রাজভোজ (দ্বিতীয় পর্ব)

১৮৭৪ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনকাল শুরু হলে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হল কলিকাতা। নতুন প্রজন্ম কার্যোপলক্ষে ভিড় জমালো বিশেষ করে কলিকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে। এদের মধ্যে ব্রিটিশ উন্নাসিকতার একটা প্রকট রূপ প্রকাশ পাওয়া শুরু হল। যা কিছু ভারতীয়, বিশেষ পরিবেশিত খাদ্যের মান ও প্রস্তুত প্রণালীকে এরা বেশ হীনচোখেই দেখতে শুরু করল।

রানির পক্ষপাত ছিল ফরাসি রান্নার উপর। অতএব ব্রিটিশ মহিলারা খাবার টেবিলে ফরাসি ঘেঁষা ইংরেজি পরিবেশন করাটাকে কেতাদুরস্ত বলে গণ্য করতে শুরু করলেন। অথচ তাঁদের দেশে ১৭৮০ সাল থেকে London Coffee House এর দৌলতে Anglo Indian চাটনি, সস, আচার এবং সর্বোপরি curry ইংল্যান্ডের বাজারে সহজলভ্য ও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এমনকী জানা যায় স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর রাজপ্রাসাদের রান্না ঘরে দুটি ভারতীয় পাচক নিয়োগ করেছিলেন, রোজ যাদের কাজই ছিল ভাত এবং নানা ধরনের কারি(curry)তৈরি করে lunch-এ খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া। যদিও রানি সেটা রোজ খাবেন কি না খাবেন নিশ্চয়তা না থাকলেও তাঁর অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত। তাঁর পর Edward VII-এর অবশ্য ভারতীয় খাদ্যের প্রতি কোনও আকর্ষণ ছিল না। তবে King George V-এর রসনাকে তৃপ্ত করতে ভারতীয় রন্ধনপ্রণালী হয়ে উঠেছিল আবশ্যিক। অবশ্য সেসব অনেক পরের কথা।

ব্রিটিশ আদলে প্রথম পর্যায়ে দিন শুরু হত ভোর ৫টায়। তখন  খানসামারা নিয়ে আসত Bed Tea বা ‘ছোটা হাজারি’ যাতে চায়ের সঙ্গে থাকত সামান্য কিছু ফলের টুকরো। এরপর রেওয়াজ ছিল ঘোড়ায় চড়ে বেড়িয়ে আসার৷ ফিরে এসে বিশ্রাম অথবা স্বল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়ে নেওয়া৷ ৯.৩০ থেকে ১০টার মধ্যে breakfast বা ‘বড়া হাজারি’৷ breakfast বা ‘বড়া হাজারি’তে প্রাথমিক দিনগুলিতে ইংরেজ ও ভারতীয় রন্ধন প্রণালীর সমন্বয়ে অগুনতি পদের সমাহার থাকত, যার মধ্যে আমিষই ছিল প্রধান৷ Anglo-Indian breakfast এ সাধারণত ঘুরিয়ে‍-ফিরিয়ে থাকত Crumbed Chop, Brown Cutlets, beef rissoles, devilled kidneys, Duck stews, Irish Stews, Mutton Heahes, Jhal Frzie, prawn depyaza, Ham Sendwitch বা Madas fritters, যা উদ্বৃত্ত মাংসের কুচির সঙ্গে আদা ও কাঁচালংকা চটকে নিয়ে তৈরি করা হত৷ পরবর্তী সময়ে অবশ্য মাংসের বদলে হালকা মাছের পদ, বিশেথঃ ভাজা, খাওয়ার প্রবণতা দেখা দিল৷ সঙ্গে হালকা Kedgeree বা খিচুড়ি যার মধ্যে চাল-জলের সঙ্গে থাকত মাছ ও ডিমের টুকরো৷ দুপুর ২টা নাগাদ খাওয়া হত lunch বা মধ্যাহ্নভোজন যাকে সাধারণতঃ বলা হত Tiffin৷ এরপর ৫টা থেকে ৫.৩০-এর মধ্যে Dinner সেটা অত কিছু এলাহি বা বিস্তারিত ছিল না৷রানির আমলে Dinner –এর সময়টা পিছোতে পিছোতে সন্ধে ৮.৩০ নাগাদ হয়৷ চা বা কফি দিয়ে Dinner সমাপন করার রেওয়াজ ছিল৷ রাতে ঘুমোবার আগে Supper-এ Soup বা নোনতা কিছু দিয়ে সারা হত৷ কারও বা পছন্দ ছিল মিষ্টি মুখ করা৷  ভাত, ডাল, রুটি, তরকারি, ডিম, ও নানারকম মাংসের হরেকরকম পদ পরিবেশন করার রীতি ছিল দু’বেলাতেই৷ খাবার শেষে নানা ধরনের Dessert, আচার বা pickles-এর প্রতি আকর্ষণ ছিল প্রায় অদমনীয়৷ ডিনারের সময় পিছিয়ে যেতে বিকেলে চায়ের সঙ্গে স্যান্ডউইচ বা কেক ইত্যাদি হালকা জল খাবারে খাওয়ার রেওয়াজের শুরু হয়৷

‘খিচরি’‍ অন্যতম আদি ভারতীয় পদবিশেষ যার সংস্কৃত নাম ‘কৃশর’৷ কয়েক হাজার বছর ধরে সমানভাবে‍ উপভোগ্য আজকের ‘খিচুড়ি’ চাল, ডাল, ঘি, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, তরকারি, তেজপাতা ও অন্যান্য মশলার সঙ্গে সেদ্ধ করে তৈরি হয়ে থাকে৷ যদিও প্রাদেশিক প্রকারভেদে স্বাদের বিভিন্নতায় উপকরণ কিছু কিছু অন্যরকম৷ ইংরেজরা ডালের বদলে মাছ, মাংস ও ডিমের টুকরোর সঙ্গে মাখনের মিশেলে চাল দিয়ে চিরাচরিত পদটির নাম নিজেদের উচ্চারণে তৈরি করলেন ‘kedgree’৷ শুধু তাই নয়, অষ্টাদশ শতকে এর রন্ধন প্রণালী ব্রিটেনে পৌঁছে‍ যথেষ্ট তৃপ্তিকর হিসেবে জনপ্ৰিয় হয়ে উঠেছিল৷ রানি ভিক্টোরিযা এবং তাঁর পুত্র এডওয়ার্ড-এর আমলে ইংল্যান্ডের গ্রামের গৃহকোণে খাবার টেবিলে সকালের জলখাবারে ভাজা মাছ ও ডিমের কোনও পদের পাশে এই kedgree স্থায়ী একটা জায়গা পেয়ে গিয়েছিল৷

সমস্ত দিনের মধ্যে Breakfast বা ‘বড়াহাজারি’ ব্যাপারটিই ছিল প্রধান৷ সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশরা যখন প্রথম ভারতবর্ষে পৌঁছল তখন প্রচলিত দেশীয় খাদ্যগুলির মধ্যে থেকে ‘খিচরি’কে সকালের খাবার হিসেবে বেছে নিল৷ ‘খিচরি’‍ অন্যতম আদি ভারতীয় পদবিশেষ যার সংস্কৃত নাম ‘কৃশর’৷ কয়েক হাজার বছর ধরে সমানভাবে‍ উপভোগ্য আজকের ‘খিচুড়ি’ চাল, ডাল, ঘি, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, তরকারি, তেজপাতা ও অন্যান্য মশলার সঙ্গে সেদ্ধ করে তৈরি হয়ে থাকে৷ যদিও প্রাদেশিক প্রকারভেদে স্বাদের বিভিন্নতায় উপকরণ কিছু কিছু অন্যরকম৷ ইংরেজরা ডালের বদলে মাছ, মাংস ও ডিমের টুকরোর সঙ্গে মাখনের মিশেলে চাল দিয়ে চিরাচরিত পদটির নাম নিজেদের উচ্চারণে তৈরি করলেন ‘kedgree’৷ শুধু তাই নয়, অষ্টাদশ শতকে এর রন্ধন প্রণালী ব্রিটেনে পৌঁছে‍ যথেষ্ট তৃপ্তিকর হিসেবে জনপ্ৰিয় হয়ে উঠেছিল৷ রানি ভিক্টোরিযা এবং তাঁর পুত্র এডওয়ার্ড-এর আমলে ইংল্যান্ডের গ্রামের গৃহকোণে খাবার টেবিলে সকালের জলখাবারে ভাজা মাছ ও ডিমের কোনও পদের পাশে এই kedgree স্থায়ী একটা জায়গা পেয়ে গিয়েছিল৷

সে আমলে যে বিশেষ পদ্ধতিতে kedgree তৈরি হত, সেটির জন্য দরকার হত–

১২ আউন্স (বা ৩৫০ গ্রাম) কাঁটা ছাড়ানো মাছের পাতলা টুকরো

১টি বড় পেঁয়াজ সরু করে কাটা

৬ আউন্স (বা ১৭৫ গ্রাম)লম্বা দানার চাল

২টি ডিম

১ টেবিল চামচ মাখন এবং ১ টেবিল চামচ রান্নার তেল

নুন ও গোলমরিচ স্বাদমতো

২ টেবিল চামচ পার্সলে পাতার কুচি‍

৩/৪ পাঁইট জল

জল গরম করে তার মধ্যে মাছের টুকরোগুলো অল্প আঁচে‍ ঢাকা দিয়ে ১০ মিনিট সেদ্ধ করে নিতে হবে৷ মাছ ছেঁকে নিয়ে জলটা রেখে দিতে হবে৷ এবার একটি ভারী প্যানের মধ্যে ১ টেবিল চামচ তেল গরম করে পেঁয়াজ স্বচ্ছ হয়ে আসা অবধি ভাঙতে হবে৷ তারপর এরমধ্যে চাল মিশিয়ে ৩/৪ মিনিট নাড়তে হবে৷ মাছ সেদ্ধ জলটা এরমধ্যে ঢেলে দিয়ে অল্প আঁচে‍ ঢাকা দিয়ে ১০ মিনিট রান্না হতে দিতে হবে, যতক্ষণ না জল শুকিয়ে চাল সেদ্ধ হয়ে য়ায়৷ ইতিমধ্যে ডিম ২টি সেদ্ধ করে নিয়ে চাকা চাকা করে কেটে রাখ‍তে হবে৷ সেদ্ধ চালের সঙ্গে মাছের পাতলা টুকরোর ছোট ছোট অংশে, ডিমের টুকরো, নুন, গোলমরিচ এবং মাখন মিশিয়ে দিতে হবে৷ পরিবেশনের আগে serving dish-এ চুড়ার মতো সাজিয়ে‍ ওপর থেকে পার্সলে কুচি ছড়িয়ে দিলেই উপাদেয় Kedgree তৈরি৷

এছাড়াও অন্য একটি, সকালের ‘বড়াহাজারি’ বা breakfast-এ মাছের যে পদটি বিশেষ উপভোগ্য বলে মনে করা হত, সেটি হল Fish Moolee. G.L. Routlefb তাঁর ‘Economical Cook Book’ (1926)-এ জানিয়েছেন যে এই পদ গরমভাত বা তাজা সেঁকা পাউরুটির সঙ্গে খাওয়ার চল ছিল৷

Fish Meoolee তৈরি করার জন্য লাগত–

১ পাউন্ড বা আধসের বড় মাছের ছোট ছোট করে কাটা টুকরো

১ কাপ ঘন নারকেলের দুধ

১ কাপ fish stock (যা মাছের কাঁটা সেদ্ধ করে ছেঁকে‍ নিয়ে তৈরি হত)

২ আউন্স ঘি‍

২টি মাঝারি পেঁয়াজের কুচি‍

১/২টি পরিমাণ হলুদের টুকরো, বেটে নেওয়া

১/২টি পরিমাণ আদার মিহি কুচি‍

২/৩টি কাঁচালংকার কুচি‍

১/২ চামচ নুন

১ টেবিল চামচ ভিনিগার বা তেঁতুলের রস

মাছের টুকরোগুলো ঘি’তে লালচে করে ভেজে নিতে হবে৷ এরপর কড়াই বা প্যানে ঘি’তে পেঁয়াজের অর্ধেক অংশে দিয়ে হালকা বাদামি হলে হলুদের সঙ্গে আদার কুচি ও নুন মেশাতে হবে৷ তারপর নারকেলের দুধ ঢেলে ৩/৪ মিনিট ফুটিয়ে কাঁচা লংকা কুচি ও বাকি পেঁয়াজ এবং মাছের টুকরোগুলো দিয়ে দিতে হবে৷ ঢাকা না দিয়ে কয়েক মিনিট সেদ্ধ করে ঠান্ডা হলে ভিনিগার বা তেঁতুলের রস মিশিয়ে পরিবেশন করতে হবে৷

