দু-কাঠা জমির ওপর ছোট্ট একটা তিনতলা বাড়ি। তিনটে তলায় তিনটে ফ্ল্যাট। প্রোমোটারের তৈরি। নানা রকম খুঁতে ভর্তি।কিন্তু রং-চং করার পরে বাইরে থেকে দেখতে বেশ ভালোই লাগে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে প্রশান্তবাবুর হাতে কিছু টাকা এসেছিল,সেই টাকায় তিনতলার ফ্ল্যাটটা কিনে নিয়েছিলেন উনি। তারপর ভাডাটে বাড়ির পাট চুকিয়ে উঠে এসেছিলেন নতুন ফ্ল্যাটে। ওঁর সংসার বলতে এখন বুড়োবুড়ি এবং ছেলে আর ছেলের বউ।
ছেলে আর ছেলের বউ কল-সেন্টারে কাজ করে। দুজনেরই চাকরির সময়টা বেজায় লম্বা। রাতেও কাজ করতে হয়। বাড়িতে থাকার বেশির ভাগ সময়টুকু ঘুমিয়ে কাটায়। ছুটিছাটায় সিনেমা-থিয়েটার দেখে কিংবা এদিক-ওদিক বেড়ায়।
প্রশান্তবাবু সারাজীবন বিস্তর কষ্ট করেছেন,ঝঞ্ঝাট-ঝামেলাও কখনও ওঁর পিছু ছাড়েনি। কিন্তু অবসর নেওয়ার পরে নতুন এই ফ্ল্যাটে এসে উনি কিছুটা সুখশান্তির মুখ দেখেছিলেন। ভেবেছিলেন, এই ভাবেই বাকি জীবনটা কেটে যাবে।
ভোরবেলায় উঠে বেড়ান,ধর্মগ্রন্থ পড়েন,সামান্য কিছু লোক-লৌকিকতাও করেন। কিন্তু বছরখানেক বাদে বিদ্ঘুটে এক সমস্যায় ভীষণ ভাবে মুষড়ে পড়েছিলেন।
প্রশান্তবাবু দূরদর্শী মানুষ। যে-কোনও বিষয়কেই দূর ভবিষ্যতে নিয়ে গিয়ে দেখার ক্ষমতা আছে ওঁর। কোথাও সামান্য ধোঁয়া উঠতে দেখলেই বিরাট অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা করে থাকেন। অবিবেচকরা মানুক আর নাই মানুক,উনি জানেন ওঁর হিসেবে কখনও কোনো ভুল হয় না।
সেদিন তিনতলার বারান্দা থেকে নীচের দিকে তাকাতেই উনি ভয়ংকর এক বিপদের আভাস পেয়েছিলেন। নাকের ওপর চশমা এঁটে অনেকক্ষণ নীচের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন রীতিমত। নীচের একটুকরো জমিতে হাতদুয়েক মাপের একটা আমগাছের চারা। চারাগাছে লালচে-লালচে পাতা গজিয়েছে বেশ কয়েকটা।
প্রশান্তবাবু গাছপালা চেনেন। বুঝতে পারলেন চারাগাছটা ভালো জাতের কলমের গাছ। তার মানে এটা লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়বে। গাছের পাতাগুলোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। এর মধ্যেই গাছটার শিকড় মাটিতে বেশ গেড়ে বসেছে। দূর ভবিষ্যতের ছবি উনি খুব ভালো ভাবে দেখতে পারেন বলেই ওঁর অস্থিরতার মাত্রা অল্প সময়ের মধ্যে অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল।
একতলার ফ্ল্যাটটা কিনেছে মাঝারি মাপের এক সরকারি আমলা। লোকটা খুব একটা সুবিধের নয়, কিন্তু প্রশান্তবাবু সৌজন্যের সম্পর্ক রেখে চলেন।
দিনতিনেক ভালো ঘুম হল না প্রশান্তবাবুর। প্রতিদিনের রুটিন কাজের মধ্যেও কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিল।তুচ্ছ কারণে বউয়ের সঙ্গে কথা-কাটাকাটিও হল কয়েকবার। প্রশান্তবাবু বরাবরই একটু চাপা স্বভাবের মানুষ। সমস্যার কথা কাউকে বলে উত্যক্ত করতে চান না।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধানের তো একটা চেষ্টা চালানো উচিত। চতুর্থ দিন সকালে উঠে উনি শুকনো মুখে কিছুক্ষণ বেড়াবার পরে ফিরে এসে একতলার অর্ণব চৌধুরীর ফ্ল্যাটের ডোরবেল টিপলেন। দরজা খুললেন মিসেস চৌধুরী। অপ্রত্যাশিত অতিথিকে দেখে উনি প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘আসুন-আসুন ভেতরে আসুন।’
প্রশান্তবাবুও হাসলেন। ‘অসময়ে এসে পড়লাম, না ?’
