১৯২৫, দার্জিলিং-এর ‘স্টেপ এ্যাসাইড’ বাড়িটির বিকেল বেলা বিষণ্ণ ও মন্থর হয়ে আছে৷ বাংলার রাজনীতির প্রাণপুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অবস্থান ছিল গত কয়েকদিন এই বাড়িতে৷ ‘ছিল’৷ কারণ আজ তিনি প্রয়াত৷ সারা বাংলা তথা দেশ হাহাকার করছে৷ শরীর খারাপ ছিল৷ সেরে উঠছিলেন৷ হঠাৎই সব শেষ৷ কয়েকদিন আগে মহাত্মা গান্ধী এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে গেছেন৷ অকালে ঝরে গেল রাজনীতির আকাশের নক্ষত্র৷ তাঁর মরদেহ নিয়ে কলকাতা রওনা দিল ট্রেন৷ নৈহাটি স্টেশনে সাদা পোশাক, খালি পা, লম্বা চুল, রক্তজবার মতো চোখ নিয়ে এক যুবক মালা দিলেন৷ সঙ্গে দিলেন একটি কবিতা৷ কাজী নজরুল ইসলাম৷
‘হায় চির ভোলা; হিমালয় হতে
অমৃত আনিতে গিয়া
ফিরিয়া এলে যে নীলকণ্ঠের
মৃত্যু গরল পিয়া৷’
ব্যারাকপুরে এসে দাঁড়ালো ট্রেন৷ সেখানে দেশবন্ধু কন্যা অপর্ণা দেবী বাবার সঙ্গী হলেন৷ এবার শিয়ালদহ৷ অসংখ্য মানুষ৷ জাতির পক্ষ থেকে দেশবন্ধুকে গ্রহণ করলেন মহাত্মা গান্ধী৷ ইতোমধ্যে তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে ফিরে এসেছেন৷ নানাপথ ঘুরে দেশবন্ধুর অবিনশ্বর দেহ চলল কেওড়াতলা মহাশ্মশানের দিকে৷ পিছনে লক্ষ জনতা৷ সবাই বুঝলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রধান কারিগর আর নেই৷
(দুই)
ঢাকা বিক্রমপুরে আদি বাড়ি৷ নদীনালার দেশ পূর্ববাংলা৷ নিত্য নদী ভাঙন লেগে আছে৷ বিক্রমপুরও তার থেকে আলাদা নয়৷ ভাঙনের ফলে পরিবারের বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে পড়লো দেশেবিদেশে৷ কেউ গেলেন রাজশাহী তো কেউ গেলেন বরিশাল৷ কাশীশ্বর দাশ গেলেন বরিশালে৷ তাঁর তিন পুত্র৷ কালীমোহন, দুর্গামোহন, ভূবনমোহন৷ ভূবনমোহনের পুত্র চিত্তরঞ্জন৷ সকলেই ব্রাহ্ম৷ কালীমোহন অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু ধর্মের মূল স্রোতে ফিরে আসেন৷ দুর্গামোহন প্রকৃত অর্থেই ‘কালাপাহাড়’ ছিলেন৷ ভূবনমোহনের মধ্যে ধর্ম নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি ছিল না৷ তবে ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন৷ তা সংগ্রহ করে পুস্তকও হয়েছে৷ চিত্তরঞ্জন ব্রাহ্ম ছিলেন৷ তাঁর বিয়ের সময় তিনি হিন্দু নয় এই মর্মে একটা মুচলেকা দিতে হয়েছিল৷ সারাজীবন তিনি এ কাজের জন্য পীড়া অনুভব করেছেন৷ তবে তাঁর মৃত্যুর পর রসা রোডের বাড়িতে হিন্দু মতে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হয়েছিল৷
রাজনৈতিক মামলায় তিনি পয়সা এবং প্রসার দুই-ই পেয়েছেন৷ কিন্তু বহু রাজনৈতিক মামলা বিনা পয়সায়ও লড়েছেন. যেমন আয় করেছেন তেমন ব্যয় করেছেন৷ একসময় পিতাপুত্র একসঙ্গেই দেউলিয়া হয়েছেন৷ কলকাতা হাইকোর্টে অনেক বিচিত্র উদাহরণ আছে, কিন্তু তিনপুরুষ দেউলিয়া এমন উদাহরণ নেই৷
প্রেসিডেন্সি কলেজের পাঠ শেষ করলেন চিত্তরঞ্জন৷ সেই সময় বাঙালি উচ্চবিত্ত পরিবারে একটি সাধারণ চাহিদা ছিল পরিবারের অন্ততঃ একজন ‘সিভিলিয়ান’ হবে৷ ভূবনমোহনের পরিবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না৷ পুত্রকে বিলেত পাঠালেন আইসিএস হওয়ার জন্য৷ বিলেতের জাঁকজমক চিত্তরঞ্জনের চিত্তবৈকল্য ঘটালো৷ তিনি ঠিকমতো পড়াশুনোতে মনই দিতে পারলেন না৷ তাছাড়া সেই সময় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন৷ সিলেট সদস্য হওয়ার জন্য দাদাভাই নৌরজী প্রতিযোগিতা করছিলেন৷ তাঁর হয়ে নির্বাচনে প্রচার করছিলেন চিত্তরঞ্জন৷ ফল হল দাদাভাই জিতলেন৷ কিন্তু চিত্তরঞ্জন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন৷ আর একবার চেষ্টা করলেন৷ তাতেও সফল হলেন না৷ শেষ পর্যন্ত আইসিএস হওয়ার আশা ত্যাগ করে আইন পড়তে শুরু করলেন৷ ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতা ফিরলেন ১৮৯৩ সালে৷
(তিন)
চিত্তরঞ্জনের পুরো পরিবার আইনজীবী৷ দাদু বরিশাল আদালতে আইনজীবী হয়ে কাজ করেছেন৷ চিত্তরঞ্জন যখন দেশে ফিরলেন তখন ভূবনমোহন কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করছেন৷ চিত্তরঞ্জন ওকালতি শুরু করলেন৷ প্রথম দিকে খুবই অসফল ছিলেন৷ ১০/১২ বছর আইন ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখেননি৷ তবে যখন রাজনৈতিক মামলাগুলো হাতে নিলেন তখন থেকে তাঁর সফলতা আসতে শুরু করল৷ বিশেষ করে আলিপুর বোমা মামলা, মানিকতলা বোমা মামলা ইত্যাদি৷ শ্রীঅরবিন্দ এই মামলায় আসামি ছিলেন৷ মামলায় জেতেন চিত্তরঞ্জন৷ রাজনৈতিক মামলায় তিনি পয়সা এবং প্রসার দুই-ই পেয়েছেন৷ কিন্তু বহু রাজনৈতিক মামলা বিনা পয়সায়ও লড়েছেন. যেমন আয় করেছেন তেমন ব্যয় করেছেন৷ একসময় পিতাপুত্র একসঙ্গেই দেউলিয়া হয়েছেন৷ কলকাতা হাইকোর্টে অনেক বিচিত্র উদাহরণ আছে, কিন্তু তিনপুরুষ দেউলিয়া এমন উদাহরণ নেই৷ সেটা কেবলমাত্র চিত্তরঞ্জনের পরিবারেই হয়েছে৷ দেউলিয়া কথাটি যখন এসেই পড়লো তখন আর এক দেউলিয়ার কথা বলা দরকার৷ তিনি এ কে ফজলুল হক৷ কলকাতা হাইকোর্টের নামকরা উকিল৷ পরে বাংলার প্রধানমন্ত্রী৷ কিছু সুযোগসন্ধানী মুসলমান ব্যবসায়ীর চক্রান্তে দেউলিয়া ঘোষিত হলেন৷ তাঁকে শেষ পর্যন্ত বাঁচালেন চিত্তরঞ্জন দাশ৷ রাজনীতিতে বিপরীত মেরুর মানুষ ছিলেন দু’জন৷ কিন্তু ফজলুল হককে খুব ভালবাসতেন চিত্তরঞ্জন৷
চিত্তরঞ্জনের জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ‘প্রাচুর্য’৷ আয়ের প্রাচুর্য, ব্যয়ের প্রাচুর্য, দানের প্রাচুর্য্য, ত্যাগের প্রাচুর্য, নিঃশর্ত বিসর্জনে প্রাচুর্য৷ তাঁর জীবন প্রাণ-প্রাযুর্যে অতিবাহিত হয়েছে৷
(চার)
আইন ব্যবসায় সাফল্যের মধ্য গগনে যখন তাঁর অবস্থান তখনই তিনি বুঝে ফেললেন এ কাজ তাঁর নয়৷ দেশ তাঁকে ডাকছে৷ পরাধীন দেশকে মুক্ত করার আহ্বান তিনি ফেরাতে পারছেন না৷ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘটালেন লর্ড কার্জন৷ কাজটা মোটেই নিরামিষ ছিল না৷ তাঁরা জানালেন বেঙ্গল প্রভিন্স আয়তনে বিশাল বড়৷ লোকসংখ্যাও বড়৷ শাসনের সুবিধার ছোট করা দরকার৷ তখন বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ছিল ১.৭৯ বর্গ মাইল৷ লোকসংখ্যা ৮ কোটি৷ প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বাংলার প্রতিবাদকে থামিয়ে দেওয়া৷ খণ্ডিত করে দেওয়া৷ মুসলমান নেতারাও বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন নবাব শলিমুল্লাহ খান, ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল, খাজা আতিকুল্লাহ, ইউসুফ বাহাদুর, লিয়াকত হোসেন৷ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রথম সমাবেশ হয় বরিশালে৷ উদ্যোক্তা ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল৷ তিনি গ্রেপ্তার হন৷ প্রতিবাদে নামেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ৷ তিনি পায়ে হেঁটে মিছিল করেন৷ নাখোদা মসজিদের ইমামের হাতে রাখি বেঁধে দিলেন৷ সারা বাংলা কেঁপে ওঠে আন্দোলনে৷
চিত্তরঞ্জন রাজনীতিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঐক্যের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চাইলেন৷ হিন্দু-মুসলমান উভয়ে যাতে সমমর্যাদায় কাজ করতে পরে সেদিকে নজর দিলেন৷
ইংরেজ গভর্নর জেনারেল এই সময় ঢাকা গেলেন৷ আহাসান মঞ্জিলে মিটিং করলেন নবাব সলিমুল্লার সঙ্গে৷ সেই ইংরেজের টোপ৷ ঢাকাকে নতুন শহর হিসাবে গড়ে তোলা হবে৷ এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হবে৷ মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা সহ অন্যান্য উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা হবে৷ পূর্ববঙ্গের ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুযোগ দেওয়া হবে৷ সবাই না হলেও নবাব সাহেবসহ মুসলমান নেতাদের অনেকেই টোপটা গিললেন৷ তবে তাতেও শেষ রক্ষা হল না৷ ১৯১১ সালে বাংলা আবার আগের মতো মুক্ত হয়ে গেল৷ তবে পুরনো ভূগোল পাল্টে গেল অনেকটা৷ এই সময় দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল৷ ১৯১১ সালে দেশের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হল৷ আর হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কটা আগের মতো থাকলো৷ পুরো রাজনৈতিক ঘটনাবলী চিত্তরঞ্জন দেখলেন৷ তখনও সরাসরি আসেননি৷ ছোটখাটো সভাতে কংগ্রেসের মঞ্চে ভাষণ দিলেন মাত্র৷
(পাঁচ)
১৯২২ সালে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে তিনি সভাপতির পদে আসীন হলেন৷ গান্ধীজি তখন কংগ্রেসের তথা ভারতের রাজনীতির মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন৷ কিন্তু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে অনেক ব্যাপারেই গান্ধীর অমিল দেখা দিল৷ বিশেষ করে সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রত্যাহার প্রসঙ্গে অমিল হল বেশি৷ উভয়ের মধ্যে বহু ব্যাপারে অমিল থাকলেও অশ্রদ্ধার সম্পর্ক কখনও হয়নি৷ উভয়েই শ্রদ্ধার সম্পর্ক বজায় রেখেছেন৷ গয়া অধিবেশনের মধ্যেই চিত্তরঞ্জন স্বরাজ পার্টি গঠন করলেন৷ শহিদ সোহরাওয়ার্দি, ডা. আনসারি, হাকিম আজমল খাঁ, বিঠলভাই প্যাটেল, মোতিলাল নেহরু, মৌলানা আকরাম খাঁ, মণিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, ডা. বিধানচন্দ্র রায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন৷ এই পার্টি নির্বাচনে লড়েছে এবং সাফল্য পেয়েছে৷
চিত্তরঞ্জন এক আবেগমথিত ভাষণে হিন্দু-মুসলমান সকলকে কাছে টেনে নেন৷ সম্মেলনের প্রতিনিধিরা এবং প্রকাশ্য সভায় বেঙ্গল প্যাক্ট দারুণভাবে সমর্থিত হয়৷ একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়৷
এই ঘটনার বাস্তব প্রভাব দেখা গেল পরবর্তী কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে৷ ১৯২৪ সাল৷ জেতার কথা সুরেন্দ্রনাথ ব্যনার্জির৷ জিতে গেলেন চিত্তরঞ্জন দাশ৷ জিতেই ৩৩টি চাকরির মধ্যে ২৫টি দিলেন মুসলমান প্রার্থী৷ ডেপুটি মেয়র করলেন শহিদ সোহরাওয়ার্দিকে৷ ৫ জন অন্ডারম্যান নিযুক্ত হলেন৷ তার মধ্যে দু’জন মুসলমান৷
চিত্তরঞ্জন তখন পুরোপুরি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন৷ সারা ভারতে তাঁর নাম৷ তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি সর্বভারতীয় স্তরে পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন৷ কংগ্রেস অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন৷ চিত্তরঞ্জন রাজনীতিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঐক্যের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে চাইলেন৷ হিন্দু-মুসলমান উভয়ে যাতে সমমর্যাদায় কাজ করতে পরে সেদিকে নজর দিলেন৷ এই সময় তিনটি বিষয় লক্ষ করলেন–
ক) ১৯২১ সালের আদম সুমারিতে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি৷ মুসলমান ৫৪ শতাংশ, হিন্দু ৪৬ শতাংশ৷ খ) সরকারি পদে যাঁরা চাকুরিরত ছিলেন তাঁদের মধ্যে শতকরা ৩০ জনও মুসলমান ছিলেন না৷ তার চাইতে অনেক কম ছিল৷ গ) বাঙালি মুসলমানরা বিধান পরিষদ, বিধানসভা, ব্যবস্থাপক সমিতি, পৌরসভা সবেতেই চূড়ান্তভাবে সংখ্যালঘু ছিলেন৷ চিত্তরঞ্জন এই পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা ভেবেছিলেন৷ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যদি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে স্বরাজও আসবে না স্বাধীনতাও আসবে না৷
(ছয়)
এই জন্যই তিনি বেঙ্গল প্যাক্টের অবতারণা করলেন৷ ১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর রসা রেডের বাড়িতে বসে প্যাক্টের খসড়া তৈরি হয়৷ মূল কথাগুলি হল–
১) মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার পৌরসভাগুলিতে ৬০ ভাগ মুসলমান সদস্য এবং ৪০ ভাগ হিন্দু সদস্য হবে৷
২) সরকারি চাকুরিতে শতকরা ৫৫ জন মুসলমান ও ৪৫ জন হিন্দুর চাকরি হবে৷
৩) যতদিন মুসলমানরা সমান সমান না হবে ততদিন শতকরা ৮০ ভাগ মুসলমানদের জন্য বরাদ্দ থাকবে৷
তাছাড়া ধর্মীয় ব্যাপারে অনেকগুলো বিষয় আলোচিত হয়৷ যেমন মসজিদের সামনে কাঁসর-ঢোল বাজানো যাবে না৷ প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য কোনও শোভাযাত্রা আটকানো হবে না৷ গরু কোরবানি প্রকাশ্যে দেওয়া যাবে না৷ কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মনে আঘাত লাগে এমন কাজ কেউ করতে পারবে না৷ সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির কোকনদে এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয় এবং যথারীতি তা বাতিল হয়ে যায়৷ চিত্তরঞ্জন জানতেন এটাই হবে৷ তবুও তিনি খানিকটা মুষড়ে পড়লেন৷ এবারেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সম্মেলনের সময় এল পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে৷ বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কর্মী, কংগ্রেস নেতা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী, যার বাড়ি সিরাজগঞ্জে, যিনি রাজনীতিতে চিত্তরঞ্জনের বিরোধী ছিলেন৷ সবাই বুঝছেন শিরাজী সাহেবকে বাদ দিয়ে সম্মেলন হতে পারে না৷ জমিদার ও সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরি সহ আরও অনেকে শিরাজী সাহেবকে শান্ত করার পক্ষে আনার চেষ্টা চালালেন এবং সফল হলেন৷ শেষ পর্যন্ত শিরাজী সাহেব নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মেলনকে এবং চিত্তরঞ্জনকে সমর্থন করেন৷ হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিধি হয়ে এই সম্মেলনে যোগ দেন৷ চিত্তরঞ্জন এক আবেগমথিত ভাষণে হিন্দু-মুসলমান সকলকে কাছে টেনে নেন৷ সম্মেলনের প্রতিনিধিরা এবং প্রকাশ্য সভায় বেঙ্গল প্যাক্ট দারুণভাবে সমর্থিত হয়৷ একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়৷
এই ঘটনার বাস্তব প্রভাব দেখা গেল পরবর্তী কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে৷ ১৯২৪ সাল৷ জেতার কথা সুরেন্দ্রনাথ ব্যনার্জির৷ জিতে গেলেন চিত্তরঞ্জন দাশ৷ জিতেই ৩৩টি চাকরির মধ্যে ২৫টি দিলেন মুসলমান প্রার্থী৷ ডেপুটি মেয়র করলেন শহিদ সোহরাওয়ার্দিকে৷ ৫ জন অন্ডারম্যান নিযুক্ত হলেন৷ তার মধ্যে দু’জন মুসলমান৷ শরৎচন্দ্র বসু একজন অল্ডারম্যান হলেন৷ প্রধান কার্যনির্বাহী অফিসার রলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ তাঁর ডেপুটি হলেন হাজি আব্দুর রশিদ৷ একজন কংগ্রেস নেতা৷ চিত্তরঞ্জনের বেঙ্গল প্যাক্ট যে বাঙালি গ্রহণ করেছে এটা তারই প্রমাণ৷
(সাত)
আমরা এখন কথায় কথায় সত্তার রাজনীতির কথা বলি৷ তা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হয়৷ সমাধানের চেষ্টা হয়৷ সমাজে কে বড় কে ছোট, জাতি ধর্ম, মহিলা পুরুষ এসব নিয়ে আলোচনা হয়৷ চিত্তরঞ্জন কিন্তু ১৯২৪ সালেই বুঝেছিলেন সত্তার রাজনীতি কাকে বলে৷ কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনের পর দেশবন্ধু মনে মনে ঠিক করলেন প্রধান কার্যনির্বাহী অফিসার হবেন বীরেন্দ্র শাসমল৷ তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত নেতা৷ মেদিনীপুর জেলায় একটার পর একটা বড় বড় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিযেছেন৷ তিনি সম্প্রদায়ে মাহিষ্য৷ তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের শহুরে নেতাদের সঙ্গে মাটির যোগসূত্র৷ তিনি চিত্তরঞ্জনের পছন্দের মানুষ ছিলেন৷ কিন্তু তা হল না৷ কারণ কলকাতার উন্নাসিক কায়স্থ মধ্যবিত্ত নেতারা দল বেঁধে বাধা দিলেন৷ চিত্তরঞ্জনও পিছিয়ে গেলেন৷
আজও উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের ঘেরাটোপ থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি৷ রাজনীতিতে এগুলো এখন বেশি পরিমাণে এসে গেছে৷ কোনও কোনও সময় নেতারা যখন কুৎসিত মন্তব্য করেন তখন আরও হতাশ হতে হয়৷ কিন্তু শুধু হতাশ হলে হবে না আমাদের একটা সুষ্ঠু সমাধান খুঁজতে হবে৷ এ ব্যাপারে দেশবন্ধু ভেবেছিলেন সহাবস্থান৷ মর্যাদাদান৷ বিশ্বাসের কথা৷ আমাদের সেই পথে পা ফেলা দরকার৷ এ কথার কোনও বিকল্প নেই যে আমাদের সহাবস্থান অবলম্বন করতেই হবে৷ তাহলে একে অপরকে মর্যাদা প্রদান এবং বিশ্বাস প্রদান অবশ্য কর্তব্য৷ রাজনীতিতে যোগ দিয়ে চিত্তরঞ্জন প্রথমেই এটা বুঝতে পেরেছিলেন৷ বেশিদিন রাজনীতি করার সময় পাননি৷ ৮/৯ বছর তিনি রাজনীতিতে ছিলেন৷ অকাল প্রয়াণ তাঁর যাত্রাপথে ছেদ টেনেছে৷ কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি নিজেকে ‘দেশবন্ধু’ হিসাবে পরিচিত করেছেন৷ সারা দেশের মানুষ এই বিশেষণে তাঁকে অবলীলায় সম্বোধন করেছে৷
(আট)
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ১৯২০-৩০ এই দশ বছরে বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে মধ্যবিত্ত অংশের উদ্ভব হচ্ছে৷ ঢাকাতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে৷ ঢাকার নবাবরা বিশাল অর্থ ও জমি দান করেছেন৷ জগন্নাথ রায়চৌধুরী, তিনিও ঢাকার জমিদার৷ জগন্নাথ হল তৈরি তিনিই করে দিয়েছিলেন৷ যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিতে বহু হিন্দু নেতার যেমন বিরোধিতা ছিল, তেমনই মুসলমানদেরও ছিল৷ এই সময়কালের মধ্যে দেশবন্ধু’র বেঙ্গল প্যাক্ট মুসলমানদের মধ্যে আলোড়ন তোলে৷ এ কে ফজলুল হক, সোহারাওয়ার্দি, কাজি নজরুল, ড. শহিদুল্লাহ, মুজফ্ফর আহমেদ, মৌলভী মুজিবুর রহমান, আবুল হাশিম, আব্দুল হালিম মুসলমানদের মধ্যে মধ্যবিত্ত অংশের নেতা৷ এই সময়কালের মধ্যে দেশবন্ধুও প্রয়াত হয়েছেন৷ যে কথা বলার জন্য এত কথা বললাম তা হলো হিন্দু-মুসলমানে যে দ্বন্দ্ব এই সময়ে দেখা দিয়েছে তা দুই অংশের মধ্যবিত্তের স্বার্থের দ্বন্দ্ব বলে অনেকেই চিহ্নিত করেছেন৷ বেশির ভাগ মানুষই মনে করেন দেশবন্ধু বেঁচে থাকলে এমন হতো না৷
কাজি সাহেবের উদ্যোগে একটা শোক মিছিল হয়৷ সবাই খালি পায়ে পথ পরিক্রমা করেন৷ সবার সামনে ছিলেন কাজি নজরুল এবং এলাকার ইমাম সাহেবরা৷ পথ পরিক্রমা শেষে যে শোকসভা হয় তার সভাপতি হন একজন ইমাম সাহেব৷ কাজি নজরুল গান ও কবিতা পাঠ করেন৷
উচ্চবর্গের কংগ্রেস নেতারা যে দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্ট মানেননি তা বোঝা গেল দেশবন্ধু মারা যাবার পর৷ ১৯২৫ সালে তিনি প্রয়াত হলেন৷ তার কিছুদিন পর কংগ্রেস অধিবেশন বসল কৃষ্ণনগরে৷ সেখানেই সবাই হাত তুলে দেশবন্ধুর স্বপ্নের ঐক্যের সমাধি ঘটালেন৷
(নয়)
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রয়াণে শতবর্ষ চলছে৷ সেই সময়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এই ছোট প্রবন্ধটি লিখছি৷ কিন্তু আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলে বিষয়টি খুবই অসম্পূর্ণ থাকবে৷ এবার কাজি নজরুল ইসলামের জন্মর ১২৫ বর্ষ চলছে৷ কাজি নজরুলকে চিত্তরঞ্জন দাশ এবং বাসন্তী দেবী খুব ভালবাসতেন৷ বাসন্তী দেবীকে কাজি নজরুল মা বলে ডাকতেন৷ চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু সংবাদ কবিকে বিহ্বল করে তোলে৷ ৬টি কবিতা লেখেন চিত্তরঞ্জনকে স্মরণ করে কাজি সাহেব৷ তা চিত্ত-নামা নামে বই হিসাবে প্রকাশিত৷ একটি কবিতার কথা আগেই বলেছি৷ এবার–
‘নিন্দা-গ্লানির পঙ্ক মাখিয়া, পাগল, মিলন সেতু
হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে সেতু৷
জানি না আজিকে কি অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান
ঈর্ষা-পক্কে পঙ্কজ হয়ে ফুটুক এদের প্রাণ৷৷’
‘ইন্দ্রপতন’ বলে ২০০ লাইনের একটি কবিতা লিখলেন শ্রদ্ধা জানিয়ে৷ কবি তখন হুগলিতে থাকছিলেন৷ কাজি সাহেবের উদ্যোগে একটা শোক মিছিল হয়৷ সবাই খালি পায়ে পথ পরিক্রমা করেন৷ সবার সামনে ছিলেন কাজি নজরুল এবং এলাকার ইমাম সাহেবরা৷ পথ পরিক্রমা শেষে যে শোকসভা হয় তার সভাপতি হন একজন ইমাম সাহেব৷ কাজি নজরুল গান ও কবিতা পাঠ করেন৷
‘ইবরাহিমের মত বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া
কোরবানি দিলে সত্যের নামে, হে মানব-নবি হিয়া
ফেরেশতা সব করিয়ে সালাম, দেবতা নোযায় মাথা,
ভগবান-বুকে মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা৷
সহজেই বোঝা যায় পরম বৈষ্ণব চিত্তরঞ্জনকে মুসলমানরা কী চোখে দেখতেন৷ প্রয়াণের শতবর্ষে তাঁকে শত কোটি প্রণাম৷
ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত