সজনীকান্ত আর তাঁর পাঠশালার গুরু

দু’জনেরই জন্মস্থান বর্ধমান জেলায় একজন সজনীকান্ত দাস প্রখ্যাত সাহিত্যিক, কবি, সমালোচক আরেকজন তাঁর প্রথম জীবনের শিক্ষক তাঁদের মধ্যে আরও মিল দু’জনেই বহিরাগত আর মালদা শহরে অতিবাহিত করেছেন জীবনের অমূল্য সময় 

গত শতাব্দীর প্রথম ভাগের বাংলা সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্বই ছিলেন সজনীকান্ত সাহিত্যের সমস্ত শাখাতেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ যদিও নির্মাণ করেছেন প্রচুর ব্যঙ্গাত্মক রচনা মানুষকে উপহাস করেছেন নজরুল জীবনানন্দ নেতাজি, বাদ যাননি কেউ তবে সজনীকান্তের অবদানও প্রচুর ‘শনিবারের চিঠি’ নামের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ‘সজনীকান্ত একজন সত্যিকার সাহিত্য রসিক, একজন উদার মানুষ বহু গুণের মানুষ’ একথা বলেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তিনি আরও লিখেছেন ‘সজনীকান্তের এত কাছে এলাম যে, তাঁর ভালো-মন্দ সবকিছু দেখলাম— দেখতে পেলাম দোষ তাঁর ছিল নির্দোষ মানুষ সংসারে ক’জন? কিন্তু গুণ, আমি দেখেছি, যাচাই করেছি, সে অনেক এবং তা সুদর্লভ্য এত গুণের মানুষ—বর্তমান কালে বেশি নেই তবে সাহিত্য-বিচারক, সাহিত্য-প্রেমিক হিসাবে তাঁর দোসর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ’(নিপাতনে সিদ্ধ, লেখক ইন্দ্র মিত্র, প্রকাশক কারুকথা, ২০১৪, পৃষ্ঠা ৫৪)

জন্মস্থান মাতুলালায় জন্ম তারিখ, ১৯০০ সালের ২৫শে আগস্ট বর্ধমান জেলার গলসী ব্লক থেকে ১৭ কিমি দূরে; গাঁয়ের নাম বেতালবন পৈতৃক বাড়ি বীরভূম জেলায় জন্ম সালটির সঙ্গে অদ্ভুত সমাপতন আরেকটি বিষয়ের শৈশবে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরাজি, অঙ্ক শিখেছেন কবি, তারও জন্ম ১৯০০ সালে আত্মজীবনীতে পরে লিখেছেন সজনীকান্ত “বাবার বদলীর চাকরি, কাজেই বহু স্থানে কেটেছে তাঁর শৈশব, বাল্য, কৈশোর দিনাজপুর জেলাস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ (১৯১৮) বাঁকুড়া মিশনারি কলেজ থেকে আইএসসি (১৯২০) স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএসসি (১৯২২)” (আত্মস্মৃতি, সজনীকান্ত দাস, নাথ পাবলিশিং, কলকাতা, তিন খণ্ড একত্রে, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১০)

ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ সমাপ্ত হয়নি মনোনিবেশ করেন সাহিত্য কর্মে ‘শনিবারের চিঠি’ ও অন্য বিবিধ পত্রিকা এবং প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন কবিতা, গল্প, সমালোচনা মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ বহু, ষাটের অধিক তাঁর রচিত ‘বাঙ্গালা গদ্যের প্রথম যুগ’ (সাল ১৯৪৬), বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি সজনীকান্তের মৃত্যু ১৯৬২ সালে 

সমাপতনের কথা বলা হচ্ছিল যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন তিনি, তারও প্রতিষ্ঠা সেই ১৯০০ সালে; বিদ্যালয়ের নাম, দুর্গাদেবী প্রাথমিক বিদ্যালয় পরে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটিয়ে নাম হয় ‘দুর্গাদেবী দীনবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠাতাকে সম্মান জানাতে তাঁর নাম বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় (১৯৪৮) (দীনবন্ধু স্মরণিকা, সম্পাদক প্রকাশক ডক্টর রাধাগোবিন্দ ঘোষ, ১৯৮৭)

