২০১৬র নভেম্বরের শেষ, স্টেশন থেকে জাইলোতে চেপে জোড়বাংলো হয়ে লামাহাট্টা আসতেই আকাশ জুড়ে স্লিপিং বুদ্ধ… ড্রাইভার পারু বলল আরেকটু এগিয়ে ভিউ পয়েন্ট আছে, ওখানে আপনাদের ছবি তুলে দেব। তিনচুলে পৌছলাম দুপুর একটায়,আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন গুরুং লজের কত্রী নমিতা গুরুং, গ্লাস ভর্তি গুরাসের(রডডেনড্রন ফুলের স্থানীয় নাম)ঘন লাল রঙের সরবত খাইয়ে জোর আপ্যায়ন করলেন। তিনচুলে নেহাতই ছোট একটা গ্রাম। ইদানিং টুরিস্ট আসায় অবশ্য প্রচুর বাড়িঘর হচ্ছে, আমাদের গুরুং লজ একটু ওপর দিকে, পিছনে বিশাল পাইনের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। সব মিলিয়ে চারটে মোটে ঘর,মাঝখানে একটা লাউঞ্জ মতো, সামনে সরু বারান্দা তারপর অনেকটা খোলা জায়গা। উল্টো দিকে দূরে পাহাড়ে দেখা যায় কালিম্পং শহর। এখানকার রান্নার মেয়েটি খাসা রাঁধে। তাছাড়া কপি, স্কোয়াশ, ব্রোকোলি–এসব নিজেদের বাগানেই হয়। নমিতা দাঁড়িয়ে থেকে যত্ন করে খাওয়ায়।
এখানেই গিন্নির সঙ্গে বহু বছর বাদে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল ওর গানের টিচার সুপ্রিয়া আন্টির। দুজনের সেকি উচ্ছ্বাস, সঙ্গে সঙ্গে বসে গেল গানের আসর। আন্টি সেদিন ‘স্বপন পারের ডাক শুনেছি…’ এত সুন্দর করে গেয়েছিলেন যে আজও ভুলিনি। এসব দেখে শুনে নমিতাও ভিড়ে গিয়ে দু’কলি নেপালি গান শুনিয়ে দিল। আন্টির কর্তার ছবি তোলার শখ, সারাক্ষণ দামী লেন্স লাগানো ক্যামেরা গলায় ঝোলে। ওঁরা আপাতত ঠিক করেছেন উত্তরবঙ্গটা চষে ফেলবেন। এই হোমস্টে’র মালিক নমিতার বর নগেন্দ্র গুরুং মহা ব্যস্ত লোক, সকালে হ্যালো, গুড মর্নিং বলে সেই যে জিপ চালিয়ে বেরোয় বিকেলের আগে ফেরেনা। শুনলাম হাজার রকম ব্যবসা আছে লোকটার, গোটা অঞ্চল জুড়ে বিরাট প্রতিপত্তি, নামডাক। ওরই মধ্যে একদিন পাকড়াও করলাম নগেন্দ্রকে, এমনিতে খুবই হাসিখুশি লোক,সামান্য ছেলেমানুষি ভাবও আছে। আমার মতো গাল ভরা ঘন দাড়ি হয় না বলে ভারী দুঃখ। সুপ্রিয়া আন্টিরা পরদিন সকালে চলে যাওয়ায় শুধু আমরা রইলাম। নমিতা জাঁকিয়ে বসল আড্ডা দিতে, গুচ্ছের ঘরোয়া প্রশ্ন বাড়িতে আর কে কে আছে,কতদিন বিয়ে হয়েছে,তারপর কথায় কথায় বেরিয়েই পড়ল সেদিনটা হচ্ছে আমাদের বিয়ের তারিখ। শোনামাত্র নমিতা যেরকম উচ্ছল হয়ে উঠল আমরা বেশ অবাক। ইচ্ছে ছিল গোটা সন্ধে দুজনে একটু নিজেদের মতো করে কাটাব, মাঝে দু একটা ফোন-টোন আসুক তাতে ক্ষতি নেই। এদিকে নগেন্দ্র ফিরতেই ওকে সব ফলাও করে বলা হয়ে গেল। সন্ধেবেলা সবে ঘরে গুছিয়ে বসেছি, দরজায় টোকা। দেখলাম কর্তা গিন্নি দুজনে হাজির, আমাদের টেনে নিয়ে গেল সামনের বারান্দায়, প্রথমেই গলায় সিল্কের উত্তরীয় ঝুলিয়ে দিল, দেখলাম চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে আর আপ্যায়ানের জন্য সাজানো জ্বলন্ত মোমবাতি,চানাচুর, চিপস, দুটো গ্লাস আর ঢাউস একটা হুইস্কির বোতল,ওল্ড স্মাগলার,একেবারে না খোলা অবস্থায়। আমরা সত্যি অভিভূত,বাড়ি থেকে এত দূরে এসে সম্পূর্ণ অচেনা লোকেদের কাছ থেকে এই আন্তরিকতা আশাই করিনি। হুইস্কি শুধু আমাদের জন্য আনলেন? মোটেই আনা হয়নি,নগেন্দ্রদের এসব চলেও না। কোনও এক অতিথি ওদের ভালবেসে দিয়ে গিয়েছিল, আজ আমাদের সন্মানার্থে কাজে লাগল। রীতিমত অপ্রস্তুত আমরা অথচ দুজনেই তখন নিলে ধন্য হব গোছের ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে। একটু একটু করে খেতেই হল, বিবাহবার্ষিকীতে গুরুং দম্পতির এই সুন্দর চমক উপেক্ষা করি কীভাবে?
