আসর বেশ জমে উঠেছে। মাসিক সাহিত্য আড্ডা। বছরের শেষ দিনের আড্ডায় জমায়েতটা বরাবরই বেশি হয়। ব্যারেজের বালির চরায় শীতের রোদ্দুর গায়ে মেখে সাহিত্যের সম্মেলন। আয়োজনে কোনো খামতি নেই। বেশ কয়েকটা পাতন, বয়স্ক এবং নিচে যারা বসতে পারেন না ; তাঁদের জন্যে খান বিশেক চেয়ার। মাইক্রোফোন সাউন্ডবক্স দুটো টেবিল আর একটা হুইসেল। ঠিক ন‘টায় নদীর ঠান্ডা জলে স্নান করে খালি গায়ে গামছা কোঁচা মেরে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে উদ্বোধক মশাই হুইসেল বাজিয়ে উদ্বোধন করবেন সাহিত্য আড্ডার। তিনবার বাঁশি বাজানো হবে; ঠিক স্পোর্টস এর মাঠে– রেডি– স্টেডি– গো–এর মতো। করতালির ধ্বনিতে উড়ে যাবে চারপাশের বসে থাকা কাকগুলো। সভায় উপস্থিত বরিষ্ঠজন একটি শাল জড়িয়ে বরণ করে নেবেন উদ্বোধককে।
বছর শেষের আড্ডার নিয়মকানুন বেশ কড়া। আধঘন্টা দেরি করলে পঞ্চাশ টাকা, একঘন্টা দেরিতে একশো; তার বেশি দেরি হলে দু‘শো টাকা ফাইন এবং বছরের শুরু থেকে তিনমাস সাহিত্য আড্ডা থেকে সাসপেন্ড।
বাঁধাকপি ধনেপাতা পেঁয়াজকলি দিয়ে গরম গরম পকোড়া আর মুড়ি দিয়ে শুরু, তারপর চা। মোবাইল ভাইব্রেশন মোডে থাকবে।
এবারে দুপুরে খাবারের মেনু – ভাত, বেগুনি, মুগডাল, পাঁচমিশালি সবজি, মাংস, চাটনি, পাঁপড়, নলেনগুড়ের রসগোল্লা; হজমোলার একটি প্যাকেট।
আজকের উপস্থিতি নব্বই জনের। কবিতা বারো লাইনের, অনুগল্প দেড়শ শব্দের,আবৃত্তি তিন মিনিটের; বক্তাদের জন্যে সময় তিন মিনিট। সাহিত্য সভার সম্মানী একটি করে বাঁকুড়ার গামছা। নব্বইয়ের মধ্যে জনা তিরিশেক শ্রোতা।
রান্নার দেখভালের কিছু, বাকি সাহিত্যের আসরে। কিছু ভালো লেখা, কিছু অখাদ্য, কিছু চারপেয়েরও অখাদ্য; এইসব মিলে-মিশেই সংসারের সামাল দেন সঞ্চালকমশাই।ভালো লেখা পাঠের যেমন তালি আছে, খারাপের পরেও তালি আছে; তবে দুই তালির মধ্যে ফারাকও আছে। ওই তালির শব্দেই বুঝে নিতে হবে – লেখক কয়প্রকার।
আসর চলছে জমিয়ে। আর একদিকে রান্নার কাজ। আশপাশের গ্রাম থেকে সহযোগী কাজের মানুষ জুটে যায়। জল আনা, সবজি কেটে দেওয়া, বাসন ধুয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাজের জন্যে। কিছু টাকার বিনিময়ে ওরা সারাদিনই পরিশ্রম করে। খাবার এবং মশলাপাতি বাঁচলে খুশি মনে নিয়ে যায়; ওটা ওদের বাড়তি পাওনা। আজও, তেমনি দু’জন জুটেছে। বাপ-মেয়ের জুটি। মেয়েটির বয়স বছর কুড়ি বাইশের মধ্যে,বাবা পঞ্চাশের কাছাকাছি। দু’জনেই কাজে কম্মে বেশ পোক্ত। মেয়েটি মাঝে মধ্যেই আসরে এসে জিজ্ঞেস করে – “বাবু, একটি বার চা নিয়ে আসি। আপনারা তো পড়াশুনা করতিছেন; তাই বলছিলম আর কি।”
কাজল পঙ্কজ অতনু রাজীব সুতনুরা বলে ওঠে – “বাঃ, বেশ ভালো বলেছিস তো তুই। তা তুই কি করে বুঝলি যে,আমাদের চা দরকার!” মেয়েটি বলে- “বাবু,মোদের এই পড়াশুনার লোকজনেরা, যারা এইখানে আসে, তাদের সাথে কাজ করতিই বেশি ভালো লাগে; আমরা বাপ-বিটিতে কাজ করতি করতি বেশ তোমাদের কথাগুলি শুনি, কত ভালো ভালো, নরম নরম কথা কও তোমরা; সবগুলো বুঝতে লারি,তবে অনেকগুলাই বুঝি।”
সুতনু জিজ্ঞেস করে – “হ্যাঁরে, তোর নাম কি!” মেয়েটি বলে –“ও বাবু , তেমন কিছু বড় লয়, ছোটপারা নাম; সকলে মুনিই বলে; নামটা অবশ্যি ছিল মুনিয়া।”
অনুগল্প পাঠ করছে কাজল। কাজলের গল্প পাঠের শেষে সঞ্চালক পরের নাম ঘোষণা করবেন, হঠাৎ শেষের দিক থেকে মুনি দাঁড়িয়ে বলে ওঠে -“বাবু,আমি দু’টি কথা বলব!” সবাই মুনির এ-হেন কথায় একটু অবাকই হয়। সঞ্চালক বলে ওঠেন – “হ্যাঁ,বলনা, বল।
পঙ্কজ বলে –“বাঃ,বেশ সুন্দর নাম তো তোর। তা, হ্যাঁরে; তোকেও দেখছি – পায়ে মোজা পড়ে আছিস; তোর বাবাকেও দেখছি পায়ে মোজা পড়ে আছে। চটিটা খুলে শুধু মোজা পড়ে কাজ করছিস কেন! পায়ে চটিটা পড়ে কাজ করলেই পারিস। মোজাগুলো নোংরা হয়ে যাবে,ভিজে যাবে। মুনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে –“না বাবু, এইটেই ভালো। চটি পড়লে হাঁটাচলা করতে সুবিধা হয়না বালির ওপর। আর আদুল পায়ে বড় সুড়সুড় করে বালিতে। মোজাতেই সুবিধা বেশি।”
মুনির কথাগুলো শুনে ফনি বেশ মজা পায়,বলে –“বাঃ,তুই তো বেশ সুন্দর একটা শব্দ বললি – ‘আদুল পায়ে’; হ্যাঁরে, ওটার মানে কি!” মুনি খিলখিল করে হেসে ওঠে – “ওমা, জাননি বুঝি; আদুল মানে হল গিয়ে খালি, যার পরনে কিছু রইবে না, তারে আদুল বলে। নাও, দেরি হতেছে; তা‘লে চা চাপাই গে। তোমরা পড়াশুনা কর।”
দুপুরের খাবার পর্ব শেষ হলো।রান্নার জিনিসপত্র সব মোটামুটি গোছানো হয়ে গেছে। মুনি আর ওর বাবার কাজকর্মও প্রায় শেষ। সমাপ্তি পর্ব চলছে।মুনি এবং মুনির বাবাও শেষের দিকে বসে আছে শ্রোতার আসনে।
