দুর্গাপুজার দিনগুলিতে যাদের হৃদয়-মন মুড়ে যায় বেদনায়

অসুর একতা সমিতির সম্পাদক ডেমিন অসুরের চা শ্রমিক আবাসের সামনের ছোট মাঠে শতচ্ছিন্ন একটি ত্রিপল পাতা৷ ত্রিপলের এক প্রান্তে একটি কাঠের জলচৌকিতে পাতা পরিষ্কার ধোওয়া সাদা কাপড়ের ওপর ছোট্ট একটি ছবি৷ দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধরত অসুর৷ ছবির চারপাশে ফুল ছিটানো৷ একটা পিতলের থালায় বাতাসা৷ পাশে জলের গ্লাস৷ দুটো ধুপতি থেকে উঠছে ধূপের ধোঁয়া৷ ত্রিপলের ওপর এবং মাঠে ছোটবড় নানা বয়সের হাজার তিনেক অসুর সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা গাদাগাদি করে বসে৷ ঘোর অন্ধকারের সমাবেশকে আলোকিত করে রেখেছে একটি হ্যাজাকের আলো৷ প্রণামের ভঙ্গিতে সকলের হাত জোড় করা৷ হাতের দুই তালুর মাঝে রয়েছে৷ ছবির সামনে প্রার্থনা করার ভঙ্গি সবার৷ বড়দের দেখাদেখি মায়ের কোলে বসা বাচ্চাগুলোও প্রণাম করার ভঙ্গিতে দু’হাত জোড়া করে রাখার চেষ্টা করছে৷ কোনও কোনও শিশু অবাক বিস্ময়ে কখনও এদিক ওদিক, আবার কখনও মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে৷ কখনও দৃষ্টি যাচ্ছে থালার বাতাসার দিকে৷

আজ দুর্গাপূজার ষষ্ঠী৷ জলপাইগুড়ি জেলার চা বলয় ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত প্রান্ত ভুটান পাহাড়ের কোল ঘেঁষা ক্যারন চা-বাগানের একটি শ্রমিক মহল্লা ক্যারি লাইনে (বস্তি‍) সন্ধ্যায় হয়েছে পুজোপাঠের আয়োজন৷ না, দেবী দুর্গার বোধন বা পুজো নয়৷ আয়োজন করা হয়েছে অসুরের পুজো আরাধনার৷ অংশ নিয়েছে বাগানের অসুর সম্প্রদায়ের পরিবারগুলির ছোটবড় নানা বয়সের সদস্যরা৷ ৭৫ বছরের প্রবীণ এতোয়া অসুর পূজা আরাধনা কর্ম সম্পাদন করছে৷ প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে হয় পুজোপাঠ৷ পুজো শেষে এতোয়া অসুর জোরে জোরে তিনবার বলে ওঠে, “জয় অসুররাজের জয়৷’ প্রত্যকেবার তার জয়ধ্বনির সঙ্গে দুয়ো তোলে উপস্তিত অসুর ভক্তরা৷ এরপর জিষ্ণু, সালিম, ডাকারু, ভোগরা, ভীমারু প্রমুখ অসুরেরা তাদের পূর্বপুরুষ অসুররাজের বীরগাথা বর্ণনা করতে থাকে৷ কেমনভাবে স্বর্গলোকের দেবতারা এককাট্টা হয়ে ছলনা করে অসুররাজকে নিধন করেছিল তা বলতে থাকে৷ নিধন করা সম্ভব না হলে স্বর্গ ও মর্তলোকের অধীশ্বর হতে পারতেন অসুররাজ৷ সত্যিকার মহাপরাক্রমশালী বীরপুরুষ ছিলেন অসুররাজ৷ তার বীরগাথার বর্ণনা শুনে অনেকে চোখের জল ফেলতে‍ থাকে৷ একক শক্তিতে নিজ বাহুবলে মর্তলোক দখল করেছিলেন বীর অসুররাজ৷ এরপর তিনি অভিযান শুরু করেন স্বর্গলোক বিজয়ে৷ বীর বিক্রমে অগ্রসর হয়ে স্বর্গলোক থেকে দেবতাদের প্রায় বিতাড়ণ করে এনেছিলেন অসুররাজ৷ তার বীরত্বের সঙ্গে পেরে না উঠে স্বর্গের সব রথী মহারথী ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ইন্দ্র, নারদ ইত্যাদি দেবতারা এককাট্টা হয়ে সবার মিলিত শক্তিতে সৃষ্টি করেছিল দুর্গাকে৷ দুর্গা ছিল ছলনাময়ী নারী৷ ছলনার আশ্রয় নিয়ে দুর্গা নিষ্ঠুরভাবে নিধন করেছিল বীর অসুররাজকে৷ অসুররাজকে এভাবে নিধন করার পর তার বংশধরদের মধ্যে নামিয়ে আনা হয় চরম দুর্দশা৷ দুর্গম গিরি কন্দর বিপদ শঙ্কুল গহিন অরণ্যে ঠাঁই নিতে বাধ্য হন অসুররাজের বংশধরেরা৷ অন্যদিকে‍ অসুররাজ নিধনে যারা খুশি ও উপকৃত হয়েছিল তারাই হয়ে যায় সিংহভাগ সুখ সমৃদ্ধির উত্তরাধিকারী৷ যুগযুগ ধরে তাদেরই পদানত হয়ে থাকতে হচ্ছে অসুররাজের বংশধরদের৷ দুর্গার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সুখ-সমৃদ্ধির উত্তরাধিকারী হওয়ার ফলে তারা এখন ঘটা করে ছলনাময়ী নারী দুর্গার কুৎসিৎ পূজা করে৷ এভাবে ছলনাময়ী ওই নারীকে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে৷

