চন্দননগরের বিখ্যাত মানুষ বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঠিক জন্মতারিখটি বোধ করি কেউ বলতে পারবনে না— ১৫ অথবা ২৫ মে, ১৮৮৬ সাল—কোনটি ঠিক৷ রাসবিহারীর নিজেরও ধন্দ ছিল, অতএব নিরাপদে থাকার জন্য তিনি বলতেন, তারিখটি ঠিক বলতে পারবেন না বাপু— তবে ১৮৮৬ সালের মে মাসটায় যে জন্মেছিলাম— এতে ভুল নেই৷
জন্মবিপ্লবী এই মানুষটা ভারতকে ব্রিটিশের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য অনেকটা সুভাষচন্দ্র বসুর পথানুসরণ করেছিলেন৷ জাপান ও ইংল্যান্ডের বিবাদের সুযোগ নিয়ে তিনি জাপানে গিয়ে তাদের ভূমি থেকেই ভারত-স্বাধীনতার কৌশল নিয়েছিলেন৷ সে সব অনেক কথা৷ তখনও তিরিশ বছর পুরো হয়নি তাঁর— ১৯১৫ সালের ১২ মে একটা জাপানি জাহাজে চড়ে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন ব্রিটিশরাজের চোখকে ফাঁকি দিয়ে৷ নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় প্রিয়নাথ ঠাকুরের ছদ্মনামে টিকিট কেটে তিনি কলকাতা থেকে জাপানের কোবের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন৷ এই সময় জাপানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন হেরম্বলাল গুপ্ত নামে জনৈক ভারতীয় একই উদ্দেশ্য নিয়ে৷ নানা জায়গায় ঘুরে দু’জনে এক জায়গায় উপস্থিত হলেন এবং নানান জায়গায় লুকিয়ে থাকতে লাগলেন৷ ইংরেজদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে থাকতে লুকিয়ে একটা প্রেমের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল রাসবিহারীর জীবনে— তা যেমন রোমাঞ্চকর তেমনই মনোহর৷
জাপানের শিনজুকু অঞ্চলের এক বিখ্যাত বেকারি নাকামুরায়া বেকারি৷ এর মালিক ছিলেন রেশমশিল্পে বিশেষজ্ঞ এক ভদ্রলোক— নাম, সোমা৷ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত এই মানুষটি মদ্যপান-বিরোধী এবং গণিকাবৃত্তি-বিরোধী আন্দোলনে ছোট থেকেই জড়িয়ে পড়েন৷ সঙ্গে চেয়েছিলেন পরবর্তীকালে আধুনিক জাপানের পয়লা নম্বর ভাস্কর মেরিযে ওগিহারাকে৷ এরই কন্যা সন্তান কোক্কো সোমা কৈশোর থেকেই লেখালেখিতে যেমন নাম করেছিলেন, তেমনই প্রেম, বিয়ে এবং বিবাহবিচ্ছেদ নিয়েও খুব হইচই ফেলে দিয়েছিলেন৷ পরে অবশ্য আইজোকে বিয়ে করে একটা সুস্থ জীবনযাপন করতে শুরু করেন৷ জাপনে বেকারির চাহিদা থাকলেও এই শিল্পটা তখনও খুব একটা সামনে আসেনি৷ এঁরা নবদম্পতি নাকামুরায়া নামে একটা বিশাল এবং নামকরা বেকারি স্থাপন করে খুব একটা হইচই ফেলে দিয়েছিলেন৷