বিদ্যালয়ের অবস্থান মহানন্দা নদী তীরের মালদা বা মালদহ নামের ছোট্ট শহরে, গোলাপট্টি পাড়া বিদ্যালয়টির আরেকটি পরিচিতি ‘গোলাপট্টি পাঠশালা’ হিসাবে

কেন এমন নাম, ‘গোলাপট্টি পাঠশালা’? কবিতার মধ্য দিয়ে উত্তর লিখেছেন শিশু সজনীকান্ত তাঁর বহু সৃজনের মধ্যে শৈশবে রচিত কবিতাটির কথা অনেকের নজরে আসেনি (সজনীকান্তের ‘আত্মস্মৃতি’তে পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ কবিতা)

“কুলুকুলু মহানন্দা, দুই তীরে শান্ত জনপদ;

এপারে দাঁড়ায়ে এক খুদ্র শিশু গণে জল-ঢেউ–

এক, দুই, তিন, চারি কাঠের গোলার আশেপাশে, …”

আবার বলি, লিখেছেন কবি সজনীকান্ত দাস পড়তেন গোলাপট্টি পাঠশালায়, থাকতেন বিদ্যালয় সংলগ্ন কালীতলা পাড়ায় পাঠশালার আশেপাশে কাঠের গোলা ছিল সে সময় ‘কাঠের গোলা’ থেকেই পাড়াটির নাম গোলাপট্টি তর্কের অবকাশ নেই প্রমাণ লিখে গেছেন স্বয়ং কবি সজনীকান্ত

কিন্তু গোলার সঙ্গে ‘পট্টি’ শব্দ কেন? মালদহের ঐতিহাসিক  রাধাগোবিন্দ ঘোষ লিখছেন, ‘প্রাচীন গুদরী বাজারের পশ্চিম দিকেই একটি পাড়ার নাম গোলাপট্টি পটি কথার অর্থ পল্লী কিংবা পাড়া পট (বেষ্টন করা)  + ইন প্রত্যয় যোগে শব্দটির উৎপত্তি মালদহের স্থানীয় উচ্চারণে পটি হয়েছে পট্টি মালদহের বেশ কয়েকটি এলাকার নাম ‘পট্টি’ যুক্ত… চুড়িপট্টি, কাঁকারী পট্টি‘ (দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৯০)

সজনীকান্ত আর তাঁর পাঠশালার প্রসঙ্গে ফিরে যাই যখন বাংলা সাহিত্য আকাশে সজনীকান্ত উজ্জ্বল নক্ষত্র, অতি ব্যস্ত তাঁর সৃজনশীল জীবন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বহু কর্মে লিপ্ত, তখনও এসেছেন এই গোলাপট্টি পাঠশালার বিশেষ অনুষ্ঠানে শিক্ষক দীনবন্ধু চৌধুরীর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মালদা টাউন হলে সংবর্ধনা সভায় (১৯৪১) সেই প্রসঙ্গে অলোচনা হবে পরে তার আগে অন্য কথা

বাংলার যশস্বী সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছেন গোলাপট্টি পাঠশালার অর্থাৎ ‘দুর্গাদেবী দীনবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এ আর থাকতেন কালীতলা পাড়ায়

কালীতলার কোন্ বাড়ি? স্বর্গীয় কমলাপতি অধিকারী যে বাড়িতে থাকতেন (প্রতিবেদক ডাকতেন ‘কমলাজ্যাঠা’ সম্বোধনে) কমলাজ্যাঠা গোলাপট্টি স্কুলের ছাত্র, দুর্দান্ত ফুটবলার ছিলেন সে সময় মালদার অনেক ফুটবলার কলকাতার মাঠেও খেলেছেন অনেকে

সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস সম্পর্কে স্বর্গীয় কমলাপতি অধিকারী লিখেছেন, “আমরা উনাকে (সজনীকান্ত দাস) সজুদা বলেই ডাকতাম সজুদারা ছিলেন চার ভাই …একজনের নাম ছিল অজু, আর একজনের নাম গজু সজুদাকে একবার মালদায় নিয়ে আসা হয়েছিল মতিই এনেছিল আমরা সেই সময় ‘শনিবারের চিঠি’ (সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত পত্রিকা) খুব পড়তাম … আমি যে বাড়িতে আছি, সজুদারা এই বাড়িতেই থাকতেন” (দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৯০) প্রসঙ্গত, এই বাড়িতে বসবাসের সময়ই সজনীকান্ত দাসের এক দাদার মৃত্যু ঘটে (আত্মস্মৃতি)

