনি অনেক ঋণগ্রস্ত সিভিলিয়ান ও বণিকের ঋণ শোধ করেছেন ।দ্বারকানাথের সঙ্গে জজসাহেবের ব্যক্তিগত  পরিচয়  না থাকলেও তিনি শুনেছিলেন দ্বারকানাথ বিপন্ন ব্যক্তিদের সাহায্য করে থাকেন ।তাই তিনি উদার হৃদয় দ্বারকানাথের সাহায্যপ্রার্থী হলেন।নিজের বিপদজ্জনক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে দ্বারকানাথের সাহায্য ভিক্ষা করে জজসাহেব তাঁকে চিঠি লিখলেন ।চিঠি পেয়েই দ্বারকানাথ খোঁজ নিলেন জজসাহেবের উক্তির সত্যাসত্য নিয়ে  এবং সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ামাত্র জজসাহেবের পাওনাদারদের প্রাপ্য লক্ষ টাকা পরিশোধ করে তাদের কাছে জজসাহেবের স্বাক্ষরিত মুচলেখা ও অন্যান্য দলিলপত্র ফেরত চেয়ে নিলেন।এই সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে দ্বারকানাথ চলে গেলেন জজসাহেবের কাছে। দ্বারকানাথ কে কাছে পেয়ে জজসাহেব কাঁদতে কাঁদতে দ্বারকানাথ কে নিজে বিপন্নতার কথা জানাতে লাগলেন ।সায়েবকে বেশি কথা বলতে না দিয়ে দ্বারকানাথ জজসাহেবের হাতে সেইসব কাগজপত্র গুঁজে দিয়ে বললেন তিনি এখন স্বচ্ছন্দে য়ুরোপ যেতে পারেন।সাহেবের দুই চোখ দিয়ে কৃতজ্ঞতার অশ্রু গড়াতে শুরু করল।দ্বারকানাথের দুটি হাত ধরে জজসাহেব সমস্ত টাকার জন্য খত লিখে দিতে চাইলেন ।কিন্তু দ্বারকানাথ তা নিতে অস্বীকার করলেন এবং সায়েবকে বললেন, ” সায়েব যদি বিলেতে গিয়ে মারা যান তবে এ মুচলেখা কোনো কাজে লাগবে না,বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিতে হবে ।আর যদি সায়েব বেঁচেবর্তে বিলেতে ছুটি কাটিয়ে ভারতে ফিরে আসেন,  তাহলে তো টাকাটা নিশ্চয় তিনি ফেরৎ দিয়ে দেবেন ।

পর্ব-৬

দ্বন্ধযুদ্ধে  দ্বারকানাথ

মহারাণী ভিক্টোরিয়া ও দ্বারকানাথের প্রীতিসম্পর্ক ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত আছে ।দ্বারকানাথের রূপ, ঐশ্বর্য ও প্রতিভার সঙ্গে শিভালরিও  যুক্ত হয়ে তাঁর মনোহারিত্ব প্রবল করেছিল।মহারাণীর দরবারে ও অভিজাত সমাজে দ্বারকানাথের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখে ইস্ট ইন্ডিয়ার ডিরেক্টররা আতঙ্কিত বোধ করেন ।দ্বারকানাথের শিভালরি ঘিরেও গল্প গল্প প্রচলিত আছে।একটি গল্প আছে যে একদা কোনো প্রণয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁকে দ্বৈরথে আহ্বান করেন ।তিনি ঘোষণা করেন যে প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বদেশী পোশাকে স্বদেশী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসবেন ।তারপর যথাকালে সর্বাঙ্গে তেল মেখে কৌপীনবস্ত্রে দ্বারকানাথ মোটা বাঁশের তেল মাখানো লাঠি নিয়ে রণক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কে চমৎকৃত করে দিলেন।মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর ” রবীন্দ্রনাথ- গৃহে ও বিশ্বে” গ্রন্থে লিখেছেন-” ঐ লাঠির বাড়ি পড়লে ফিনফিনে তলোয়ার এক মুহূর্ত টিকতে পারে না, কিন্তু দ্বারকানাথ অবিচল- তাঁর স্বদেশীয় পোশাক ও অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার নিশ্চয়ই আছে।” দ্বন্দ্বযুদ্ধের   ফলাফল কী হয়েছিল তা মৈত্রেয়ী দেবী জানাননি।গল্পটির উৎস সম্মদ্ধে ও তিনি কিছু লেখেননি, তবে দ্বারকানাথ কে নিয়ে এই গল্প টি তাঁর চরিত্রের বীরত্ব ও জাত্যাভিমান কে স্পষ্ট করে তোলে।

 


“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১ এবং পর্ব ২ পড়তে হলে ক্লিক করুন
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৩ এবং পর্ব ৪ পড়তে হলে ক্লিক করুন।