গরম আবহাওয়ার কারণে মাছ-মাংস ইত্যাদি এমনকি তরকারিতেও খুব তাড়াতাড়ি পচন ধরত৷ সেই জন্য মাছ দিয়ে আচার বানানোর পন্থা আবিষ্কার করে সকালের খাবারকে আরও মুখচোরক করার চেষ্টা হত৷ সকলে সেটা খুব তৃপ্তি করেই খেত৷ Mouiet Lawrance এর Cookery for the Million (1904) বইটি থেকে দু’টি আচার বানানোর পদ্ধতি বেশ আকর্ষক মনে হয়েছে যেগুলি সাধারণতঃ Breakfast-এ পরিবেশিত হত৷

আচারি মাছ বা Pickled Fish

২ টেবিল চামচ কারি পাউডার

১২টা কাঁচালঙ্কা

১২ জোড়া ছাড়ানো রসুন

৬টি পাতলা করে কাটা তাজা আদার চাকা

৪টি লবঙ্গ

১ চা চামচ গোটা গোলমরিচ

১/২চা চামচ গোটা সৈন্ধব নুন

১ চা চামচ বিটনুন

২ কাপ ছোট ছোট মাছ

২ কাপ ভিনিগার

প্রথমে মাছগুলো কেটে পরিষ্কার জলে ধুযে ১ ঘণ্টা নুন জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে৷ তারপর শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে নিয়ে একটা মাটির হাড়িতে সমস্ত মশলা ও ভিনিগার মিশিয়ে অল্প আঁচে‍ ফুটিয়ে প্রায় শুকিয়ে নিতে হবে৷ ঠান্ডা হলে বোতলে ভরে রেখে দরকার মতো অনেকদিন ধরে খাওয়া যেতে পারবে৷ ছোট মাছের বদলে বড় কোনও মাছের কাঁটা ছাড়ানো সরু সরু পাতলা টুকরোও পাওয়া যায়৷

Balachong

এটির জন্য প্রয়োজন যে কোনও সামুদ্রিক মাছ, কাঁটা ছাড়িয়ে ও ছাল বাদ দিয়ে‍ ১ পাউন্ড

১০ আউন্স পেঁয়াজ কুচি‍

২ আউন্স রসুন কুচি‍

৪ আউন্স কাঁচা লঙ্কা কুচি‍

৪ আউন্স ঘি‍

৩ পাউন্ড টমেটো

১ চা চামচ সৈন্ধব নুন

১ চা চামচ জাফরান গুঁড়ো

২ কাপ ভিনিগার

গরম জলে মাছ ও টমেটো একসঙ্গে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে৷ তারপর টমেটোর খোসা ছাড়িয়ে বীচি ফেলে দিয়ে চটকে নিতে হবে৷ এবার একটি পাত্রে ঘি দিয়ে মাছের সরু সরু ছোট টুকরোগুলো জাফরান সহকারে বাদামি করে ভেজে নিতে হবে৷ ওই একই পাত্রে অন্য সমস্ত উপকরণ মিশিয়ে ভিনিগারে ঢেলে ঘন না হওয়া পর্যন্ত ফোটাতে‍ হবে৷ ঠান্ডা হলে বোতলে ভরে রেখে অনেকদিন পর্যন্ত খাওয়া যাবে৷

Rumble Tumble পাঁউরুটির স্লাইস সেঁকে নিয়ে তারওপর লংকার গুঁড়ো ছড়িয়ে পরিবেশিত হত ৷ তার নাম হয়ে যেত Egg Toast৷ পাউরুটির মাঝের অংশ গোল করে কেটে নিয়ে তার মধ্যে baked বা poached ডিম দিয়ে পরিবেশন করলে তাকে বলা হত ‘Oxtyes’ অর্থাৎ ‘ষাঁড়ের চোখ’৷ এছাড়াও সব থেকে বেশি প্রচলিত প্রিয় ডিমের পদটি ছিল ‘Omlet’৷ সরকারি কাজে Camp-এ, ডাকবাংলোতে, পিকনিকে বা বাড়ির খাবার টেবিলে স্বাদু এই খাদ্যটি ছিল সুলভ৷ Army Cantonment-এর কিচেনে এটি তৈরি হত বিশেষ পদ্ধতিতে৷

