রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ (পর্ব- ৯, ১০)

পর্ব-৯

দ্বারকানাথের কৃতজ্ঞতা

দ্বারকানাথের চরিত্রে বহু গুণের সমাবেশ ঘটেছিল-পরোপকারিতা, অনন্য সাধারণ ঔদার্য,বদান্যতা,বিশ্বাস করার প্রবণতা। এই সমস্ত গুণাবলীর পাশাপাশি দ্বারকানাথের আরেকটা বিশেষ গুণ তাঁর চরিত্রকে মহিমান্বিত করেছিল- তা হল উপকারীর উপকার মনে রাখা এবং যথাসময়ে তাকে সাহায্য করা। দ্বারকানাথ কৃতজ্ঞ ছিলেন; কৃতঘ্ন ছিলেন না। তাঁর এই স্বভাব বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। দ্বারকানাথ তখন পিতৃহীন। তাঁর পৈতৃক জমিদারিতে কর্মচারীর অত্যাচার- উৎপীড়নে প্রজাবিদ্রোহ শুরু হয়। ফলস্বরূপ দুটো খুন হয় এবং দ্বারকানাথের নামে খুনের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। যে ম্যাজিস্ট্রেট পরোয়ানা জারি করেন, তিনি কলকাতায় এলে দ্বারকানাথ সুকৌশলে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। দ্বারকানাথের সঙ্গে কথা বলে ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতে পারেন যে দ্বারকানাথ নিরপরাধ। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কীভাবে মোকদ্দমা চালাতে হবে তার উপদেশ দেন। ম্যাজিস্ট্রেটের উপদেশ অনুসারে দ্বারকানাথ মোকদ্দমায় লড়ে জয়লাভ করেন। শুধু তাই নয়,ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব দ্বারকানাথের জমিদারির বিদ্রোহী প্রজাদমনের ব্যবস্থা করেন। এবার ম্যাজিস্ট্রেটের পালা। এই ঘটনার কিছুদিন পর ম্যাজিস্ট্রেট অতিশয় ঋণভারে জড়িয়ে পড়েন। তিনি কলকাতায় এলে দ্বারকানাথ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারকানাথকে ঋণের টাকা জোগাড় করে দিতে বলেন। দ্বারকানাথ তখন নিজে এই টাকা দিতে পারেন এমন অবস্থাপন্ন ছিলেন না, তা সত্ত্বেও কৃতজ্ঞতাবশত দ্বারকানাথ টাকা সংগ্রহের ভার নিলেন। রাজা সুখময় রায়ের বংশধর রাজা শিবচন্দ্র রায় ছিলেন দ্বারকানাথের পিতৃবন্ধু। শিবচন্দ্র রায়কে দ্বারকানাথ বিষয়টা জানালেন। শিবচন্দ্র উদার হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। বন্ধুপুত্রের উপকারের জন্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে দ্বারকানাথকে ২৫ হাজার টাকা দিলেন। এভাবে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের প্রতি দ্বারকানাথ কৃতজ্ঞতাবশত তাঁকে ঋণ থেকে মুক্ত করলেন। কিন্তু তিনি আবার কৃতজ্ঞতার জালে জড়িয়ে পড়লেন।এই ঘটনার পর দ্বারকানাথ চিরদিন রাজা শিবচন্দ্র ও তাঁর পুত্রদের বৈষয়িক প্রয়োজনে যখন সাহায্যের প্রয়োজন হত, তখন তা অম্লানবদনে অকাতরে সম্পাদন করতেন।   

পর্ব-১০

পশ্চিমভ্রমণে ডোয়ার্কি

সমসাময়িক পত্রিকার খবর অনুযায়ী দ্বারকানাথ-১৮৩৫, ১৮৩৮, ১৮৪১ ও ১৮৪৩- এই চারবার পশ্চিমভারতে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এই চারবার ভ্রমণের মধ্যে তিনি যে বছর আগ্রা যান না কেন, তাঁর শৈল্পিক চোখ মোঘল সাম্রাজ্যের সৌন্দর্য ও মহিমা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তাজমহল দেখে তাঁর মনে হয়েছিল তাজমহল হল ‘স্থাপত্য- শিল্পের কোহিনূর।’ আগ্রা- ফোর্ট দেখতে যাবার সময় ‘দরবারী পোশাকে সুসজ্জিত এই সম্ভ্রান্ত ভারতীয়’ দ্বারকানাথকে দেখে ব্রিটিশ সৈন্যদল বিস্মিত হয়েছিল। দ্বারকানাথের আগ্রা ভ্রমণ প্রসঙ্গে ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গল্প লিখেছেন।গল্পটি এরকম: দ্বারকানাথ আগ্রায় পৌঁছে সেখানকার ডেপুটি গর্ভনর টমসন সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। দুর্গ পরিক্রমাকালে  প্রহরীদের চমক লাগিয়ে দ্বারকানাথ গটগট করে ঢুকে পড়েছিলেন খোদ ডেপুটি টমসনের খাস-কামরায়। প্রহরীরা কালাআদমিকে এরকমভাবে ঢুকতে দেখে আটকাতে গিয়ে পথ আটকায়নি। দ্বারকানাথ প্রহরীদের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন টমসন সাহেবের দিকে। টমসন সাহেব তখন দরজার দিকে পিঠ করে টেবিলে বসে মেলের চিঠি লিখছিলেন। সেখানে গিয়ে পিছন থেকে কাতুকুতু। বেচারী তো চমকে উঠলেন- এরকম আস্পর্ধা কার হতে পারে। তারপর ফিরে “ও হো,ডর্কি” বলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে অভ্যর্থনা জানালেন। তখন লাট-বেলাট সরকারের সেক্রেটারি বা ঐরকম বড়সাহেবরাই একমাত্র দ্বারকানাথ কে ‘ডর্কি’ বলে ডাকতেন। শাস্ত্রীর দল তো ব্যাপার দেখে অবাক। কেবলমাত্র শাস্ত্রীর দল নয়,পরাধীন  ভারতের প্রিন্সের এমন কান্ড-কারখানা দেখে আমরাও বিস্ময়ে হতবাক।

 


“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১ এবং পর্ব ২ পড়তে হলে ক্লিক করুন
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৩ এবং পর্ব ৪ পড়তে হলে ক্লিক করুন
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৫ এবং পর্ব ৬ পড়তে হলে ক্লিক করুন
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৭ এবং পর্ব ৮ পড়তে হলে ক্লিক করুন