অনুগল্প পাঠ করছে কাজল। কাজলের গল্প পাঠের শেষে সঞ্চালক পরের নাম ঘোষণা করবেন, হঠাৎ শেষের দিক থেকে মুনি দাঁড়িয়ে বলে ওঠে –“বাবু,আমি দু‘টি কথা বলব!” সবাই মুনির এ-হেন কথায় একটু অবাকই হয়। সঞ্চালক বলে ওঠেন – “হ্যাঁ,বলনা, বল। খুব ভালো তো। বল তোর কথা। কী, আর কিছু টাকা লাগবে! বেশ তো, দেব আমরা। তোরা বাপ-মেয়ে সারাদিন ধরে অনেক কাজ করেছিস। তোরা তো কমই চেয়েছিস।আমরা তোদের এমনিতেই আরো কিছু বেশি টাকা দেব।”
মুনি বলে-“নাগো, কথা কথা; যা বুলেছি,তার কমও লিব না, বাড়তিও না। আমার একটা অন্য কথা ছিল; ওই যে,তোমরা বলতিছ না, অমন পারাই দু’টি কথা বুলব।”
আসরের সবাই একসাথে বলে ওঠে –“হ্যাঁ,নিশ্চয়ই বলবি; আয়, এদিকে সামনের দিকটায় আয়। মাইক্রোফোনের সামনে এসে বল। আমরা সবাই শুনব।”
মুনি মুখটা তুলে সামনে সবার দিকে তাকায়। পেছনে বাপটাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মুনি এগিয়ে আসে, মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে, আমতা আমতা করে বলতে শুরু করে –“আজ্ঞে, ওই যে আগের বাবুটা একটা পড়া বলতেছিল না; ওই কুকুরটার কথা। তা, আমাদেরও একটা ভুলো আছে;ওটা তেপায়া বুঝলেন। তবে, তেপায়া হলি কি হবে, ও চারপেয়ে ক্যানে ছ‘পেয়েকেও হারাই দিবে। বুঝলেন, ভুলোটা যখন এইটুকুন ছিল, কুঁই কুঁই কুঁই কুঁই করত; ত্যাখনই আমি দেখেছি,ওটার তেপায়া। আমি তো বেশ অবাকই হইছিলাম। ইটো কী করে হলো! তারপর, আর একটা কথা কি বুঝলেন – ওর মায়ের ছ ছ‘টা বাচ্চার মধ্যে সবগুলা পট পট করি মরে গেল। আর বাঁচবি তো বাঁচ; ওই তেপায়াটাই বেঁচে গেল। অনেক যত্ন আত্তি করে ওটার বড় করলাম। ওরে ,অনেক বুঝোলম – বুঝলি, তোকে, তেপায়াতেই খেল দেখাতে হবে। আমি ছুটলে, ভুলোও আমার সঙ্গে ছুটতো। খুব জোর ছুটতম, ভুলোও ছুটতো। ঝপ করি থেমে যেতুম, ভুলোও থেমি যেত। টপাং করি লাফ দিতম, ভুলোও লাফ দিত। আর একটা কথা কি জানেন!”
সবাই বলে উঠলো –“বল,বল, আর একটা কথা কি বল!”
মুনির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে ; বলে – “আর একটা কথা হতিছে; ভুলোর যেটা মা; সেটাও তেপায়া ছিল বুঝলেন।”
সবাই একসাথে বলে ওঠে –“সে কি রে ! ওর মা‘টাও তেপায়া!”