আর আত্মজীবনীতে সজনীকান্ত যে বাড়ির বিবরণ লিখেছেন, তাতেও বর্ণনা রয়েছে কমলাপতি অধিকারীর বাড়ির আর কোন্ ‘মতি’ সাহিত্যিক সজনীকান্তকে মালদায় আনতে সমর্থ হয়েছিলেন? তিনি মতিলাল বিহানী কৃতী ইঞ্জিনিয়ার, কবিতাও লিখতেন কমলাপতি অধিকারী আরও লিখেছেন, গোলাপট্টি পাঠশালার ছাত্র স্বর্গত শৈলেন মজুমদারের কথা শৈলেন মজুমদার কংগ্রেস কর্মী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী তাঁর কথা মালদাবাসী স্মরণে রাখেননি

মালদার ইতিহাস চর্চা করেছেন অনেকে তবু বহুবিধ বিষয় এখনও অনালোচিত কেমন ছিল তখনকার মালদা? কোন প্রেক্ষাপটে ১২৪ বছর আগে তৈরি হল গোলাপট্টি স্কুল বা ‘দুর্গাদেবী প্রাথমিক বিদ্যালয়?’

গোলাপট্টি পাড়া দিয়েই শুরু হোক মালদার বর্ণনা প্রথমত কেন এমন নাম, গোলাপট্টি? উত্তর লিখেছি আগে ‘গোলা’র সঙ্গে সংযুক্ত এই নাম ‘এখানে (গোলাপট্টি অঞ্চলে) রেশম, নীল রং, ধান, কাঠ, চুন, কাপড়, সোনা, লোহা, নারিকেল, সুপারি, লবণ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসের কারবার ছিল নীল রঙের কারবার চলত, তাই একসময় শহরের নাম ছিল ‘রংরেজ বাজার’ ইংরেজ আসার পর এই শহরের নাম ইংরেজবাজার হয়েছে বর্তমানে নেতাজি রোড ইংরেজবাজারের একটি প্রসিদ্ধ রাস্তা’ লিখছেন শ্রীযুক্ত বনবিহারী পোদ্দার, গোলাপট্টি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, শহরের স্বনামধন্য রেশম ব্যবসায়ী (দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৫৪)

স্বর্গীয় হিমাংশুভূষণ চক্রবর্তী, শহরের বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী তিনি লিখছেন, ‘ঠিক যে সময়ে দীনবন্ধুর মালদহে আগমন ঘটে সে সময় শহরের ফুলবাড়ি কুতুবপুর এলাকার লোক—যারা মালদার আদি বাসিন্দা নামে খ্যাত—তারা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত মকদুমপুর এলাকার মানুষকে ‘বিদেশী শালারা’ বলে অভিহিত করত (দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ১১৯-১২৯) প্রসঙ্গত, দীনবন্ধুর জন্ম ১৮৭১ সন ২৫/২৬ বছর বয়সে তাঁর মালদায় আগমন আর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যখন তাঁর বয়স ২৯ বছর

হিমাংশুবাবু আরও জানিয়েছেন, গোলাপট্টি অঞ্চলে সোনার দোকান ছিল অনেক দোকানগুলোতে সারারাত ধরেই কাজ চলত অন্য রকম প্রোডাকশনও হত এখন যেখানে ‘গৌরবার্তা’ ছাপাখানা, সেখানে আগে ছিল একটি বিস্কুটের কারখানা মালদহে ওটি ছিল হিন্দুদের একমাত্র রুটি বিস্কুটের কারখানা মালিকের নাম স্বর্গত সজনীকান্ত বনিক গোলাপট্টির ছাত্ররাই ছিল বিস্কুটের বড় খরিদ্দার আখের গুড় দিয়ে পাটালী বিস্কুট ও গোলমরিচ ইত্যাদি নানাবিধ মশলা দিয়ে ঝাল বিস্কুট প্রস্তুত করতেন