আইজোর সঙ্গে দাম্পত্যজীবন স্থাপনের ফসল স্বরূপ তাঁদের একটি কন্যা সন্তান তোসিকো সোমার জন্ম হলো৷ এদিকে বেকারির ব্যবসায় তাঁরা ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন৷ হোডাকায় আইজোর বাবার কাছে মেয়েকে তাঁরা পাঠিয়ে দিয়েছেন পড়াশোনার জন্য৷ সেখানে বিধিবদ্ধ পড়াশোনার শেষে তোসিকো বাবা-মায়ের কাছে ফিরে এসেছেন৷ মেয়েকে তখন তাঁরা আমেরিকান ডিসিপ্লিন চার্চের অধীনস্থ একটি গার্লস স্কুলে ভর্তি করে দিলেন আরও পড়াশোনার জন্য৷ সেখানের একটি ছাত্রীনিবাসে থেকে সে পড়াশোনা করে৷ সপ্তাহের শেষে শিনকুজুতে এসে মা-বাবার সঙ্গে কাটিয়ে যায়৷ এই মিশনারি স্কুলে সে জাপানি ভাষার বাইরে খুব ভালভাবে ইংরাজি শিখতে আরম্ভ করেছিল৷
এর মধ্যে সোমাদের বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটে গেছে৷ তাঁদের বেকারিতে তাঁরা একটা চমৎকার স্টুডিও বসিয়েছেন৷ সেখানে সুনে নাকামুরা (Tsune Nakamura) নামে একজন চিত্রকর (পরে ইনিই আধুনিক জাপানের পাশ্চাত্য চিত্রকলার প্রবর্তক হন) এসে নাকামুরায়া সেলুনে স্টুডিও খুলে সেখানেই থাকতে আরম্ভ করেছিলেন৷
একদিন নাকামুরা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন, বুকে অসহ্য যন্ত্রণা, তার সঙ্গে প্রায়ই রক্তবমি হয় তাঁর৷ তবুও ছবি আঁকা তিনি ছাড়তে পারেন না৷ তোসিকোকে স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে তাঁর মডেল করে ফেলেছেন লুকিয়ে লুকিয়ে৷ তকে নগ্ন করে তার ছবি আঁকেন৷ তোসিকোর বেশ মজা লাগে৷ সে তখনও বালিকা— নাকামুরাকে মাঝে মাঝে আদর করে বসে৷ তাতেই তার নগ্নমূর্তির ছবি কখনও ‘বালিকার নগ্নমূতি’, কখনও ‘নারীপ্রতিমা’ কখনও বা ‘একটি মেয়ে’ নাম দিয়ে তিনি সেসব ছবি আঁকতে লাগলেন—সেগুলি খুব নাম করল৷ সোমা-দম্পতি তখনও জানতে পারেননি এসব কথা৷
ফলে নাকামুরা তোসিকোর প্রেমে পড়ে গেলেন৷ সব কথা জানতে পেরে কোক্কো যেমন রাগে অগ্নিশর্মা তেমনই রেগে গেলেন তার স্কুলের শিক্ষকেরাও৷ তাঁরা দু’জনকে জোর করে আলাদা করতে চাইলেন৷ নাকামুরা তত তাঁকে আঁকড়ে ধরে থাকছেন৷ নাকামুরা বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, কিন্তু মায়ের প্রবল আপত্তি৷ বাধ্য হয়ে নাকামুরা স্কুডিও ছেড়ে চলে গেলেন৷ তোসিকোর মনের যন্ত্রণা মা একটুও বুঝলেন না৷ বালিকা থেকে তোসিকো যেন অভিজ্ঞ নারী হয়ে উঠলেন৷
বিয়ের কথা এগিয়ে চলল৷ ৯ জুলাই ১৯৪৮— পরিচয়ের খুব তাড়াতাড়িই তাঁদের বিয়ে হল— কোনও সমারোহ ছাড়াই৷ বসুর পক্ষে তো কেউই নেই, কনে পক্ষের আত্মীয়স্বজনরাও কেউ এলেন না৷ খুব একটা সাধারণ পোশাক পরে বাবার সঙ্গে ট্রামে চড়ে তোসিকো তোয়ামার বাড়িতে এলেন৷ তাকাশিমারায় ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকে কিনে আনা ওয়েডিং কিমোনো পরিয়ে দিলেন শ্রীমতী তোয়ামা৷