এছাড়াও অবশ্য ডিমের নানারকম পদ ‘বড়া হাজারি’র টেবিলে পরিবেশিত হত৷ অনেক ব্রিটিশের কাছে ভারতীয় স্থানীয় ডিম খুব ছোট ও স্বাদহীন মনে হত৷ তাই অনেকেই নিজস্ব বাড়ির বাগানে মুরগি পোষার ব্যবস্থা করছেন৷ ফলে তাজা ডিম বা মাংস অনায়াসেই সংগ্রহ হয়ে যেত৷ বিশেষ করে বাজার থেকে কেনা ডিম প্রায়ই পচা ও খাবার অযোগ্য হত৷

এখন আমরা যাকে ‘Scrambled egg’ বলে জানি, সে সময় তার নাম ছিল ‘rumble tumble’, মাখন, দুধ, নুন ও গোলমরিচ দিয়ে তৈরি rumble-tumble এর সঙ্গে টমেটো মেশালে এর নাম হত Craggy Toast. Rumble Tumble পাঁউরুটির স্লাইস সেঁকে নিয়ে তারওপর লংকার গুঁড়ো ছড়িয়ে পরিবেশিত হত ৷ তার নাম হয়ে যেত Egg Toast৷ পাউরুটির মাঝের অংশ গোল করে কেটে নিয়ে তার মধ্যে baked বা poached ডিম দিয়ে পরিবেশন করলে তাকে বলা হত ‘Oxtyes’ অর্থাৎ ‘ষাঁড়ের চোখ’৷ এছাড়াও সব থেকে বেশি প্রচলিত প্রিয় ডিমের পদটি ছিল ‘Omlet’৷ সরকারি কাজে Camp-এ, ডাকবাংলোতে, পিকনিকে বা বাড়ির খাবার টেবিলে স্বাদু এই খাদ্যটি ছিল সুলভ৷ Army Cantonment-এর কিচেনে এটি তৈরি হত বিশেষ পদ্ধতিতে৷ ডিম ঘেঁটে‍‍ নয়, শুধু মিশিয়ে‍ নেওয়া হত৷ এর জন্য ২টি মানুষের হিসেবে দরকার হত–

৬টি ডিমের কুসুম

৪টি ডিমের সাদা অংশ

১ চামচ পেঁয়াজ পাতা কুচি‍

১ মুঠো পার্সলে পাতা কুচি‍

১ টেবিল চামচ ফ্রেশ ক্রিম

১ টেবিল চামচ মাখন

ফ্রাইং প্যানে মাখন গলিয়ে গরম হলে সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে ঢেলে দিতে হবে৷ অল্প আঁচে‍ রেখে তলার অংশ বসে গেলে পাশ থেকে উঠিয়ে নিয়ে ওপর থেকে তরল অংশ চারিদিক দিয়ে নীচে ছড়িয়ে‍ দিতে হবে৷ এই ভাবে ওপর-নীচে মিশ্রণটি বসে গেলেই ওমলেট তৈরি৷ এটি তৈরি করে তৎক্ষণাৎ না খেলে ভালো লাগবে না৷ এটি অনেকটা French Omlette-এর ধাঁচে তৈরি৷

তবে সবথেকে সুস্বাদু ছিল ইউরোপীয় তথা ব্রিটিশ পদ্ধতির সঙ্গে ভারতীয় খানসামার হাতে তৈরি Anglo Indian Omlette দেশীয় মানুষরা যাকে সাধারণভাবে বলত ‘আমলেট’ এবং বাঙালিরা ‘মামলেট’৷ Eliya Acton তাঁর লেখা Modern Cooking (1845) বইটিতে এর বানানোর পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন৷ মিহি পেঁয়াজ কুচি, রসুন ও পেঁয়াজ পাতার কুচি ও পুদিনা পাতার কুচি ডিমের সঙ্গে ভালো ভাবে নুন দিয়ে ফেটিয়ে সামনে বাজা হত৷ বম্বে অঞ্চলের পার্শীরা পুদিনার বদলে ধনে পাতা দিতেন৷

