মাধুরীলতা। রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে। জন্ম ১৮৮৬। বাবার আদরের বেলা। বাবা রবীন্দ্রনাথ তখন সদ্য পঁচিশের গণ্ডি অতিক্রম করেছে। বন্ধু শিশিরচন্দ্র মজুমদারকে বলেছিলেন, কালকে মেয়ের নাম দিলাম মাধুরীলতা। ছেলে রথীর নামও রবীন্দ্রনাথই রেখেছিলেন। রবির বেলাও বিরল প্রতিভার অধিকারিণী। ছেলেমেয়ে দু’জনই বাবার পরম অনুগত। ইন্দিরাদেবী লিখেছিলেন, ‘রবিকাকার সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে কেবল বেলাই তার সৌন্দর্য্য পেয়েছে।’ বেলা খুব মিষ্টি ও দয়ালু স্বভাবের। ছিন্নপত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথ সেকথার উল্লেখ করেছেন, ‘খোকা (রথীন্দ্রনাথ) সেদিন একটি পিপড়ে মারতে যাচ্ছিল দেখে বেলা নিষেধ করার কতো চেষ্টা করলো… আমার ছোটবেলায় ঠিক এরকম ভাব ছিল।’ বাবা মেয়ের সুখের সম্পর্কের ভাবের বিনিময় ঘটেছে চিঠিতে। চার বছর বয়স থেকেই বেলা চিঠি লিখছে বাবাকে। বাবার সব আদেশ পালন করত। ‘যেতে নাহিব দেবো’তে লেখা আছে, ‘কন্যা মোর চারি বছরের।’ ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের মিনি আসলে বেলার প্রতিচ্ছবি। হেমন্তবালা দেবীকে কবি লিখেছেন, ‘কাবুলিওয়ালা গল্পের মিনি আমার বড়ো মেয়ের আদর্শে রচিত।’
বেলার পড়াশোনা নিয়ে বাবার চিন্তার শেষ ছিল না। মেয়ের পাশে জেগে থাকতেন সারা রাত। দার্জিলিংয়ের বাড়িতে রাতে দুধ গরম করে খাওয়াতেন বেলাকে। ছোটবেলায় মায়ের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াত। মায়ের প্রতি টান ছিল খুব। জ্ঞানদাদি তাদের ভালো পরিচর্যার জন্য পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়ে আসেন। ২৫ জুলাই, ১৮৮৭ বেলার মুখেভাত। খরচ হয়েছিল ৩৭১ টাকা। বাবা মেয়ের উদ্দেশ্যে লেখেন, ‘ওহে নবীন অতিথি, তুমি নতুন কি তুমি চিরন্তন’। বাবা হিসাবে তিনি মেয়েকে সব থেকে ভালো জিনিসটাই দিতেন। বেলা বাবা রবীন্দ্রনাথের কাছে যেমন আদরের, তেমনিই মায়াবী। তাই মেয়ের ক্ষেত্রে তিনি কোনো কার্পণ্য করতেন না। লন্ডনে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ স্কট আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তাই বেলাকে সেইভাবেই বড় করতে চেয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির স্কুলে বেলা পড়ত। ১৫ জন ছিল তখন। বাড়িতে পড়াতে আসতেন মিস পাসনস, লরেন্স, অ্যালজিরোর। পরে জমিদারির কাজে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে চলে আসেন। বেলা শিলাইদহের স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে। পড়াশোনায় যেমন ভাল ছিল বেলা, তেমনি দুষ্টুমিতেও কম যেত না। মাষ্টারমশাই বেশি বকাঝকা করল মায়ের কাছ থেকে পান এনে খুশি করতেন মাষ্টারমশাইকে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ সালে বাবাকে লেখা চিঠিতে বেলা লিখেছে, কবে আসবে কলকাতায়? মিস লিনকন আর পড়বেন না শরীর খরাপ। তবে শিলাইদহে রথীন্দ্রনাথের কাছে স্বাধীনতার প্রতিশব্দ হলেও বেলা ও তার মায়ের কাছে ছিল যন্ত্রণার। শিলাইদহে নির্জনতা তাদের ভাল লাগত না। তাই মা মৃণালিনী দেবীও মনস্থির করেছিলেন, বেলার বিয়ে হলে হয়ত এই নির্জনতা থেকে মুক্তি মিলবে।
রথীর মতো ভাল হাতের কাজ জানত মাধুরীলতা। সেলাই জানত, ইংরেজিতে কবিতা লিখত। গল্পের বই পড়ার শখ ছিল। প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ তাই বেলার মৃত্যুর পর লিখেছিলেন, ‘ওর ক্ষমতা ছিল কিন্তু লিখত না।’ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেলার লেখা, যেমন সবুজপত্র, ভারতী পত্রিকায়। তার গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল– সুরো, সৎপাত্র, মামা ভাগ্নে। সাহিত্যের প্রতি বেলার অনুরাগ ছিল গভীর। কিন্তু দাদা বৌদির মতো কাব্য প্রতিভার বিকাশের চেষ্টা করেননি সেভাবে। শখের জন্য যেটুকু করা দরকার, সেটুকু করেই নিজেকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছে বেলা। ভাই রথীন্দ্রনাথের ১২তম জন্মদিনে ইংরেজি কবিতা উপহার দিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, ‘থিন হার্ট মাস্ট বি / অ্যাস পিউর অ্যাস দা লিলি দ্যাট।’ বিয়ের পরেও সাহিত্যকে ভুলে যায়নি। তখন সাহিত্যকে সামাজিক সংস্কারে ব্যবহার করেছেন। শরৎকে বিয়ে করে যখন পাকাপাকি ভাবে বিহারের মোজাফফরপুরে থাকতে শুরু করলেন তখন আলাপ হয় প্রখ্যাত লেখিকা অনুরূপা দেবীর সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যেই দুজনের গভীর বন্ধুত্ব হয়। তাঁরা চালু করেন লেডিজ কমিটি। পরে সেখানে মেয়েদের জন্য স্থাপন করেন চ্যাপম্যান বালিকা বিদ্যালয়। মেয়েদের স্কুলে আসতে উৎসাহী করতে বেলা বাড়ি বাড়ি ঘুরত। বলা বাহুল্য, সময় যখন তাকে যেখানে নিয়ে গেছে বেলা নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। কখনও প্রতিবাদ করেনি। রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্রদের জটিল অভিমানের জীবন্ত ছায়াছবি তাঁর বেলাই। বাবার অনুগত বেলা। ২৯ মে, ১৮৯৯ সালে, বেলা তাঁর বাবাকে লেখা চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি রথীকে ক্ষীর খাইয়েছি আর বোম্বাই আম। কিন্তু রথী আমার কথা শোনে না…।’
বিলেত থেকে ফিরে শরত-বেলা আর ঠাকুরবাড়ি যায়নি। কারণ ছোটো বোন মীরা সপরিবারে তখন সেখানে বাস করছে। ছোটবোন আর তার স্বামীর ব্যবহারে অখুশি ছিল বেলা-শরত। বেলা মনে করত, মীরার খারাপ ব্যবহারে বাবার সমর্থন আছে। রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন সে অভিমান। তাই লিখেছিলেন, ‘কিছুদিন থেকে অনুভব করতে পারছি যে তোমরা কোনও কারণে আমার উপরে রাগ করেছো।’ কিন্তু তিনি মেয়ের রাগ ভাঙাতে ব্যর্থ। অভিমান এত গভীর যে, নোবেল পাবার পর সবাই শুভেচ্ছা জানাতে এলেও বেলা-শরত আসেনি।
বন্ধুর মেয়ের বিয়ের কথা শুনে বিচলিত বাবা রবীন্দ্রনাথ। শিশিরচন্দ্রকে বলেন, ‘আমার মেয়েও বড় হয়ে গেল।’ প্রিয়নাথ সেন শরতের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ আনেন। শরত বেলার থেকে ষোলো বছরের বড়। প্রিয়নাথ প্রথমে বিয়ের কথা শরতের মা আর বড়দা অবিনাশকে বলেন। বিয়ে দিতে গিয়ে কবিকে আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয়। পাত্রপক্ষ কুড়ি হাজার টাকা দাবি করে। শেষে দশ হাজারে থামে। রবীন্দ্রনাথ অনেকবার অনুরোধ করেন প্রিয়নাথকে। শরত বলে, ‘সে শুধু নিজের সুখ চায় না।’ ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পনের টাকা দিতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। অভিযোগ ওঠে, ভুল পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। দেবেন্দ্রনাথ রেগে গিয়েছিলেন। তিনি আশীর্বাদস্বরূপ যা দিয়েছিলেন তা যৌতুকের থেকে অনেক বেশি। বিয়েতে তাই অনেকেই আসেনি। যদিও কবি লিখেছিলেন, ‘এমন সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য জামাই তুমি হাজার খুঁজলেও পেতে না।’ কবি শরতের মধ্যে কি এমন দেখেছিলেন যে পরিবারের অমতে গিয়ে বিয়ে দিতে হল? তবে সম্ভাব্য কারণ হিসাবে, কবি একজন ভাল শিক্ষিত ছেলে চাইছিলেন যাকে তিনি তাঁর মনের মতো করে গড়ে নিতে পারেন এবং অবশ্যই বেলাকে যে ভালোবাসবে। শরত মেধাবী। দর্শনে গ্র্যাজুয়েট। কেশব সেন স্বর্ণপদক লাভ করে। বেলা শরতের সম্পর্ক প্রথমদিকে ভালই ছিল। বিহারে আইন ব্যবসা করত শরত। বিয়ের আগে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ১৫ই জুন, ১৯০১ সালে বিয়ে হয়। ইন্দিরা দেবী লিখেছিলেন, ‘বেলাকে যখন দেখতে আসে রবিকাকার লালবাড়ির বারান্দায় আমরা খড়খড়ি তুলে দেখেছিলাম।’
রবীন্দ্রনাথ শরৎকে বিলেত পাঠান। মাসে ১৫০ টাকা করে দিতেন। স্বামীর বন্ধুরা এলে রান্না করত বেলা। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, বেলা দিনের শেষে কুমারসম্ভব শোনাবে। কবিও যেতেন বিহারে মেয়েকে আনতে। বিহারের মুখার্জি সম্মেলনে কবিকে সম্মানিত করা হয়। শরত যখন বিলেতে, রবীন্দ্রনাথ বেলাকে নিজের কাছে রেখেছিলেন। বেলা তখন শান্তিনিকেতনে বাচ্চাদের পড়াতো। বিহারে শরতের ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথ তাদের কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। বিলেত থেকে ফিরে শরত-বেলা আর ঠাকুরবাড়ি যায়নি। কারণ ছোটো বোন মীরা সপরিবারে তখন সেখানে বাস করছে। ছোটবোন আর তার স্বামীর ব্যবহারে অখুশি ছিল বেলা-শরত। বেলা মনে করত, মীরার খারাপ ব্যবহারে বাবার সমর্থন আছে। রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন সে অভিমান। তাই লিখেছিলেন, ‘কিছুদিন থেকে অনুভব করতে পারছি যে তোমরা কোনও কারণে আমার উপরে রাগ করেছো।’ কিন্তু তিনি মেয়ের রাগ ভাঙাতে ব্যর্থ। অভিমান এত গভীর যে, নোবেল পাবার পর সবাই শুভেচ্ছা জানাতে এলেও বেলা-শরত আসেনি। কলকাতার এন্টালিতে থাকতে শুরু করে। পরে শরত শ্রীরামপুরে পৈতৃক বাড়িতে চলে যায়। যখন তার অবস্থা ঘুরতে শুরু করেছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথায় জানা যায়, পরিবারের সবার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হলেও বাবার সঙ্গে বেলার সম্পর্ক আর ঠিক হয়নি।
১৯১৭ সালে যক্ষ্মা ধরা পড়ল বেলার। শরত সে সময় পাশে ছিল না। মেয়ের পাশে থেকে সব কাজ করতেন বাবা। গান শোনাতেন, কবিতা আবৃত্তি করতেন। মীরা দেবীকে লিখেছিলেন, ‘বেলা আজ ভাল আছে… কবিরাজ গনানাথ সেন বলেছেন চিন্তা না করতে।’ চেষ্টা করেও বাবা বাঁচাতে পারেনি তার প্রিয় বেলাকে। চোখের সামনে দেখেছেন মেয়ের মৃত্যু। সাল ১৬ মে, ১৯১৮, মাত্র ৩১ বছর বয়সে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে মাধুরীলতা বৃত্তি চালু করেন। পলাতক গ্রন্থে প্রিয় বেলাকে নিয়ে কবি লিখেছিলেন, ‘তবু রাখি বলে / বলো না সে নেই / সে কথাটাই মিথ্যা তাই।’
…. …. …. …. ….
মীরা দেবী। রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ কন্যা। আদরের অতসীলতা। মীরা দেবী না থাকলে রবীন্দ্রনাথের অনেক অজানা কাহিনি জানা যেত না। তাই রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে পরিপূরক স্বরূপ মীরা দেবীকেও জানতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ছিল সিঁড়ির শখ। বাড়িতে অন্তত দুটো সিঁড়ি থাকতেই হবে। বিচিত্রা বাড়িটি তৈরি করার সময় নীতিন্দ্রনাথ সিঁড়ি রাখতে ভুলে যায়। পরে কাঠের সিঁড়ি তৈরি করে পরিস্থিতি সামলে দেন। রবীন্দ্রনাথ খুব সকালে লিখতে বসতেন আর দুপুরে উঠতেন। এমনকী বাইরে প্রচণ্ড লু বইলেও কোনোদিন জানালা বন্ধ করতেন না। মীরা দেবী লিখেছিলেন, ‘রোদ্দুরে ভয় করতেন না। সূর্যের সঙ্গে তাঁর মিতালি ছিল।’ বাবা-মেয়ের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর। তাই মীরা দেবী বলেছিলেন, বাবা আমাদের মায়ের অভাব বুঝতে দেননি, আবার অতিরিক্ত আদর দিয়ে নষ্ট করেনি। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মজাদার সব খেলা খেলত। মীরা দেবীর বর্ণনায় জানা যায়, বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরলে কবি আদা দিয়ে চা করে দিতেন। রান্না নিয়ে কবির শখ ছিল। বাবার রান্নার গুণ ছেলে রথীন ও মেয়ে বেলা, মীরাও পেয়েছিল। রান্না নিয়ে কবি গবেষণা করতেন। একবার ঘিয়ের বদলে ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে আটা মেখেছিলেন। বয়সের তুলনায় কবি একটু দার্শনিক বই পড়তে ভালোবাসতেন। যদিও মীরা দেবীর পছন্দ ছিল প্রাচীন ইতিহাস। কবি ভাল সাঁতার জানতেন। সাঁতরে নদী পার হতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের হোমিওপ্যাথিকের নেশা ছিল। গ্রামের মুসলিম মেয়েরা পুরুষের সামনে না এলেও কবির কাছে সবাই আসতো। মেয়েদের ব্যাপারে কবি ছিলেন যত্নবান। মীরা দেবীর যেহেতু ঔষধ খেতে অনীহা ছিল, তাই ভার পড়েছিল সুধাকান্তের উপর। এরকম ইতিউতি অজানা রবীন্দ্রনাথের খবর রয়েছে মীরা দেবীর লেখায়। জগদীশচন্দ্র বসুর কাছের মানুষ ছিলেন মীরা দেবী। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর ভাগ্নে অরবিন্দমোহনের সঙ্গে মীরার বিয়ে দিতে। বিয়াই বিয়ান সম্পর্ক হলে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে মজা করা যাবে। যদিও তা হয়নি। অসমের তরুনরাম ফুকোনের সঙ্গেও বিয়ের সম্বন্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজের ভক্ত বামনচন্দ্রের পুত্র নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মীরা দেবীর বিয়ে হয়, ৬ই জুন, ১৯০৭। তাঁদের এক ছেলে এক মেয়ে– ছেলে নিতু আর মেয়ে নন্দিতা।
মীরা দেবী লিখেছিলেন, ‘বাবা নিজের লেখাপড়ার কাজে ব্যস্ত থাকলেও তারই মধ্যে রোজ সকালে আমাকে নিয়ে পড়াতে বসতেন।’ গোল্ডেন ট্রেসার থেকে কবিতা পড়তেন। বুঝতে না পারলে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিতেন। বাবার কাছে পড়তেই ভাল লাগতো মীরা দেবীর। মীরা দেবীর লেখায় শান্তিনিকেতনের অনুপম বর্ণনা রয়েছে। বোলপুরে বাবা, মা, ভাই, বকুলগাছের কথার উল্লেখ রয়েছে।
মীরার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে শান্তিনিকেতনে। ফলে অনেক গুনী মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে পূর্ণিমা তাঁর গল্প করার বন্ধু। জ্ঞানদানন্দিনী, রাজলক্ষ্মী দেবী ও বড়দিদি বেলার কাছেই বড়ো হয়েছে মীরা। খুব কম বয়সে মাকে হারায়। তখন দশ বছর বয়স। মাকে সেবা করার জন্য কলকাতায় যায় মীরা। মীরা দেবী লিখেছিলেন, মায়ের শরীর খারাপ হলে বাবা তালপাতার বাতাস করত। মাকে নিয়ে মীরা লিখছেন, ‘মা শান্তিনিকেতনের বাড়ির বারান্দায় সন্ধ্যের পর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ইংরেজি নভেল থেকে বাংলা অনুবাদ করে দিদিমাকে শোনাতেন।’ তখন শান্তিনিকেতনে কুঁয়ো থেকে জল তুলে সব কাজ করতে হত। রাজলক্ষ্মী দেবীর কাছে রান্না শিখেছিলেন। মাধুরীলতা লিখেছিলেন, ‘তোর কেমন মজা, সব শিখে নিচ্ছিস। আমার মতো পরে কষ্ট পেতে হবে না।’ মীরার রান্না নিয়ে ইন্দিরা দেবী বলেছিলেন, ‘রাঁধা বাড়া সম্বন্ধে কাকীমার খুব সখ ছিল। তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা মীরাতেও তা সংক্রমিত হয়েছে।’ চার বছর বয়স থেকে তাঁর জেদ সেলাই, রান্না শিখবে। দাদা-দিদির মতো লেখালিখিও করতে পারতেন। বাবা যখন প্রবাসী পত্রিকা সামলাচ্ছেন তখন মীরা সংকলনে সাহায্য করত। বাগানের সখও ছিল। বোলপুরের অনুর্বর জমিতে সুন্দর বাগান তৈরি করেছিলেন। বাগানের কাজে তিনি সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রেখে ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন জীবনের অপ্রাপ্তি। মীরা দেবী লিখেছিলেন, ‘কোনো কাজে যখন আমি মন বসাতে পারছিলুম না তখন এই বাগানের নেশা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।’ উল্লেখযোগ্য, এই বাগানের জন্যই কবি বাড়ির নাম রাখেন মালঞ্চ।
অসুস্থ রেণুকাকে নিয়ে কবি যখন আলমোরা যান, মীরার রয়ে গেল জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে। মীরা দেবী লিখেছিলেন, ‘বড়ো আনন্দে ও মেজমার আদর যত্নে সেই বাড়িতেই দিন কাটিয়েছি। সন্ধের আগেই বসে মেজমা আমাদের খাইয়ে দিতেন ঘুমিয়ে পড়ব বলে।’ রবীন্দ্রনাথের জীবনে জ্ঞানদানন্দিনীর অবদান অনেক। তাই হয়তো কাদম্বরী দেবীর অভিমান থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ নীরব থেকেছেন। মেয়েবেলাতে মীরা দেবীর ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আর লরেন্স সাহেব, ইতিহাস পড়াতেন অজিত কুমার চক্রবর্তী। সেলাই শেখার জন্যও বিদেশি মেম রাখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মীরা দেবীর অঙ্কতে ভয় ছিল। অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন ভূপেন সান্যাল। তবে শুধু মাত্র শিক্ষকদের উপরই ছেড়ে দেননি, নিয়মিত মেয়ের পড়াশোনার খেয়াল রাখতেন রবীন্দ্রনাথ। পড়ানোর পদ্ধতিও ছিল আধুনিক। মীরা দেবী লিখেছিলেন, ‘বাবা নিজের লেখাপড়ার কাজে ব্যস্ত থাকলেও তারই মধ্যে রোজ সকালে আমাকে নিয়ে পড়াতে বসতেন।’ গোল্ডেন ট্রেসার থেকে কবিতা পড়তেন। বুঝতে না পারলে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিতেন। বাবার কাছে পড়তেই ভাল লাগতো মীরা দেবীর। মীরা দেবীর লেখায় শান্তিনিকেতনের অনুপম বর্ণনা রয়েছে। বোলপুরে বাবা, মা, ভাই, বকুলগাছের কথার উল্লেখ রয়েছে। প্রথমবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে গোয়ান দেখে বাস মনে হয়েছিল। শমীন্দ্রনাথের অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। আশা করতেন, বড় হলে বাবার মত ভাল অভিনেতা হতে পারবে। মীরা যখন দিদির কাছে তখন দাদা কেদার থেকে ফিরছে। শিলাইদহে দুটি বজরা ছিল– পদ্মা আর আত্রাই। জগদীশচন্দ্র বসু সেখানে যেতেন। দিদি বেলার মতো মীরাও শান্তিনিকেতনে ছোটদের পড়াতেন। ইতিহাসের টানে শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গেছেন রাজশাহীর পাহাড়পুরে।
মীরার বিয়ের পর অবশ্য সুখের সমাপ্তি ঘটে। নগেন্দ্রনাথ বিলেত যাবার সখ ছিল। আর্থিক কারণে হয়নি সেটা। বিয়ের দিন থেকেই অশান্তি শুরু হয়েছিল। বেলা রথীনকে লিখছেন, ‘বরের অসভ্যতায় আমাদের পর্যন্ত লজ্জাবোধ হয়েছিল, সব কাজেরই সীমা আছে। কিন্তু নগেন্দ্রর বেহায়াপনার সীমা নেই।’ বিয়ের তিন সপ্তাহের পর রবীন্দ্রনাথ জামাই নগেন্দ্রনাথকে আমেরিকা পাঠান। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক হন। কবি চেয়েছিলেন, জামাই তাঁর কাজের হাল ধরুক, তিনি সাধনার কাজে মগ্ন হতে চান। কিন্তু নগেন্দ্র দেশে ফিরে চাকরি করতে চায়। তাছাড়া নগেন্দ্রর খামখেয়ালী আচরণ রবীন্দ্রনাথ, মীরা দেবী যেমন ভাল চোখে দেখেনি তেমনি বেলা শরতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। কবিকে চিন্তা মুক্ত করতে পাশে দাঁড়ান আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি নগেন্দ্রকে কলকাতায় কৃষি বিভাগ খোলার ভার দেন। যদিও তাতে লাভ হয়নি। মীরা দেবী নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ। মীরা দেবী লিখেছিলেন, ‘আমি যতই অযোগ্য হই, অপটু হই, তুমি আমাকে শিখিয়ে নেবে।’ পরে মীরা বোলপুরে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। নগেন্দ্র আদালতে যাবার হুমকিও দেন। লোকনিন্দার ভয় দেখায়। কবি লিখেছিলেন, ‘মীরা নিজে সম্বন্ধে লোকনিন্দাকে গ্রাহ্য করে না… জীবনের সব মানুষের ভাগ্য সুখের হয় না– তা নাইবা থাকলো কিন্তু স্বাধীনতা যদি না থাকে তবে তার চেয়ে দুর্গতি কিছু হতে পারে না।’
নগেন্দ্র ভাবতো, কবি মীরাকে জোর করে আটকে রেখেছে। তাই কবি লিখছেন, ‘মীরার সঙ্গে তোমার লেশমাত্র বিচ্ছেদ হয়, এ আমার কিছুতেই ইচ্ছা সম্মত নয়।’ জামাইকে তিরস্কার করেছেন তিনি। মীরার কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেননি। রথীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, গোখরো সাপটা কামড়ালে মীরাকে এতো কষ্ট ভোগ করতে হতো না। বিদেশে থাকলেও কবি মেয়ের পাশে থেকেছেন সর্বদা। লিখেছেন, ‘তোর দুঃখ আমার হৃদয় ভরে আছে… সুখের আসা রাখিসনে মীরু, দুঃখকে ভয় করিসনে।’ কবি নগেন্দ্রকে লিখেছিলেন, ‘তোমাদের দুজনের কাউকেই আমি সুখি করতে পারিনি… তার শাস্তি নিয়ত অন্তরে মধ্যে ভোগ করছি, অতএব আমাকে ক্ষমা করো।’ ‘তোমাদের দুই জনেরই ভাগ্য তোমাদের নিজেদের হাতে। আমি জোর করে তার পরিবর্তন করতে পারিনি’ । তাই জীবনকথাতে সবার কথা উল্লেখ করলেও মীরা দেবী স্বামীর কথা বলেননি। শাস্তি গল্পের চন্দরার বাস্তব প্রতিফলন।
ছেলে নিতুর মৃত্যুর পরে আরো একা হয়ে যান মীরা। কবি লিখেছিলেন, ‘কেবল কামনা করতে পারি এর পরে যে বিরাটের মধ্যে তার গতি সেখানে তার কল্যাণ হোক।’ ছেলের মৃত্যুতে জার্মানিতে মীরার স্বামীর সঙ্গে দেখা হলেও সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয়নি। মেয়ে নন্দিতাকে নিয়েই থাকতেন মীরা। নন্দিতা কবিরও খুব আদরের। কবির নৃত্যভাবনার প্রতীক নন্দিতা। রবীন্দ্রনাথ নিজের মতো করে মেয়েদের বড়ো করেও সুখী করতে পারেননি। পাত্র নির্বাচনে ভুল ছিল। ঠাকুরবাড়ির একাংশ এ নিয়ে অভিযোগ করেছে। জামাইদের আরও রুচিবান হবার দরকার ছিল। যদিও নগেন্দ্র সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। ছোটদের শারদ সংকলন ‘পুজোর ছুটি’ প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে কবি সত্যেন্দ্রনাথ তার নাম পাল্টে রাখেন পার্বনি, প্রচ্ছদ করেন নন্দলাল বসু। পত্রিকায় লিখেছেন নগেন্দ্র নিজে, সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, ইন্দিরা দেবী। যদিও আর্থিক সমস্যায় এ নিয়ে মনোমালিন্য হয় কবির সঙ্গে।