ঠিক এমন সময়েই সেই ফাঁকা স্টুডিওতে গোপন আশ্রয়, বলতে পারি অজ্ঞাতবাসের জন্য হাজির হলেন রাসবিহারী বসু এবং হেরম্বলাল গুপ্ত৷ ব্রিটিশের গুপ্তচর তাঁদের পিছনে ধাওয়া করেই চলেছে আর তাঁরা নানা ছদ্মবেশে জাপানের এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা এই স্টুডিওতে এসে পড়লেন৷ সেটিকে ফাঁকা দেখতে পেয়ে মুরগি যেমন তা দেওয়ার জন্য বসে থাকে, ঘরের মেঝেতে তেমন করেই লুকিয়ে রইলেন৷ মালিকেরা কি কখনও স্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে এই ছবির ঘরে ভারতবর্ষ থেকে পালিয়ে আসা বিপ্লবীরা আস্তানা গাড়বে!অনেক মানসিক টানাপোড়েন, অনেক ভাবনাচিন্তা, কারাবাসের ভয়— সব বিচার করে তাঁরা আশ্রয় দিলেন৷ কিন্তু শরণার্থীরা যে জাপানি কথা জানেন না৷ নাকামুরায়াতেও কেউ ইংরেজি জানে না কোক্কো এবং তাঁর মেয়ে তোসিকো ছাড়া৷ তোসিকো খুব ভয় পেয়ে গেছেন— কী জানি কী হয়! রাতের বেলায় তাঁর মা গিয়ে খবরের কাগজে ‘ভারতীয়দের পালিয়ে যাওয়া’ নিয়ে যে খবর বের হয়েছিল তা বসু-গুপ্তদের ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনালেন৷ কাগজে লেখা ছিল বিপ্লবীরা কোবে শহরে লুকিয়ে আছে৷ রাসবিহারী শুনে একচোট হেসে নিলেন৷
কোক্কোর আবার একটি মেয়ে হয়েছে সদ্য সদ্য৷ নাম দিয়েছেন তেৎসুকো৷ এখানে বসুদের থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে— কিন্তু উপায় কী! অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ দুটোর দৃষ্টিশক্তিও যেন চলে যাচ্ছে৷ স্টুডিওতে কোনও বাথরুম নেই, স্নান নিষিদ্ধ অতএব৷ এরই মধ্যে হেরম্বলাল অন্যত্র চলে গেলেন৷
এরই মধ্যে নির্বাসনের আদেশ ফিরিয়ে নিয়েছে ব্রিটিশ সরকার৷ রাসবিহারী বিপুল উৎসাহে জাপানি কথা শিখে চলেছেন৷ বই পড়েন আর কোক্কোর কাছে শেখেন৷ এখন বসু মুক্ত পুরুষ৷ তিনি ওই স্টুডিওর তামসকক্ষ ছেড়ে দিলেন৷ তারপরে শিনরায়ুডো মাচির (আজাবু শহরে) একটা নতুন আস্তানায় উঠে এলেন— এখন তাঁর গায়ে জাপানি পোশাক আর মুখে জপানি বুলি৷ একদিন তো একটা ছোটখাট মিলন সভায় জাপানিতেই একটা বক্তৃতা দিয়ে বসলেন রাসবিহারী— কোক্কো সোমা তো অবাক৷ আরও অবাক কাণ্ড বিপ্লবী মানুষটি অন্যরকম বিপ্লব ঘটিয়েছেন— সবাইকে খাওয়ানোর জন্য এদিনের পার্টিতে নিজে হাতে রান্না করেছেন ‘ইন্ডিয়ান কারি— জাপানের লোক কস্মিনকালে এমন খাবার খায়নি—নাকামুরাতে এ এক নতুন সংযোজন— কপিরাইট যাঁর, তিনি বিপ্লবী রাসবিহারী বসু৷ এবং মাননীয় বসু এই পার্টিতে প্রথম একটি মেয়েকে দেখলেন যাঁর নাম কুমারী তোসিকো—আইজো আর কোক্কো সোমার সেই মেয়েটি৷ সারা মুখ জুড়ে একটা বেদনার মায়া৷ বাবা-মা তাঁকে চোখে চোখে রেখেছেন—ভুবনে প্রেমের ফাঁদ পাতা, কে কোথায় আবার ধরা পড়ে যায়৷ মেয়েটি খুব কম কথা বললেন এবং যা বললেন তা নির্ভুল এবং স্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণে৷ কিন্তু তাতেই তাঁর চিবুকে ওষ্ঠাধরে উচ্চারিত হল সংযম ও ব্যক্তিত্ব৷
