কোন আলোতে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন

সভ্যতার প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় তপস্বী ও ঋষিরা সাধনবলে যে অমৃত জ্ঞান অর্জন করতেন, সেই জ্ঞানই তাঁরা তাঁদের শিষ্য ও অনুগামীদের মুখে মুখে বিতরণ করতেন। যা ছিল শুধুই শ্রুতিনির্ভর। শ্রোতারা সেগুলি শুনে শুনে মনে রাখত। তখনও পর্যন্ত লেখনী রীতির প্রচলন শুরু হয়নি। আবিষ্কার হয়নি কালি-কলম-কাগজ। সময়ের বিবর্তনে আরও অনেক পরে ভেষজ নির্যাস থেকে মানুষ যখন রংয়ের আবিষ্কার করতে পারল, তখনই সেই রং ব্যবহারের সূত্র ধরেই এল অলংকরণের প্রবণতা। যার একটি অংশ স্থায়ীভাবে বর্ণ সংস্থাপন। কথ্য রূপ পেল লেখশিল্পে। আরও পরে আবিষ্কার হয়েছিল ভূর্যপত্র। সেখান থেকে পুঁথি— এল তালপাতার পুঁথি। মানুষের মধ্যে জ্ঞান বুভুক্ষের তাগিদে তৈরি হল শিক্ষার একটি কাঠামোগত পরিসর। এল তপোবন ভিত্তিক গুরুগৃহ। সেই গৃহে যশস্বী মুনি ঋষি ও প্রাজ্ঞ তপস্বীরা তাদের আহরিত জ্ঞানের প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে তাঁদের শিষ্যদের মনের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতেন। তখন গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো সম্পর্ক। আর শিক্ষায় ছিল সকলের অবাধ অধিকার। এভাবেই পরবর্তী সভ্য সমাজে ক্রমে ক্রমে তৈরি হল শিক্ষাদানের শ্রেণিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। তৈরি হল শিক্ষক সমাজ। তাঁদেরও কাজ থাকল ওই একই— জ্ঞানের আলা ছড়িয়ে অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করা। 

শিক্ষকরা হলেন সমাজ গড়ার কারিগর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন শিক্ষকরা। তাই তাদের মর্যাদাকে প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান জানাতে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সহযোগিতায় শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এই বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা শুরু হয়। বিশ্বের প্রায় ১০০টির মতো দেশ ওই দিনটি নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পালন করে থাকে বলেই আমরা জানি। 

১৯৬২ সালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর ৫ সেপ্টেম্বর ডক্টর রাধাকৃষ্ণনের ৭৭তম জন্মদিনটি ছাত্ররা বিশেষভাবে উদযাপনের জন্য তাঁর কাছে অনুমতি চেয়ে অনুরোধ করলে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাঁদের এই দিনটি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করতে বলেছিলেন।

ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা নিয়ে থাকে।

কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষকদের মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেই ১৯৬২ সাল থেকে ৫ সেপ্টেম্বর দিনটি উদযাপন করা হয় শিক্ষক দিবস হিসাবে। সারা দেশে শিক্ষার্থীরা তাঁদের শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এইদিনে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা হয় শিক্ষক দিবস। তার কারণ প্রখ্যাত পণ্ডিত, দার্শনিক ও সর্বোপরি একজন আদর্শ শিক্ষক স্বাধীন ভারতের প্রথম সহ-রাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন পালন উপলক্ষে তিনি এই দিনটি উৎসর্গ করেছিলেন সমগ্র শিক্ষক সমাজকে।

১৯৬২ সালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর ৫ সেপ্টেম্বর ডক্টর রাধাকৃষ্ণনের ৭৭তম জন্মদিনটি ছাত্ররা বিশেষভাবে উদযাপনের জন্য তাঁর কাছে অনুমতি চেয়ে অনুরোধ করলে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাঁদের এই দিনটি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করতে বলেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘আমার জন্মদিনকে আলাদাভাবে পালন করার পরিবর্তে, যদি প্রতি বছর ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয় তাহলে আমি অনেক বেশি আনন্দ পাবো।

খুব ছোটবেলা থেকেই রাধাকৃষ্ণনের মধ্যে মন দিয়ে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক সমস্ত বিষয়ের ওপর অনুসন্ধানী চোখ রেখে চলার অভ্যাস ছিল। তাঁর জন্ম ১৮৮৮, ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মাদ্রাজ, আজকের অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুত্তানি শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। কিংবদন্তি অনুসারে, তাঁর বাবা চাননি ছেলে ইংরেজি শিখে কোনো বড় কোনো লাট-বেলাট হোক। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর ছেলে একজন সাত্ত্বিক পুরোহিত হোক। কিন্তু ছোট্ট কৃষ্ণনের মধ্যে লেখাপড়ার প্রতি অপরিসীম আগ্রহ ও ব্যতিক্রমী মেধার কারণে তাঁকে প্রথমে তিরুত্তানি এবং পরে ভেলোরের একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে তিনি তৎকালীন মাদ্রাজের খ্রিস্টান কলেজে ভর্তি হন, যেখানে তিনি দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। রাধাকৃষ্ণন, যিনি দৈবক্রমে দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হলেও ক্রমেই আত্মবিশ্বাস, মনোযোগ এবং দৃঢ় প্রত্যয়ের কারণে দর্শন শাস্ত্রে একজন অসাধারণ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। 