আরও অন্য রকম ব্যবসা হতো গোলাপট্টির পাড়ার চৌহদ্দিতে সারা পরিবারের বিভিন্ন রকম কারবার, স্বর্গত মুকুন্দলাল সাহা ও তাঁর পিতার সার ও অন্য ব্যবসা পূর্ববঙ্গ (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে নৌকা বা স্টীমার যোগে নারকেল, সুপারি ও ঝাঁটার খিল আমদানি করতেন অনেকে মালদা থেকে বাইরে যেত আম, মুসুরডাল, আখের গুড় বাড়ি তৈরির উপকরণ—চুন, বালি, সিমেন্ট ইত্যাদির বড় কারবার ছিল গোলাপট্টি অঞ্চলে (দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ১২১)

এবার গোলাপট্টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রসঙ্গ্য ‘দুর্গাদেবী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করলেন কে? বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধানশিক্ষক, স্বর্গীয় দীনবন্ধু চৌধুরী (১৮৭১-১৯৪৮) এমন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন কেন হল? মালদার ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টির আলোচনা প্রয়োজন 

সাংবাদিক স্বর্গীয় সুধীর চক্রবর্তী জানিয়েছেন, দুর্গাদেবী দীনবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের গায়ের ফলক জানান দিচ্ছে, প্রতিষ্ঠা বর্ষ ১৯০০ সাল মালদহ জেলা গঠিত হয়েছিল ১৮১৩ সালে অর্থাৎ বিদ্যালয়ের পাকা ঘর নির্মাণের ৮৭ বছর আগে যে কোনো সংগঠনের পাকা ঘর প্রতিষ্ঠার বেশ কয়েক বছর আগে ঐ সংগঠনের জন্ম হয় তাই মালদহ জেলা তৈরির ৭৭-৭৮ বছর পর বিদ্যালয়ের জন্ম মনে রাখা দরকার, ১৮১৩ সালে মালদা জেলা গঠিত হলেও ১৮৫৯ সালের আগে পরিপূর্ণ ক্ষমতাশালী কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুর নিয়োগ করা হয়নি অর্থাৎ পাঠশালা গড়ে ওঠার ৪১ বছর আগে মালদহ পরিপূর্ণ জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এই জেলা প্রতিষ্ঠা (১৮১৩) হবার পর জেলার সদর স্থাপিত হয়েছিল ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে জেলা প্রতিষ্ঠা হবার পর চাকরির সন্ধানে অখণ্ড বঙ্গের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণের জেলাগুলি থেকে ইংরেজবাজারে বহু শিক্ষিত মানুষ আসতেন চাকরি পেয়ে মালদায় সপরিবারে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার তাগিদেই পাঠশালার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল (সুধীর চক্রবর্তী, দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৩১-৩৪)

সজনীকান্ত দাসের শিক্ষক, শ্রদ্ধেয় দীনবন্ধু চৌধুরী

 

সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস

বিদ্যালয়ের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, তাঁরও জন্মস্থান বর্ধমান, কাটোয়া গ্রাম শ্রীসুরুড়া, লোকমুখে সুড্ডা বর্ধমানের দীনবন্ধু চৌধুরী মালদা শহরের আদি শিক্ষাগুরু তিনি নিঃসন্তান ছিলেন বহু গুণের অধিকারী রাগসঙ্গীতে পারদর্শী, এস্রাজ বাজাতেন অসংখ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, সাহিত্যিক তৈরি হয়েছিল তাঁর শিক্ষায় দীনবন্ধুবাবুর পরনে থাকত ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে চটি শীতকালে বালাপোষ গায়ে দিতেন মাঝে মাঝে লং কোট পরতেন সুড্ডা গ্রামে একটি কালী বিগ্রহের পূজা প্রবর্তন করে পূজার জন্য তাঁর সম্পত্তি দান করে যান খুব রাশভারী আর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষক ছিলেন ছাত্ররা তাঁকে ‘বড় মাষ্টার’ বলে ডাকতো (ডক্টর রাধাগোবিন্দ ঘোষ, ইতিহাসকার দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৮৯-১০৪)

প্রখ্যাত গম্ভীরা রচয়িতা মরহুম সূফী মাষ্টার একটি গানে তাঁর শিক্ষক দীনবন্ধু চৌধুরূ সম্পর্কে বলছেন, “মালদহে জন্মিয়াছেন এক সুবৃক্ষ চন্দন / পরিচয় করি তার নাম যদুনন্দন / তার গন্ধে মাতিয়াছে যত ডাক্তার কবিরাজ, / দীনু মাষ্টার যোগ দেন হয়ে গন্ধরাজ”| (রবীন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী, দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৪৫)