এখন রাসবিহারী মুক্ত কিন্তু ব্রিটিশ টিকটিকির গোপন নজর তাঁর পিছন ছাড়েনি৷ সেজন্যেই তো কতবার কত ছদ্মবেশ তাঁকে ধারণ করতে হয়েছে৷ কখনও ভবঘুরে, কখনও আনাজ-বিক্রেতা, কখনও বা আরও সাধারণ মানুষ৷ এজন্যে তাঁর জীবনে একজন জীবন-সহায়কের বিশেষ দরকার৷ তোয়ামা— বসুর বর্তমান আশ্রয়দাতা— খুঁজে-পেতে ওই তোসিকোকেই সেই দায়িত্বটা দিতে চাইলেন৷ মিচিরু তোয়ামার এই অনুরোধ শুনেই তোসিকোর মা-বাবা আঁতকে উঠলেন৷ কী বলছেন তোয়ামা? তোসিকোর সঙ্গে রাসবিহারী বসু নামে একটা অজানা-অচেনা ভিনদেশি মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠবে৷ কোন মা চান যে তাঁর জামাই হবে সেই লোক যাঁর পিছনে হুলিয়া জারি হয়ে আছে— জীবন যাঁর টলমল করছে৷ তোসিকো কি জেলে পচবে ওই লোকটাকে বিয়ে করে! কিন্তু ন্যাশনালিস্ট গ্রুপ জোনিওসার সর্বময় কর্তা মিচিরু তোয়ামার অনুরোধ ঠেলে ফেলা আরও দুরূহ৷ সোমা মেয়েকে বললেন— তুই কী ভাবিস এ ব্যাপারে৷ ভেবে দেখ সব— আর পাঁচটা বিয়ে থেকে এটা হবে সম্পূর্ণ আলাদা৷
চুপ করে রইলেন তোসিকো— গভীর হ্রদের মতো শান্ত৷ তারপর দুটি সপ্তাহ কেটে গেল৷ মায়ের হৃদসম্পন্দনকে বাড়িয়ে দিয়ে তোসিকো বললেন— তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন— রাসবিহারী বসুকেই বিয়ে করবেন৷
–সবদিক ভেবে দেখেছিস?
— হ্যাঁ মা, সব দিক ভেবেই বলছি৷
— তোর জীবনে কিন্তু বিপদের গন্ধ পাচ্ছি৷
— আমি বাবার আর তোমার মনের অনুভব উপলব্ধি করতে পারছি মা৷
এবার রাসবিহারীও সম্মত হলেন বিয়েতে৷ সংকটের মুখোমুখি হলেও ঘাবড়ে যাওয়ার মেয়ে নয় তোসিকো—তা যেন মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারলেন তিনি৷ এমন মেয়েকে তিনি ভাল না বেসে থাকতেই পারেন না৷ দু’জনে গভীর প্রেমে নিমগ্ন হলেন৷
বিয়ের কথা এগিয়ে চলল৷ ৯ জুলাই ১৯৪৮— পরিচয়ের খুব তাড়াতাড়িই তাঁদের বিয়ে হল— কোনও সমারোহ ছাড়াই৷ বসুর পক্ষে তো কেউই নেই, কনে পক্ষের আত্মীয়স্বজনরাও কেউ এলেন না৷ খুব একটা সাধারণ পোশাক পরে বাবার সঙ্গে ট্রামে চড়ে তোসিকো তোয়ামার বাড়িতে এলেন৷ তাকাশিমারায় ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকে কিনে আনা ওয়েডিং কিমোনো পরিয়ে দিলেন শ্রীমতী তোয়ামা৷ তিনি সোমাকে পরে অনুযোগ করে বলেছিলেন—মেয়েটার জন্য দুঃখ হয়! নিজের বাড়ি থেকে ওকে বিদায়ী ভালবাসা জানাতে পারলেন না!
বসু বললেন, সত্যিসত্যিই যদি তুমি আমাকে ভালবাস তবে আমি তার প্রমাণ চাই৷ তুমি কি আমার জন্য মরতে পারো? এই রেলিং থেকে তুমি ঝাঁপ দিতে পারো গভীর নীচে?
তোসিকো স্তম্ভিত এবং খুবই টানটান হয়ে উঠলেন৷ এত বড় কথা!সোজা দাঁড়িয়ে তিনি রেলিংগুলোর দিকে দৌড়ে গেলেন৷
শিবার আতাগোমায়া অঞ্চলে একটি বাড়ি ভাড়া করে বসুর দাম্পত্যজীবন শুরু হল৷ কিন্তু টিকটিকিরা পিছন ছাড়ে না৷ একটার পর একটা বাড়ি বদল করে করেই তাঁদের উৎকণ্ঠিত বিবাহিত জীবনের কন্টকজ্বালা অনুভব করতে পারলেন তোসিকো৷ একটু কি অবসন্ন তিনি! মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না, সাড়াশব্দও বেশি দেন না৷ রাসবিহারীর মনে সংশয়ের কাঁটা বিঁধতে লাগল— তবে কি তোসিকো তাঁকে ভালবাসেন না, শুধু চাপে পড়ে বিয়ে করেছেন!
একদিন তাঁর উদ্বেগ ফেটে পড়ল, চাপা থাকল না৷ চিবার একটা বিচ-হাউসে দু’জনে বিশ্রম্ভালাপ করছিলেন৷ হঠাৎ করে রাসবিহারী প্রশ্ন করলেন— তোসিকো, তুমি আমাকে বিয়ে করেছ ঠিকই, কিন্তু তুমি কি আমাকে অন্তর দিয়ে ভালবাস? আমি সত্যি কথাটা জানতে চাই৷
আচমকা এমন একটা প্রশ্নের সামনে পড়ে তোসিকো একেবারে চুপ হয়ে গেলেন৷ তাঁর চোখ দুটি দিয়ে অবিরল ধারায় জল গড়িয়ে পড়ল৷
বসু বললেন, সত্যিসত্যিই যদি তুমি আমাকে ভালবাস তবে আমি তার প্রমাণ চাই৷ তুমি কি আমার জন্য মরতে পারো? এই রেলিং থেকে তুমি ঝাঁপ দিতে পারো গভীর নীচে?
তোসিকো স্তম্ভিত এবং খুবই টানটান হয়ে উঠলেন৷ এত বড় কথা!সোজা দাঁড়িয়ে তিনি রেলিংগুলোর দিকে দৌড়ে গেলেন৷ তাঁর দৃঢ়তা এবং যা ঘটতে চলেছে, তা আঁচ করতে পেরে বসু ভয় পেয়ে পিছন দিক থেকে তাঁকে জড়িয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে গভীর আশ্লেষে তাঁকে চুম্বন করলেন৷ তারপর কণ্ঠে আর নয়নে মিনতি ঝরিয়ে তাঁর হঠকারিতার জন্য তাঁর কাছে মার্জনা ভিক্ষা করলেন৷ দু’জনের অভিমান দূরে গেল, প্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় সতী তোসিকো জিতে গেলেন৷ গভীর প্রেমে দুজনে অতঃপর মগ্ন হলেন৷ যতদিন বাঁচলেন—এই হীন প্রশ্ন আর দু’জনকে বিড়ম্বিত করেনি৷
বিয়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণামস্বরূপ তোসিকো বছর দু’য়েক বাদে ১৩ আগস্ট ১৯২০ তারিখে প্রথম সন্তান, পুত্রসন্তান মাসাহিদের জননী হলেন৷ আরও দু’বছর পেরিয়ে ২৪ ডিসেম্বর ১৯২২ তারিখে তাঁর কোলে এল তাঁদের কন্যাসন্তান— তেৎসুকো৷ ছেলের নামকরণ করেছিলেন তোয়ামা৷ আর মেয়ের নামকরণ হলো সোমার অকালপ্রয়াতা কন্যাসন্তানের নামে৷ আসলে কোক্কোর মনে হয়েছিল তাঁর হারানো মেয়েটিই নাতনির রূপ ধরে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে৷ আর এই ধারণাটিই বসু পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিবারের বন্ধনকে অনিবার্য করে দিল৷