ডিমের ওমলেটের সঙ্গে সেঁকা পাউরুটি বা ভাঁজ করা পরোটা খাওয়ার একটা রেওয়াজও ছিল৷ সেদ্ধ ডিম দিয়ে ডালের কারি তৈরি হত যা ভাতের সঙ্গে Breakfast বা Lunch এই দু’সময়ই খাওয়া যেত৷ ‘The Memsahib’s Book of Cooking’ বইটরি লেখিকা Angela C Spray (1894) একটি ‘Dhall Curry with Eggs’ নামে রান্নার পদ্ধতি জানিয়েছেন, যাতে লাগবে‍—

১ পেয়ালা সেদ্ধ করা ডাল

২ বড় চামচ ঘি‍

১ চা চামচ নুন

১/২ চা চামচ শুকনো লঙ্কা বাটা

১/২ চা চামচ রসুন বাটা

১ চা চামচ আস্ত ধনে‍

১ চা চামচ পরিমাণ ২টি দারচিনির টুকরো

৩/৪টি লবঙ্গ

৩টি সেদ্ধ ডিম, চাকা করে কাটা

৬টি পেঁয়াজের কুচি, লাল করে সামনে ভেজে নেওয়া

১ পেয়ালা স্টক

একটা পাত্রে ঘি গরম করে ধনে, লংকা, রসুন, দারচিনি, লবঙ্গ ও নুন দিয়ে স্টক ঢেলে দিয়ে ফুটে উঠল ডালটা মিশিয়ে দিতে হবে৷ এরপর ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে‍ ১৫ মিনিট সেদ্ধ করে ওপরে ঘি জেগে উঠলে serving dish-এ ঢেলে দিয়ে সেদ্ধ ডিমের টুকরো ও ভাজা পেঁয়াজ দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে৷

Mutton Curry নামে ডিমের পদটি ছিল মূলত পাঞ্জাব অঞ্চলে প্রচলিত৷ এটি তৈরি করতে লাগত–

৩টি সেদ্ধ করা ডিম

৪ চা চামচ পেঁয়াজ বাটা

১/২ চা চামচ আস্ত ধনে‍

১ চা চামচ হলুদ বাটা

১/৪ চা চামচ শুকনো লঙ্কা বাটা

১ বড় চামচ ঘি‍

১/২ কাপ গরম জল

নুন স্বাদমতো

একটি পাত্রে ঘি গরম করে পেঁয়াজ বাটা সহ অন্যান্য মশলা দিয়ে বাদামি রং ধরা পর্যন্ত নাড়তে হবে৷ জল ও ডিম যোগ করে অল্প আঁচে‍ রেখে ওপরে ঘি ভেসে আসা পর্যন্ত ফোটাতে হবে৷ Breakfast-এ সেঁকা পাউরুটি বা ভাতের সঙ্গে‍ খাওয়া হত৷

Culinary Art Sparklets (1904) বইয়ের লেখিকা Bratrice A. Vieyra একটি Egg Curry with Rice নামের তাঁর প্রিয় রান্নার পদ্ধতি জানিয়েছেন–

৪ জনের জন্য এখানে দরকার হত

দেড় আউন্স ঘি (৪৫ গ্রাম)

১টা বড় পেঁয়াজ লম্বা ও সরু করে কাটা

১ আউন্স (১৫ গ্রাম) ময়দা

১ চামচ উঁচু কারি পাউডার

১টা আপেল, খোসা ও বীচি ছাড়িয়ে কুচি করে কাটা

১টা লেবুর রস

২ চামচ টমেটো চাটনি (সস?)

স্বাদ মতো নুন এবং ৪টি সেদ্ধ ডিম

শিশুদের খাদ্যের ব্যাপারে ইংরেজ গৃহিনীরা থাকতেন পূর্ণ সচেতন৷ তাদের জন্য তৈরি করা হত স্বাস্থ্যসম্মত সহজপাচ্য খাবার৷ দুধের থেকে নানারকম পেটের গোলযোগ দেখা দিতে পারে এই আশঙ্কায় বাড়ির বাগান সংলগ্ন এলাকায় অনেকেই গরু পুষতেন৷