‘না-না, অসময় হবে কেন? বসুন আপনি। চা খাবেন তো?’
‘তা একটু খেতে পারি।’
মিসেস চৌধুরী দ্রুত পায়ে শোবার ঘরে ঢুকে কর্তাকে পাঠিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিলেন।
মিস্টার চৌধুরী কেঠো হাসি হেসে বললেন, ‘বেড়িয়ে ফিরলেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’
‘শরীর ভালো তো আপনার?’
‘এখনও পর্যন্ত মোটামুটি ভালো।’
এই ফ্ল্যাটে এখন বোধহয় চায়ের ব্যবস্থাই হচ্ছিল, মিসেস চৌধুরী চটপট একটা ছোট ট্রেতে তিন কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে ফিরে এলেন।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশান্তবাবু বললেন, ‘যাতায়াতের পথে আপনাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় ঠিকই,কিন্তু সে ভাবে গল্পগুজব হয় না তো কখনোই। তাই ভাবলাম মিনিট দশ-পনেরোর জন্যে আপনাদের একটু বিরক্ত করে আসি।’
প্রতিবাদের গলায় মিসেস চৌধুরী বলে উঠলেন, ‘কী আশ্চর্য! বিরক্ত হব কেন? বেড়িয়ে ফেরার পথে সময় থাকলে মাঝেমধ্যে চলে আসবেন এখানে। ’
প্রশান্তবাবু চায়ের কাপে গোটাদুয়েক চুমুক দেওয়ার পরে বললেন, ‘আপনারা সামনের ওই টুকরো জমিটায় সুন্দর একটা ফুলের বাগান বানিয়েছেন—আপনাদের রুচির প্রশংসা করতেই হয়,কিন্তু—।’
প্রশংসার পরে একটা ‘কিন্তু’ জুড়লে শ্রোতারা একটু থমকে যাবেই। কেশে গলা পরিষ্কার করে প্রশান্তবাবু বললেন, ‘আপনারা ওই বাগানে একটা আমগাছের চারা লাগিয়েছেন দেখলাম—।’
মিসেস চৌধুরী বললেন, ‘ওটা আমরা লাগাইনি,ছেলে লাগিয়েছে। পল্টুর খুব গাছপালার শখ।’
প্রশান্তবাবু পকেট থেকে রুমাল বার করে শুকনো মুখ আরও শুকনো করে মুছে নিয়ে বললেন, ‘আমি বয়সে আপনাদের চাইতে ঢের বড়। বুড়ো বয়েসের দোষ থাকে অনেক, কিন্তু সবটাই দোষ নয়। পাকা মাথার দামটা তো অন্তত দেওয়া উচিত। ’
হেঁয়ালির মানে ধরতে পারলেন না শ্রোতারা।
প্রশান্তবাবুর গলার স্বর এবার আর একটু ভারী হয়ে উঠেছিল। বাড়ির ঠিক পাশেই যদি খুব বড় একটা গাছ থাকে বাড়ির ভিত কিন্তু কমজোরি হয়ে যায়। বাড়িটা উটকো একটা কন্ট্রাকটরের তৈরি।খুবই বাজে কাজ। একেবারেই শক্তপোক্ত নয়।এই বাড়ির ঠিক পাশেই যদি প্রকাণ্ড একটা গাছ থাকে—।’
মিসেস চৌধুরী ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, ‘প্রকাণ্ড গাছ কোথায়! ওটা তো এইটুকুন একটা চারা।’
