সব বাঙালির না হলেও, অধিকাংশ বাঙালির সবচেয়ে বড় পার্বণ নিশ্চয়ই দুর্গাপুজো। কী করি আমরা এই পার্বণ উপলক্ষে? মূলত খাই। আর নতুন নতুন জামাকাপড় পরে ঠাকুর দেখি, ভাল ভাষায় প্রতিমা দর্শন করি, অঞ্জলি দিই। আজকাল থিম পুজোর কল্যাণে এই ক’দিন সমস্ত বাঙালিই ইতিহাস ও কলাবোদ্ধা হয়ে ওঠে। ফুচকা আর হ্যামবার্গার খেতে খেতে বোরোবুদুরের ভাস্কর্য, মায়া সভ্যতার পাথুরে কেরামতি, রাজস্থান কিংবা হনলুলুর সংস্কৃতির সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা চলে। অত্যন্ত সু-বিপণিত এই সমস্ত ব্যাপারটার ফায়দা তোলেন জনাকতক দূরদর্শী ব্যবসায়ী। তা তুলুন। ব্যবসায়ীর কাজ ব্যবসায়ী করবে, কামড় দেবে পকেটে, তাতে আর আশ্চর্য কী? তাছাড়া ওটার ওপরতো আমাদের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন একটাই: কী অর্থে এটা সর্বজনীন সামাজিক উৎসব?
এর কিছুটা উত্তর মিলবে শ-দেড়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গীয় গ্রামের দুর্গাপুজোর চেহারাটা কেমন ছিল সেটা জানলে। সেটা জানা যাবে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির কাছে। তার আগে একটু জেনে নিতে হবে, কে ছিলেন পরীক্ষা-পাশের ‘জিকে’ বইতে ঠাঁই না-পাওয়া এই যোগেশচন্দ্র?
বাংলায় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও ভূগোলের পাঠ্যবই ছাড়াও তিনি পুরাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব বহু বিষয়ে প্রচুর লিখেছেন এবং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও আগে বাংলা শব্দকোষ রচনা করেছিলেন। মুদ্রণের সুবিধার জন্য বাংলা হরফকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অসাধারণ এক ইতিহাস লিখেছিলেন।
বহুশাস্ত্রজ্ঞ যোগেশচন্দ্র
আরামবাগের কাছে দিঘড়া গ্রামে এক সম্পন্ন মধ্যবিত্ত হিন্দু কায়স্থ ঘরে যোগেশচন্দ্র রায়ের (১৮৫৯-১৯৫৩) জন্ম। ইস্কুলের পড়াশোনা বর্ধমান রাজ কলেজে। হুগলি মহসিন কলেজ থেকে ১৮৮২ সালে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে বিএ এবং তখনকার নিয়ম অনুসারে ১৮৮৩ সালে বটানিতে অনার্স নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ। ১৮৮৩ সালে সরকারি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান। ক্যালকাটা মাদ্রাসা কলেজে বিজ্ঞান পড়ান ও কটকের রাভেনশ কলেজে বিজ্ঞানের প্রফেসর হন। প্রধানত উদ্ভিদবিদ্যা পড়ালেও রসায়ন ও পদার্থবিদ্যাও পড়িয়েছেন। বাংলায় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও ভূগোলের পাঠ্যবই ছাড়াও তিনি পুরাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব বহু বিষয়ে প্রচুর লিখেছেন এবং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও আগে বাংলা শব্দকোষ রচনা করেছিলেন। মুদ্রণের সুবিধার জন্য বাংলা হরফকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অসাধারণ এক ইতিহাস লিখেছিলেন। ইংরেজি না-জানা প্রাচীনপন্থী ওড়িয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সামন্তর নিজের হাতে বানানো বাঁশের যন্ত্রপাতির সাহায্যে গৃহীত আকাশ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আধুনিক পর্যবেক্ষণ কীভাবে এবং কতটা মিলে যায়, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে জগৎসভায় তাঁর কৃতিত্ব প্রচার করেছিলেন যোগেশচন্দ্র। ক্লাসঘর কিংবা ল্যাবরেটরির বাইরে, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের সুবিধার জন্য খুব সস্তায় কার্যকর নলকূপ বা ‘ঢেঁকি পাম্প’ বানানো (যে কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন রাজশেখর বসু) কিংবা ইঁদারা থেকে জল তোলবার জন্য ‘পবনচক্র’ বা উইন্ডমিল বানানো, ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর মনের বাস্তবমুখী গড়নটা বোঝা যায়। গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় বুজরুকির বিরুদ্ধে, অসাধু পাণ্ডা-পুরুতদের মুখোশ খুলে দেওয়ার কাজে তাঁর তৎপরতার মজাদার সব কাহিনি পাওয়া যায় তাঁর আত্মচরিতে।
রায়বাড়ির দুর্গাপুজো
আত্মচরিতে যোগেশচন্দ্র ১৮৭০-এর দশকে তাঁর গ্রামের বাড়ির দুর্গাপুজোর যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তা যেমন উপভোগ্য তেমনই শিক্ষাপ্রদ। শ্রেণি এবং জাতপাতের যাবতীয় বৈষম্য বজায় রেখেই, এমনকী তারই সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে দুর্গাপুজো যে তখন প্রকৃত অর্থেই একটা সর্বজনীন সামাজিক উৎসব ছিল, গ্রামের সকল স্তরের মানুষের, এমনকী অন্ত্যজদেরও স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের মধ্য দিয়েই তা যে সার্থক হয়ে উঠত, সেই কথাটা যোগেশচন্দ্র খুব স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং স্পষ্ট করে বলেছেন। তিনি ১৯৫৩ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। দীর্ঘ জীবনলাভের দৌলতে শহুরে বারোয়ারি সর্বজনীন দুর্গাপুজো তিনি দেখে গেছেন, যদিও স্পনসরিত দুর্গাপুজো যতদিনে চালু হয়েছে, ততদিনে তিনি প্রয়াত। তবু, একটা স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক উৎসব আর একটা তৈরি-করা ফূর্তির তফাতটা কোথায়, তার চমৎকার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর লেখা থেকে।
