আত্মজন

খবরটার জন্য তৈরি ছিল না সুলেখা বর্ষার নদীর মতো ভরাট আলোড়নের শব্দ বুকের মধ্য থেকে উঠে আসছিল অদ্ভুত এক বিষাদ মেশানো অনুভূতি শিরশির করছিল শরীর ঝরে যাওয়া সময়ের পৃষ্ঠা উল্টে একটা মুখই সেদিন ও দেখেছিল তা ওর ছেলে শিবুর

ব্যাপারটা বছর দুই গড়িয়ে গেছে তবু সুলেখার কাছে টাটকা বিয়াল্লিশ বছর কী এমন একটা বয়স! এই বয়সে ছেলেমেয়েরা আকছার বিয়ে-থা করছে নতুন সংসার পাতছে হইহই করে দিন কাটাচ্ছে আর তার ছেলে শিবু বিয়াল্লিশে পা রেখে মারা গেল আসলে মৃত্যু এমন একটা ব্যাপার যা কোন নিয়মকানুন সময় অসময়ের ধার ধারে না

তারপর এই সারদা আশ্রম তাও প্রায় বছর গড়িয়ে গেছে সরকারি আশ্রম যার তিনকূলে কেউ নেই অসহায় বিধবা, স্বামী থেকেও নেই তাদের জন্য এই সারদা আশ্রম ব্যারাকপুর রোডে নীলগঞ্জ সরকারি বাস ডিপো বাঁ হাতে রেখে এল প্যাটার্নের সাদা দোতলা বানি কয়েক বিঘে জমিতে ফুল ফলের গাছে লাল শালুকে ঢাকা পুকুর ইটের সুরকি বিছানো রাস্তা দু’ধারে মরশুমি রঙবেরঙ ফুল সবুজ ঘাসের মোলায়েম কার্পেট এক টুকরো শান্তির পৃথিবী 

স্বামী অতীন মারা যাবার পর যা কিছু ছিল তা দিয়ে চলছিল কোনরকমে অতীন প্রায়ই বলত—সুলেখা, ছেলেমেয়ে বড় আদরের কিন্তু একটা সময় ওরাও আর নিজের থাকে না পর হয়ে যায় আর সেই কষ্ট বেঁচে থেকে সহ্য করা কঠিন তুমি আর যাই করো নিজের সম্মানটুকু বজায় রেখো কোনদিন শিবুর সংসারে যেয়ে উঠো না ও মানসী, তিতিরকে নিয়ে সুখে আছে এটাই তো আনন্দের

তুমি বললেই তো হবে না শিবুর ইচ্ছা মানসীর দাবি এসব তুমি ঝেড়ে ফেলবে কী করে? ওরাও তো চায় বাবা-মা ওদের কাছে থাকুক তোমার কি ইচ্ছে করে না ছেলে-বৌমার কাছ থাকতে নাতিকে নিয়ে খেলতে সুলেখা নিজের দুর্বল জায়গাটা উল্টো করে জানিয়ে দেয় অতীনকে 

অতীন হাসে দমকা সে হাসির অভাস চোখেও ফুটে ওঠে– কী বললে যেন? ওরা চায় আমরা ওদের কাছে থাকি ওরা একটু সেবাযত্ন করুক নাতিকে নিয়ে ঠাম্মা-দাদুর জমিয়ে আড্ডা গল্প গুজব এসব আজকাল সিনেমাতেও হয় না সুলেখা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের কথা ভুলে যাও এখন ইন্টারনেট সাইবারর কাফে-এর যুগ বাবা-মা আছো, বেশ আছো দু-চার দিন এসে ঘুরে বেড়িয়ে যাও দ্যাটস্ অল

বৌমা, শ্রদ্ধা ভালবাসা যাই বল না কেন, সম্পর্ক টিকে থাকে হৃদয়ের উদারতায়। পারস্পরিক বিশ্বাস সহমর্মিতায়। এই যে শিবু আমার ছেলে। কষ্ট করে ওকে আমরা মানুষ করেছি। ও ভালো আছে, সুখে আছে এতেই শান্তি। যদি মাকে ওর কিছু করার থাকে করবে, না করলেও কিছু বলার নেই। সন্তান মা-বাবাকে দেখবে এটা আইন করে হয় না। তার জন্য শ্রদ্ধা-ভালোবাসার একটা গোপন টান দরকার। সেটা রক্তের পরিচয়ে নয়। ভেতর থেকে আসে।

