বন্ধু বুদ্ধদেব

সুখের কথায় দাম্পত্য সুখ, সংসারিক সুখের কথাই খুব আসে দেখি। বন্ধুত্বের সুখের কথা সেভাবে আসে কই? বন্ধুত্বের রকমফেরের মতো বন্ধুত্বের সুখেরও যে কত রকমফের আছে, সেটা প্রতি বছর পয়লা মার্চ এলে মাথায় ঘুরপাক খায়। কারণ তারিখটায় বন্ধু বুদ্ধদেবের জন্মদিন। কাছাকাছি বয়সের আমরা। কিন্তু পেশায়, কাজের ধারায় দুই পৃথিবী দূরত্বে। অথচ বুদ্ধদেবের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ব্রাহ্মমুহূর্তে নিয়তির বশে আমাকেই নিতে হলেও ওঁর সাক্ষাৎকার, কলকাতা দূরদর্শনে। কথা শুরুর আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কীভাবে পরিচয় করালে ভালো লাগবে আপনার?” প্রায় কিছু না ভেবেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “খুব খুশি হব যদি এইটুকুই বলেন : আমার বন্ধু বুদ্ধদেব।”

কথাটা যে নিতান্ত বাঙালি সৌজন্য বা সাহেবি কেতা ছিল না, তা বছরের পর বছর ধরে অনুভব করে আসছি। বন্ধুত্বও একটা গভীর অনুসন্ধান, তা-ও টের পেয়েছি ঘটনা থেকে ঘটনায়, ভাবনা থেকে ভাবনায়, হাসি থেকে হাসিতে, নানা বই, মানুষ, সিনেমা, নাটক, গান ভালোবাসা থেকে ভালোবাসায়। মন্ত্রী বুদ্ধদেব রাইটার্সে কাজের পর নন্দনে ওর বিশেষ ঘরটায় বিদেশী ছবি দেখতে বসেন। কিন্তু ছবি দেখা ছাড়াও সময়টা ওঁর মেলামেশার। বড়ো হলে ছবি দেখতে এসেছি শুনলে, ডাক পড়ত। তারপর নানা গল্পে, কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রোবিং কোয়েশ্চন, খোঁজের জিজ্ঞাসা। “আচ্ছা আলমোদোভারের ছবিটা কেমন দেখলেন?”

একদিন যেমন জিজ্ঞেস করলেন কী পড়ছেন? বললাম ইয়োসে সারামাগোর ‘দ্য গসপেল অ্যাকর্ডিং টু জিসাস ক্রাইস্ট’। সারামাগো সেই বছরই সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। উত্তর শুনে ওঁর তখনকার ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া কিংস-এ চুটিয়ে একটা সুখটান দিয়ে বুদ্ধদেব বললেন, “ওর ‘স্টোন রাফট’ও পড়ুন। অসম্ভব ভালো। এরপর আমরা অন্য কথায় চলে গিয়েছিলাম। পরদিন, রোববার দুপুরে, বেল বাজল। খুলে দেখি একজন এক কপি ‘স্টোন রাফট’ নিয়ে দাঁড়িয়ে। বলল, “সাহেব এটা পাঠিয়েছেন।”

ধুতি-পাঞ্জাবির নিপাট বাঙালিবাবুটির এহেন কিছু সাহেবিয়ানা ছিল। বই উপহার দেওযার অর্থ হল, সে-বই নিয়ে আলোচনার পরিসর তৈরি করা। সুনীলদা (গঙ্গোপাধ্যায়) একদিন যেমন বললেন, “বুদ্ধদেব আমাকে চিনা লেখক গাও-এর একটা বই দিয়েছেন। তার মানে অ্যাসেসমেন্ট চাইছেন। মন্ত্রীত্ব সামলে কখন যে এসব পড়ে লোকটা!”  আমায় বলতেই হল, পড়া বলছেন? আমায় বলেছিলেন, রাতে ঘন্টাখানেক রবীন্দ্রসংগীত না শুনলে ওঁর ঘুম আসে না এছাড়া কবিতা ঘাঁটাঘাঁটি তো আছেই।