(দুই)

জলপাইগুড়ির চা বলয় ডুয়ার্সের ক্যারণ চা-বাগানে প্রায় হাজার দুয়েক তপশীলি উপজাতি অসুর সম্প্রদায়ের চা শ্রমিকের বাস৷ তারা নিজেদের দৈত্য অসুর বা অসুররাজের বংশধর বলে বিশ্বাস করে৷ এজন্য গৌরবও বোধ করে৷ অসুর সম্প্রদায় কোনও দেবদেবীর পূজা করে না৷ কোনও দেবদেবীর উপাসকও নয় তারা৷ তারা পূজা আরাধনা করে শুধু অসুররাজের৷ আরাধনার সময় দুর্গা ও অসুরের ছবি একসঙ্গে থাকলেও তারা পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করে অসুররাজের উদ্দেশ্যে৷ দুর্গাকে তারা দেবীর বদলে ছলনাময়ী ঘৃণিত কুৎসিৎ নারী বলে হেয় জ্ঞান করে৷ তারা প্রণাম করে ছবির অসুরকে৷ দুর্গাকে নয়৷

অন্যান্য জায়গার মতো ক্যারণ চা-বাগানেও অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে ঘটা করে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়৷ বাগানের অসুরেরা বাদে অন্য সব উপজাতি সম্প্রদায়ের চা শ্রমিক পরিবারের মানুষেরা মেতে ওঠে পূজা আনন্দ উৎসবে৷ আলোর রোশনাই, আতসবাজি, ঢাকের বদ্যি, যাত্রাগান, ধামসা মাদলের দ্রিমদ্রিম তালে সাঁওতাল এবং অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের চা শ্রমিক নারী-পুরুষেরা গা ভাসিয়ে দেয় নাচ-গান আনন্দ উৎসবে৷ কিন্তু এসব আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকে বাগানের অসুর সম্প্রদায়ের চা শ্রমিক পরিবারের মানুষেরা৷ দুর্গার হাতে তাদের পূর্বপুরুষ অসুররাজের নিধনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত পূজা অনুষ্ঠানকে তারা ঘৃণ্য কুৎসিত এবং নিজেদের পক্ষে অমর্যাদাকর বলে মনে করে৷ পুজোর চারদিন ক্যারণ চা বাগানের অসুর মহল্লাগুলি ঢেকে থাকে বিষাদের কালো মেঘে৷ দুর্গা পূজা মানে বাগানের অসুর মহল্লাগুলিতে বীর অসুররাজের নির্মমভাবে নিধনের অন্ধকার দিনগুলির স্মরণ৷ পুজোর চারদিন বাগানের অসুর মহল্লাগুলিতে অনেক চা শ্রমিক আবাসে চলে অরন্ধন৷ ঘর থেকেও পুজোর চারদিন কেউ বিশেষ, বেরোয় না৷ বয়স্করা বাড়িতে অসুররাজের ছবির সামনে বসে চোখের জল ফেলে৷ কেউবা নিজেদের দুর্দশার জন্য হাহুতাশ করে৷ পুজোর চারদিন তাদের কাছে চরম দুঃখকষ্টের স্মৃতি৷ এই চারদিন তাই তারা দুঃখের স্মৃতির রোমন্থন করে৷ পুজোর চারদিন তারা নিজেরা একত্রিত হয়ে আরাধনা করে তাদের সম্প্রদায় ও বংশধারার প্রতি,্ঠাতা বীর অসুররাজের৷

