পুরাকাহিনিতে বাসন্তী পূজার উল্লেখ আছে৷ চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের বাসন্তী পুজোই বাঙালির আদি দুর্গাপুজো৷ পুরাণ অনুযায়ী, সমাধি নামক বৈশ্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজা সুরথ বসন্তকালে ঋষি মেধসের আশ্রমে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন৷ যা পরে বাসন্তী পূজা নামে প্রসিদ্ধ হয়৷ দেবী দুর্গার প্রথম পুজারী হিসাবে চণ্ডীতে রাজা সুরথের উল্লেখ রয়েছে৷
সুরথ সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে বেশ খ্যাত ছিলেন৷ কোনও যুদ্ধে নাকি তিনি কখনও হারেননি৷ কিন্তু প্রতিবেশী একটি রাজ্য কোনও এক সময় অতর্কিতে তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে এবং যে-কোনও কারণেই হোক সুরথ পরাজিত হন৷ এই সুযোগে তাঁর সভাসদরাও রাজকোষে লুটপাট চালায়৷ কাছের মানুষের এমন আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যান সুরথ৷ তিনি ঠিক করেন, এই মানুষ সমাজে তিনি আর জীবন কাটাবেন না৷ এমনিতেই তখন তিনি রাজ্যহারা৷ তাই সবকিছু ছেড়ে রাজা সুরথ বনের পথে পা বাড়ান৷ ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধসাশ্রমে গিয়ে পৌঁছোন৷ সেখানে স্ত্রী-পুত্র দ্বারা বিতাড়িত আর এক হতভাগ্য পুরুষ সমাধির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়৷
ওই আশ্রমে রাজা সুরথ এবং সমাধি থেকে যান৷ তাঁদের এই আশ্রমেই থাকার কারণ মানবিক দিক থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যাঁদের কারণে তাঁদের সবকিছু হারাতে হয়েছে, নিজেদের দুঃসময়েও তাঁরা তাঁদের ভালো চাইতেন, মঙ্গল কামনা করতেন৷ মেধস ঋষিকে তাঁরা একথা বলায় তিনি বলেন, সবই মহামায়ার ইচ্ছা৷ এরপর ঋষিপুরুষ তাঁদের মহামায়ার কাহিনি বর্ণনা করেন৷ ঋষির উপদেশেই রাজা সুরথ কঠিন তপস্যা শুরু করেন৷
পুরাণভাষ্যে জানা যায়, দেবী মহামায়া সুরথের কঠোর তপস্যা ও অবিচল ভক্তি অনুভব করে তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেন, তুমি তোমার সমস্ত হৃতসম্পদ ফিরে পাবে৷ রাজ্যে তোমার জন্য সকলে অপেক্ষা করে আছে৷ ফিরে গিয়ে তুমি আমার পূজা দিয়ে নিজের সৌভাগ্যকে আরও বৃদ্ধি কর৷ সুরথরাজা মায়ের আশীর্বাদ পেতেই সমাধিকে নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে গিয়ে বসন্ত কালের শুক্ল পক্ষে দেবী মহামায়ার পূজা শুরু করেন৷ সেই থেকে শুরু হয় বাসন্তী পূজা৷
অন্যদিকে, শারদীয়া দুর্গাপূজাকে ‘অকালবোধন’ বলা হয়৷ কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের আগে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে মা দুর্গাকে পূজা করেছিলেন৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন৷ তাই এই সময়টি তাঁদের পূজার যথাযথ সময় নয় বলেই বিবেচনা করা হয়৷ রামচন্দ্র অকালে এই পূজা দিয়েছিলেন বলে এই পূজার নাম হয় ‘অকালবোধন’৷
পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলাদেশ, আসাম, বিহার, ওড়িশার প্রচলিত ‘দুর্গোৎসব’ মূলত কালিকাপুরাণে বর্ণিত পদ্ধতি নির্ভর৷ তবে বলা হয়ে থাকে যে, বাংলায় দুর্গোৎসব মূলত বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ (যার অস্তিত্ব তর্কসাপেক্ষ), কালিকা ও দেবী পুরাণে বিধৃত রীতি অনুযায়ী তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধারায় সম্পন্ন হয়৷ অনেক সময় আবার মহাকাল সংহিতায় বর্ণিত পদ্ধতির কদাচিৎ অনুসরণ করা হয়, যা তান্ত্রিক দুর্গোৎসব নামে পরিচিত৷ পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতির জন্য অবশ্য স্মার্ত রঘুনন্দনের দুর্গোৎসবতত্ত্ব ও তিথিতত্বকে অনুসরণ করা হয়৷ তবে ক্ষেত্রবিশেষে বিদ্যাপতির ‘দুর্গাভক্ততিরঙ্গিনী’ বা শূলপাণি রচিত ‘দুর্গোৎসববিবেক’ প্রভৃতি স্মৃতিভাষ্য বা মহাকালসংহিতা, কালীবিলাসতন্ত্র বর্ণিত পদ্ধতিও অনুসরণ করা হয়৷আবার বিহারে দুর্গোৎসব মূলত ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ অনুসারে হয়ে থাকে৷ পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের মৃন্ময়ী মন্দির এবং অনেক পরিবারে এই রীতি প্রচলিত আছে৷
পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে দুর্গাসপ্তমী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত (শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দুর্গাসপ্তমী থেকে কোজগরী লক্ষ্মীপূজা পর্যন্ত) চারদিন সরকারি ছুটি থাকে৷ বাংলাদেশে বিজয়া দশমীতে সর্বসাধারণের জন্য একদিন সরকারি ছুটি থাকে৷
শরৎকালের এই আনন্দমুখর দিনগুলিতে এ রাজ্যের কোথাও কোথাও এক অদ্ভুত রীতি পালনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়৷ ঝাড়খণ্ডের নিকটবর্তী পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির চা-বাগানে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী ‘অসুর’ জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা এই সময়টা ‘শোক সময়’ হিসেবে পালন করে৷
পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা প্রধান ধনী পরিবারগুলোতেই আয়োজিত হয়৷ কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারগুলোর দুর্গাপূজা ‘বনেদি বাড়ির পূজা’ নামে পরিচিত৷ পারিবারিক দুর্গাপূজাগুলোতে শাস্ত্রাচার পালনের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়৷ পূজা উপলক্ষ্যে বাড়িতে আত্মীয়-সমাগম হয়ে থাকে৷ অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে এক-একটি অঞ্চলের বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তা বারোয়ারি পূজা বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত৷ ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন পূজা শুরু হয়৷ মূলত দেবী দুর্গাকে প্রতীকী হিসাবে সামনে রেখে দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির প্রতি জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের ধারণা গড়ে ওঠে৷ দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বন্দে মাতরম’ গানটি তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস-এ সংযোজন করেন যা ছিল ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের মূল মন্ত্র৷ সুভাষচন্দ্র বসু এবং অন্যান্য আরও বেশ কিছু বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী নেতারা এই রকম সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷
আধুনিক যুগে সর্বজনীন পূজায় ‘থিম’ বা নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক মণ্ডপ, প্রতিমা ও আলোকসজ্জার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে৷ থিমগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ‘শারদ সম্মান’ নামে বিশেষ পুরস্কারও দেওয়া হয়৷ এছাড়া বেলুড় মঠ-সহ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বিভিন্ন শাখাকেন্দ্র এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘের বিভিন্ন কেন্দ্রের সন্ন্যাসীরা দুর্গাপূজার আয়োজন করেন৷
শরৎকালের এই আনন্দমুখর দিনগুলিতে এ রাজ্যের কোথাও কোথাও এক অদ্ভুত রীতি পালনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়৷ ঝাড়খণ্ডের নিকটবর্তী পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির চা-বাগানে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী ‘অসুর’ জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা এই সময়টা ‘শোক সময়’ হিসেবে পালন করে৷
এই হল পুরাণ রীতি ও আধুনিক রীতি অনুযায়ী দুর্গোৎসবের ইতিহাস৷ এরপরও দুর্গাপূজার সূচনা বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন৷