বুদ্ধদেব জীবনটা ভাগই করে রেখেছিলেন ছোট মাছের ঝোল আর ভাতে, লম্বা সিগারেট আর কাপের পর কাপ চায়ে, প্রিয় পদ্য (পড়ুন জীবনানন্দ), আর প্রিয় গদ্যে (পড়ুন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রিয় কাজ (দল করা) আর প্রিয় নিঃসঙ্গতায়। এই নিঃসঙ্গতাই উনি কাজে লাগাতেন গান শোনায়, এই নিঃসঙ্গতা থেকেই টান পেতেন বন্ধুত্বের।প্রিয় বোদলেয়ারের মতো বলতেই পারতেন, “নেভার অ্যালোন হোয়েন অ্যালোন।” নিঃসঙ্গ নই, যখন নিঃসঙ্গ।

কিন্তু বড় মুখ করে কিছু বলার স্বভাব ছিল না ওরঁ। রূপে, গুণে, ক্ষমতায় যখন উনি জীবনশীর্ষে, তখনও মহাভারতে অর্জুন হতে চাননি। হতে চেয়েছেন যুধিষ্ঠীর। আরেক বুদ্ধদেব (বসু) যাঁকে তাঁর ‘মহাভারতের কথা’য় শনাক্ত করেছেন মহাকাব্যের নায়ক হিসেবে। ধুরন্ধর যোদ্ধা নন যে যুধিষ্ঠির, বনপর্বের, বনপর্বের দীর্ঘ বারো বছর— তিনি যত না বলেছেন তার থেকে ঢের বেশি শুনেছেন, মুনিদের মুখে পুরাণকথা। অরণ্য হয়ে উঠেছে বিশ্বজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর মন্ত্রিত্ব, উপ মুখ্যমন্ত্রীত্ব এবং মুখ্যমন্ত্রীত্বের দীর্ঘ বছরগুলো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যুধিষ্ঠিরের মতো কাজে লাগিয়েছেন দীক্ষা, শিক্ষা, পরীক্ষায়। পাস-ফেল, সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়ে যার বিচার হয় না, বিচার হয় যৌক্তিকতায়, লাবণ্যে, উত্তরণে।

যৌক্তিকতা ও সময়োপযোগিতা কীরকম, তার একটা ছোট্ট নমুনা দিই। মুখ্যমন্ত্রীত্বের দায় নেওয়ার মুখেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর বই বেরল – ‘পুড়ে যায় জীবন নশ্বর।’ যা তিনি শেষ করেছেন মানিকের ডায়েরি থেকে উদ্ধৃত করে। মানিকবাবু সেখানে লিখছেনঃ “সন্ধ্যার পর খবর এলঃ দিল্লিতে প্রার্থনাসভায় পিস্তলের গুলিতে গান্ধীজি নিহত। সমস্ত মনপ্রাণ যেন ‘হায় সর্বনাশ!’ বলে আর্তনাদ করে আঘাতে মুহ্যমান হয়ে গেল।

‘ধর্ম! অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ম।’

‘সাম্প্রদায়িকতার উপরটাই লোকে দেখছে। পিছনে কী গভীর ও ব্যাপক ষড়যন্ত্র, চোখে পড়ে না। যে উদ্দেশ্যে ভারত বিভাগ, সেই উদ্দেশ্যেই এই ভারত-পাকিস্তানের বিবাদ বাড়িয়ে চলা। ব্রিটিশ-আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ দু-রাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে থাকতে পারবে।’

একসময় বই পাওয়া-দেওয়াটাই একটা সংলাপের মতো হয়েছিল।যা ক্রমশ ফাউন্টেন পেনে ছড়ায়। আসলে ডায়লগ ততটা নয়, যতটা মনোলগ। আমি লিখি জেল পেনে আর বুদ্ধদেব আমায় কাবু করতে লাগলেন মঁ ব্লঁ, ফোর্ড, ঝর্না কলম দিয়ে, যার কোনও জবাব আমার কাছে ছিল না। আমার সাহায্যে এসেছিল গিন্নি ইন্দ্রানী, ওর সদ্য প্রকাশিত প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট ওঁকে উপহার দিয়ে। তার কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর ফোন। “আপনি এত ভালো গান করেন! আগে বলেননি কখনও? অনুষ্ঠানে গাইবেন?” ইন্দ্রাণীর তখন বিশ্বাসই হচ্ছে না ওপার থেকে কার গলা ভেসে আসছে।

এই গলাটা সামনে বা ফোনে পাই না বলে বেদনার শেষ নেই। বন্ধুত্বের যে-সুখের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই সুখ এখন স্মৃতিতে। আর অন্য বুদ্ধদেবের(বসু) গুণী গৃহিনী প্রতিভা বসু তো পৃথিবীকে বই লিখে জানিয়েই দিয়েছেন ‘স্মৃতি সততই সুখের।’ বন্ধু বুদ্ধদেবের এরকম দু একটা স্মৃতির কথা দিয়ে শেষ করব।

দূরদর্শনে যে সাক্ষাৎকার আলাপ শুরু সেখানে কীরকম মগ্ন স্বরে বলছেন পুরীতে সৈকতে বসে কীভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন বামপন্থী রাজনীতি করবেন। স্মৃতিচারণা করলেন শৈশবে দেখা কাকা সুকান্ত-র শেষ দিনগুলো নিয়ে।

শক্তিদার (চট্টোপাধ্যায়ের) শেষ দিককার বিদায়সংগীতের মতো একগুচ্ছ কবিতার ইংরেজি তর্জমা করেছিলাম। ‘ডিপাচার্জড’ নামের সেই সংকলন নন্দনে উদ্বোধন করেছিলেন বুদ্ধদেব। তারপর ফয়ারে দাঁড়িয়ে হাতে চা নিয়ে কবিদের বিদায় বাসনার মনোভাব নিয়ে কথা হল কিছুক্ষণ। এবং অবধারিতভাবে প্রসঙ্গে এসে পড়লেন জীবনানন্দ। মনে নেই কোন কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু গতকাল সাতাত্তরে পা দেওয়া বন্ধুর চোখের অসুবিধের কথা ভেবে ‘রূপসী বাংলা’ থেকে সেরকমই ক-টি পংক্তি উদ্ধার করছি ওঁর সুখের জন্য— “…যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে/ অপরাজিতার মতো নীল হয়ে— আরও নীল – আরও নীল হয়ে/ আমি যে দেখিতে চাই,..”

বুদ্ধদেবের বন্ধুত্বে, সুখ পেয়েছিলাম বলে এখন ওঁর জটিল স্বাস্থ্যের পরিস্থিতির জন্য দুঃখ করব না। তাতে কষ্ট পাবেন বুদ্ধদেব নিজে। একসময় চোখের অপারেশন নিয়ে খুব বলতেন আমাকে। কিউবাতে গিয়েও সেরা চিকিৎসা করিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও ফল হয়নি দেখে দমে গিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যের কারণে ওঁর যে কষ্টটা সেটা সবচাইতে বেশি ওঁর চোখ নিয়ে। চোখ না থাকলে আর কী রইল?—এটাই বুদ্ধদেবের দুশ্চিন্তা ছিল বড়ো। রবীন্দ্রনাথের গান আছে ঠিকই, তাই বলে বই পড়তে পারবো না? সেটা যে কত ঘোরতর হতে পারে, বুদ্ধদেবের শেষদিকের জীবন সেই সাক্ষ্য দেয়। অন্ধকার ঘরে সময় কাটাতে হচ্ছে বাঙালির এই উজ্জ্বল পুরুষকে।ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি যাঁর পরন, তাঁকে দিনমানে অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে হয়, চোখে আলো সহ্য করতে পারছে না।

বুকও কি বাইরের হাওয়া নিতে পারছে? সিওপিডি আক্রান্ত বুদ্ধদেব কীকরে মানবেন এসব? মানতে যে পারছেন না তার একটা ছোট্ট প্রমান হাসপাতাল থেকে পালাই পালাই করে চলে আসা। কাগজে এসব পড়লে আমার চোখে জল আসে, এ যেন অর্জুন আর গাণ্ডীব ধনু তুলতে পারছেন না। বুদ্ধদেব যুধিষ্ঠির ঠিকই, কিন্তু সাহসে তিনি অদ্বিতীয় অর্জুন।আর এখন জীবনসায়াহ্নে প্রায় কর্ণ হতে চলেছেন। তাঁর রথের চাকা দিনদিন বসছে। এটাই সময়, কৃষ্ণ অর্জুনকে বলবেন, “যাও ওকে প্রণাম করে এস।”

এ তো আজব ব্যাপার দেখছি। আমার বন্ধু বুদ্ধদেব একইসঙ্গে যুধিষ্ঠির, অর্জুন এবং কর্ণ।এক কথায় মহাভারত।

লেখকের অনুমতি অনুসারে চার বছরে আগের রচনা ‘বন্ধু বুদ্ধদেব’ পুনর্মুদ্রিত হল ‘শনিবারের চিঠি’তে।