কে এই যদুনন্দন? যদু নন্দন চৌধুরী ছিলেন মালদার জমিদার জমিদার পরিবারের সদস্য শ্রী মণীন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী লিখেছেন, “যদুনন্দন চৌধুরীর সঙ্গে বৈদ্যনাথবাবুর (মালদহের মোক্তার; উকিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর পুত্র) বেশ ভাল পরিচয় হয়ে যায় কালক্রমে দীনবন্ধুবাবুর সঙ্গে যদুনন্দন বাবুর বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় যদুনন্দনবাবুর দরবারের প্রতি তিনি (দীনবন্ধুবাবু) আকৃষ্ট হন এবং ক্রমান্বয়ে একজন নিত্য দিনের সাথী হয়ে পড়েন যদুনন্দনবাবু নিজেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড় সমঝদার ছিলেন এবং ধ্রুপদ গাইতেন তিনি তাঁর দরবারে দুই একজন সঙ্গীতজ্ঞকে আহার বাসস্থান দিয়ে প্রতিপালন করতেন ঠিক সেই সময় পণ্ডিত মশায়ের (দীনবন্ধুবাবু) সান্নিধ্য লাভ করে যদুনন্দন চৌধুরী আরও এক ধাপ উঁচুতে উঠে যান 

পণ্ডিত মশায় বাঙালি ঘরানার একজন এসরাজ বাদক ছিলেন যদুনন্দনবাবুর দরবারে বহু রকম গায়ক ও বাদকেরা বিদেশ হতে আসতেন টাউনের বহু গুণী জ্ঞানী লোক শ্রোতা হিসাবে যোগদান করতেন পণ্ডিত মশায়ও উপস্থিত থাকতেন মনে পড়ে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা এক এসরাজ বাদ্যকার চণ্ডিকা প্রসাদ দুবেজীর কথা তিনি এসরাজ বাদ্যের উপর নানাপ্রকার আলোচনা করতেন দীনবন্ধুবাবুর সঙ্গে সঙ্গীতের প্রতি পণ্ডিত মশাইয়ের এত অনুরাগ দেখে যদুনন্দনবাবু বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন তারপর থেকে পণ্ডিত মশায় যদুনন্দনবাবুর দরবারের দৈনিক সদস্য হয়ে যান

এগুলি যেমন পণ্ডিত মশায়ের জীবনের একটি দিক, তেমনই আরেকটি দিক হচ্ছে তাঁর শিশু শিক্ষার দিক …যদুনন্দনবাবু পণ্ডিত মশায়কে মালদায় স্থায়ীভাবে রেখে দিতে সচেষ্ট হন এবং তাঁর বসবাসের জন্য গৃহ এবং স্কুল তৈরির জন্য জমির ব্যবস্থা করে দেন” (দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯)

প্রসঙ্গক্রমে বরদাপ্রসাদ চৌধুরীর পুত্র উকিল প্রিয়নাথ চৌধুরী (মালদহের বিশিষ্ট উকিল স্বর্গীয় নন্দগোপাল চৌধুরীর পিতা) কাটোয়া শহর থেকে মালদায় আসেন আনুমানিক ১৮৭০ সালে প্রিয়নাথ চৌধুরী তাঁর ভাই দীনবন্ধু চৌধুরীকে মালদায় ডেকে আনেন