(তিন)

আজ দুর্গা পূজার নবমী৷ নবমীর সন্ধ্যায় আরাধনা সেষে প্রবীণ এতোয়া অসুর সমবেত অসুরদের সামনে ব্যাখ্যা করছিল অসুররাজের বীরত্বের গাথা৷ আক্ষেপ করে জানাচ্ছিল, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং অন্যান্য দেবতারা একজোট হয়ে ছলনার আশ্রয় নিয়ে কেমন করে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে অসুররাজকে নিধন করেছিল৷ যদি তারা তা না করতে পারত তবে আজ মর্ত্য ও স্বর্গলোক থাকত অসুরদের দখলে৷ সুখ-সমৃদ্ধিতে এখন ভেসে থাকতে পারত অসুর সম্প্রদায়৷ অসুররাজের নিধনের পর তার বংশধরদের মধ্যে নামিয়ে আনা হয় চরম সঙ্কট ও দুর্দশা৷ আজও তার শিকার অসুর সম্প্রদায়৷ সমাজের মূল স্রোতে তাদের ঠাঁই নেই৷ সমাজের মূল স্রোত তাদের অবজ্ঞা ও অবহেলার চোখে দেখে৷ সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি ভোগ করা মানুষদের চোখে করুণার পাত্র হয়ে থাকতে হয় অসুরদের৷ যেন তাদের দয়ায় অসুরদের বেঁচে‍ থাকা৷ দুর্গার আশীর্বাদপুষ্ট মানুষেরা এখনও পদানত রেখেছে অসুর সম্প্রদায়কে৷ অথচ অসুরদের শরীরে রয়েছে বীরের রক্ত৷ কিন্তু তার প্রকাশ ঘটাতে পারে না আজকের অসুর সম্প্রদায়৷ তাদের প্রতি বঞ্চনার অবসানে দুর্গার আশীর্বাদপুষ্টদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না আজকের অসুরেরা৷ এটা অসুর সম্প্রদায়ের দুর্ভাগ্য এবং নিজেদের কলঙ্ক৷ এতোয়ার কথার মাঝে হটাৎ গুঞ্জন৷

এতোয়া একটু থামতেই সমবেত অসুরেরা চিৎকার করে তাকে সমর্থন জানাতে থাকে৷ এতোয়া তখন প্রায়শ্চিত্তের রায় শুনিয়ে বলা শুরু করে, প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য মংরাকে একাদশীর দিন অসুর একতা সমিতিকে দিতে হবে একটা শুয়োর৷ এই শুয়োর বলি দিয়ে একাদশীর রাতে অসুর মহল্লায় ঘটা করে অসুররাজের বিশেষ আরাধনা হবে৷

