বাইশে শ্রাবণ ও পৌরুষের অপমৃত্যু

শান্তিনিকেতনে একটা গোরুর গাড়ির চাকা কাদায় বসে গিয়েছে। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্ররা সবাই মিলে উৎসাহের সঙ্গে গাড়িটাকে টেনে তুলল। কাজের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার এই ছবিটা দেখে ধীরেন্দ্রমোহন সেনকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘এই আমন্ত্রণ ইকনমিকাল ডিগ্রি নেওয়ার নয়, চরিত্রকে বলিষ্ঠ কর্মিষ্ঠ করায়, সকল অবস্থার জন্যে নিপুণভাবে প্রস্তুত করায়, নিরলস আত্মশক্তির উপর নির্ভর করে কর্মানুষ্ঠানের দায়িত্বসাধনা করায়, অর্থাৎ কেবল পাণ্ডিত্যাচর্চায় নয়, পৌরুষচর্চায়।’

ঘটনাটা খুব মনে রাখার মতো। কেবল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতির একটা খুব গভীর কার্যকর দৃষ্টান্ত হিসেবেই নয়, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তার স্বরূপ বোঝার জন্যও। নিরন্তর কেবল পুঁথিচর্চা যে আসলে মনের মৃত্যুরই সামিল সেই কথাটা কত বার কত ভাবে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ঋণশোধ’ নাটকের কথা মনে পড়বে আমাদের, ‘তোতাকাহিনী’ কিংবা ‘অচলায়তন’-এর কথাও মনে পড়তে পারে।

জীবনভাবনা আর মৃত্যুভাবনার প্রেক্ষিতেই বাংলা ভাষার রবীন্দ্রচর্চার মোটামুটি গত একশো বছরের ইতিহাসে ওই শেষ দুটো শব্দ বড় গুরুত্বপূর্ণ। ‘পাণ্ডিত্যচর্চা’ আর ‘পৌরুষচর্চা’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিছক তথ্য আর জ্ঞানের ভাণ্ডার যদি সার্ধশতবার্ষিক রবীন্দ্রচর্চায় ক্রমেই উপচীয়মান হতে থাকে তবে তার তুলনায় স্পষ্ট করে বলা কাজের কথা, বোধের কথার ভাণ্ডার নিতান্ত শূন্যই। কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাহিত্য সমালোচক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের বাইরে (কিংবা হয়তো ভেতরেই) যে কর্মী রবীন্দ্রনাথ, তাঁর কথা সেভাবে কেউ বললেন না।

আসলে বাঙালির চিন্তা করার শক্তি কোথাও মরে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গুটি কেটে বেরনোই যে নতুন ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথকে বোঝার, তাঁর সর্বকালের আধুনিক দর্শন ও ভাবনাগুলিকে রূপায়ণ করার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সেই কথা বাঙালি আজও জানে না।

রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ রবীন্দ্রচিন্তায় যে ব্যাপকতর পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছিল, তা আশা জাগিয়েছিল যে এইবার হয়তো চিরাচরিত ধারাটির সাময়িক মৃত্যু ঘটবে, যে ধারায় রবীন্দ্রনাথকে শুধু কবি আর গদ্যকার হিসেবে দেখা হয়। কর্মী রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কারের চেষ্টা হয়তো এইবার শুরু হবে। কিন্তু না, তেমন কোনও আশা এখনও দুরাশাই। খণ্ড খণ্ড গভীর গবেষণা হয়তো হল, কিন্তু সামূহিক দৃষ্টিতে রবীন্দ্রভাবনাকে বোঝা, নতুন ভারতের আত্মার সঙ্গে তাঁকে মিলিয়ে পড়ার কাজটা অধরাই থেকে গেল। এই চর্বিতচর্বণটাই কি রবীন্দ্রচর্চায় মননের মৃত্যু নয়? যে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বার বার ভেঙেছেন, মৃত্যু ঘটিয়েছেন পুরনো রবীন্দ্রনাথের, আবিষ্কার করতে চেয়েছেন নিত্যনতুন রবীন্দ্রনাথকে, তাঁকে ঘিরে আলোচনা-তর্পণে কেন এত পুরনো ছাঁদ, মরে যাওয়া গড়ন?