হাসি দেখে আর কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন প্রশান্তবাবু। একট বাদে গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমি আজকের কথা বলছি না,ভবিষ্যতের কথা। গাছ আজ ছোট আছে ঠিকই,কিন্তু একদিন তো বড় হবেই। আমি গাছপালা একটু-আধটু চিনি।আমগাছের চারাটা দেখে মনে হচ্ছে—-এ-গাছ একদিন ঠিক এ-বাড়ির তিনতলা ছাড়িয়ে যাবে। গাছ যদি অত বড় হয়,একবার ভেবে দেখুন—- মাটির তলায় তার শেকড় কত দূর ছড়াবে! একেই তো পলকা একটা বাড়ি, তার ওপর ওই শেকড় ভিতের ভেতরে ছড়িয়ে পড়লে বাড়ি একেবারেই কমজোরি হয়ে যাবে। ভেঙে পড়াও অসম্ভব নয়।’ বলতে বলতে বেশ একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন প্রশান্তবাবু।
মিস্টার চৌধুরী লজ্জিত মুখে বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন।আমরা সত্যিই এতটা ভেবে দেখিনি। আপনি এ নিয়ে একদম ভাববেন না,চারাগাছটা আমরা তুলে ফেলে দেব।’
শুনে শান্ত হলেন প্রশান্তবাবু।তারপর দু-চারটে এ-কথা সে-কথা বলার পরে বিদায় নিলেন একসময়।
কিন্তু শান্তি তখনকার মতো এলেও পরের তিন দিনে প্রশান্তবাবুর অশান্তি মাত্রা ছাড়িয়ে বেড়ে গিয়েছিল। আমগাছের চারাটা এখনও তোলা হয়নি। কাল ভোররাতে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল, সেই জলে চারাগাছটা আরও তাজা হয়ে উঠেছে।
সন্ধেবেলায় আবার একতলার ফ্ল্যাটে এলেন তিনি। আজকেও দরজা খুললেন মিসেস চৌধুরী। আজকেও হাসলেন সেদিনের মতো, কিন্তু এই হাসির মধ্যে আগেকার সেই ঝলমলে ভাবটা ছিল না। প্রশান্তবাবু একট বুঝি উত্তেজিত হয়েই ছিলেন। কথা পাড়লেন সরাসরি। ‘আমগাছের চারাটা তো এখনও তোলা হল না!’
শুকনো মুখে জবাব দিলেন মিসেস চৌধুরী, ‘আপনি অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? চারাগাছ তো, যে-কোনও সময় তুলে ফেললেই হল।’
‘কিন্তু—-।’
‘ওইটকুন তো একটা গাছ,হয়ত দেখবেন নিজে থেকেই মরে গেছে একদিন। ব্যস্ত হবেন না আপনি।’
ভেতরে-ভেতরে একটু অস্থির হয়ে পড়েছিলেন প্রশান্তবাবু,কিন্তু নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, ‘ব্যস্ত হওয়ার কারণ আছে মা। কথায় বলে পথের কোনও কুকুরকে প্রতিদিন খেতে দিলে তার ওপরেও মায়া পড়ে যায়—কথাটা সত্যি। আমগাছের চারাটা প্রতিদিন দেখতে দেখতে ওর ওপরেও মায়া পড়ে যাবে তোমাদের। তখন আর তুলতে পারবে না। আর ওই যে বললে না—গাছটা একদিন নিজে থেকেই মরে যাবে—তা হওয়ার নয়। আমি গাছ চিনি,ও গাছের জান আলাদা। শেকড় মাটিতে গেড়ে বসেছে। তার ওপর বর্ষাকাল এসে গেল বলে।বর্ষায় ও গাছ লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়বে। সুতরাং আর দেরি কোরো না মা, গাছটা এক্ষুনি তুলে ফেল। আমি তুলে দিয়ে যাব কি?’
মিসেস সেন চমকে উঠে বললেন, ‘না-না, আমরাই তুলে ফেলব। আপনি ব্যস্ত হবেন না একদম।’
অস্থিরতার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল প্রশান্তবাবুর। ‘ব্যস্ত হওয়ার কারণ আছে বলেই ব্যস্ত হচ্ছি। সেদিন তো তোমাদের একটা মোটে কারণ বলেছিলাম। আরও অনেক কারণ আছে। এ গাছ বড় হলে বাড়ির ভিতই শুধু নষ্ট করবে না, আরও অনেক ঝামেলার সৃষ্টি করবে।’
অবাক হলেন মিসেস চৌধুরী। ‘কী ঝামেলা ?’
‘বাড়ির পুবদিকে এত বড় একটা গাছ থাকলে শীতকালে রীতিমত কষ্ট পেতে হবে আমাদের। ঘরে রোদ ঢুকবে না একটুও। শুধু শীতকাল বলে নয়,সব ঋতুতেই ঘরে রোদ ঢোকা দরকার। স্বাস্থ্যের পক্ষে দরকারি। তাছাড়া বিপদও আছে—।’
‘বিপদ!’
‘বিপদই তো। কালবৈশাখী উঠলে এই গাছের ডালের ধাক্কায় জানলার শার্সি ভাঙবেই। তেমন ঝড় উঠলে ডালপালা ভেঙে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়াও অসম্ভব নয়। তাই বলছিলাম কি—। ’
থামিয়ে দিয়ে মিসেস চৌধুরী বলে উঠলেন, ‘ঠিক আছে আপনি অত ভাববেন না, চারাগাছটা আমরা তুলে ফেলব।’
ভদ্রমহিলা আশ্বাস দিলেন,কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারলেন না প্রশান্তবাবু। মুখ শুকনো করে উঠে গেলেন তিনতলায়।
ওই আশ্বাস দেওয়ার পরে দেখতে দেখতে আরও বেশ কয়েকটা দিন কেটে গিয়েছিল, কিন্তু চারাগাছের গায়ে হাত দেয়নি কেউই। গাছ ইতিমধ্যে লকলক করে আরও কিছুটা বেড়ে গিয়েছে।
চারাগাছ যে হারে বাড়ছে ঠিক সেই হারে কমছেন প্রশান্তবাবু। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় ভদ্রলোকের ঘুম কমেছে,ইদানীং আবার হঠাত-হঠাত বুক ধড়ফড় করে ওঠে।প্রশান্তবাবু এমনিতেই কম কথা বলতেন,আজকাল বাড়ির লোকের সঙ্গে ধরতে গেলে কথাই বলেন না। আগে প্রতিদিন বেড়াতে যেতেন,এখন যান মাঝেমধ্যে।
তা,একদিন বেড়ানো সেরে বাড়ি ফেরার পথে প্রশান্তবাবুর সঙ্গে মিস্টার চৌধুরীর দেখা হয়ে গেল হঠাত। চৌধুরী সৌজন্যের হাসি হাসলেন,কিন্তু পালটা হাসি হাসতে পারলেন না প্রশান্তবাবু। দু-পা একসঙ্গে হাঁটার পরে বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, ‘আপনারা কিন্তু আমার কথায় গুরুত্ব দেননি একেবারে।’
‘কোন কথা?’
‘কোন কথা আবার, গাছটা আপনারা তুললেন না। লক্ষ্য করে দেখেছেন—এর মধ্যেই কত বড় হয়ে গেছে গাছটা!’
‘ওহ! ওই আমগাছের চারাটার কথা বললেন,ওটা একদিন কেটে ফেললেই হবে।’
‘কবে কাটবেন? কাটব-কাটব করেই এর মধ্যে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে!’ প্রশান্তবাবুর রাগ আর বিরক্তি ওঁর কথার প্রতিটি শব্দের গায়ে জড়িয়ে ছিল।
চৌধুরী এবার একটু অসন্তুষ্ট হয়ে মানুষটির দিকে তাকালেন।
প্রশান্তবাবু নরম হলেন খানিকটা। ‘আমাকে ভুল বুঝবেন না, গাছটা বড় হলে আমাদের সকলেরই অসুবিধে হবে। পোকামাকড় বাদুড়ের উতপাত লেগে থাকবে বারো মাস।’
চৌধুরী কথাটার কোনও উত্তর দিলেন না।
এবার একটি গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে প্রশান্তবাবু বললেন, ‘তাছাড়া ভেবে দেখেছেন কি—- বাড়ির পাশে অত বড় একটা গাছ থাকলে সব ফ্ল্যাটেই চুরি হবে নিয়মিত। চুরি করা খুব সহজ হয়ে উঠবে তখন। গাছ বেয়ে চোর উঠবে,আর ডাল ধরে জানলা বা বারান্দা টপকে ঘরে ঢুকবে।পাকা চোরের দরকার নেই,এলেবেলে চোরই কাজ সারতে পারবে।’
এত বড় একটা তথ্য জানার পরেও চৌধুরীর চোখমুখের চেহারা পালটালো না।
শ্রোতাকে কব্জায় পাওয়ার ভঙ্গিতে প্রশান্তবাবু বললেন, ‘তাছাড়া আমগাছ বড় হলে আম হবেই।আর আম হলে পাড়ার ছেলেদের উতপাতও বাড়বে। ভেবে দেখুন,একগাদা বাচ্চাকাচ্চা ঢিল ছুড়বে আম পাড়ার জন্যে। এবার বলুন,ওই সব ঢিলের কটা লাগবে আমের গায়ে,আর কটা ঢুকবে বাড়ির মধ্যে। এটা ঘটবেই। পাড়ার ছেলেদের কতক্ষণ আপনি বা আমরা আটকে রাখতে পারব?’
চৌধুরী এ-কথাটারও কোনও জবাব দিলেন না, তবে একটু দ্রুত পা চালাতে লাগলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে প্রশান্তবাবুর বেশ কষ্ট হচ্ছিল। একটু দম নিয়ে বললেন, ‘এ-বাড়ির তিনটে ফ্ল্যাটের মধ্যে সম্পর্ক বেশ ভালো। প্রতিবেশীদের মধ্যে এইরকম সম্পর্কই তো থাকা উচিত। তবে খারাপ দিকটার কথাও আগে থেকে ভেবে রাখা দরকার। আমাদের বাড়ির সামনের ওই জায়গাটা তো কমন ল্যান্ড। ওখানে আপনি ছোট্ট একটা ফুলের বাগান বানিয়েছেন—খুব ভালো করেছেন। বাড়িটার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। এর জন্যে আমরা সবাই আপনাদের প্রশংসা করি। তবে এর পাশাপাশি একটা খারাপ দিকও তো দেখা যাচ্ছে—।’
এই কথাটার জবাবেও চৌধুরী কিছু বললেন না,তবে ওর চলার গতি বোধহয় আরও একটু বেড়ে গিয়েছিল।
আগের কথার জের টেনে খানিকটা হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশান্তবাবু বললেন, ‘ওই যে খারাপ দিকটার কথা বলছিলাম—সেটা কিন্তু মোটেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয় নয়। কমন ল্যান্ডে ফলন্ত আমগাছের ভাগ নিয়ে ভবিষ্যতে অশান্তি দেখা দিতে পারে প্রতিবেশীদের মধ্যে।আমি বলছি না যে এটা হবেই—তবে একটা আশঙ্কা তো থেকেই যায়। তাই বলছিলাম কি– যত নষ্টের গোড়া ওই আমগাছটা কেটে ফেলাই ভালো।