বছর বারোর একজন কিশোর সালমি অসুর জমায়েতে ঢুকে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে৷ তার নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে৷ অসুরদের ভবগম্ভীর সভার কাজে ছেদ পড়ে৷ বিঘ্ন ঘটে৷ সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে৷ সালমির অবস্থা দেকে‍ অনেকে বিচলিত৷ অনেকেরই উৎকণ্ঠা৷ কেউ কেউ আবার বিরক্ত৷ অসুর গাথা বর্ণনারত এতোয়া অসুর নিজ আসনে স্তব্ধভাবে বসে বসে৷ গুঞ্জন ক্রমেই হই হট্টগোলের রূপ পেতে থাকে৷ জানা গেল সন্ধ্যায় বাগান ফ্যাক্টরির সামনে দুর্গাপুজো মণ্ডপে আরতি চলছিল৷ বাগানের অনেকে একের পর এক এসে প্রতিমার সামনে জ্বলন্ত ধুপতি নিযে‍ আরতি‍ করছিল৷ ঢাকের বাদ্যের তালে তালে পা ফেলে কোমর দুলিযে চলছিল আরতি৷ দূর থেকে দেখতে দেখতে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে যায় সালমি৷ নাচের ছন্দ ওর মনে আনে দোলা৷ কেমন করে হল মনে নেই৷ একসময় হঠাৎ দৌড়ে মণ্ডপে ঢুকে একটা জ্বলন্ত ধুপতি তুলে নিয়ে বাজনার তালে নাচার চেষ্টা করে সালমি৷ হইহই করে ওঠে অনেকে৷ বাবুলাল লোহার ছুটে এসে সালামির হাত থেকে‍ ধুপতি কেড়ে নিযে তার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তাকে পূজামণ্ডপ থেকে অনেকটা দূরে নিযে যায়৷ সঙ্গে‍ আরও বেশ কয়েকজন৷ বাবুলাল এবং অন্যরো প্রচণ্ড মারধোর করতে থাকে সালমিকে৷ অসুর হয়েও মণ্ডপে ঢুকে অপবিত্র করেছে পূজামণ্ডপ৷ অপরাধের জন্য মারধোরের সঙ্গে‍ ওর ওপর চলতে তাকে প্রচণ্ড গালিগালাজ৷ শোরগোল সুনে বাগানের ছোট ম্যানেজার ঘোষসাবও সেখানে ছুটে আসেন৷ পায়ের জুতো খুলে সালমিকে পেটাতে‍ থাকেন ঘোষসাব৷ সালমির নাক মুখ দিয়ে‍ রক্ত ঝরতে থাকে৷

ঘটনা শুনে অসুরেরা স্তম্ভিত৷ গুঞ্জন থেকে শুরু হয়ে যায় প্রচম্ড হট্টোগোল৷ চিৎকার চ্যাঁচামেচি‍৷ সবাই একসঙ্গে কথা বলতে চায়৷ নিজের আসনে দাঁড়িয়ে‍ প্রবীণ এতোয়া অসুর দু’হাত তুলে সকলকে শান্ত হওয়ার আবেদন জানাতে থাকে৷ কিন্তু কে কার কথা শোনে৷ ক্রমশ সভায় দুটো অভিমত স্পষ্ট হতে থাকে৷ এক দলের বক্তব্য, তাদের পূর্বপুরুষ অসুররাজের নিধনের পর থেকে‍ দুর্গার আশীর্বাদপুষ্টরা অসুরদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালিযে যাচ্চে৷ সমাজে তাদের পদানত করে রাখার চেষ্টা এখনও অব্যাহত৷ আজকের ঘটনা তারই প্রমাণ৷এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার৷ বিহিত করা দরকার৷ অসুররা তো শক্তিহীন নয়৷ এখনই দলবদ্ধ ভাবে পূজামণ্ডপে যাওয়া উচিত৷ প্রতিবাদ জানানো উচিত৷ রুখে না দাঁড়ালে দুর্গার অনুগামীরা তাদের পদানত করে রাখবেই৷ এই অভিমতের বিরুদ্ধে‍ সমাবেশে পাল্টা আরেক বক্তব্য ক্রমেই জোরালো হতে‍ থাকে৷ তা’হল, অসুরদের অতীত অত্যন্ত গৌরবময়৷ এককভাবে শুধু নিজ বাহুবলে বীর অসুররাজ মর্তলোকের দখল নিযে স্বর্গে‍র দেবতাদের্ প্রায় পরাজিত করেছি‍লেন৷ ভীত কাপুরুষ দেবকুল তখন একজোট হযে মিলিত শক্তিতে দুর্গাকে সৃষ্টি করে অসুররাজকে নিধন করেছিল৷ ছলনাময়ী নারী দুর্গার আশীর্বাদপুষ্টরা স্বাভাবিক ভাবেই দুর্গাকে দেবী জ্ঞান করে তার আরাধনার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করে৷ সেই অভিশপ্ত আরাধনাস্থলে অসুরদের উপস্থিতি তাদের নিজেদের অতীত গৌরবকে ম্লান করে৷ নিজেদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে৷ তাই কোন দুর্গাপূজা মণ্ডপে অসুরদের যাওয়া একেবারেই অনুচিত৷ এতে অসুরদের বীরত্ব ও মর্যাদার হানি হয়৷ অসুররাজের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়৷ অথচ সালমি আজ অসুররাজের আরাধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থেকে দুর্গাপুজো মণ্ডপে গিয়ে সেই কলঙ্কের গর্হিত কাজটাই করেছে৷ এতে অসুরদের বীরগাথা লঙ্ঘিত হয়েছে৷ সালমি কিশোর৷ ওর বুদ্ধি পরিণত নয়৷ ওকে অসুরদের অতীত গৌরব ঠিকঠাক বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে ওর বাবা মংরা অসুর৷ দুর্গাপূজা মণ্ডপে ঢুকে অসুরদের বীরত্বকে কালিমালিপ্ত করেছে সালমি৷ এর দায় নিতে হবে মংরাকে৷ তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে৷ মংরা কিছু বলার চেষ্টা করে৷ কিন্তু হইহট্টগোলে তার কণ্ঠ ডুবে যায়৷ ছেলের অপরাধের জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে থাকে মংরা৷ এক সময় চুটে গিয়ে সালমিকে মারতে থাকে৷ কয়েকজন এসে মংরাকে সরিয়ে দিয়ে উল্টে তাকে ধমকাতে থাকে৷ ছেলেকে ঠিকঠাক শি‍ক্ষা না দিয়ে এখন মারধোর করে কী লাভ? বেশ কিছুক্ষণ হইহল্লা চলার পর সভা কিছুটা শান্ত হয়৷ এতোয়া অসুর বলতে থাকে, ‘আজকের এই ঘটনাই বুঝিয়ে দেয় অসুরদের ওপর দুর্গার অনুগামীদের অত্যাচার অবিচার এখনও কেমন চলছে৷ পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, দুর্গাপূজা প্রাঙ্গনে ঢুকে সালমি অসুরদের বীরত্ব ও বংশমর্যাদাকে কলঙ্কিত করেছে৷ অসুররাজের অসম্মান করেছে৷ এর দায় নিতে হবে সালমির বাবা মংরাকে৷ তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে৷’