তারপর রাসবিহারীর উপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিল সরকার৷ এখনকার হারাজুকো রেলস্টেশনের কাছে রাসবিহারী নিজের একটা মনোমতো বাড়ি তৈরি করিয়ে নিলেন৷ এই বাড়ির নকশাটা তোসিকোরই মনে এসেছিল৷ নানা বিড়ম্বনার মধ্যে এক ঝলক সৌভাগ্যরে আলো এসে এই চারজনের পরিবারটিকে স্বল্পকালের জন্য হলেও আলোকিত করে দিল৷
১৯২৩ সালে রাসবিহারী জাপানের নাগরিকত্ব নিলেন৷ সেই অবস্থান থেকে ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা তাঁর পক্ষে সুবিধে হবে— এমনটিই তাঁর মনে হয়েছিল৷ কিন্তু জাতীয়তাবাদ আইনের গলদ নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক লেগে গেল৷ আর এই সময়েই দুই সন্তানের জননী তোসিকো খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন৷ সংসারের যাবতীয় ভার তিনি মাথা পেতে নিয়ে মায়ের স্নেহে সন্তান পালন করছিলেন৷ কিন্তু প্রবল নিউমোনিয়া তাঁকে একেবারে শয্যাশায়ী করে দিলে৷ দীর্ঘকাল রৌদ্রালোক বিহীন অন্ধকার ঘরে অজ্ঞাতবাস আর মানসিক উদ্বেগ তাঁর জীবনীশক্তিকে একেবারে শূন্য করে দিলে৷ চিকিৎসকের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে স্বামী-সন্তানদের ফেলে রেখে তোসিকো চিরবিদায় নিলেন ১৯২৫ সালের ৪ মার্চ তারিখে৷ বয়স মাত্র আটাশ— না ফুটিতে ফুল, ধরণীতে ঝরে পড়ল৷
শেষের দিনগুলোতে তাঁদের দাম্পত্যজীবন এক মহৎ পরিবেশ রচনা করে চলেছিল৷ রাসবিহারী তাঁর পাশে বসে গভীর মন্দ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করতেন সংস্কৃত মন্ত্র৷ অস্ফুট স্বরে স্বামীর সঙ্গে মিলিয়ে তোসিকো সেগুলি উচ্চারণ করতেন৷ প্রতিদিন সকালে দূর জাপানের এক আবাসে বসে বসু তাঁর মাতৃভূমিজাত সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করে মনে মনে দেবোপাসনা করতেন৷ শুনে শুনে তোসিকোর সেগুলোর কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল৷ এমনই মন্ত্রের ওঁকার ধ্বনির মধ্যেই তোসিকো চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ সংক্ষিপ্ত দাম্পত্যজীবনে যে ঈশ্বরের আশীর্বাদে তিনি পুণ্যবতী ছিলেন৷
সংসার বিচিত্র৷ কয়েক মাসের মধ্যে বসুর শুভার্থীরা তাঁকে বললেন— এই বাচ্চাদের তুমি মানুষ করবে কী করে? তুমি আবার বিয়ে কর৷ বসু সবিনয়ে বললেন—তোসিকোর জায়গায় অন্য মেয়ে! আইজো আর কোক্কো ছাড়া এখন আমার আর কোনও বাবা-মায়ের দরকার নেই৷ কফির দোকান আর ইন্ডিয়ান কারি নিয়েই বসু জাপানে বেঁচে রইলেন৷ অর্থের অভাব নেই তাঁর৷ শুধু তোসিকোর শূন্য জায়গাটাকে তিনি গভীর প্রেমে পূর্ণ করতে থাকলেন৷