তোমার যতসব আজগুবি চিন্তাভাবনা সুলেখা প্রতিবাদ করে এসব তো বিদেশের কালচার আমাদের ছেলেমেয়েরা এখনও এতটা স্বার্থপর মেকানিক্যাল হয়নি তুমি বড্ড বেশি বেশি বল এই তো শিবু চেন্নাইয়ে থাকলেও ফোন করে কেমন আছি জিজ্ঞেস করে টাকার কথা অবশ্য ও কিছু বলে না আমারও প্রয়োজন নেই, বলি না বললে ঠিকই পাঠাবে

পাঠাবে তো বটেই তবে একবার দু’বার তারপর ফোন বন্ধ সম্পর্কের ইতি 

লোকটা কি আগে থেকে সব জানত? না হলে কথাগুলো এভাবে মিলে যায় কী করে?

অতীতের ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন আর স্মৃতি আজ সকালে আবার উঠে আসছে শিবুর মৃত্যুর তারিখ কি হঠাৎ হানা দিল বুকের গভীরে? পুরনো ব্যথা খুঁচিয়ে কী লাভ ছেলের মৃত্যু তো স্বামীর চেয়ে বড় আঘাত কিন্তু কই, আজ যে শুধু অতীনের কথা বারবার মনে আসছে চোখ ছাপিয়ে যে জল তাও বুঝি অতীনের জন্য

বাবার মৃত্যুর পর শিবু চেন্নাই থেকে এসে শ্রাদ্ধশান্তি যা করণীয় সব করল মানসী বলল, মা এবার তুমি আমাদের সঙ্গে চল আমি আছি তিতির আছে তোমার অসুবিধা হবে না জায়গাটাও ভাল পণ্ডিচেরি কাছ শ্রীঅরবিন্দের আশ্রমে যেয়ে দু-একদিন বেড়িয়েও আসতে পারবে

কিন্তু মা, বাড়ি ঘরদোর ফেলে যাব কেমন করে? তোমার বাবা এই বাড়িতে জীবন কাটিয়েছেন শিবুর জন্ম এখানে বিয়ে হয়ে আমি এ বাড়িতে এসেছিলাম সে সব স্মৃতি মুছে ফেলে কি করে আমি যাব? ভাড়া বাড়ি হলে কী হবে, ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট

মা যখন যেতে চাইছে না তখন জোরাজুরি করে লাভ নেই মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে নিজের জায়গা ছেড়ে যেতে চায় না ওটাই তার নিশ্চিন্ত আশ্রয় আরামের জায়গা তাই মাকে টেনে নিয়ে গিয়ে লাভ নেই মানসী যতদিন চায় মা এখানে থাকুক অসুবিধা হলে তখন দেখা যাবে 

একটা কথা তোকে বলা হয়নি, ছেলের কথার মাঝে কথা বলে সুলেখা, তোর বাবার টাকাপয়সায় আমার চলে যাবে কিন্তু, আমি একটা লোক, ঘর ভর্তি এত জিনিস কী হবে বলতো? তোরা সব নিয়ে যায় আমি আজ আছি কাল নেই কী হবে এইসব জঞ্জাল রেখে

এত জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া মুশকিল তার থেকে বিক্রি করে দেওয়া ভালো

তাই কর বাবা তুই থেকে যা করার করে যা 

ফ্রিজ থেকে বাসনকোসন সবই প্রায় জলের দরে বিক্রি করে দিল সুলেখা এসবে তার আর কোন প্রয়োজন নেই জীবনটাকে শুরুর দিনে সে নামিয়ে আনতে চায় শুধু দু’বেলা দু’মুঠো ভাত আর রাতে একটু শোবার আস্তানা 

মা এভাবে সন্ন্যাসীর মতো বাঁচা যায় নাকি? তোমার কত সাজগোজ শখ শৌখিনতা ছিল সব ছেড়েছুড়ে যদি থাকতেই হয় তাহলে আমরা কী দোষ করলাম? মানসীর গলার শব্দ হাহাকার শোনায় 

