হুজুগের একটা বয়স থাকে,আমাদেরও এককালে ছিল,তাই দীঘা গেলে নিয়ম করে সাইকেল ভ্যানে চেপে চক্কর মেরে বেড়াতাম এদিক সেদিক। তখনও অটোর জমানা শুরু হয়নি, ফলে সবাই মিলে ঠাসাঠাসি করে কাঠের তক্তার ওপর বসে প্রবল ঝাঁকুনি খেতে খেতে যাওয়া ছাড়া গতি ছিল না। কিন্তু তাতেই আমাদের হুল্লোড় জমত বেশি। ওইভাবেই একবার চন্দনেশ্বরের মন্দির দেখতে গিয়ে ঝাঁকিদর্শন দিয়ে এসেছিলাম তালসারিতে। সে প্রায় বছর পঁচিশ আগেকার কথা,তখন স্রেফ একফালি রাস্তা আর দুধারে জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হয়েছিল। তাছাড়া ওখানে সমুদ্রটা যে ঠিক কোথায় তার চটজলদি হদিশ না পেয়ে কিছুটা দমেও গিয়েছিলাম। আদতে ব্যাকওয়াটার বলে জোয়ারের জলের আসা যাওয়া্টার মধ্যে যে একটা অভিনবত্ব লুকিয়ে আছে, আর সেটা দেখার জন্য অন্তত একটা গোটা দিন যে ওখানে থাকতে হয়, এসব খবর পেয়েছিলাম পরে।নিউ দীঘা ছাড়ালেই চেক পোস্ট পেরিয়ে চন্দনেশ্বরে ঢুকতে হয়। ওটাই উড়িষ্যার সীমানা,তালসারিও তাই। একবার গিয়ে থাকতেই হয় ভেবে ওখানকার পান্থনিবাসে ঘর বুক করলাম,আগে দুদিন তাজপুরে কাটিয়ে তারপর একদিন তালসারি।
দুপাশে ঝাউবন আর সামনে বালির চড়ার ফাঁক দিয়ে ছোট ছোট খাঁড়ি বেয়ে জেলে নৌকোর অবিরাম আনাগোনা। দূরে সমুদ্রের জল জোয়ারের টানে কাছে চলে এসে হাঁটু ডুবিয়ে দিচ্ছে। তারই মধ্যে গরুর পাল নিয়ে পারাপার করছে মানুষজন। পান্থনিবাসের দোতলার ঘর থেকে এসব দেখে বেশ সময় কেটে যায়। দুপুরে উৎকলিয় রাঁধুনির বানানো কাতলা মাছের কালিয়া দিয়ে সাপটে ভাত খেয়ে কিঞ্চিত বিশ্রাম। বিকেলে ভাঁটার টানে চারপাশটা শুকনো মাঠ হয়ে দাঁড়ায়। মোটরবাইক নিয়ে ইতিউতি লোক ঘুরছে। পিছনে চাপিয়ে দূরে সমুদ্র অবধি ঘুরিয়ে আনবে, খরচাও মাথাপিছু তেমন কিছু নয়। আমি আর গিন্নি দুজনে দুটোতে চেপে বসলাম। ওরা অদ্ভুত নির্জন একটা বালিয়াড়ির ওপর এনে ছেড়ে দিল।সামনে দুপাশ জুড়ে সমুদ্র আর পিছনে ঝাউয়ের ঘন জঙ্গল। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় সন্দেশ পত্রিকায় জুল ভের্ন এর লেখা ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ -এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হত। যার হেডপিস এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বিশাল সমুদ্র আর ডাঙ্গায় গভীর জঙ্গল মিশিয়ে তৈরি হয়েছিল দারুন গা ছমছমে একটা পরিবেশ। মনে হল আমরা যেন ঠিক সেইরকম কোনও জায়গায় এসে পড়েছি। সেটা ছিল অঘ্রাণ মাস, বেলা ছো্ট হয়ে আসছে ফলে বাইকওলারা তাড়া দিল ফেরার জন্য। তাছাড়া একবার জোয়ার এসে গেলে জল এমনভাবে ঘিরে ফেলবে, যে একমাত্র সাঁতরে পার হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
সব মিলিয়ে তালসারি আমাদের বেশ মনে ধরেছিল, তাও যাচ্ছি যাব করে যাওয়া হয়নি বহুকাল। শেষমেশ এক দাদা বৌদি নিজেরাই প্ল্যান বানিয়ে,ঘর বুকিং করে আমাদের নিয়ে গেল। এবারও যাওয়া হল তাজপুর হয়ে এবং শুধু এক দিনের জন্য। ভাদ্র মাস – ফলে বৃষ্টি পিছু ছাড়ছে না। অগত্যা দুপুরটা ঘরেই কাটল। দেখলাম হপ্তার মাঝখানে হলেও লোকজন ঘুরতে এসেছে দলে দলে। বিকেলের দিকে আকাশ পরিষ্কার হওয়াতে আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বেরোলাম। সমুদ্র অবধি যেতে হবে। পাড়ের ধার বরাবর আজকাল প্রচুর দোকানপাট বসে গেছে, বেশির ভাগই চা, ঘুগনি,অমলেট বেচছে। এরই মধ্যে এক লটারিওয়ালা তারস্বরে মাইকে গান বাজিয়ে চলেছে। খেয়াল করলাম কথাগুলো উড়িয়া ভাষায়। আর সুরটা হিন্দি সিনেমার। জোয়ার না থাকলেও মাঝে মাঝেই জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে, ছপাত ছপাত করে পা ফেলে যেতে হল। ঢেউ না থাকলেও আকাশজোড়া প্রাক শরতের রকমারি মেঘ যেভাবে সমুদ্রকে আগলে রেখেছে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ঠিক যেন ইংরেজ শিল্পী উইলিয়াম টার্নারের আঁকা ছবির মতো। বালিয়াড়ির কোলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাঁধা রয়েছে অজস্র ছোট বড় জেলে নৌকো। লাল টুকটুকে একটা ট্রলার আঁকব ঠিক করলাম, সামনের একটা ছোট নৌকোতে কসরত করে উঠে পাটাতনে সরঞ্জাম সাজিয়ে কাজ শু্রু হল। গিন্নি একটু বেশি গভীর জল পেরোতে হবে বলে প্রথমে আসতে চায়নি, এখন আমার নৌকো চড়ার ছবি তুলবে বলে পাশে এসে হাজির। সামান্য রসিকতা করে বললাম তুমিও উঠে পড়ো তারপর দজনে মিলে সমুদ্রে পাড়ি জমাই।
পান্থনিবাসের সেরা পজিশনের দুটো ঘর দাদা আগে থেকেই চেয়ে রেখেছিল। ম্যানেজার মোহান্তি সাহেবের তৎপরতায় ঠিক মতো পেয়েও গিয়েছিলাম। ফেরার সময় ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে ওঁকে বললাম পরেরবার এলে আপনি দেখবেন এই ঘরগুলোই যেন পাই। কিছুটা বিষণ্ণ মুখে মোহান্তি সাহেব বললেন “সামনের মাসেই আমি রিটায়ার করছি,তাই আর হয়ত…”।