আসলে বাঙালির চিন্তা করার শক্তি কোথাও মরে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গুটি কেটে বেরনোই যে নতুন ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথকে বোঝার, তাঁর সর্বকালের আধুনিক দর্শন ও ভাবনাগুলিকে রূপায়ণ করার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সেই কথা বাঙালি আজও জানে না। ফলে ভারতবর্ষের কাল ভাবার সম্ভাবনা দূর অস্তই। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন বহমান থেকেছেন, আর তাঁর বেশিরভাগ অনুগামী সেই বহমান চিন্তককে ক্রমশ বদ্ধতায় ছকবন্দি করে ফেলতে চেয়েছেন। যে আশ্রম রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন সেই আশ্রমকেই আশ্রম থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখার কথা বলেছিলেন তিনি একবার। বিশ্বভারতীর সংবিধান যখন তৈরি হল তখনকার একটি বক্তৃতা পড়লেই আশ্রম থেকে বেরনোর কথাটা আর অর্বাচীনের মতো মনে হবে না। – ‘এই প্রতিষ্ঠানের বাহ্যায়তনটিকে সুচিন্তিত বিধি-বিধান দ্বারা সুসংবদ্ধ করবার ভার আপনারা নিয়েছেন। এই নিয়ম-সংঘটনের কাজ আমি যে সম্পূর্ণ বুঝি তা বলতে পারি নে, শরীরের দুর্বলতা-বশত সব সময়ে এতে আমি যথেষ্ট মন দিতেও অক্ষম হয়েছি। কিন্তু নিশ্চিত জানি, এই অঙ্গবন্ধনের প্রয়োজন আছে।… সেই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা চাই যে, চিত্ত দেহে বাস করে বটে কিন্তু দেহকে অতিক্রম করে।… এই প্রতিষ্ঠানের কায়া-রূপটির পরিচয় সম্প্রতি আমার কাছে সুস্পষ্ট ও সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু এর চিত্তরূপটির প্রসার আমি বিশেষ করেই দেখেছি। তার কারণ, আমি আশ্রমের বাইরে দূরে দূরে বারবার ভ্রমণ করে থাকি।’

যে এক কিংবদন্তির ছকে আমরা নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি গড়ে তুলেছি সেই মূর্তিটাকে যদি দেহ হিসেবে ধরি, তবে দেখব আমাদের রবীন্দ্রচিন্তায় সেই দেহকে অতিক্রম করার দুঃসাহস খুব কমই। তার একটা বড় কারণ, রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাণ্ডিত্যচর্চায় গণ্ডিভুক্ত করেছি, তাঁর পৌরুষকে সেভাবে বুঝতে চাইনি। রাবীন্দ্রিক কথাটা তাই আজও কোনও কোনও ক্ষেত্রে পৌরুষহীনতার সামর্থে অপপ্রযুক্ত হয়। মুগ্ধললিত অশ্রগলিত গীত-ই তাই আমাদের অধিকাংশ রবীন্দ্রসঙ্গীত উপস্থাপনের মূল মেজাজ, রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুবনের যে বিপুল অনির্দেশ্য প্রেম-মহাকাব্য, তার বীজে যে আসলে এক প্রবল পুরুষকারের সংরাগ সে কথা আমরা ভুলেই থাকি।

দেড়শো বছর পেরিয়ে গিয়েছে তবু বাঙালির রবীন্দ্রভাবনায় দু-একটি বিচ্ছিন্ন, দুঃসাহসী এবং প্রবলনিন্দিত ব্যতিক্রম ছাড়া দেহকে অতিক্রম করে চিত্তরূপের প্রসারের কোনও চেষ্টা নেই। আজ বাইশে শ্রাবণ তাই শুধু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন নয়, বাঙালির চিন্তনশক্তির মৃত্যুরও একটা প্রতীকী দিন। রাবীন্দ্রিক সংজ্ঞাটির ছকে আশ্রমিক, ত্যাগী, ঋষিপ্রতিম রবীন্দ্রনাথের দেহটাই গড়ে তোলা হয়েছে তিল তিল করে।

বদলে যেতে থাকা ভারতবর্ষে’র এইবার আত্মার অনুসন্ধান শুরু হোক, এক অর্থে সেটা আত্মানুসন্ধানও হয়ে উঠতে পারে আমাদের।

শনিবারের চিঠি, ৫২ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা