পর্ব- ৭
উদ্ধারকর্তা দ্বারকানাথ
দ্বারকানাথ শুধুমাত্র যে জমিদারদের আইনি পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেছেন তা নয়, তিনি মাঝেমধ্যে জমিদারদের উদ্ধারকর্তা রূপেও আর্ভিভূত হয়েছিলেন।একবার মফঃস্বলের কোনো এক জমিদারের অসাবধনতায় তার একটি বড় জমিদারি নিলামে ওঠার উপক্রম হয়।কালেক্টর কলকাতার শেরিফকে দিয়ে এই নিলাম কলকাতায় করবার ব্যবস্থা করলেন।যাঁর জমিদারি, তিনি দেখলেন যে, যে জেলার জমিদারি সেই জেলায় নিলাম হলে তিনি সেটা কিনে নিতে পারেন কিন্তু কলকাতায় নিলাম হলে বহু ক্রেতার মধ্যে ঐ জমিদারি আবার কিনে নেওয়া শক্ত- প্রায় অসম্ভব বললেই চলে।
প্লাউডেন সাহেব তখন শেরিফের কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন।যিনি শেরিফ, তিনি মনে না করলে আর কেউ কিছু বলতে পারে না।সাহেবদের বশীভূত করতে হলে,তখন দ্বারকানাথের সাহায্য অকাট্য উপায় ছিল।জমিদারটি কলকাতায় এসে দ্বারকানাথের শরণাপন্ন হলেন।
দ্বারকানাথ জমিদার কে বললেন,‘আমি নিজেই ওই জমিদারি ক্রয় করিব বলিয়া স্থির করিয়াছি,কারণ উহা লাভজনক সম্পত্তি।’জমিদারটি তখন মহা সংকটে পড়লেন।যাঁর আশ্রয় চাইলেন, দেখা গেল তিনিই প্রতিপক্ষ।জমিদারটি কাতর হয়ে কেঁদে ফেললেন।
দ্বারকানাথ কারও চোখের জল সইতে পারতেন না,কাজেই বললেন,“বেশ আমি চেষ্টা করিব কিন্তু বর্তমান শেরিফের সঙ্গে কোন কারণে আমার বিবাদ আছে।ফল কতদূর হইবে জানি না।আমি অনুরোধ করিলে কখনই সে রাখিবে বলিয়া বোধ হয় না।তথাপি যতটা পারি আপনার সাহায্যের চেষ্টা করিব।”
দ্বারকানাথ চালাকির আশ্রয় নিলেন।দ্বারকানাথ পূর্ববর্তী শেরিফ প্লাউডেনের প্রিয়পাত্র ছিলেন কিন্তু নতুন শেরিফের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল না।তাই তাঁকে গিয়ে দ্বারকানাথ বললেন,“যদি ওই জমিদারি কলকাতায় নিলাম হয় তা হলে আমার উপকার হয়,আমি বেশি দাম দিয়ে ও সেটি কিনতে পারি।”
শেরিফ দ্বারকানাথের প্রতি বিদ্বেষবশত দ্বারকানাথের সুবিধা হবে জেনে একেবারে বেঁকে বসে বললেন,“তাও কি সম্ভব দ্বারকানাথ!ওটা অমুক জেলার জমিদারি, সেই জেলাতেই নিলাম হবে।”
দ্বারকানাথ আগ্রহ দেখিয়ে বললেন,“আপনি আমার বন্ধু। আপনি যদি এই সামান্য উপকারটুকু না করেন ত’ আমি অন্য কার কাছে সাহায্য চাইব বলুন।”
শেরিফ বললেন,“সে কি হয়?আমি তা পারি না।জেলার কালেক্টর অবশ্য এখানে নিলামের জন্য অনুরোধ করেছেন, কিন্তু আমি এখনই তা সম্ভব নয় তা জানিয়ে দিচ্ছি।”
দ্বারকানাথ বললেন,“কালেক্টর যদি ব্যবস্থাই করে থাকেন তবে আপনি কেবল দয়া করে সেটা বদল করিবেন না।এতে আমার উপকার হয়।এত সহজ উপায়ে একটি বন্ধুর উপকার করিতে আপনার আপত্তি থাকতেই পারে না।”
শেরিফ বললেন, “আমায় মাপ কর দ্বারকানাথ, এ সম্ভব নয়।তুমি বসিয়া দেখ আমি তোমার সামনেই কলিকাতায় নিলাম না হইবার হুকুমনামা লিখিয়া দিতেছি।”এই বলে শেরিফ তখনই পত্র লিখিলেন।
লেখা শেষ হলে দ্বারকানাথ হেসে বললেন, “এমন আশা করি আপনার প্রিয় বন্ধু শেরিফের রহস্য এখানেই শেষ হবে।ঐ চিঠি এই টেবিলেই থাকিবে,পাঠানো আর হইবে না।”
শেরিফ বললেন,“না দ্বারকানাথ তুমি ভুল করছ।এ বিষয়টা এতই জরুরি যে এই দেখ এখনই এ পত্র রওনা করে দিতেছি।” এই বলে সাহেব চাপরাশীকে ডেকে চিঠিটা পাঠাবার জন্য উপযুক্ত কর্মচারীর হাতে দিতে বললেন।
দ্বারকানাথ দেখলেন, তাঁর কৌশল সিদ্ধ হয়েছে, তখন তিনি সাহেবকে অনুরোধরক্ষায় নিতান্ত অপারগ বুঝে যেন কাতর এমনি ভাব করে বিদায় নিলেন।
দ্বারকানাথ জমিদারকে জানালেন নিলাম কলকাতায় হবে না, জেলাতেই হবে।জমিদার তাঁর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে দ্বারকানাথকে লক্ষ টাকা প্রণামী দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন।
এই প্রসঙ্গে নগেন্দ্রনাথ বসুর মন্তব্য টি স্মরণযোগ্য –‘দ্বারকানাথের লোভ সংবরণ ও শরণাগত রক্ষার ইহা একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত।শরণাগতের জন্য শত্রুর উপাসনা করিতেও দ্বারকানাথের ন্যায় গৌরবান্বিত,মান্যগণ্য ব্যক্তি কিছুমাত্র ‘কিন্তু’ বোধ না করিয়া যে ন্যূনতা স্বীকার করিয়াছেন, তাহাও তাহার চরিত্রে উজ্জ্বল হইয়া রহিয়াছে।’
পর্ব-৮
শিকারে দ্বারকানাথ
লন্ডনে পৌঁছানোর পর দ্বারকানাথ মহারাণী ভিক্টোরিয়া ও তাঁর সভাসদদের প্রিয়পাত্র হন।একবার লন্ডনে দ্বারকানাথকে শিকার পার্টিতে নিমন্ত্রণ করা হয়।শিকারের জায়গায় ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে।কথা ছিল যে শিকারির দল তাঁকে হোটেল থেকে নিয়ে যাবে।বন্ধুরা তাঁকে নিতে এলে দ্বারকানাথ জানালেন যে, তাঁর পা ব্যথা করছে,ফলে তাঁর পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া সম্ভব নয়।তিনি শিকারে যেতে চাইলেন না। তারা অনেক জোরাজুরি করার পর রফা হল যে তাঁকে ঘোড়ায় চড়তে হবে না,তাঁর জন্য আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করা হবে।শিকারের দল রওয়ানা হল।মাঝখানে তিনি গাড়িতে বসা। আর চারপাশে ঘোড়ায় চড়া বৃটিশ নরনারী, অনেকটা উচ্চপদস্থ কাউকে প্রোটোকল দিয়ে নিয়ে যাবার মতো ব্যাপার।সেদিন সকালে লন্ডনবাসীরা অবাক হয়ে দেখল যে অভিজাত বৃটিশরা এক ভারতীয়ের গাড়ি পাহারা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১ এবং পর্ব ২ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৩ এবং পর্ব ৪ পড়তে হলে ক্লিক করুন।
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৫ এবং পর্ব ৬ পড়তে হলে ক্লিক করুন।