এতোয়া একটু থামতেই সমবেত অসুরেরা চিৎকার করে তাকে সমর্থন জানাতে থাকে৷ এতোয়া তখন প্রায়শ্চিত্তের রায় শুনিয়ে বলা শুরু করে, প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য মংরাকে একাদশীর দিন অসুর একতা সমিতিকে দিতে হবে একটা শুয়োর৷ এই শুয়োর বলি দিয়ে একাদশীর রাতে অসুর মহল্লায় ঘটা করে অসুররাজের বিশেষ আরাধনা হবে৷ বাজবে বাদ্যি৷ ঢাল খড়গ হাতে অসুররাজের ভূমিকায় ধামসা মাদলের তালে সমবেত ও একক নৃত্য হবে৷ গান হবে৷ হ্যাজাকের আলোর রোশনাইতে সারারাত চলবে অসুর আরাধনা উৎসব৷ সঙ্গে শুয়োর দিয়ে ভোজ৷ রাখতে হবে হাড়িয়া (ঘরে তৈরি দেশি মদ)৷ দুর্গাপূজা প্রাঙ্গনে ঢোকার পাপ স্খালনের জন্য অসুররাজকে তুষ্ট করার চেষ্টা হবে৷ প্রার্থনা জানান হবে৷ মার্জনা চাওয়া হবে অসুররাজের কাছে৷ একাদশীতে রাতভর বাগানের অসুর মহল্লায় ধুমধাম করে হবে অসুররাজ উৎসব৷’

রায় শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে মংরা এবং ওর স্ত্রী ফুলিয়া৷ মংরা ছেলের অপকর্মের জন্যে বারেবারে করজোড়ে মার্জনা চাইতে থাকে৷ কিন্তু রায়কে সংশোধন করতে রাজি নয় এতোয়া৷ সমবেত অসুরেরাও হইহই করে সমর্থন জানাতে থাকে‍ এতোয়াকে৷ মংরা ফুলিয়ার আর্ত কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়৷

(চার)

গতকাল সারারাত ঘুমোয়নি মংরা৷ কোথা থেকে যোগাবে শুয়োর কেনার টাকা৷ হাতে সময় একদিন৷ টাকা দিতে না পারলে অসুর সমাজ তাকে একঘরে করবে৷

আজ দশমী৷ সন্ধ্যার ব্যারণ চা-বাগান ঘেঁষা পাহাড়ি নদী ডায়না পার সেজে উঠেছে মায়াবী রূপে৷ নদী পারে থিকথিকে ভিড়৷ বিসর্জনের আগে নদীর পারে রাখা হয়েছে দুর্গা প্রতিমা৷ তার চারদিকে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে চারটি হ্যাজাকের আলো আঁধারকে চিরে ঝলমলে করে রেখেছে৷ বাজছে ঢাক৷ কাঁসর ঘণ্টা৷ দেশি সানাই৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে পাপড়-তেলেভাজার দু-চারটি দোকান৷ বেলুন প্লাস্টিকের খেলনা বাঁশের বাঁশির পসরা নিয়ে ঘুরছে কয়েকজন ফেরিওয়ালা৷ তাদের ঘিরে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের জটলা৷ কেউ কেউ দুর্গা প্রতিমার সামনে কোমর দুলিয়ে জ্বলন্ত ধুপতি হাতে ঢাকের বাদ্যির তালে করছে আরতি৷ ছোট ম্যানেজার ঘোষসাব আজ পরেছেন ধুতি গরদের পাঞ্জাবি৷ হ্যাজাকের আলোয় চকচক করছে তার গলার সোনার চেন৷ তিনিই ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন অনুষ্ঠানের সবকিছু তদারক করছেন৷ নদী পারের অনেকটা দূর থেকে লোকটাকে দেখে ঘৃণায় মুখ থেকে থুতু ফেলল মংরা৷ একবার নিজের বাংলোয় ডেকে নিয়ে মংরার স্ত্রী ফুলিয়ার ইজ্জত নিয়েছিল হারামখোর লোকটা৷ সেই থেকে লোকটার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা মংরার৷ নদী পারে ঘোষসাবের পোঁ হয়ে তার মতব্বরির সহায়তায় মহা ব্যস্ত বাবুলাল লোহার৷ বাবুলালটাও পয়লা নম্বরের হারামি৷ লুকসান বাজার থেকে ঘোষসাবের জন্যে বিলেতি মদ কিনে এনে দেয়৷ শুয়ার কা বাচ্চা ঘোষসাব যখন তার বউয়ের ইজ্জত নিয়েছিল তখনও তার হয়েই সাফাই গেয়েছিল হারামি বাবুলাল৷ ঘোষসাবকে তেল দিয়ে শ্রমিক থেকে শালা এখন বৈদার (শ্রমিক সর্দার) হয়েছে৷ মাস তিনেক আগে মংরার বিরুদ্ধে ফ্যাক্টরি থেকে কাঁচা পাতা চুরির মিথ্যা অবিযোগ এনেছিল হারামখোর বাবুলাল৷ তার নালিশ শুনে, শুয়োরের বাচ্চা ঘোষসাব মংরাকে একমাস কাজ থেকে বসিয়ে দিয়েছিল৷

বেশ কিছুটা দৌড়ে গিয়ে মংরা ঝাঁপিয়ে‍ পড়ে ডায়নার জলে৷ নদীতে ঝপ করে বড় একটা শব্দ হল৷ চারদিকে ঘোর অন্ধকার৷ সর্বশক্তি নিংড়ে জোরে সাঁতরাচ্ছে মংরা৷ এদিকে পার থেকেও শোনা গেছে নদীতে ঝপ করে‍ কিছু একটা পড়ার বড় শব্দ৷ বোঝা যাচ্ছে কেউ যেন নদীতে সাঁতরে যাওয়ার চেষ্টা যাচ্ছে৷ আরও কয়েকজন ছুটে গিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে‍ পড়ল৷ তারা সাঁতরে‍ যাওয়ার চেষ্টা করল মংরার দিকে৷

ডায়না নদী পারে হ্যাজাকের আলোর চৌহদ্দির অনেকটা দূরে ঘন আঁধারে‍ একটা বড় গুঁড়ির পাকুড় গাছের আড়ালে শরীর লুকিয়ে দাঁড়িয়ে‍ মংরা৷ তাকিয়ে রয়েছে দুর্গা প্রতিমাকে ঘিরে চলতে থাকা উৎসব অনুষ্ঠানের দিকে৷ বাবুলালের দিকে চোখ পড়তেই মংরার শরীরটা ঘৃণায় রিরি করে উঠল৷ শুয়োরের বাচ্চা নয় ঘোষসাবকে দেখে একটা ধেড়ে শুয়োর বলে মনে হচ্ছে মংরার৷ এই ধেড়ে‍ শুয়োরটাকে মেরেই তো কাল অসুর একতা সমিতিকে দেওয়া যায়৷ দুর্গা ঠাকুরের দিকে নয়৷ মংরার চোখ কিছুক্ষণ স্তির হয়ে রইল প্রতিমার অসুরের মূর্তির দিকে৷ অসুররাজের সারা শরীরে বীরত্বের ঢল৷ হাত পা বুক পেট কাঁধ উরু সর্বত্র ফুলে ওঠা মাংসপেশিতে শারীরিক শক্তি ও বীরত্বের ছাপ ফুটে রয়েছে৷ অসুরের চুলের মুঠি এক হাতে টেনে রেখেছে দুর্গা৷ দুর্গার হাতের ত্রিশূল বিদ্ধ হয়ে রয়েছে অসুরের বুকে৷ গলগল করে রক্ত ঝড়ছে অসুররাজের বুক বেযে৷ বুকে ত্রিশূল বেঁধা যন্ত্রণাক্লিষ্ট অসুররাজ হাতের ঢাল খড়গ নাড়াতে পারছেন না৷ অসুররাজের চোকে চিকচিক করছে জল৷ মংরার মনে হল অসুররাজের অসহায় দৃষ্টি যেন তার দিকে৷ যেন তার প্রতি‍ অত্যাচারের প্রতিকার চাইছেন ভবিষ্যৎ বংশধর মংরার কাছে৷ মংরা অনুভব করল তারা শরীর তো রয়েছে‍ অসুররাজের বংশের রক্ত৷ মনে হল অসুররাজ যেন তাকে প্রতিশোধ নিতে বলছেন৷ বীর অসুর বংশের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য দু’চোখ দিযে‍ আকুতি জানাচ্ছেন৷ অসুররাজের অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মংরার শরীরের রক্ত যেন তেতে উঠছে৷ অসুরদের প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ নিতে তৈরি হয়েই এসেছে মংরা৷ এক পকেট থেকে বের করল বড় একটা পেয়ারা কাঠের গুলতি৷ অন্য পকেট থেকে বের করল ধাড়ালো কোণের একটা পাথর৷ এই গুলতি দিয়ে পাথর ছুঁড়ে‍ই অসুরেরা অরণ্যরে পাখি বনবিড়াল খরগোশ ইত্যাদি ছোট প্রাণীদের শিকার করে৷ এমনকি শুয়োর চিতা বাঘও অসুরদের ছোঁড়া গুলতির পাথরে ঘায়েল হয়ে মাটিতে লুটিযে পড়ে৷ তখন বল্লম ছুঁড়ে‍ বাকি কাজটা শেষ করা হয়৷ মংরার স্থির বিশ্বাস উস্কে‍ উঠল৷ তাদের সমাজের বর্তমান দুর্দশা ও অবহেলার মূলে তো সর্বনাশী দুর্গা৷ দুর্গার আশীর্বাদ পেয়েই চশমখোর ঘোষসাব বাবুলালরা অসুরদের পদানত করে রাখে৷ এসব ভাবতে ভাবতে‍ই মংরার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফোটা শুরু করল৷ তপ্ত রক্ত যেন মাথায় উঠে আসছে৷ মংরা অনুভব করছে প্রতিকার চাই৷ প্রতিশোধ চাই৷ বংশধর হয়ে অসুররাজের বীরত্বের মর্যাদা রক্ষা করা চাই৷ উত্তরসূরি হিসেবে অসুররাজের রক্তঋণ শোধ করা চাই৷ এই তো সুযোগ৷ গাঢ় আঁধারে‍ পাকুড় গাছের মোটা গুঁড়ি‍ থেকে শরীরের মাথা বুক একটু বের করে পাথর ভরা গুলতি‍ তাক করল মংরা৷ গুলতি থেকে‍ ছুঁড়তেই জ্যা মুক্ত ধনুকের থেকে বের হওয়া তীরের মতো তীব্র বেগে পাথর গিযে লাগল দুর্গা মূর্তির কপালে নাকে৷ মূর্তির নাক উড়ে গেল৷ কপাল গাল ফেটে চৌচির৷ মাথার মুকুট ছিটকে গিয়ে পড়ল অনেকটা দূরে৷ কী হল? সবাই হতভম্ব৷ কিছু বোঝার আগেই গুলতি তেকে‍ ইচটকে‍ আসা আর একটা ধারাল পাথর এস লাগল বাবুলালের কপালে৷ মাটিতে লুটিযে পনল বাবুলাল৷ কপাল বেযে নামতে থাকে রক্তের দারা৷ পরক্ষণেই পাকুড় গাছের আড়াল থেকে তীব্র গতিতে চিটকে আসা আর একটা পাথর লাগে ঘোষসাবের দু’ঠোটের মাঝে৷ পাথরের ঘায়ে টাল খেয়ে মাটিতে চিত হযে পড়েন ঘোষসাব৷ দাঁত মুখ থেকে‍ রক্ত ঝড়তে থাকে৷ পরপর আরও কয়েকটি ছিটকে আসা পাথরে ঘায়েল হয়ে যায় বেশ কয়েকজন৷ কী হল বোঝা যাচ্ছে না৷ শুরু হয় হইচই৷ ভয়ার্ত আর্তনাদ৷ ছুটোছুটি৷ নদী পারে শরীর আড়াল করার জায়গা নেই৷ হুটোপুটি করে সকলেই দুর্গা প্রতিমার পিছনে আশ্রয় নিতে ছোটে৷ দুর্গা প্রতিমার সামনের জমি নিমেষে ফাঁকা৷ গুলতি থেকে ছোঁড়া একের পর এক পাথর এসে লাগতে থাকে দুর্গা প্রতিমার সারা দেহে৷ প্রতিমা ভেঙে প্রায় চৌচির৷ ক্ষতবিক্ষত প্রতিমার দিকে তাকিয়ে মংরার মুখে হাসি৷ সে তখন এক ঝলক তাকাল অসুররাজের মূর্তির দিকে৷ অসুররাজের মুখে যেন প্রশান্তির হাসি৷ এদিকে দুর্গা প্রতিমার পেছনে শুরু হয়ে গেছে হইহল্লা৷ বোঝা যাচ্ছে পাকুড় গাছটার দিক থেকে কেউ গুলতি থেকে ঢিল ছুঁড়ছে৷ কিন্তু সেদিকে এগোনো যাচ্ছে না৷ কারণ যে কোনও সময় আরও ঢিল এসে পড়তে পারে৷ নদীর ঘাটে সবাই তো নিরস্ত্র৷ কিছুক্ষণ৷ তারপর একদল লোক সাহস করে ধেয়ে আসতে থাকে পাকুড় গাছের দিকে৷ না, আর দেরি করা ঠিক নয়৷ বেশ কিছুটা দৌড়ে গিয়ে মংরা ঝাঁপিয়ে‍ পড়ে ডায়নার জলে৷ নদীতে ঝপ করে বড় একটা শব্দ হল৷ চারদিকে ঘোর অন্ধকার৷ সর্বশক্তি নিংড়ে জোরে সাঁতরাচ্ছে মংরা৷ এদিকে পার থেকেও শোনা গেছে নদীতে ঝপ করে‍ কিছু একটা পড়ার বড় শব্দ৷ বোঝা যাচ্ছে কেউ যেন নদীতে সাঁতরে যাওয়ার চেষ্টা যাচ্ছে৷ আরও কয়েকজন ছুটে গিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে‍ পড়ল৷ তারা সাঁতরে‍ যাওয়ার চেষ্টা করল মংরার দিকে৷ মংরার শরীরে তখন যেন অসুর বংশের শক্তি৷ টগবগ করে ফুটছে রক্ত৷ শীর্ণ দেহেও মনে হচ্ছে শরীরের সব জায়গার পেশি যেন শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে৷ শরীরে এসেছে বাড়তি শক্তি৷ অসুররাজ ও তার বংশধরদের প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ নিতে পেরেছে৷ মংরার মনে সাফল্যের তৃপ্তি৷ বাড়তি‍ উৎসাহ৷ প্রাণপনে সাঁতরে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মংরা৷ টের পেল যারা তার দিকে সাঁতরে এগোচ্ছে তাদের থেকে মংরার দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে৷ অসুররাজ নিধনের প্রতিশোধ নিতে পারায় প্রবল উৎসাহে খুশির জোয়ারে ডায়নার জলে ভেসে তীরগতিতে সাঁতরে এগিয়ে চলেছে মংরা৷