‘প্রতিমাদর্শন’’, অর্থাৎ লাইন দিয়ে এলাম, ঠাকুর দেখলাম, ঢোকলা খেতে চলে গেলাম, এই ব্যাপারটাকে ব্যঙ্গোক্তি মনে হয়েছিল যোগেশচন্দ্রের। গাঁয়ের সবাই জানত, পুজোটা ‘রায়েদের’, কিন্তু ঠাকুর তাদের সকলের। ‘অঞ্জলি’ তারা দিত না, ঠাকুরকে প্রণাম করত। আর এ গাঁ থেকে সে-গাঁ ঘুরে ঘুরে ‘প্যান্ডেল-হপিং’ করত না, করবার সুযোগও ছিল না।
ব্যাপারটা আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে অন্য অনেক বিষয়ের মতো পুজোপার্বণের ইতিহাস বিষয়েও তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। তাঁর পূজা-পার্বণ (১৯৫১) আজও এ বিষয়ে মান্য বই। সে-বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন:
আমাদের পূজা-পার্বণ অসংখ্য বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। স্থানভেদে পার্বণেরও ভেদ আছে। পশ্চিমবঙ্গের কতকগুলি পার্বণ পূর্ববঙ্গে নাই, পূর্ববঙ্গের কতকগুলি পশ্চিমবঙ্গে নাই। পূজা-পার্বণের উৎপত্তি ও প্রকৃতি না জানিলে কথা মাত্র হয়, ইতবৃত্ত হয় না। আমি এই পুস্তকে কতকগুলি প্রসিদ্ধ পূজা-পার্বণের উৎপত্তি ও প্রকৃতি বর্ণনা করিয়াছি। ইহা হইতে পূজা-পার্বণের প্রয়োজনও স্পষ্ট হইবে…।
তাঁর মতে ‘দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের তান্ত্রিক রূপ।… দুই ধারা মিশে এক নূতন ধারা হয়েছে।বাঙ্গালী এক নূতন ধারা মিশিয়েছে। পূজা শব্দের অর্থ, ভোজ্য ও বস্ত্রাদি দ্বারা আদরণীয় ব্যক্তির সন্তোষ বিধান।’
‘মধ্যবিত্ত গৃহস্থ’— এইভাবে তিনি গ্রামীণ সমাজকাঠামোয় নিজ পরিবারের স্থান নির্দেশ করেছেন। তাঁর নিজের কথায়, আমাদের ষাট বিঘা চাষ ছিল। কেবল ধান নয়, কলাই, হলুদ, শন, যব, তিল, আখ, কাপাস চাষ ছিল… ঘরে তুলা-ফোড়া ধনুক চরকা ছিল, বিধবারা সন্ধ্যার পর সূতা কাটতেন। বোধহয় মায়েরও একটা ছিল।
হিন্দু মধ্যবিত্ত গৃহস্থদের বৈশিষ্ট্য:
১) বাস্তুভিটা নিষ্কর হবে, কিছু নিষ্কর ভূমি সংলগ্ন থাকবে।
২) সন্নিকটে স্নান, পান ও মাছের জন্য পুষ্করিণী থাকবে।
৩) ফলের বাগান থাকবে, অন্তত গোটাকয়েক আমগাছ থাকবে।
৪) বাড়িতে নিত্যপুজো হবে, শালগ্রাম শিলা থাকবে।
৫) শাক্ত হলে দুর্গোৎসব হবে, বৈষ্ণব হলে শ্রীকৃষ্ণের রাস ও দোলোৎসব হবে।
প্রথম চারটি চাই-ই চাই।
এবার আসা যাক রায়বাড়ির দুর্গাপুজোর বর্ণনায়। প্রথমেই তিনি তখনকার কলকাতার পুজো আর তাঁর ছোটবেলার (১৮৭০-এর দশকের) পুজোর মূল ব্যবহারিক তফাতটা স্পষ্ট করে দেন:
কলিকাতা শহরে যখন যা ইচ্ছা, তখন তাই কিনতে পাওয়া যায়… কিন্তু সেটা উৎসব নয়, রেলগাড়ীতে তীর্থভ্রমণ। গ্রামের লক্ষণ এই, সেখানে প্রত্যেক উপকরণ খুঁজতে হবে, যোগাড় করতে হবে।
আর সেই জোগাড় করতে গিয়েই গ্রামসুদ্ধ সক্কলের যোগদান আবশ্যিক হয়ে পড়ে। ‘পুজোর একমাস পূর্বে কর্তা ফর্দ বার করতেন, এত খইয়ের ধান, এত মুড়ির চাল, এত আলোচাল, এত সিদ্ধচাল, এত সরুচাল চাই।‘ এরপর চাই জ্বালানি:
পুকুর পাড়ের তেঁতুল গাছ, বাবলা গাছ কাটতে ও চেলাতে মুনিষ লেগে গেছে। দিনকয়েক চেলিয়ে কর্তাকে দেখালে, এই কাঠে কুলোবে? কর্তা হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় গয়লা এসে হাজির, দই বসাতে কাঠ চাই, এখনই দেওয়া হক। সে গোয়াল ঘরের মাচায় তুলে রেখে যাবে…। গিন্নী এসে বললেন, ‘খই মুড়ি ভাজবার কাঠ কই?…’
তখন আবার চলল আর এক প্রস্থ কাঠ কাটা। কেননা, ‘মুড়ি খই অনেক চাই, যে আসবে তাকেই এক সরা মুড়ি, এক সরা মুড়কি, গোটা চারি নারিকেল নাড়ু দিতে হবে। যাত্রার দলকেই কত চাই। …ও পাড়ার অখিলের বউকে, সে পাড়ার তিনুর মাকে ডাকতে হবে, তারা মুড়ি ভাজে ভাল। … (এখানে বেতনের প্রশ্ন উঠত না)।‘
এরপর বলির পাঁঠা:
এই সময়েই কিনতে হবে, পরে দাম চড়ে যাবে। পশ্চিমের কারা ছাগলের পাল নিয়ে এসেছে, অনেক ছাগলের মুখে ঘা, বেছে বেছে নিতে হবে, পূজার পাঁঠায় খুঁত চলবে না। সন্ধিপূজার কাল পাঁঠা সহজে পাওয়া যায় না। একজন বললে, ‘অমুকের একটা আছে, এখনই বলে রাখা ভাল।’
এইবার প্রতিমা। চিন্তামণি সূত্রধর ‘আগে একমেট্যে করে গেছে। খড়ের পুতুল, বেঁট্যে দোড়ী দিয়ে টান করে বেঁধে মাটি ধরিয়ে দিয়ে গেছে। …এখন দু-মেট্যে করতে এসেছে। এখন মাটিতে পাট মিশাতে হবে। তখন গাঁয়ে পাট চাষ ছিল না, হাট হতে কিনে রাখতে হত। … দু-মেট্যে করতে দু-তিনদিন লাগত।’ চিন্তামণি অন্দরমহলের সবাইকে চিনত। ‘খুড়ী, নাইবার তেল দাও’, ‘খুড়ী জলপান দাও’, ‘খুড়ী, ঘর যাচ্ছি, সিধা দাও।’ …এতদিন ‘মাথা ছিল না। চিন্তামণি ঘর হতে মুণ্ড গড়ে এনেছে, বলে ছাঁচে গড়েছে।’
এরপর বাসনকোসন। তার দায়িত্ব ‘কুমর-বউ’য়ের ওপর:
দু-বাজরা (বাজারের বোঝা লইবার বৃহৎ ‘বংশপাত্র’) হাঁড়ী-কুঁড়ী, দু-বোনপোর মাথা হতে বাইরে ঠাকুর দালানে নামানো হচ্ছে। … ঘেমে গেছে, মাথার কাপড়ে বিড়া খুলে বাতাস করছে, এক ছিলিম তামুকের ব্যবস্থা দেখছে। …কুমর বউ হাঁড়ী, কলশী, খাপরি, ঘট সব বাজিয়ে বাজিয়ে আলাদা করছে, ঝিযাড়ীরা রোদের ফুটো দেখছে।‘