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজের পরাজয় হয়৷ অন্যভাবে বলা যায়, ওই দিনই গোটা ভারতের সাধারণ মানুষের পরাজয় আর ব্রিটিশ বণিকদের বিজয়৷ যদি বলা হয় যে, পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসবরূপে কতিপয় বাঙালি দুর্গোৎসবকে ‘বিজয় উৎসব’ রূপে পালন করেছিলেন পলাশীর যুদ্ধের অনতিবিলম্বেই শারদীয়ার প্রাক্কালে— একথা বললে বোধহয় ভুল হবে না৷ এ প্রসঙ্গে সঙ্গত কারণে তখনকার কলকাতার বাবুশ্রেণি ও নদিয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কিছু প্রাসঙ্গিক ইতিহাস না জানালেই নয়৷
কলকাতার শোভাবাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবদের মুন্সি৷ নবকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার নিকট গোবিন্দপুরে৷ ইনি কোনো এক সময় ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি ভাষার প্রাইভেট টিউটর৷ নবকৃষ্ণ দেব প্রথম জীবনে মুন্সি নামেই পরিচিত ছিলেন, এমনকি কেউ তাকে ‘বাবু’ পর্যন্ত বলত না৷ পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পরাজয়ের পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে৷ সেই মুহূর্তে তাঁর ওই ভূমিকার রহস্য অনেকেই টের পাননি৷ টের পাওয়া গেল, যখন তিনি মীরজাফর, রামচাঁদ রায়, আমির বেগের সঙ্গে সিরাজের কোষাগার লুঠ করেন৷ পলাশীর যুদ্ধে তিনি কেবল টাকাই পেলেন না, পেলেন ব্রিটিশদের কাছে সম্মানও৷ সেই তাঁর উন্নতির সূচনা৷
উন্নতি করতে করতে শেষ পর্যন্ত ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিলেন সুতানটির তালুকদার৷ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগে শোভাবাজার অঞ্চলটি বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল৷ নবকৃষ্ণের প্রচেষ্টায় ওই অঞ্চলটি মানুষের স্বাভাবিক বাসযোগ্য করে তোলা হয়৷ রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট নামক রাস্তাটি তিনি নিজের অর্থ ব্যয় করে নির্মাণ করে ব্রিটিশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন৷
পলাশীতে সিরাজের পতনে যারা সবচেয়ে উল্লসিত হন তাঁদের মধ্যে আর একজন ছিলেন নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়৷ কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণের মতো মানুষেরা পলাশীর যুদ্ধে কোম্পানির জয়কে হিন্দুর জয় মনে করলেন৷ ধূর্ত ক্লাইভও তাঁদের সেরকমই বোঝালেন৷ ক্লাইভ চাইলেন এই জয়কে সেলিব্রেট করতে৷ ক্লাইভের পরামর্শেই তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব হিসাবে বাসন্তী পূজাকে পিছিয়ে আনলেন শরৎকালে৷ তৈরি হল নূতন ঠাকুরদালান৷ গড়ে উঠল একচালা প্রতিমা৷ প্রতিমার অঙ্গ বর্তি সোনার গয়না ঝলমল করে উঠল৷ দুর্গার কেশদামে গুঁজে দেওয়া হল ২৬টি স্বর্ণনির্মিত স্বর্ণচাঁপা৷ নাকে ৩০টি নখ৷ মাথায় সোনার মুকুট৷ তারপর তোপধ্বনির সঙ্গে সহ্গে সন্ধিপুজোর শুরু৷ দৈনিক নৈবেদ্য দেওয়া হয়েছিল ৩০ মন চালের৷ সে-বছর নবকৃষ্ণদেব আর নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র লক্ষাধিক টাকা বয়ে করে শরৎকালীন দুর্গাপূজার মাধ্যমে ইংরেজদের যাঞ্চিত বিজয় উৎসবটি পালন করলেন৷
অনেকে বলেন, অবিভক্ত পূর্ববঙ্গে দুর্গাপূজা হতো বসন্তকালে৷ আর শরৎকালে চালু ছিল নবপত্রিকা পূজা৷ দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িত ছিল মূর্তি আর নবপত্রিকা পূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ন-টি উদ্ভিদ৷ ১৭৫৭ সাল থেকে এই দুটি প্রথা এক করে ফেলা হয়৷ তাই আধুনিক দুর্গাপূজাতে আগে নবপত্রিকা পূজা করে বোধন করার প্রচলন হয়েছে৷
