আচমকা–একেবারেই আচমকা জলে গিয়ে পড়ল নোংরাভর্তি প্লাস্টিকের ভারী প্যাকেটটা। ছলাৎ করে জল উঠল ছড়িয়ে। একেবারেই ঘাটের গায়েই বসেছিল শিবা। জল ছিটকে এসে পড়ে তার ময়লা শাড়ি ব্লাউজের ওপর। একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শিবা। ঘাটবাবু। ক্রাচ নিয়ে এক পায়ে চলা গঞ্জের ঘাটবাবু।
–শালা অলপ্পেয়ে খোঁড়া মিনসে। পায়ের সাথে চোখের মাথাও খেয়েছ নাকি?দেখছ না ঘাটের ওপর মনিষ্যিটা বসে আছে?
—আহাহা। চটছিস কেন বাছা?আমি বুঝতে পারিনি।
শিবার ঝাঁঝালো গলার জবাবে মোলায়েম ঘাটবাবু ফের শুধোলেন– আজ বড় উদাস বসে আছিস? কিছু হয়েছে নাকি রে?
— কী আবার হবে?শিবার তিরিক্ষি উত্তর। –শালা, কানা খোঁড়ার একগুণ বাড়া। চল্ চল্ পাতলা হ এখান থেকে।
শিবার শত অপমানেও ঘাটবাবু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বগলের ক্রাচটা চেপে ধরে দু’পা এগিয়ে আসে শিবার দিকে। চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে মুখ নীচু করে আওয়াজটা ছড়িয়ে দেয়– শুনেছিস কিছু?
অবাক চোখে তাকায় শিবা– কী?
–কাল রাতে বিশুয়ার খোঁজে ঘাট তোলপাড় করেছে পুলিশ।
–সে তো রোজই করে। তাতে আর হল কী?
— হল কী?কাঁকড়ার মতো মুখখানায় ভেংচি খেলে যায়– এবার তিন-তিনটে মার্ডার কেস আছে বিশুয়ার নামে।
— তিনটে মার্ডার কেস?শালা ঢ্যামনা শুয়ার। বিশুয়াকে খোঁজে তো খালি আবগারি বাবুরা।
তাড়াতাড়ি আরও এগিয়ে যায় ঘাটবাবু। উঁচু ডাঙায় হোঁচট খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলে নেয়।
–শালা আমার গুমটিতে বসে মাল খেতে খেতে কাল নিজে ছোটবাবু বলেছে এ-কথা।
— ঘোড়ার আন্ডা বলেছে–আমার ইয়ে বলেছে রে শালা। যাঃ। যাঃ। তোর কাজে তুই যা।
— বেশ! যা বলার ছিল আমি বলে দিলাম। হাজার হোক এক ঘাটের বাসিন্দা আমরা। তা তুই সে যা হোক, প্রতিবেশী তো বটে?
ঘাটবাবু এগোতে থাকেন নিজের বেড়ার গুমটির দিকে।
বীরগঞ্জের ব্যস্ত ফেরিঘাট। বিশাল গঙ্গার ওপর হাজারো রকমের নৌকো আর স্টিমারের পারাপারের পঞ্চায়েতী ব্যবসা। এপারের সাঁইথে-আমোদপুর থেকে ওপারের জিয়াগঞ্জ-বহরমপুর পর্যন্ত ব্যবসাদারদের এই একটাই চলতি ঘাট। ঘাটের উত্তরদিক বরাবর বীরগঞ্জের শ্মশান। এদিকে স্টিমার ঘাট বরাবর সারি সারি লাইনের দোকান। চা-পান-বিড়ির গুমটি। চুল্লুর ঠেক। পেটচুক্তি গরম ভাতের বেড়া ছাওয়া হোটেল। সস্তার জুতো– সাট্টার ঠেক আর ওপরে কদরভরা ময়রা ছেয়ে বসে আছে ঘাট জুড়ে।
ওদিকে শ্মশানের হাঁকডাক মড়াকান্না আর এধারের সারি সারি ঘুপচিতে জমে উঠেছে মাঝিমাল্লা-দোকানি আর ওপারের বাবুদের মদের আসর।
আর? আর একটা জিনিস বীরগঞ্জে ঘুপচিতে ঘুপচিতে মদমস্তির সঙ্গে জমিয়ে দেবে– তারা ঘাট বেশ্যা।
ওপার থেকে আসে গামছা–মিহিজালের বুনোট দানা মশারি–দোমোহানী গরু। আর আবগারি আঁচে ছাপ্পা লাগানো বিলিতি মদ। বীরগঞ্জের ঘাটে একটা চলতি কথা ছোটে বাতাসে।…
বীরগঞ্জের মাগী-চুল্লু-সুপারি
জিয়াগঞ্জের মদ-মিষ্টি আর মশারি।
সেই কোন সকাল থেকে শুরু হয়ে যায় পারাপার। প্রথমে চার আনা ভাড়ায় নৌকো পারাপার। পরে দু’টাকায় ছুটবে স্টিমার। লোকজনের চেল্লামিল্লি– দোকানির হাঁকডাক–মাঝিমাল্লাদের কাঁচা খিস্তি গালাগালিতে ফেরিঘাট জেগে থাকবে রাত পর্যন্ত। আর বিদ্যুতের বাতি– হ্যাজাকের আলো– লণ্ঠনের কূপি জ্বলতেই বেরিয়ে আসবে আসল চেহারাটা।
ওদিকে শ্মশানের হাঁকডাক মড়াকান্না আর এধারের সারি সারি ঘুপচিতে জমে উঠেছে মাঝিমাল্লা-দোকানি আর ওপারের বাবুদের মদের আসর।
আর? আর একটা জিনিস বীরগঞ্জে ঘুপচিতে ঘুপচিতে মদমস্তির সঙ্গে জমিয়ে দেবে– তারা ঘাট বেশ্যা।
সন্ধের ঝোঁকে বিশুয়া আসে। মদে চুর টালমাটাল চেহারা। শিবা বসে কোলের ওপর হাত আয়নাটা ফেলে চুল আঁচড়াচ্ছিল।
আয়নায় বিশুয়ার ছায়া পড়তেই চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলল– তোর নামে মার্ডার কেস আছে রে বিশুয়া!
–জানি। — ক্লান্ত হতাশ গলায় জবাব দেয় বিশুয়া।
–তোকে ফালতু ফাঁসালো ওরা। এখন কী করবি?
–জানি না। দেখি। উকিলবাবুকে ধরতে হবে। বেফালতু আমায় ফাঁসিয়ে দিল হীরুদা।
তাকের ওপর আয়নাটা রেখে বিশুয়ার দিকে ফেরে শিবা। বলে–থানার হিস্যা এবারে দিসনি তুই?
— দিইনি আবার!
— তালে?তালে কেস খাওয়াচ্ছে কেন?
— কিছু খাবার আছে রে?সারাদিন আজ পেটটা বড় ঝাঁক মারছে।
সকালে জল দেওয়া ভাত ছিল। পেঁয়াজ কেটে কাঁচালঙ্কা কুচিয়ে একটা পেতলের কাঁসিতে ধরে দেয় শিবা।
— নে, ধর।
সন্ধের আলো ফুরিয়ে আসছে। আশপাশের ঘুপচিগুলো সেজে উঠেছে। হেসে উঠছে। হাজার চেল্লামেল্লি, সামনের মিউনিসিপ্যাল কলের লাইনে মেয়ে বউদের কাঁচা খিস্তির মধ্যেও কোথাও শাঁখ বেজে উঠল। রেডিওতে বিবিধভারতীর গান চলছে কোথাও।
–আজ কোথায় বসবি রে শিবা?
বিশুয়ার কথার জবাব দেয় না শিবা। আনমনে বলে,
— দেখি, ওপারের সিরাজ মাস্টারের আসার কথা আছে।
— সেই শালা বুড়ো ভাম?শালার মাথার ওপর শকুনে চক্কর দিচ্ছে তাও শালা বুড়োর মেয়ের নেশা যায়নি।
উস্কোখুস্কো চুলগুলো আঙুল দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি হয় বিশুয়া। পেছন থেকে ডাকল শিবা,
–আজ কোন ঘাটে থাকবি?
–চিতা ঘাটে। বহরমপুর থেকে বিশ পেটি দু’নম্বরি বিলেতি মদ ঢুকবে আজ। মাল চালান করতে করতে রাত হয়ে যাবে। তুই চিন্তা করিস না। রাত বেশি হলে ইচ্ছা আছে আজ বেথুয়া রোডে ললিতদের সঙ্গে ছিনতাই-এ নামব। শালা পকেট এক্কেবারে সুনসান আলি।
— মেসিন নিয়েচিস?শিবার কথায় কোমরে হাত লাগায় বিশুয়া– হ্যাঁ।
— সাবধানে যাস। দেওয়ালে টাঙানো কালী ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে টুক করে একটা পেন্নাম ঠোকে শিবা।
গঙ্গা। অকূল দরিয়ার তুফান। হরেক জীবনের মতো এরও কোনও কূল-কিনারা নেই। অকূল দরিয়ায় ভাসছে জীবন। উঠে আসছে হরেক জীবিকা। সব পাপ ঠেলা মেরে সাগরের দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজ মাস্টারের সারের দোকান। জমিজিরেত সমেত তিন তিনটে বিবি। কিন্তু দিনের আলো ফুরোতে না ফুরোতেই গঙ্গা বেয়ে চলে আসে এপারের বীরগঞ্জে। আজ এসে উঠেছে রশিদের ঝুপড়িতে।
শিবা এল অনেক পরে। সিরাজ মাস্টার এক ঝলক শিবাকে দেখেই বুঝল বেশ খানিকটা মাল টেনেই এসেছে। রশিদের ঝুপড়িতে হুকিং করে ওপার থেকে আলো নেওয়া আছে।
— আয় শিবা আয়। — সিরাজ মাস্টারের ডাকে সাড়া দেয় না শিবা। আলগোছে এসে বসে খাটের এক ধারে। হাত বাড়িয়ে রেডিওটা বন্ধ করে দেয় সিরাজ মাস্টার। ডানহাত বাড়িয়ে কাছে টানে শিবাকে– আয়, বিছানায় আয়।
— আজ ভাল লাগছে না গো বাবু। মনটা উতলা আছে।
— কী হয়েছে রে আল্লাদী আমার?
–বিশুয়াকে ওরা ফাঁসিয়ে দিয়েছে বাবু। বলে কিনা মার্ডার কেস দিয়েছে?
গম্ভীর হয় সিরাজ মাস্টার। — কারা চাপাল মার্ডার কেস?
–ঘাটবাবু বলছিল হীরেদার দল। মানে হীরেদাই।
–হুম! নতুন দারোগা আর হীরে বড্ড বেড়েছে দেখছি।
— কী হবে বাবু?বিশুয়াকে কী?
প্রায় হুমড়ি খেয়েই পড়ে শিবা সিরাজ মাস্টারের কোলের ওপর।
— দেখি। আমার সুম্মুন্দি মোজাম্মেল এম.এল.এ সাহেবের খুবই কাছের লোক। কাল যাই ওর কাছে। দেখি–
হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দেয় সিরাজ মাস্টার।…
গঙ্গা। অকূল দরিয়ার তুফান। হরেক জীবনের মতো এরও কোনও কূল-কিনারা নেই। অকূল দরিয়ায় ভাসছে জীবন। উঠে আসছে হরেক জীবিকা। সব পাপ ঠেলা মেরে সাগরের দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
রাতভোর পুলিশি তল্লাশি চলল বিশুয়াদের গঙ্গা বস্তিতে। গতরাত থেকেই বিশুয়া ধাঁ। এম.এল.এ সাহেবের চিঠি নিয়ে সিরাজ মাস্টার গেছে নতুন দারোগার সঙ্গে দেখা করতে। ঘাট বরাবর দু’নম্বরি ব্যবসাপত্তর আজ লাটে। সাট্টাখোর রাজু বিপিনের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে পা নাচাচ্ছে। সন্ধের আলো অন্ধকার ধরতেই শিবার বন্ধ দরজায় কড়া নড়ে ওঠে।
দরজা খুলেই শিবার মেজাজ চড়ে যায়। — শালা, এখানে কী দরকার রে তোর?
দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে ঘাটবাবু। ঘরে ঢুকতে চাইলেই ফের চিৎকার শিবার। — কী চাস তুই?
সন্ধের আধো-অন্ধকারে ভারী ক্লান্ত দেখায় ঘাটবাবুর মুখটা। পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করে এগিয়ে ধরে শিবার দিকে।
— নেঃ। নেঃ, ধর। নতুন দারোগা হিসেবে বসে গেছে। আজ কোথাও বসবি না। রাত দশটার পর ঘাট রেড হবে। আমার গুমটিতে আসিস। নতুন দারোগা এসে টাকা নিয়ে যাবে।
ক্রাচ বগলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘাটবাবু। শিবার কথায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
–আমাকে কার সঙ্গে আজ বসতে হবে?তোর না নতুন দারোগা?
–কী বলছিস তুই?হাজার হোক একঘাটের–
হঠাৎই শিবার ঘরের চৌকাঠে ক্রাচ বেধে গিয়ে সটান হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঘাটবাবু।
–আরে আরে মরণটাকে দ্যাখো। শালা আমার ঘরেই পড়ে মরবি নাকি রে?
গলা উঁচু করে তাকায় ঘাটবাবু। অসহায় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতে যায়। ছুটে এসে শিবা হাতটা ধরে তোলে। সেই সময়েই ঘাটবাবুর গলা থেকে ছিঁড়ে একটা রুপোর লকেট শিবার ঘরের মেঝেয় এসে পড়ে।
অবাক গলায় বলে ওঠে শিবা– কী এটা?
গলা থেকে ছিঁড়ে পড়ে যাওয়া লকেটটাকে হামলে পড়ে ধরে নিতে যায় ঘাটবাবু। বলে– না না। ও কিছু না দে আমাকে।
লকেটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শিবা। তারপর অতি কৌতূহলে চাপ দিয়ে ফেলে লকেটটায়। ঝকমকিয়ে ওঠেরুপোর লকেটের ভেতরে মিনে করা একটা কচি মেয়ের মুখ।
— মেয়েটা কে রে?কচি কচি মুখ? বেড়ে দেখতে তো?
— সে তুই বুঝবি না। দে আমাকে।
— বল না শালা কচিমালটা কে তোর?
— দে বলছি। — এবার চিৎকার করে ওঠে ঘাটবাবু— ও আমার মেয়ে।… ডানহাতের মুঠোয় লকেটটা চেপে ধরে ঘাটবাবু। বগলের ক্রাচটা ঠিকমতো জুতে নেয়। তারপর ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে ক্লান্ত গলায় বলে ওঠে–
–টাকাগুলো দিয়ে আজই নতুন দারোগাকে ফিট করে নে।…
দিনদুয়েক পরে অনেক রাতে বিশুয়া আসে। মুখে-কপালে-হাতে দগদগে আঘাতের চিহ্ন। অনেক জায়গায় ফুলে ঢোল হয়ে রক্ত জমে আছে।
— এ কী! আঁতকে ওঠে শিবা। — এ দশা কে করলে তোর?
— বেথুয়ার মোড়ে লরি ছিনতাইয়ে নেমেছিলাম। উঠিয়েও নিয়েছিলাম একটা চারশো সাত। শালা অন্য ট্রাকের ড্রাইভার খালাসিরা রড দিয়ে ক্যালাতে শুরু করল। মেসিন বের করে গুলি চালাল। ললিত পেটে দানাসুদ্ধু জমে পড়ে গেল। আমি শালা কোনওরকমে ফুটলাস হলাম।
সারারাত ধরে মুকুন্দর পানের দোকান থেকে বরফ আনিয়ে ঘষতে ঘষতে বেঘোর কাঁদল শিবা। তারপর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিশুয়ার পা দুটো জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল শিবা– চল বিশুয়া, আমরা এখান থেকে কোথাও পালিয়ে যাই।
একরাশ যন্ত্রণামাখা মুখে বিশুয়া জিজ্ঞেস করে— কোথায়?
ভোরের আলো ফুটে উঠতে আর বেশি দেরি নেই। ওরা চলে আসে ফেরিঘাটে। শিবার মাথায় সামনের ঘর-গেরস্থালি।
ঘাটের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা। ঘাটবাবুর বেড়ায় গুমটির ভেতরটায় উঁকি দেয়। ঘুমোচ্ছে ঘাটবাবু। ভেসে আসছে বিষনিঃশ্বাসে ভরা ঘাটবাবুর নাক ডাকার শব্দ।
অঙ্কন: অনুপ রায়
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা ১৪২১
লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হল