বাড়িতে ঢোকার মুখে মিস্টার চৌধুরী একটু কর্কশ গলায় বললেন, ‘বললাম তো কেটে ফেলব–।’
কিন্তু একদিন-দুদিন করে অনেকগুলো দিন কেটে যাওয়ার পরে বর্ষা নেমে গেল ঝমঝমিয়ে,অথচ আমগাছের গায়ে হাত দিল না কেউ। সব ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়ে আমগাছটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল,নতুন কয়েকটা ডালও বেরিয়েছে গাছে।
প্রশান্তবাবু বিছানা নিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিন ওঁর শরীরে একটা করে উপসর্গ বাড়ছে। বাড়ির ডাক্তার রোগ ধরতে পারলেন না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা ধরনের ওষুধ খাওয়ানোর পরে বড় ডাক্তারকে যখন ডাকা হল, তখন রোগীর শেষ অবস্থা।
রোগী ভুল বকছে—আহ! তখনই তোমাদের বলেছিলাম না-—গাছটা কেটে ফেল। এত বড় গাছ,এত ডালপালা। ঘরে একবিন্দু আলো ঢুকছে না, হাওয়া ঢুকছে না।উহ! আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে! নিশ্বাস নিতে পারছি না।
প্রলাপ শুনে প্রশান্তবাবুর স্ত্রী আর ছেলের বউ কেঁদে বুক ভাসাল। ছেলে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মতো। বড় ডাক্তার ভগবানকে ডাকার উপদেশ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
এবারের বর্ষাকালটা অনেকদিন ধরে চলেছিল।বর্ষার শেষে হিম ধরেছে বাতাসে। ওইরকমই সময় এক রাতে বাড়ির সবাইকে আরও একবার কাঁদিয়ে মারা গেলেন প্রশান্তবাবু।
তিন ফ্ল্যাটের নতুন এই বাড়িতে এই প্রথম মৃত্যু। খবর পেয়ে অন্য দুই ফ্ল্যাটের এবং পাড়ার লোকজনরা এসে হাজির হয়েছিল।মৃতের পরিবারের প্রতি সবাই খুব সহানুভূতিশীল। শেষকৃত্যের আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল দ্রুত।
ভোররাতে শ্মশান থেকে ফিরে এলো সবাই। এ-বাড়ির তিনটে ফ্ল্যাটেই আলো জ্বলছে। চাপা কথা সব ঘরেই।আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে উঠেছিল চারদিকে।
একতলার ফ্ল্যাটের মিসেস চৌধুরীর খুব ভোরে ওঠা অভ্যাস। আজ তো সারা রাত ওঁর ঘুমই হয়নি। তবু ভোরবেলায় কিছুতেই শুয়ে থাকতে পারলেন না বিছানায়। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সামনের ওই একচিলতে বাগানে। প্রতিদিনের মতো জল দিলেন ফুলগাছে।
ফেরার পথে হঠাৎই যেন আমগাছটার সামনে পড়ে গিয়েছিলেন। গাছটা কবে যে এত বড় হয়ে গিয়েছে—খেয়ালই করেননি! একমানুষ সমান গাছ। গাছে অনেকগুলো ডালপালা বেরিয়েছে। গাঢ় লালচে-সবুজ পাতা। গাছটাকে বেশ বড়সড় একটা পাতাবাহারের মতো দেখাচ্ছিল। হঠাতই দমকা হাওয়ায় দুলে উঠেছিল গাছটা। কয়েক মুহূর্ত ওদিকে তাকিয়ে থাকার পরে কেমন যেন ছিটকে গিয়ে ঘরে ফিরে এসেছিলেন উনি।