‘ডোমনি’ এসে খিড়কী দুয়ারে বাসন এনে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে ‘হাড়ীনি’ এনেছে অজস্র খেজুর-চাটাই। তা ছাড়া এলা মাটির মেঝে ঝাঁট দেবার উপযোগী ‘খেজুড়-ঝাঁটা’। কানুর মা ‘গোবরে মাটি মিশিয়ে মাঝে লাতা দিয়ে’ মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে। নীচে মুনিষ লেগেছে, ‘উঠানের ঘাস ছুলছে।’
সবই তো হল, এবার পুরুত: ‘আজ মহালয়ার শ্রাদ্ধ, ভটচাজ্জি নিজে এসেছেন। শ্রাদ্ধ শেষ হতে আড়াই প্রহর হয়ে গেল। তিনি বাতাসা খেয়ে জল খেলেন। কাল… তিনি খুব সকালে আসবেন।’ লক্ষণীয়, যোগেশচন্দ্র ‘তর্পণ’ কথাটা ব্যবহার না-করে সরাসরি ‘শ্রাদ্ধ’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। তারপর একদিন দ্বারকেশ্বর নদীর ঘাটে রায়েদের পূজার ঘট উঠছে। নিকটের কত ছেলে দৌড়ে এল, ঘাট পর্যন্ত যাবে। এক স্বজাতি ঘট ও আম্রশাখা নিয়ে চলল, কেহ ঝারী নিয়ে চলল, ঘটের আগে আগে পথে জলের ধারা দিতে দিতে আসবে। ভটচাজ্জি মশায়ের উত্তরীয় পইতার আকারে বাম স্কন্ধ হতে লম্বিত, দক্ষিণ-স্কন্ধে গামছা। তিনি জলে নামলেন, জল ঢেইয়ে (ঢেউ তুলে) ঘট ধুলেন, আবার ঢেইয়ে ঘট পূর্ণ করলেন, আম্রশাখা আচ্ছাদন করলেন। কি করলেন, তিনিই জানেন, সে ঘট আমাদের ছুঁবার জো নেই। কারণ পূজা রায়বাড়ির হলেও রায়েরা কায়স্থ।
এইভাবে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো ধাপে ধাপে সাজিয়ে দুর্গাপুজোর আয়োজন ও অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়েছেন যোগেশচন্দ্র। তার প্রতিটি অনুপুঙ্খই উদ্ধৃত হবার যোগ্য। কিন্তু অবকাশ ও পরিসরের অভাব-হেতু এখানে কতকগুলি অতি-কৌতূহলজনক চিত্রর অবতারণা করে ক্ষান্ত হব।
জেলেরা মাছ তুলল। তারা ‘মাছ চুরি করে, কোমরে কাপড় জড়িয়ে রাখে, দু’সেরী মাছও লুকিয়ে রাখে।’ তাদের ওপর নজর রাখার কাজ ছোটদের। এরপর মাছ কোটার পালা। কাটবে ‘দুল্যে বউ’। সে এমনিতে ভাল লোক, ‘তবে মাছের লোভ সামলাতে পারে না।’ তাকে পাহারা দেয় ‘ছোট ছোট মেয়ে’। উৎসবে সবারই কিছু না কিছু ভূমিকা আছে।
এরপর রান্নাবান্নার পালা। ‘বড়বউও জানেন না বাইরের কত লোক কত খাবে।’ কুটুমবাড়ি থেকে নাপিত পুজোর তত্ত্ব এনেছে। তত্ত্ব অন্দরে গেল, ‘সদর ভাঁড়ারি নাপিতকে খুরিতে মাখবার তেল দিলেন, চানের পর ঠাকুরদালানের বারান্দায় সাল-পাতে জলপান দিলেন।’
পঞ্চমীর দিন ‘যে মুড়কি করতে জানে, সে এসেছে, গুড়ের পাক সকলে জানে না। … কিছু মোয়াও হবে।’ তারপর চিন্তামণি এল ‘প্রতিমায় রঙ দিতে। … ডাক সাজ লাগাতে মালাকার কাল সকালে আসবে।’ ষষ্ঠীর দিন নাপিত যেত, পাড়ায় পাড়ায় বলে আসতে। কিন্তু ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণের ভার নিতেন পুরুত। পুজোর নিমন্ত্রণ আর যাত্রা শুনবার নিমন্ত্রণ, দুই বলতে হতো। উৎসবের একটা বড় অঙ্গ যাত্রা–