স্টক অথবা জল

একটা সসপ্যানে ঘি গলিয়ে নিয়ে পেঁয়াজের টুকরোগুলো বাদামী করে ভেজে নিতে হবে৷ এবারে তার মধ্যে ময়দা ও কারি পাউডার মিশিয়ে ভালো করে নেড়ে নিয়ে স্টক বা জল ঢেলে দিতে হবে৷ ফুটে উঠলে আপেলের টুকরো ও লেবুর রস দিয়ে ১০ মিনিট পর খোসা ছাড়ানো ডিমগুলো অর্ধেক করে কেটে নুন ও টমেটো চাটনি মিলিয়ে ঘন হলে নামিয়ে ফেলতে হবে৷ পরিবেশনের আগে একটি ‘রাইস প্লেট’-এর ওপর চারদিকে ভাত সাজিয়ে মাঝখানের খালি জায়গায় ডিমের রান্নাটি ঢলে দিতে হবে৷

সকালে জলখাবারে অত্যধিক খাদ্য হজম করা সহজ হত না৷ তাই দুপুরে হালকা লাঞ্চ খাওয়ার চল হল, যাকে বলা হত টিফিন৷ এই ‘টিফিন’ কথাটির উৎস হল অষ্টাদশ শতকে একটি ইংরিজি অপভাষা বা Slang যার অর্থ অল্প অল্প চুমুক দেওয়া৷ মধ্যাহ্নভোজনে সাধারণত খাওয়া হত বেঁচে‍ যাওয়া মাংস বা মাছের অংশ দিয়ে তৈরি হালকা কোনও পদ৷ রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে এদেশী ব্রিটিশ গৃহিণীরা অনেক সচেতন হয়ে উঠেছিলেন এবং খাদ্য নষ্ট করা নৈব নৈব চ৷ ততদিনে কর্মব্যস্ত পুরুষরাও আর টিফিন খেতে বাড়িতে আসতেন না৷ সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন স্যান্ডউইচ বা কেকের টুকরো৷ অবশ্য রবিবারের মধ্যাহ্ন ভোজন ছিল বিশেষ ব্যাপার৷ সময়সাপে‍ক্ষ সুস্বাদু অনেক পদের সমাবেশে পরিবারের সকলে অতিথি আপ্যায়ন করেও পরিতৃপ্ত হতেন৷ কারও না কারও বাড়িতে একত্র হয়ে এই পর্বটি সারা হত৷

শিশুদের খাদ্যের ব্যাপারে ইংরেজ গৃহিনীরা থাকতেন পূর্ণ সচেতন৷ তাদের জন্য তৈরি করা হত স্বাস্থ্যসম্মত সহজপাচ্য খাবার৷ দুধের থেকে নানারকম পেটের গোলযোগ দেখা দিতে পারে এই আশঙ্কায় বাড়ির বাগান সংলগ্ন এলাকায় অনেকেই গরু পুষতেন৷ ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর শিশুদের ‘ছোটা হাজারি’ হত ফলের রস ও ছটা কলা বা কমলালেবু দিয়ে৷ আম বা আঙুর তাদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ৷ এরপর ‘বড়াহাজারি’ বা ব্রেকফাস্ট তারা বারান্দায় বসে মা-বাবার সঙ্গে হালকা সেঁকা পাউরুটি, মাখন, জেলি ইত্যাদি দিয়ে সারত৷ এরপরের সময়টা নার্সারিতে খেলাধুলোয় কাটত, আয়া বা খানসামাদের তত্ত্বাবধানে৷ তারা সক্রিয়ভাবে যত্ন সহকারে ও স্নেহের সঙ্গে সারাদিন রাত দেখাশোনা করত৷ বিনিময়ে উপার্জন করত প্রচুর অর্থ৷ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও কর্মঠ এবং মিষ্টভাষী হওয়াটাই ছিল তাদের শর্ত৷

একটু বড় হওয়ার পর তাদের দেওয়া হত কারি আর ভাত৷ কিন্তু তার আগে তারা পেত শুধু আইরিশ স্টু, চিকেন সেদ্ধ করে বানানা Croguette, milk pudding আর সেদ্ধ করা ফল৷ বিশেষভাবে বানানো হত ভাপানো কলার ওপর ঘি ও চিনি ছড়ানো dessert৷

Mrs. J. Barttey তাঁর Indian Cokery (1901) বইতে শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্রধান যে রান্নার পদ্ধতি জানিয়েছেন, তা হল–