স্বর্গীয় অধ্যাপক দুর্গাকিঙ্কর ভট্টাচার্য, মালদা কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময় তিনিও কাটোয়ার সুড্ডো গ্রামের লোক দীনবন্ধু চৌধুরী ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় সম্পর্কে লিখেছেন বহু কথা ‘বর্ধমান জেলার কাটোয়া রেল স্টেশন থেকে মাইল দেড়েক দূরে আমাদের গ্রাম— সুড্ডো, পোষাকী নাম অবস্য সুরুড়া আকারে আভিজাত্যে শিক্ষাদীক্ষায় ও ঐতিহ্যে বিরাট চৌধুরী পরিবার এই গ্রামের প্রাণকেন্দ্র পুরাতন দিনের জমিদারি কৌলীন্যের ধারক ও বাহক ছিলেন বিধু চৌধুরী ও ওরম্বা চৌধুরী (এর দুই ছেলে সুধীর ও সুন্দর আমার শৈশবের বন্ধু) বিধু চৌধুরীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা গ্রামের প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার চন্দ্রমোহন চৌধুরী, লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ব্যবহারজীবী প্রিয়নাথ চৌধুরী এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র নন্দগোপাল চৌধুরী, ব্যবহারজীবী কালীচরণ চৌধুরী ও তাঁর ভাই ভুজঙ্গভূষণ চৌধুরী, বৈদ্যনাথ চৌধুরী ও তাঁর পুত্র অমিয় চৌধুরী, কেতুগ্রাম স্কুলের প্রয়াত প্রধানশিক্ষক ‘হৃদদা’ অর্থাৎ হৃদয় গোপাল সিংহ এবং অনুপপত্তি বোধ রহিত বুনো রামনাথের আদর্শের যথার্থ উত্তরসুরী দীনু জ্যেঠু— এই সব নাম এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এঁদের প্রতিভার সাক্ষর সুড্ডোকে প্রতিবেশী অন্যান্য গণ্ড গ্রাম হতে বিশেষ এক স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত করে রেখেছে; ব্যতিক্রম শুধু এখান হতে কুড়ি মাইল দূরে অবস্থিত চুরুলিয়া গ্রাম, বিদ্রোহী কবি নজরুলের জন্মভূমি” (দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ১৮-২২)

মালদহের উকিল স্বর্গত নন্দগোপাল চৌধুরী সম্পর্কে আরও অনেক কথা লিখেছেন স্বর্গীয় অধ্যাপক দুর্গাকিঙ্কর ভট্টাচার্য প্রসঙ্গক্রমে স্বর্গীয় নন্দগোপাল চৌধুরী প্রতিবেদকের পিতা প্রতিবেদক নিজেও দুর্গাদেবী দীনবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র (১৯৬০-৬৪) বিদ্যালয় সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন পিতার মুখে স্বর্গত নন্দগোপাল চৌধুরী লিখছেন, ‘দুর্গাদেবী পাঠশালা প্রথমে শুরু হয় বি দে থিয়েটার হলে প্রথম ব্যাচের ছাত্র অমলাপদ চট্টোপাধ্যায় (ম্যাট্রিকে ডিভিশনাল স্কলার, পরে ভাগলপুর কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক), প্রবোধ কুমার রায় (ডিভিশনাল স্কলার), অধর চন্দ্র রায় (জেলা স্কলার) অধরদা, প্রবোধদা মালদহের তৎকালীন বিখ্যাত উকিল তখনকার মালদহ একটি শহর শহরের সুখ স্বাচ্ছন্দ এবং গ্রামীণ সরলতা সহজভাবেই ছিল যানবাহন পাল্কী গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি এবং সাইকেল, তা-ও খুব কম মালদহের আদি বাসিন্দারা মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ করেছিলেন বহিরাগতদের সকলে মিলে একটি সুন্দর এবং উদার সমাজ গড়েছিলেন’ (দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৯)

দীনবন্ধু চৌধুরী সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছেন সাহিত্যিক সজনীকান্ত দীনবন্ধুর জন্ম ১৮৮৭ সালে, তাঁর সত্তর বর্ষ পূর্তিতে (১৯৪২) গোলাপট্টি পাঠশালায় হয়েছিল মহতি উৎসব তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বহু ছাত্র উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সজনীকান্ত দাস তিনিই  ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি (উদ্যোক্তারা লিখছেন, ‘ডায়াবেটিসের জন্য সজনীকান্ত নিজে মিষ্টি খান না, আম নিশ্চয় খাবেন’) (রাধা গোবিন্দ ঘোষ, মালদহের একটি ঐতিহ্য সম্পন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, দীনবন্ধু স্মরণিকা, পৃষ্ঠা ৮৯)