অবাক হবার বিষয়, ক্লাইভ নিজে খ্রিস্টান আর মূর্তিপুজোর বিরোধী হয়েও শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে হিন্দুপ্রেমিক সেজে ১৭৫৭ সালে নবকৃষ্ণের দুর্গাপূজায় ১০১ টাকা দক্ষিণা আর ঝুড়িঝুড়ি আনন্দও উপভোগ করেছিলেন৷ কথিত আছে, তিনি এখানে পশুবলি-সহ পূজা দিয়েছিলেন! নবকৃষ্ণের কাছেও দুর্গাঠাকুর ছিলেন উপলক্ষ্য মাত্র৷ ক্লাইভকে তুষ্ট করাই ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য৷ নবকৃষ্ণ ভালো করেই জানতেন মূর্তিপূজার বিরোধী খ্রিস্টান ক্লাইভকে শুধু দুর্গাঠাকুর দেখিয়ে মন ভরানো যাবে না৷ তিনি তাই ক্লাইভের জন্যে মদ-মাংস-বাঈজিনাচেরও বন্দোবস্ত করেছিলেন৷ সেই কারণেই উঠোনের একপ্রান্তে ঠাকুরদালান তৈরির সঙ্গে সঙ্গে অন্যপ্রান্তে তৈরি করা হয়েছিল নাচঘর৷ ক্লাইবকে তুষ্ট করবার জন্য আনানো হযেছিল বিদেশ থেকে নিকিবাঈ নামে এক নর্তকীকে৷ এসব থেকে বোঝা যায় যে, নবকৃষ্ণের কাছে দুর্গাপুজোটা ছিল নেহাত উপলক্ষ্য মাত্র, আসলে তিনি ক্লাইভ-পূজকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন৷
অনেকেই হয়তো জ্ঞাত নন যে, বাঙালির শারদীয়া দুর্গাপূজা এইভাবেই ১৭৫৭ সালে শুরু হয়েছিল নবকৃষ্মের হাত ধরে৷ বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গাপূজার কথা নেই, আছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে৷ তাছাড়া রামায়ণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণের সঙ্গে ইতিহাসের কোনো যোগ প্রায় নেই বললেই চলে৷ অন্য সূত্রানুসারে, উত্তরবঙ্গের তাহেরপুরের ভুঁইয়া রাজা কংসনারায়ণ মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে আট লক্ষ টাকা দিয়ে শরৎকালে দুর্গাপূজা করেন৷ এমনকি নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় প্রথম শারদীয়া বা শরৎ দুর্গাপূজা সংগঠিত করেন বলেও শোনা যায়৷ কিন্তু তাতেও কিংবদন্তি বেশি, ইতিহাস কম৷ সেন রাজারাও বসন্তকালেই দুর্গাপূজা করতেন বলে জানা যায়৷
অনেকে বলেন, অবিভক্ত পূর্ববঙ্গে দুর্গাপূজা হতো বসন্তকালে৷ আর শরৎকালে চালু ছিল নবপত্রিকা পূজা৷ দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িত ছিল মূর্তি আর নবপত্রিকা পূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ন-টি উদ্ভিদ৷ ১৭৫৭ সাল থেকে এই দুটি প্রথা এক করে ফেলা হয়৷ তাই আধুনিক দুর্গাপূজাতে আগে নবপত্রিকা পূজা করে বোধন করার প্রচলন হয়েছে৷
তবে অন্য একটি সূত্রের মতে, ১৬১০ সাল থেকে বড়িষার বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবার তাদের আদি বাসভবনে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছেন৷ এটিই সম্ভবত কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গোৎসব৷ তবে সে ছিল নিতান্তই বাড়ির পুজো৷ ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেব যে দুর্গাপূজা শুরু করেন সেটির নির্দেশিত পথেই দুর্গাপূজা পরবর্তীকালে কলকাতার ধনী বাবু সম্প্রদায়র মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে৷ শাস্ত্রাচার এই সব পূজায় গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়৷ যে পূজায় যত বেশি সংখ্যক আমন্ত্রিত ইংরেজ অতিথি উপস্থিত হতেন, সেই পূজার মর্যাদা ততই বাড়ত৷ দেবী প্রতিমার সম্মুখেই মুসলমান বাঈজি নাচের আসতো৷ ইংরেজরা এসে নাচগান করতেন, তাদের জন্য উইলসন হোটেল থেকে গোরু ও শূকরের মাংস আনানো হতো এবং মদ্যপানের আসরও বসত৷ এভাবেই এরপর থেকে প্রতি বছরই শরৎকালে দুর্গাপূজা করে নবকৃষ্ণ-কৃষ্ণচন্দ্রের দল পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করেছেন এবং অন্যান্য জমিদার ও ব্যবসায়ীদেরও তা পালন করতে উৎসাহিত করেছেন৷ আর এই সুযোগে প্রশাসনিক ও বাণিজ্যকি স্বার্থে ইংরেজরা এদেশে দুর্গাপূজাকে উপলক্ষ্য করে গড়ে তুললেন এক অনুগ্রহজীবী তাঁবেদার সম্প্রদায়৷
তথ্যসূত্র:
১. কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমন রায়, দেব সাহিত্য কুঠির
২. কলিকাতার কথা, প্রমথনাথ মল্লিক, পুস্তক বিবণী
৩. কলিকাতার ইতিহাস, বিনয়কৃষ্ণ দেব, সপ্তর্ষি
৪. কলকাতার দুর্গাপূজা, নির্মল কর, আনন্দবাজার পত্রিকা
৫. কলকাতার দুর্গাপূজা, উইকিপিডিয়া
৬. বাংলায় দুর্গা পুজো ও তার ইতিহাস, দেবলীনা দত্ত দে, এশিয়ানেট নিউজ