যাত্রা-সম্প্রদায় সপ্তমীর দিন দু’পর বেলা আসত। দক্ষিণ পাড়ায় কারও ঘরে বাসা দেওয়া হত। সেই লোকটি তাদের খাওয়া, বসা, শোওয়া দেখতেন। বাইরের ভাঁড়ারী সম্প্রদায়ে কতজন জিজ্ঞাসা করতেন। সেই মত সিধা, হাঁড়ী, কাঠ, পাতা, জলখাবার, তেল, পান, তামাক, আসন দিতেন। এদিকে (এদের)লুচি মণ্ডা খাওয়াতে হত না। মুড়ি, মুড়কি, লাড়ু, পান, তামাক খেয়ে গান করতে আসত।… যখন যাত্রা আরম্ভ হত, দক্ষিণ থেকে পশ্চিম দিকে, উত্তর দিকে ঢাকী ঢাক পিটত। … কলিকা এসেছে, তামুক করা আছে, মালসায় আগুন আছে,জাতি দেখে দেখে নূতন হুকা দেওয়া হয়েছে, দু’তিনজন চাকর সারারাত্রি তামুক সেজেসেজে হয়রান হয়ে যেত। হিঙ্গলী তামাক ঘরে কোটা, গন্ধটা মন্দ নয়।
যাত্রা হল, এবার বাজনা। ঢাক বাজাবার জন্য চাই মুচী। মুচী ছাড়া মরা পশুর চামড়া নিয়ে কে-ই বা কাজ করবে। আর চামড়া ছাড়া ঢাক তৈরি হবে কী করে? কিন্তু ‘আমাদের গাঁয়ে মুচী নাই। পাশের গাঁয়ে আন্দে (আনন্দ) ঢাক বাজাত। দুই ঢাকী; এক কাঁসী, ভোর হতে না হতে চণ্ডীমণ্ডপের অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাতে লাগল।’ ঢাক হল, এবার ঢোল। পাশের গাঁয়ের লক্ষ্মীপুর থেকে আসছে ডোম, সে ঢোল বাজায়, রোশন চৌকি বাজায়:
ষষ্ঠীর দিন বিকেলবেলা ঢুলী আসত। গাঁয়ের পাশে ঘর। পাঁচজন বাঁধা ছিল, ষষ্ঠীর দিন আসতেই হবে। …দলটি রসোন-চৌকি বাজাত, চমৎকার বাজাত, সানাইর নাম ভুলে গেছি। … সানাই ভৈরবী বাজাত, কি মধুর লাগত। বাপ, পিতামহ হতে পরপর শিখেছে। বাঁশী, আড়বাঁশী বাজাত, সেতারে হাত কি মিষ্টি ছিল।
যোগেশচন্দ্র লেখেননি, কিন্তু আমাদের মনে না-হয়ে পারে না, সরস্বতীর এই শ্রমজীবী বরপুত্ররা, সেতার-সানাই-ঢাক-ঢোলে ওস্তাদ এইসব মুচী, ঢুলীরা, কিন্তু হিন্দু সমাজকাঠামোয় বীণানিন্দিতহস্ত সরস্বতীর পুজো করার অধিকার থেকে বঞ্চিত, অন্ত্যজ।
যোগেশচন্দ্র কথিত এই উৎসব, যাতে কদিনের জন্য শ্রেণি আর জাতপাত নির্বিশেষে সব শ্রমজীবী মানুষ সানন্দে যোগ দিত, কিন্তু যাতে সেতার-সানাই-ঢাকঢোলের আনন্দধ্বনিতে শ্রেণি আর জাতপাতের বৈষম্য চাপা পড়ত না, সে-উৎসবকে উচ্চচাপে ফুঁসতে থাকা প্রেসার কুকারের বাষ্প বার করে দেওয়ার ‘ভেন্ট’ (নির্গম-রন্ধ্র) বলা যেতে পারে। মানবিক নিয়মে জমে-ওঠা খেদ-বাষ্পর চাপকে কখনও বিস্ফোরণ-মাত্রায় পৌঁছতে দেওয়া হয় না।
বিসর্জন