আর সজনীকান্ত তাঁর শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রচনা করেছেন কবিতা, ‘তবু ভালবাসি’ কবিতাটি প্রতিবেদনে যুক্ত করা হল পাঠশালা প্রসঙ্গে সজনীকান্ত লিখেছেন বহু কথা “প্রসিদ্ধ দীনু পণ্ডিতের পাঠশালার শিক্ষা আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া আছে সার্থক গুরু মহাশয় হিসাবে তাঁহার তুলনা এ যুগে তো মিলেই না, সে যুগেও মিলিত না মালদহের বর্তমান, প্রবীণ, উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের অধিকাংশের শিক্ষার পত্তন এই দীনু পণ্ডিতের পাঠশালায় দীনু পণ্ডিতের কাছে কী শিখিয়াছিলাম—সরাসরি এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন আজ আমার সমগ্র জীবনের আলোকে হিসাব খতাইয়া এটুকু মাত্র বলিতে পারি, তিনি আমাকে বিশেষ যত্নের সহিত অঙ্ক বা গণিত শাস্ত্র শিখাইয়াছিলেন— পরবর্তী জীবনে যাহা নিয়মানুবর্তিতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদে রূপান্তরিত হইয়াছে পাঠশালা এবং স্কুল জীবনের লেখাপড়ায় আমার কৃতিত্ব ছিল অসাধারণ এই পাঠশালা হইতে সমগ্র জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছিলাম অতঃপর স্থানীয় জিলা স্কুলে ক্লাশ ফোর ও ফাইভের হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা পর্যন্ত পড়িয়া, পিতা পাবনায় ১৯১২ সালে বদলি হওয়ায়, ন’মামার কর্মস্থল বাঁকুড়ায় নিত হই (আত্মস্মৃতি, সজনীকান্ত দাস) 

বর্তমান প্রতিবেদনে দুর্গাদেবী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একশ পঁচিশ বছর পূর্তির প্রাক্কালে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র তথা বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক ও তাঁর শিক্ষাগুরুর প্রতি প্রতিবেদনে পুরনো দিনের—বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের—শহরের পরিচ্যয় উঠে এসেছে খানিক শতবর্ষ অতিক্রান্ত (প্রায ১২৫ বছর) ‘দুর্গাদেবী দীনবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়’ অনেক ইতিহাসের সাক্ষ্য নিয়ে মালদা শহরে টিকে আছে এখনও কালীতলা পাড়ার সেই বাড়িও টিকে আছে কিন্তু বর্ধমানে সজনীকান্তের জন্মভিটা (মামা-বাড়ি), বাঁকড়ার পৈতৃক ভিটা প্রায় নিশ্চিহ্ন

পরিশেষে বলি, ঐতিহাসিক শহর মালদার শিক্ষা বিস্তারের কাহিনী আজও উপেক্ষিত মালদার ইতিহাস চর্চায় এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে আশু আলোচনা এবং বহু তথ্য উদ্ধার প্রয়োজন নইলে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে মূল্যবান ইতিহাস

 

তথ্যসূত্রঃ

আত্মস্মৃতি, সজনীকান্ত দাস, নাথ পাবলিশিং, কলকাতা, তিন খণ্ড একত্রে, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১০

দীনবন্ধু স্মরণিকা, সম্পাদক, প্রকাশক ডক্টর রাধা গোবিন্দ ঘোষ, ১৯৮৭

ব্যক্তিগত স্মৃতি ও সংগ্রহ

 

সজনীকান্ত দাসের কবিতাঃ

তবু ভালবাসি

সজনীকান্ত দাস, ১৪/৭/৪২

মানুষের স্বার্থ, তার বহু উর্দ্ধে মানুষে প্রেম,

কাব্যের আকাশে শুধু সেই প্রেম নিত্য জেগে রয়, 

কল্পনা-পাখায় উড়ি মোরা সেথা ভাসিয়াছিলেম,

পিছনে পড়িয়া ছিল ধরণির দ্বিধা দন্দ ভয়

দেখিলাম নিত্য শুন্যে লাখ লাখ অত্মিয় আত্মার

অভাবে ভ্রমিয়ে ফেরে কহে কানে আশ্বাসের বাণী,

বহু শত যুগান্তের মানবের প্রেম সমাচার–

বিচিত্র ভাষায় ছন্দে শুনাইল কলে কণ্ঠে আনি

এ যুগের প্রেম কথা আমরাও শোনানু তাদের;

কহিলাম আমাদের চিত্তে তবু জাগে যে সংশয়, 

ধূলার ধরণী হতে আর্তস্বর যে প্রতিবাদের

আজও ভেসে আসে শূন্যে মানুষের বানী তাহা

সংশয়-তিমির ছেঁড়া রৌদ্রালোকে অনির্বান হাসি

শুনিলাম কণ্ঠে কণ্ঠে এক ব্বাস, তবু ভালবাসি