Baby’s Pish-Pash

১/৪ পাউন্ড মাটনের ১ ইঞ্চি‍ পরিমাপে কাটা টুকরো

১ কাপ জল

১ ডেসার্ট স্পুন চাল

১/৪ আদার টুকরো

১/২ দারচিনির টুকরো

এক চিমটে নুন

এক কাপ জলে মাংসের টুকরোগুলো দিয়ে একটা পাত্রে বসিয়ে ফুটে উঠলে ওপরের ভেসে ওঠা ফ্যানা  ফেলে দিতে হবে৷ একটা কাপড়ের পুটুলিতে চাল ও আদা একসঙ্গে বেঁধে‍ ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে দিতে হবে৷ এক চিমটে নুন দিয়ে দারচিনির টুকরোর সঙ্গে অল্প আঁচে‍ ১ ঘণ্টা সেদ্ধ করে ঘন হয়ে এলে আদা ও দারচিনি ফেলে দিয়ে চালটাকে গলা মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে শিশুটিকে খাওয়ানো যেতে পারে৷

Dhal Bhat (দুটি শিশুর জন্য লাগবে)‍–

৭ আউন্স বা ২০০ গ্রাম মসুর অথবা সবুজ মুগ ডাল

৭ আউন্স বা ২০০ গ্রাম লম্বা দানার চাল

২টি ডিম

নুন

২ পাঁইট জলে (১.২ লিটার) ডাল ভালো করে ধুয়ে ফোটাতে হবে৷ ওপরে ভেসে ওঠা ফ্যানা তুলে ফেলে ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে‍ অন্তত ১ ঘণ্টা ধরে ফুটতে দিতে হবে৷ মাঝে মাঝে ঢাকা সরিয়ে নেড়ে দিতে হবে৷ গলে গিয়ে ঘন হয়ে এলে নামিয়ে নিয়ে আগে থেকে তৈরি করা ভাতের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে ২টি প্লেটে সাজিয়ে ওপরে একটা করে ‘প্যাকেট এগ’ রেখে পরিবেশন করতে হবে৷

শিশুদের আরও একটি বিশেষ পদ খুবই নিরাপদ ও সুস্বাদু বলে মনে করা হতো৷ সেটি হল ‘ধোবি পাই’৷ এটি তৈরি করার পদ্ধতি পাই Herrietta Harvey লিখিত Anglo Indian Cokery at Home (1895) বইটিতে৷

Dhobi Pie রান্না করার জন্য দরকার হত৷

৬টি ল্যাম্ব বা মাটনের চাপ

২ পাউন্ড খোলা ছাড়ানো আলু

২ আউন্স (৫০ গ্রাম) মাখন

২টি ফোটানো ডিম

১টি বড় পেঁয়াজ কুচি‍

নুন, গোলমরিচ এবং ময়দা

২ টেবিল চামচ Worcestershire Sauce

মাংসের থেকে চর্বি ফেলে দিয়ে ছোট ছোট চৌকোতে কেটে নিতে হবে৷ হাড় থাকবে না৷ একটি পাত্রে মাখন দিয়ে নুন, গোলমরিচ, ময়দা মাখানো মাংসের টুকরোগুলো চারিদিকে বাদামি করে ভেজে নিতে হবে৷ একই মাখনে পেঁয়াজ স্বচ্ছ হওয়া পর্যন্ত ভেজে মাংস মিশিয়ে নিয়ে জল দিয়ে অল্প আচে ঢেকে ২০ মিনিট সেদ্ধ করতে হবে৷ এরপর Worcester Sauce ঢেলে একটা pie বানাবার ডিসে রাখতে হবে৷ ইতিমধ্যে আলু সেদ্ধ করে মাখন দিয়ে মেখে নিতে হবে৷ ঠান্ডা হলে ডিম দুটো ফেটিয়ে আলুর মিশ্রণ মিশিয়ে দিতে হবে৷ এরপর আলু সেদ্ধ প্রায় ১ ইঞ্চির একটু কম পুরু ও সোজা করে বেলে নিয়ে Pie Dish-এ রাখা মাংস ভালো করে ঢেকে ১৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট ও আধঘণ্টা বেক করে নিতে হবে৷ বোধহয় সাদা চাদরের মতো আকারের আলুর আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকার জন্য এটি ধোপা বা ধোবির ধোওয়া চাদরকে মনে করিয়ে দিত৷ তাই এর নাম হয়তো হয়েছিল Dhobi Pie.


রাজভোজ (প্রথম পর্ব )