বৌমা, শ্রদ্ধা ভালবাসা যাই বল না কেন, সম্পর্ক টিকে থাকে হৃদয়ের উদারতায় পারস্পরিক বিশ্বাস সহমর্মিতায় এই যে শিবু আমার ছেলে কষ্ট করে ওকে আমরা মানুষ করেছি ও ভালো আছে, সুখে আছে এতেই শান্তি যদি মাকে ওর কিছু করার থাকে করবে, না করলেও কিছু বলার নেই সন্তান মা-বাবাকে দেখবে এটা আইন করে হয় না তার জন্য শ্রদ্ধা-ভালোবাসার একটা গোপন টান দরকার সেটা রক্তের পরিচয়ে নয় ভেতর থেকে আসে 

শাশুড়ির কথায় মানসী নিজেও যে মা সেই উপলব্ধিতে সুলেখার বুকের কষ্টটা বুঝতে পারে

আমি কথা দিচ্ছি মা, তোমার কোন কষ্ট হবে না আমাদের সঙ্গে চল সবই তো বিক্রিবাট্টা করে দিলে ফাঁকা ঘরে একা এ বয়সে কী দরকার কষ্ট করার

কষ্ট! মলিন হাসল সুলেখা জীবন তো কয়েকটা বছরের তার মধ্যে সুখশান্তি কষ্ট সবই যে থরে বিথরে সাজানো থাকে বৌমা তুমি একটা নেবে অন্যটা বাদ দেবে তা তো হয় না তুমি আমি কেন, কেউ বাদ দিতে পারে না তাই তোমরা যাও আমি ভালই থাকব তেমন অসুবিধা হলে তোমরা কী আর ফেলে দিতে পারবে? সুলেখার কথায় পুরনো কষ্ট ফের বেরিয়ে আসে 

শিবু জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করছে পরশু চলে যেতে হবে তার মধ্যে ওদের কথাও কানে আসে ওর শরীরের মধ্য দিয়ে অদৃশ্য তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে সুলেখার কথায় সে স্থির ভাবে কাজ করতে পারে না নিজের বউ ছেলের জন্য সে তো চব্বিশ ঘণ্টাই ভাবে কিন্তু বাবা-মার জন্য দায়দায়িত্বে সে কতটুকু ঘাড় পেতেছে বরং চোখ বুঁজে দূরে থাকার ছলে দায় এড়িয়েছে এই যে কত কিছু বিক্রি হল সে টাকার বেশির ভাগটা মা যখন নাতি আর বৌমার নাম করে ওর হাতে তুলে দিল, কই, সে তো বলতে পারল না— এটা কী করছ মা? এ টাকা তোমার আমি কিছুতেই এ টাকা নিতে পারব না বরং টাকাগুলি পেয়ে মনে মনে খুশিই হয়েছিল মায়ের স্নেহ না বোকামি কোনটা ঠিক? এসবও তো সে ভেবেছিল

মা, তুমি যখন যাবে না আমার বলার কিছু নেই তবে যখন যা প্রয়োজন জানিও বাবা যতদিন ছিলেন জানতে চাইনি এখন তুমি একা আমারও দায়িত্ব আছে

এই যে কথাটা বললি শিবু, এর থেকে বড় শান্তি আর কিছু নেই আমি ভালই থাকব রে, দাদুভাইকে মাঝে মাঝে নিয়ে আসিস ওকে দেখলে বুকটা জুড়িয়ে যায়

ঠাম্মা, তুমি আমাকে একটুও ভালবাস না বলে, তিতির সুলেখার গলা জড়িয়ে ধরে

ফাঁকা ঘরে দেওয়ালে রবারের বল শট করে ফুটবল খেলছিল ছেলেটা কি খেয়ালে খেলা বন্ধ করে সুলেখার গলা দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরে

বট, অশ্বত্থ, শিমুল, যজ্ঞডুমুর, নিম, বাবলা গাছের সঙ্গে একই সংসারে বেড়ে উঠেছে কৃষ্ণচূঢ়া, সোনাঝুরি, অর্জুন। অন্ধকারে এদের নিকষ কালো শরীর, খোলা হাওয়ার আস্ফালন আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পরতে পরতে ওকে ভাললাগার গভীরে ঠেলে দেয়। ওর মনে হয় এই গহীন আঁধারে একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দ বাতাসের গান সবকিছুতে জড়িয়ে আছে মানুষের সুখ দুঃখের অনুভূতি। আর কী অদ্ভুত! এই অভিজ্ঞতা ওর আগে কখনও হয়নি। এখানে এসে ও বুঝি পাল্টে যাওয়া নতুন মানুষ। 

নাতির গালে একটা লম্বা চুমু দিয়ে সুলেখা বলে— এই হল আমার বীরপুরুষ যে একদিন ঠাম্মাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে

কোথায় ঠাম্মা? তিতিরের দু’চোখে বিস্ময়

কেন, সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে যেখানে থাকবে মস্ত এক রাজপ্রাসাদ দাস-দাসী হিরে-মুক্তো আর একটা ফুটফুটে রাজকন্যা যে আমার তিতির রাজকুমারকে বিয়ে করবে

ধ্যাৎ ঠাম্মা, তুমি যে কী বল! এখন তো হ্যারি পটার, টিনটিন, হার্জ, অ্যাসটেরিক্স-এর যুগ তোমার ওই রাজকন্যা রাজপুত্তুর একদম চলবে না

বেশ তো, না হয় না-ই চলল কিন্তু তিতির সাহেব তো মেমকে আনতে পারবে

ঠাম্মার কথায় তিতির প্রাণ খুলে হাসে ওর চোখ ছোট হয়ে যায় আর সেই প্রাণখোলা হাসি সুলেখার জীবন পূর্ণ করে তোলে

বেশ তো কাটছিল দিনগুলি হঠাৎ খবরটা এল শিবু আর নেই মাত্র বিয়াল্লিশ বছরে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে একটা তাজা জীবন শেষ হয়ে গেল মানসী আর তিতিরের জন্য চিন্তা হয়নি সুলেখার ছেলের চাকরি বৌমা পাবে টাকা-পয়সার অভাব হবে না তবু এতবড় একটা শোক মানসী আর তিতিরের পক্ষে সামলানো খুবই কষ্টের মা হয়ে সুলেখার কী কষ্ট হচ্ছে না? ভীষণ হচ্ছে তবু একজন দুঃখী নারীকে এই আঘাত নতুন ভাবে বাঁচার প্রেরণাও দিচ্ছে 

অনুরাধা মিত্র ডাকসাইটে বিধায়ক আবার এলাকার কাউন্সিলর খবরটা পাড়ায় চাউর হতে দলবল নিয়ে হাজির 

আমরা আছি সুলেখাদি ভেঙে পড়বেন না পার্টিকে বিপদে আপদে সবসময় পাবেন যদি কোন সাহায্যের দরকার হয় বলতে পারেন

অনুরাধা, আমি জানতাম তুমি আসবে তুমি এলাকার বিধায়ক শুধু নও, সকলের বাড়ির লোক তাই তোমাকে সব কথা বলা যায় আমি আর নিজের খরচ, বাড়ি ভাড়া চালাতে পারছি না ছেলে চলে গেল বৌমার গলগ্রহ হতে চাই না মহিলাদের জন্য থাকার সরকারি বৃদ্ধাশ্রমের একটা ব্যবস্থা করে দাও যে কয়টা দিন বাঁচি সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই একা ঘরে এতবড় একটা শোক নিয়ে কী করে থাকা যায়, তুমি বল?

কিচ্ছু চিন্তা করবেন না সুলেখাদি এটা আমি করে দেব আমার নিজেরও তো একটা দায়িত্ব আছে 

কথা রেখেছিল অনুরাধা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে কাগজপত্র সইসাবুদ হয়ে বিকাশ ভবন রাইটার্স বিল্ডিংস ঘুরে সারদা আশ্রমে থাকার পাকাপাকি অ্যালটমেন্ট লেটার হাতে পেল সুলেখা অনুরাধাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেলে বলেছিল— সুলেখাদি, আপনাকে পাড়ায় মিস করব এটা ভাবতেই খারাপ লাগছে নীলগঞ্জের কাছে সারদা আশ্রম জায়গাটা ভাল বেশ খেলোমেলা দেখবেন ভাল লাগবে