পুজোর অন্তে দশমী। স্পনসরিত পুজোর সঙ্গে আসল পুজোর সবচেয়ে বড় তফাতটা বোধহয় এই জায়গাতেই। মাইক বাজিয়ে কান ফাটানো, টিভি ক্যামেরার দিকে লক্ষ্য রেখে সিঁদুর খেলার আদিখ্যেতা, পুরস্কার জেতবার বাসনায় সুপ্রশস্ত কোমরে আঁচল বেঁধে কোমর দুলিয়ে গৃহবধূদের নকল ধুনুচি-নৃত্য, রঙ কোম্পানির নির্বাচিত ভাড়াটে বিশেষজ্ঞদের বিচারে ‘শ্রেষ্ঠত্বে’র পুরস্কার পেলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের কাপ জেতার কায়দায় ধেই-নৃত্য, হিপ হিপ হুররে বলা, এমনকী রসুই ঘরে কী ভোগ রাঁধা হচ্ছে তার সানুপুঙ্খ ছবি টিভিতে প্রচার করা, এসবের কোনও স্থান ছিল না সেদিন:
দুর্গা, উমা, তিনদিন বাপের বাড়ি আসেন, মায়ের আদর পান, সপ্তমীর দিন মেয়ের হাসি হাসি মুখ, যে দেখে সে ভুলে যায় মেলানির (শেষ মিলনের) মুখ, যে দেখে সেই কাঁদে। …গিন্নী (মা) বরণ করতেন, তাঁর চোখ ছলছল করত। সত্য সত্য তাঁর কন্যা তিনদিনের জন্যে এসেছিলেন। এখন কৈলাশে শ্বশুরালয়ে চলে যাবেন। মা বলতেন, আবার এস, অবার এস।
প্রতিপদ থেকে শুরু করে বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রলম্বিত এই উৎসবে খরচ পড়ত কত? ‘বোধ হয় নগদ তিনশ’ টাকা। এই তথ্য জানাবার পরই তাঁর টিপ্পনী:
কিন্তু টাকা গণে উৎসব নয়। যে আনন্দের সহিত খাটনির অন্ত নাই, সেটাই উৎসব। হায় এখন (১৯৪০-এর দশকের?) উৎসবের ‘উ’ নাই, পূজাটি নিয়মরক্ষা হয়েছে।
যোগেশচন্দ্রর একটি অন্তর্দৃষ্টিময় মন্তব্য থেকে ফূর্তির পুজো আর পুজোকেন্দ্রিক সর্বজনীন সামাজিক উৎসবের প্রভেদটা স্পষ্ট হয়ে যায়:
গ্রামস্থ লোককে পূজার নিমন্ত্রণ। পুষ্পাঞ্জলীর নয়, প্রতিমা দর্শনেরও নয়। কেহ পুষ্পাঞ্জলী দিতেও আসত না। কেন আসবে? পূজা রায়েদের, তাদের নয়। প্রতিমাদর্শন, এই ব্যঙ্গোক্তি কোনোদিন শুনিনি। পূজার নিমন্ত্রণ, পূজা উৎসবে নিমন্ত্রণ। সকলেই ঠাকুর প্রণাম করতে আসত, ঠাকুর কেবল রায়েদের নয়, তাদেরও।
এইখানেই মজাটা। ‘প্রতিমাদর্শন’’, অর্থাৎ লাইন দিয়ে এলাম, ঠাকুর দেখলাম, ঢোকলা খেতে চলে গেলাম, এই ব্যাপারটাকে ব্যঙ্গোক্তি মনে হয়েছিল যোগেশচন্দ্রের। গাঁয়ের সবাই জানত, পুজোটা ‘রায়েদের’, কিন্তু ঠাকুর তাদের সকলের। ‘অঞ্জলি’ তারা দিত না, ঠাকুরকে প্রণাম করত। আর এ গাঁ থেকে সে-গাঁ ঘুরে ঘুরে ‘প্যান্ডেল-হপিং’ করত না, করবার সুযোগও ছিল না। পুজোর আয়োজক একটি সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবার, কিন্তু সে-পুজোয় যোগ দিচ্ছে গোটা কমিউনিটি, তার জাতপাতের যাবতীয় ভেদাভেদ বজায় রেখেই–
পূজার তিন চারিদিন কারও কোন কাজ নাই, উৎসব ছাড়বে কেন? এখন সকলকেই ডাকা হয়েছে, তারা না এলে পূজা করবে কে? পূজা ভণ্ডুল করলে কার পাপ হবে? বেতন নিয়ে এমন লোক পাওয়া যায় না। ডেকরেটর, ইলেকট্রিশিয়ান আর ভাড়াটে পুরুত দিয়ে ফূর্তির অনুষ্ঠান হয়, উৎসব হয় না।
উপসংহার
বর্ণাশ্রমের ভিত্তিতে জাতপাতের আপাত-অভঙ্গুর কাঠামো নির্মাণ হিন্দু সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের অমর কীর্তি। ভূদেব মুখোপাধ্যায় থেকে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত অনেকেই হিন্দুদের এই সাফল্যে আপ্লুত। ওরই জোরে নাকি হিন্দুধর্ম এত ঝড়ঝাপটা সয়ে, এত উত্থানপতনের মধ্যে আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এই অনন্য সিস্টেমটা কী আশ্চর্যজনকভাবে ক্রিয়া করে তার পরিচয় পাই যোগেশচন্দ্রর বিবরণে। চামার, হাড়ী, ডোম, জেলে, দুলে প্রমুখ ‘নিম্ন’জাতির লোকেরা, নাপিতরা, মুনিষরা চাকররা পুরুষানুক্রমেই এই সিস্টেমের হাতে লাঞ্ছিত, কিন্তু তা নিয়ে তাদের কোনও হেলদোল নেই। উৎসবে তাদের ভূমিকা খুব সুনির্দিষ্ট। তারা সেতার-সানাই-ঢাক-ঢোল-বাঁশী বাজাবে, কাঠ কেটে দেবে, তামাক সেজে দেবে, জোগাবে বিনোদন, কিন্তু এক পঙক্তিতে বসে খেতে পাবে না,পাবার আশাও করে না। যাত্রার শিল্পীদের জাত বিচার করে করে হুঁকো দেওয়া হবে। এমনকী যাদের বাড়ির পুজো, তারা নিজেরাও, কায়স্থ বলে, পুজোর ঘট ছুঁতে পারবে না। পরতে পরতে বৈষম্য আর শোষণের নাটবল্টু-আঁটা এই কাঠামোটা কিন্তু মসৃণভাবে ক্রিয়া করে, কোথাও জোরজুলুমের চিহ্ন নেই। ডোমরা কিংবা মুচিরা কখনও বলবে না, আগে আমাদের মানুষের মর্যাদা দাও, তবে আমরা ঢাক-ঢোল-সেতার-সানাই বাজিয়ে তোমাদের বিনোদন জোগাব। বরং তারা নিজেরাই বিশ্বাস করে, তারা অধঃপতিত নীচ। এই অবস্থায় যোগেশচন্দ্র কথিত এই উৎসব, যাতে কদিনের জন্য শ্রেণি আর জাতপাত নির্বিশেষে সব শ্রমজীবী মানুষ সানন্দে যোগ দিত, কিন্তু যাতে সেতার-সানাই-ঢাকঢোলের আনন্দধ্বনিতে শ্রেণি আর জাতপাতের বৈষম্য চাপা পড়ত না, সে-উৎসবকে উচ্চচাপে ফুঁসতে থাকা প্রেসার কুকারের বাষ্প বার করে দেওয়ার ‘ভেন্ট’ (নির্গম-রন্ধ্র) বলা যেতে পারে। মানবিক নিয়মে জমে-ওঠা খেদ-বাষ্পর চাপকে কখনও বিস্ফোরণ-মাত্রায় পৌঁছতে দেওয়া হয় না। সামন্ততান্ত্রিক হিন্দু সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক আশ্চর্য রকমের সফল উদ্ভাবন এই দুর্গোৎসব।
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা ১৪২৬
বানান অপরিবর্তিত রেখে লেখাটি পুর্ণমুদ্রিত হল