কর্ম জীবনের শুরুতেই মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজের লেকচারার হিসাবে প্রথম দিন থেকেই তিনি শিক্ষাদানের একজন প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন। পাঠ্য বিষয়কে প্রাঞ্জল করে উপস্থাপিত করতে পারার গুণে তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। এরই সঙ্গে শুরু হল দর্শন শাস্ত্রের উপর তাঁর নানাবিধ গবেষণামূলক কাজকর্ম, লিখতে শুরু করলেন বইপত্র। রাধাকৃষ্ণনের মেধা ও পাণ্ডিত্যের কারণে মাদ্রাজের শিক্ষা পরিধির বাইরেও তাঁর পা পড়তে শুরু করল। একের পর এক বিভিন্ন মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর পদার্পণে ধন্য হয়ে উঠল। এক সময়ে তিনি এলেন তখনকার সেরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ পদের দায়িত্ব নেওয়া হল তাঁকে। তখন তার বয়স ছিল তিরিশ বছরেরও কম। এখান থেকে তিনি উপাচার্য হয়ে যান মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানকার উপাচার্য ছিলেন। ১৯৩৯ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন। পরে বেনারসে ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার স্যার স্যায়াজি রাও চেয়ারএর দায়িত্ব নেন।

প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও তিনি পরস্পর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটি এমন ছিল যে, দু-জনেই দুজনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও স্নেহের চোখে দেখতেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাধাকৃষ্ণন নির্বাচিত হওয়ার পর পণ্ডিত নেহরু তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘তিনি তাঁর দেশকে নানা দিক থেকে সেবা করেছেন। তবে সর্বোপরি, তিনি একজন মহান শিক্ষক; যার কাছ থেকে আমরা সবাই অনেক কিছু শিখেছি। আগামী দিনেও মানুষ অনেক কিছু শিখতে থাকবে। একজন মহান দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং একজন মানবতাবাদী কৃষ্ণনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পাওয়া ভারতের সাধারণ মানুষের পক্ষে বিশেষ গৌরবের।’

দেশ স্বাধীন হবার পর ডঃ রাধাকৃষ্ণন ১৯৫২ সালে ভারত প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। দশ বছর পরই ১৯৬২-তে তিনি পাঁচ বছরের মেয়াদে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নির্বাচিত হন। 

গবেষক, আইনজীবী, শিক্ষক এবং রাজনীতিবিদ— বহু গুণের আধার ডঃ রাধাকৃষ্ণন সর্বোপরি ছিলেন একজন শুদ্ধ মননের চিন্তাবিদ এবং আদর্শ শিক্ষক। তাঁর এই বহুমুখী গুণ ও শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের জন্য বিশেষ অবদানের কারণে তাঁকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত করা হয়। 

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও তিনি পরস্পর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটি এমন ছিল যে, দু-জনেই দুজনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও স্নেহের চোখে দেখতেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাধাকৃষ্ণন নির্বাচিত হওয়ার পর পণ্ডিত নেহরু তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন: তিনি তাঁর দেশকে নানা দিক থেকে সেবা করেছেন। তবে সর্বোপরি, তিনি একজন মহান শিক্ষক; যার কাছ থেকে আমরা সবাই অনেক কিছু শিখেছি। আগামী দিনেও মানুষ অনেক কিছু শিখতে থাকবে। একজন মহান দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং একজন মানবতাবাদী কৃষ্ণনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পাওয়া ভারতের সাধারণ মানুষের পক্ষে বিশেষ গৌরবের।

কনফুসিয়াসকে বিশ্বের প্রথম শিক্ষক বলে মনে করা হয়। তিনি একজন প্রাইভেট টিউটর ছিলেন যিনি ইতিহাস পড়াতেন। চিনে এক সময় শুধুমাত্র রাজকীয় বা সম্ভ্রান্ত শ্রেণিরই শিক্ষার সুযোগ ছিল। কনফুসিয়াস সেই বাতাবরণে পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। শিক্ষার অধিকার নিয়ে প্রাচীন ধারণা ভেঙে তিনি সকলের জন্য শিক্ষার আলো খুলে দিয়েছিলেন তাঁর অবারিত শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষা বিতরণ তাঁর মধ্যে কোনো বাছবিচার ছিল না। 

কনফুসিয়াস (জীবনকাল খ্রিস্টপূর্ব 551-479) প্রাচীন চিনের একজন দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।তিনি খ্রিস্টপূর্ব 551 সালের 28 সেপ্টেম্বর চিনের লু রাষ্ট্রের দুফু শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর দর্শন এবং রচনাবলী চিনসহ পূর্ব এশিয়ার জীবনদর্শনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে।তিনি মূলত নীতিবাদী দার্শনিক ছিলেন।তাঁর বিশ্বাস ছিল, শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে নীতিজ্ঞান।এই প্রাচীন চিনা দার্শনিকের খ্রিস্টপূর্ব 479 তে জীবনাবসান হয়।

ঠিক এমনিভাবেই রাধাকৃষ্ণণও শিক্ষার আলো সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার কাজে আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর জীবন থেকেও অনেক কিছুই গ্রহণ করার মতো তত্ত্ব আছে, শেখার আছে। তাঁর মতে–শিক্ষার শেষ পণ্য হওয়া উচিত একজন মুক্ত সৃজনশীল ব্যক্তি, যিনি ঐতিহাসিক পরিস্থিতি এবং প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারেন।’ 

শিক্ষাগত তত্ত্ব ও অনুশীলনে ডঃ রাধাকৃষ্ণনের সবচেয়ে বড় অবদান হল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের যিনি একটি সুসংহত ও আদর্শ নীতি রচনা করা। আজকের দিনে ভারতের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমপ্রসারমান বহুমুখী বিস্তার তাঁরই অবদান।

                                                             শিক্ষক দিবস উপলক্ষে লেখাটি প্রকাশিত হল