উত্তরে সুলেখা কিছু বলতে পারেনি কৃতজ্ঞতায় চোখ দুটি শুধু ভিজে গিয়েছিল 

প্রথম যেদিন পা রেখেছিল সেই দিনটির কথা এখনো মনে আছে চারপাশে ঝাঁটি জঙ্গল অচেনা পাখির ডাক রাস্তার ধার ঘেষে গভীর নয়নজুলি ঘাস বনে উড়ে বেড়াচ্ছে গঙ্গাফড়িং, রঙিন প্রজাপতি এক দঙ্গল ছাড়া গরুর দলের সঙ্গে ছাগলের পাল চরে বেড়াচ্ছে সবুজ বনের আনাচে কানাচে সুলেখা ঠায় বসে থেকে শুধু দৃশ্য দেখে যায় কখন যে রাত গড়িয়ে গভীর হয় টের পায় না বট, অশ্বত্থ, শিমুল, যজ্ঞডুমুর, নিম, বাবলা গাছের সঙ্গে একই সংসারে বেড়ে উঠেছে কৃষ্ণচূঢ়া, সোনাঝুরি, অর্জুন অন্ধকারে এদের নিকষ কালো শরীর, খোলা হাওয়ার আস্ফালন আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পরতে পরতে ওকে ভাললাগার গভীরে ঠেলে দেয় ওর মনে হয় এই গহীন আঁধারে একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দ বাতাসের গান সবকিছুতে জড়িয়ে আছে মানুষের সুখ দুঃখের অনুভূতি আর কী অদ্ভুত! এই অভিজ্ঞতা ওর আগে কখনও হয়নি এখানে এসে ও বুঝি পাল্টে যাওয়া নতুন মানুষ 

সংসার কেমন বিচিত্র জায়গা সবাই সকলের জন্য আবার কেউ কারো নয় অতীন যতদিন বেঁচেছিল শিবু যখন ছোট ছিল তখন মনে হত এরাই ওর ভবিষ্যৎ ছেলে মানুষ হবে কেউকেটা হয়ে বাবা-মা’র দুঃখ দূর করবে সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে আর ওরা তখন তোফা থাকবে

অতীন হাসত সুলেখার ছেলেমানুষিতে

তুমি একশ বছর আগের যুগে বাস করছ সদাসত্য কথা কহিবে কভু মিথ্যা বলিবে না এসব কথা এ যুগে অচল শিবু তোমার ছেলে হতে পারে সে তোমার দায়িত্ব নেবে কেন? সে নেবে তার বউ ছেলের দায়িত্ব এখনকার ছেলেমেয়ে বোকা নয় আগে থেকে তৈরি থাকলে কষ্ট পাবে না নিজের মনকে বোঝাতে পারবে, এ তো জানাই ছিল

কিন্তু মানুষের মন বলে তো একটা জিনিস আছে অতীন সেটা মানতে না চাইলেও সুলেখা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে না যে ছেলেকে কোলে পিঠে করে গড়ে তুলেছে যার জন্য প্রতিদিন ত্যাগ আর বঞ্চনায় নিজেকে রেখেছে তারা এত স্বার্থপর নির্মম হয় কী করে? দিনকালের আবহাওয়াটাই কেমন পাল্টে গেল শুধু পাশ্চাত্য অনুকরণ টাকার পিছনে ম্যারাথন রেস ভোগবাদী জীবন এ যেন শিকড়হীন ঐতিহ্যহীন এক রোবট নিজেই অবাক হয় সুলেখা আর সেই সন্তানের মা সে

এখন পিছুটান নেই অতীন কবেই চলে গেছে শিবুও নেই তাই অনেকটা হালকা হয়ে গেছে সে হঠাৎ অন্ধকারে সোনাঝুরি পাতায় ফরফরানি শব্দ কোন রাতচরা পাখি হয়তো এডাল ওডালে লাফিয়ে পাতা থেকে রাতের শিশির ঝরাচ্ছে