মুনি ওর বাবার দিকে হাঁক পারে – “ও বাপ, একটিবার ইদিকে আয় দেখিনি।”
মুনির বাপ, সঙ্গে ভুলো আর ভুলোর মা এসে দাঁড়ায় মুনির পাশে। মুনি বাবাকে বলে, “ বাপ, তোর মোজাদু’টা একবার খুল।”
মুনি বলে –“হ্যাঁ,বাবু; ওর মা‘টাও তেপায়া ছিল; কিন্তুক, অমনি ভুলোর পারাই ছুটে বেড়াত।কারও খ্যামতা ছিল না রেতের বেলা আমাদের ঘরকে আসার। আর একটা কথা কি বুঝলেন বাবুরা।” এবার সত্যিই অবাক হবার পালা। আবার কি আছে। গোটা আসরটা তাকিয়ে আছে মুনির দিকে। মুনি শুরু করে – “ওই ভুলোটাকে একটিবার ডাকবো বাবু! দ্যাখবেন – ক্যামন ছুটতি পারে। না ডাকলি ও কিছুতেই আসবেনি। সে আপনি মাংসের গোটা হাঁড়িটা দেখান ক্যানে, তাও লয়।”
এবার সবাই চেঁচিয়ে ওঠে – “ডাক ডাক, তোর ভুলোকে ডাক।” সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে; দ্যাখে – মুনির ডাক শুনে দূর থেকে বালির চরার ওপর দিয়ে বাঘের মতো পা ফেলে দূরন্ত গতিতে ভুলো আর ভুলোর মা ছুটতে ছুটতে আসছে। সামনে আসতেই নজরে পড়ে, তেপায়া ভুলো আর ভুলোর মা‘কে। হাঁফাতে হাঁফাতে ওরা দু‘জনে মুনির বাবার দু‘পাশে বসে। মুনি মাইক্রোফোনের সামনে বলে ওঠে –“বাবু, আর একটি কথা পড়ে রইছে। বলি তা‘লে!
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বল বল।” মুনির গলার স্বরটা এবার একটু ভারি হয়। স্বরটা নামিয়ে বলে- “শ্যাষ কথাটা হল কি জানেন! ভুলো আর ভুলোর মা যাদের কাছে থাকে; উদের যে মালিক,তার তিনটাও লয়, দু‘টাও লয়; দেড়খান পায়া ছিল। আর সব্বশেষ কথাটা হল গিয়ে কী জানেন বাবু!” মুনি আসরের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দ্যাখে – সবাই ক্যামন ,মাথা নিচু করে বসে আছে। মুনি বলে ওঠে – “বাবু, তা‘লে শ্যাষ কথাটা থাক। আপনারা কুনো রা কাড়ছেন না।” সম্বিত ফেরে সবার। সঞ্চালক বলে ওঠেন –“না না , বল বল; তোর শেষ কথাটা আমরা সবাই শুনব।”
“বুঝলেন গো বাবু, ওই যে ভুলো আর তার মা, আর তাদের মালিক; সেই মালিকের তিন তিনটা ব্যাটাছেলে হইছিল; আর সব ক‘টাই পট পট করে মরে গেইছিল। শ্যাষতক্কো, চারনম্বরটা য্যাখন হল – সেটা হল গিয়ে একটি বিটিছেলে।আর বিটিছেলেটা হল তো হলো; সেটাও হল গিয়ে দেড়পায়া।” কথাগুলো বলেই মুনি ওর বাবার দিকে হাঁক পারে – “ও বাপ, একটিবার ইদিকে আয় দেখিনি।”
মুনির বাপ, সঙ্গে ভুলো আর ভুলোর মা এসে দাঁড়ায় মুনির পাশে। মুনি বাবাকে বলে, “ বাপ, তোর মোজাদু‘টা একবার খুল।”
মুনির বাবা মোজাদুটো খোলে।একটা পায়ের হাঁটুর নিচে থেকে কৃত্রিম পা লাগানো।এবার মুনি ওর মোজাদুটো খোলে – মুনির পায়ের গোঁড়ালির ওপরের অংশ থেকে নিচেটা কৃত্রিম অঙ্গ।দুটো মানুষ আর আর দুটো কুকুর সামনে দাঁড়িয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে।
আসরের সবাই এক এক করে উঠে দাঁড়ায়। স্যালুট করে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সারমেয় আর মানবসন্তানকে।
অঙ্কনঃ দেবাশীষ দেব