তিনচুলে থেকে দার্জিলিং যাবার পথে একদিন তাগদায় কাটাব। এখান থেকে মাত্র চার কিলোমিটার পথ। নগেন্দ্রই ওর গাড়িতে নিয়ে গেল,রাস্তায় একবার নামতে হল ওদের বিশাল মনিহারি দোকানের সামনে। কারন সিনিয়র গুরুং সর্দার সিং- এর একটা স্কেচ করতে হবে। খবর আগেই পৌছে গেছিল। ফলে দোকানের সামনে চেয়ারে বসা সর্দার মশাইকে ঘিরে ছোটখাট একটা ভিড় জমেছে দেখলাম। যেন ম্যাজিক শো হচ্ছে এমন ভাব নিয়ে আমার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়ল সবাই তারপর আঁকা শেষ হতে চমৎকৃত হয়ে হাততালি দিয়ে উঠল। সিনিয়র গুরুং-এর অবশ্য বিশেষ হেলদোল দেখলাম না লাঠি হাতে আগের মতই নির্বিকার হয়ে বসে রইলেন।
একদা ইংরেজ সেনাদের ঘাঁটি এই তাগদায় নিজেদের জন্য সাহেবরা যেসব বাংলো বানিয়েছিলেন সেগুলো হাতবদল হয়ে এখন টুরিস্টদের থাকার জায়গা হয়ে উঠেছে। তাগদার মূল আকর্ষণ বলতে গেলে এই হেরিটেজ তকমা দেওয়া বাংলোগুলোই। আমরা এইরকম একটা বাংলোয় ঘর বুক করে এসেছি যার নাম সাই হৃদয়ম এবং আপাতত যা সঙ্গম থাপার সম্পত্তি। পাহাড়ের গায়ে সেডার গাছের জঙ্গলের মধ্যে ছড়ানো একতলা বাড়ি, টানা লম্বা বারান্দা। সামনে অনেকটা ঘাসজমি,দোলনা,ছাতার তলায় বসার ব্যাবস্থা। সঙ্গম স্কুলে পড়ায়,বাংলো দেখাশোনা করে ওর বউ ভগবতী। দুজনেই খুব লাজুক গোছের,সঙ্গমের তো পাত্তাই পাওয়া যায় না। তার মধ্যেই জানাল ১৯০৫ সালে এই বাংলোটি তৈরি করেন হারবার্ট জোসেফ ল্যাঙ্গলে যাঁর কলকাতায় বড় ব্যবসা ছিল। ১৯৫৭ সালে তিনি তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারি টিকারাম মুখিয়ার হাতে বাংলোটি তুলে দিয়ে দেশে ফিরে যান। এই টিকারামের নাতি হল সঙ্গম।
একটা গোটা দিন দিব্যি আয়েস করে কাটল, আমি ছবি আঁকলাম গিন্নি খানিক দোলনায় দুলল তারপর নিচে বাজারে গিয়ে প্যাকেট ভর্তি করে এই অঞ্চলের বিখ্যাত ঝাল লঙ্কা ‘দল্লে খুরসানি’ কিনে আনল। দুপুরে তিন রকম সবজি আর পর্কের ঝোল দিয়ে খাওয়া সেরে একটু এদিক ওদিক করতে বেরোলাম। কাছাকাছির মধ্যে আরও গোটাকয়েক হেরিটেজ বাংলো দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল, অনেক বছর আগে ল্যান্সডাউন পাহাড়ে গিয়ে দেখেছিলাম এই ধরনের বেশ কিছু সাহেবি বাংলো। তবে এখন আমাদের সেনাবাহিনির দখলে চলে যাওয়ায় গেটের বাইরে থেকেই উঁকিঝুঁকি মারতে হয়। তাগদায় অবশ্য সে সমস্যা নেই,ভেতরে ঢুকে খোঁজখবর নিলে সবাই খুশিই হয়,যতোই হোক হোমস্টে’র ব্যবসা চালাচ্ছে কিনা! এখানে হাল আমলে তৈরি একটা গুম্ফাও রয়েছে নিয়মমাফিক ঘুরে দেখলাম,ত্রিসীমানায় কাউকে চোখে পড়লানা। ফিরে এসে বাকি দিনটা নিজেদের বাংলোতে বেশ হাত পা ছড়িয়ে বসে উপভোগ করলাম চারপাশে পাহাড়ের দৃশ্য। তাগদার পাট চুকিয়ে পরের দিন আবার সেই দার্জিলিং। যাবার জন্য এখান থেকে শেয়ার জিপ পাওয়া যায়। সঙ্গম আগে থাকতেই দুটো ভালো বসার জায়গা আমাদের জন্য বুক করে রেখেছে।