তিতির কি তার বাবার মতো হবে? সুলেখার বুকটা কেঁপে ওঠে না, ও বাবার মতো হবে না তিতির হবে ওর দাদু-ঠাম্মার মতো এই তো ক’দিন আগে নিজের হাতে চিঠি লিখেছে চিঠি লিখতে গেলে ওর অক্ষর বেঁকে যায় বাঁকতে বাঁকতে বেঁকে চুরে শব্দে আবেগে মিলেমিশে নদী হয়ে যায় 

‘ঠাম্মা, আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ আমি কিন্তু তোমার সেই বীরপুরুষ একদিন ঠিক তোমাকে বন্দি করে নিয়ে আসব আর কোনদিন আমাকে ছেড়ে পালাতে দেব না বাবা বড্ড বোকা ছিল আমি কিন্তু তোমার মতন তাই আমার ভুল হবে না সারদা আশ্রম আমাকে সবসময় টানে একদিন ঠিক চলে যাব

যে ছেলে এই চিঠি লেখে সে কি শিবুর ছেলে? হতে পারে না ও সুলেখার নাতি অতীনের বড় আদরের দাদাভাই শুকনো পাতা হাওয়ায় টানে এলোমেলো উড়ছে জঙ্গলের মধ্য থেকে ভেসে আসছে বুনো ফুলের গন্ধ সুলেখা টের পায় তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রাণের চারাগাছ সেই বীজ কে ফেলেছিল অতীন না সুলেখা? এই মুহূর্তে শিবুর মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে নিরুচ্চারিত আশ্চর্য চোখে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে সুলেখা ছেলেটা সত্যি কি এত বোকা ছিল? মনে হয় না নিজে চলে যাবে বলে তিতিরকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে রেখে গেছে এই চারাগাছ তো তারই রোপন করা ভেতরের প্রসন্নতায় মন ভরে যায় সুলেখার

অনুরাধা বলেছিল, সারদা আশ্রম যাঁর নামে তিনি জগতের মা মার কাছে থাকলে কারো কষ্ট থাকে না তাই সুলেখাদি আপনি আনন্দেই থাকবেন দেখবেন সকলের সঙ্গে বাঁধা পড়ে যাবেন নতুন সংসারে

সেটা টের পেতে বেশি সময় লাগেনি এখন সুলেখা সবার দিদি সবকাজে এমনভাবে জড়িয়ে থাকে কোথা দিয়ে দিন যায় রাত আসে টের পায় না তবু অন্ধকার রাতে জঙ্গল দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের গান, ঝরাপাতার খসখসানি শব্দে যখন নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে, ওর মনে হয় এত শান্তির জায়গা আর কোথাও নেই সে বুঝি মায়ের কাছ ফিরে এসেছে 

ইতিদি বলল— সুলেখা, অন্ধকারে একা বসে আছিস চোখে জল, কী ব্যাপার? ছেলের জন্য এখনও কষ্ট? মানুষ তো চিরদিন বেঁচে থাকে না রে 

ইতিদি, আমি কাঁদছি আমারনাতি তিতিরের জন্য এ কান্নায় আমার দুঃখ নেই 

দুঃখ নেই, তবে কাঁদছিস কেন? আমাকে লুকিয়ে কী লাভ

জানো ইতিদি, এই অন্ধকারে বসে যখন নিজের কথা ভাবছিলাম তখন বারবার তিতিরের কথা মনে পড়ছিল হঠাৎ কেন জানি নিজেকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে নতুন করে সব মানুষের পুরনো খোলস ফেলার প্রয়োজন আছে ইতিদি তাতে জীবনটা সুন্দর হয়ে ওঠে আমি পুরনো খোলস এতদিনে পাল্টাবার সুযোগ পেয়েছি তাই হঠাৎ আসা আনন্দের ঢেউ আমাকে কাঁদিয়ে ছেড়েছে আর এজন্য আমি নই, দায়ী ওই পুঁচকে ছেলেটা 

ইতি বোঝে সুলেখার মধ্যে এখন অন্য অনুভূতি ওর মনের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে এক দস্যি দামাল বীরপুরুষ তাই ফোটা ফোটা অন্তহীন চোখের জলে ঝরে পড়ছে আনন্দের বিন্দু আর সেই জলের দাগে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রাণে বেঁচে ওঠার এক আশ্চর্য সুন্দর জীবন

                                                 অঙ্কনঃ দেবাশীষ দেব