বাঙালির বিদেশযাত্রা এবং

“২০১৬ সালের ৯ই নভেম্বরের সকাল। তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি।গৃহকর্তা আজ ঘুম থেকে উঠেছেন খুব সকালে। গত কাল রাতে দেশে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এমন ঘটনার সাক্ষী এর আগে কখনো দেশবাসী হয়নি। রাতে খবরটি প্রচার হওয়ার পর পর ভদ্রলোক বেশ কয়েকটি ফোন পেয়েছেন। তখন অনেক রাত। যাঁরা ফোন করেছিলেন তাঁদের প্রায় সকলকেই উনি চেনেন। এই জেলার নামী ডাক্তার ওঁরা।ভদ্রলোকের সঙ্গে ওঁদের সম্পর্কও বহুদিনের। খুব নাকি জরুরি কথা আছে, এবং তা বলতে হবে সাতসকালেই, বেশি বেলা করা যাবে না। তাই উনি প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন।”

“সকাল ছটা থেকে আটটা। সেইদিন সকালে এই দুঘন্টায় ভদ্রলোকের আলমারিতে ঢুকে গেল একাশি লক্ষ টাকা। সব পাঁচশো এবং এক হাজার টাকার নোট। আর যাঁরা দুহাত ভরে টাকা এনে তুলে দিয়ে গেলেন তাঁরা এই বাংলারই কোনো এক জেলার নামী ডাক্তার। ওঁদের সকলের একটাই অনুরোধ ছিল। “টাকাটা রাখুন। সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে ওই টাকাটা দিয়ে আমাদের সপরিবারে বিদেশভ্রমণ করিয়ে দেবেন। ব্যালান্স যা থাকবে তা দিয়ে দেওয়া যাবে। “ওই বছরের ৮ই নভেম্বর সরকারি ঘোষণায় বাতিল হয়েছিল পাঁচশো, হাজার টাকার নোট।

এইটুকু বলে চারণ থামলেন। দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত এলাকায় ওদের নতুন অফিস কেনা হয়েছে। অনেকদিন অফিস দেখতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন কিন্তু যাওয়া হয়নি। কেননা শীত

গ্রীষ্ম এবং পুজোর সময় তাকে মস্ত দল নিয়ে বিদেশ ভ্রমনে বেরোতে হয়। পনেরো কুড়ি দিন ঘুরে এসে দিন পাঁচেক কাটিয়ে ফের উড়োজাহাজের পেটে। বিদেশ থেকে ফিরে লোকে নতুন দেখে আসা দেশের গল্প শোনায়। কিন্তু চারণ এস্কিমোদের দেশেই ঘুরে এসেছেন বার সাতেক। ইউরোপের প্রায় সব কটি রাষ্ট্রকে নিজের পাড়া বানিয়ে ফেলেছেন সে কারণে। তাই ওঁর কাছে আমি যে সব গল্প শুনতে যাই সেইসব গল্প একেবারে অনাস্বাদিত। বিজ্ঞাপনী ভাষায়, “এ স্বাদের ভাগ হবে না”। তবে মুখ খোলার আগে প্রতিবারের মতই তিনি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ করেন— দেখবেন আমার আর কোম্পানির নামটা আবার রাষ্ট্র করে বসবেন না যেন। তবে কি জানেন, আপনাকে যা যা বলব তার সব সাক্ষী আছে। আমার তথা কোম্পানির ল্যাপটপে সব কিছু রাখা থাকে সাজিয়ে।

ওঁর নামটা তাই বানিয়ে রাখা। ওঁর সঙ্গে আলাপ বেশ কয়েক বছর আগে, আমার প্রথম ইউরোপ সফরের সময়। তিনি তখন একটি বাঙালি ভ্রমণ সংস্থার সর্বেসর্বা। প্রথম আলাপের দিনে জেনেছিলাম চারণ সাধু হতে চেয়েছিলেন, শুধু দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবেন বলে। তাঁর চেহারা ও কথাবার্তায় একটা বিশ্বাসযোগ্যতার সিলমোহর আছে। তাই ফাইনাল ইনস্টলমেন্টের চেক তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার সময়  মনের মধ্যে কোন গুড়গুড়ানি ভাব ওঠেনি। আর যাত্রা শুরুর আগে একটি হোটেলে যেদিন সবকিছু আমাদের হাতে তুলে দেবার সময় ফাইনাল মিটিং হল সেদিন চারণ একটি কথা বলেছিলেন তা আজও মনে আছে। বলেছিলেন— বিদেশ যাত্রার রাতে যদি ডলার ভরা ব্যাগটা বাড়িতে ফেলেও যান তা হলেও নিশ্চিন্তে ঘুরে আসবেন। কেননা ওখানে প্রদেয় সব কিছু কড়ায় গন্ডায় মেটানো আছে। এমন কী বকশিসের টাকা অবধি। কথাটি ভ্রমণ শেষে ফলতে দেখেছিলাম।

দল বেঁধে বাঙালিরা কবে থেকে বিদেশমুখী হল? আমার এই প্রশ্নের উত্তরে চারণ জানিয়েছিলেন “২০১০ সাল থেকে। ওই সময় থেকেই আমাদের দেশে বাণিজ্যিক আন্তর্জাতিক উড়ানের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।

এর পর সেই দুঃসহ কোভিড মহামারী। পৃথিবীর ভ্রমণ শিল্পটাই ঢুকে গিয়েছিল ভেন্টিলেশনে। চারণের সেই কোম্পানিও তার ব্যতিক্রম হতে পারেনি।ওই সময় তাঁর সঙ্গে আমার কথা হত।তাঁর অফিসের অনেকেই অন্য জীবিকা খুজে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।কিন্তু চারণ বিশ্বাস করতেন, আবার সব ঠিক  হয়ে যাবে। যে সংস্থায় তিনি চাকরি করতেন মহামারী তাদের পঙ্গু করে দিয়ে গেল। চারণ এবার কলকাতার বেশ কয়েকটি ভ্রমণসংস্থা থেকে ডাক পেলেন। তিনি যে সংস্থায় সবদিক দেখে শুনে যোগ দিলেন, সৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম আছে সেটির৷

সারা ভারতে যত বিদেশ বেড়ুনে কোম্পানি আছে তাদের মধ্যে ভাগ্যবান হলেন যাঁরা কলকাতা তথা এই বঙ্গে ব্যবসা করেন। কেননা, গোটা ভারত যেখানে ব্যবসা করে শীত ও গ্রীষ্ম ঋতুতে সেখানে মা দুর্গার আশিসে এঁদের লক্ষ্মী লাভ সবচেয়ে বেশি হয়   পুজোর ছুটির মরশুমে। যা শুরু হয় পয়লা অক্টোবর থেকে, চলে ১৫ই নভেম্বর পর্যন্ত ।

এই বছর আমাদের ডিপারচারের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় চারশ গুণ বেশি। সেদিন বেশ গল্প করার মুড্ নিয়েই শুরু করেছিলেন তিনি। ডিপারচার মানে এক একটা দল যখন বিদেশযাত্রা করছেন সেগুলিকে আমরা ডিপারচার বলি। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল অব্ধি এক পয়সার ব্যবসাও কেউ করতে পারেনি। ২০২২ সালে আমরা ৬টা ডিপারচার করাতে পেরেছিলাম, সেই সংখ্যা এই বছরে ২৩ এ উঠেছে।পুজোর মরশুম ছাড়া আর যে দুটি মরশুম বা ঋতুতে আমরা ব্যবসা করে থাকি তা হল শীত আর গ্রীষ্ম। আমাদের ক্যালেন্ডারে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি হল শীত আর এপ্রিল থেকে জুন হল গ্রীষ্ম। ফেব্রুয়ারি, মার্চ আর এপ্রিল এই তিন মাস আমাদের ব্যবসা তেমন থাকে না।”

দল বেঁধে বাঙালিরা কবে থেকে বিদেশমুখী হল? আমার এই প্রশ্নের উত্তরে চারণ জানিয়েছিলেন “২০১০ সাল থেকে। ওই সময় থেকেই আমাদের দেশে বাণিজ্যিক আন্তর্জাতিক উড়ানের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। আমার চাকরি শুরু ২০০৭ থেকে। কাজেই মনে পড়ে কীভাবে আমরা চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলাম যে দল বেঁধে বিদেশ সফর করালে ব্যবসা জমানো যাবে কি না।

তার আগে কি তাহলে বাঙালি বিদেশ বেরাতে যেত না?— আমার প্রশ্নের উত্তরে উনি জানিয়েছিলেন, বিত্তশালী বাঙালিরাই তখন স্বনির্বাচিত বা কাস্টমাইজড ট্যুরে বেরতেন। এখন অবশ্য বাঙালিদের দৌলতেই এই বাংলায় আমরা করে খাচ্ছি। বিদেশ দেখতে যাওয়া বাঙালিদের গড় বয়েস ৫০ থেকে ৭০। আমরা বুক করার সময় সবার আগে ক্লায়েন্টের বয়েস জিজ্ঞাসা করি। বয়সোচিত বেশ কিছু সমস্যা আছে যা হঠাৎ করে যা মাথা চাড়া দিতে পারে। তবে বিদেশ যাবার আগে আমাদের প্রতিটি যাত্রীর মোটা অঙ্কের স্বাস্থ্যবিমা করে দিই। এটা আমাদের দু তরফেই যে কতটা স্বস্তির ব্যাপার তা ভুক্তভোগীরাই শুধু বোঝেন৷দলে দু একজন ডাক্তার থাকাটা আমাদের কাছে স্বস্তির ব্যাপার। আমরা তাঁদের রিকোয়য়েস্ট করি হঠাৎ এমারজেন্সিতে লাগার মতো ওষুধ যেন তাঁরা সঙ্গে রাখেন।

এই প্রসঙ্গে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা জানাই। আমাদের ইওরোপ সফরের একেবারে শুরুতেই এক বয়স্ক সহযাত্রী আমাদের লন্ডন শহর পরিক্রমার প্রথম দিনেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর  প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছিল। ভাগ্য ভালো তাঁর স্ত্রী ছিলেন একজন অভিজ্ঞ নার্স। তিনি প্রাথমিকভাবে সামলে দিলেও পরে কোলন শহরে বেড়াবার সময় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে যাত্রায় একজন ডাক্তার সহযাত্রী আমাদের ট্যুর গাইডের সহায়তায় একটি  ওষুধের দোকানে গিয়ে ব্যক্তিগত প্রেসক্রিপশন প্যাডে ওষুধের নাম লিখে তা জোগাড় করে দেন বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে। বেশ মনে আছে তাঁর রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ভেরিফিকেসন করে যতক্ষণ দোকানি নিশ্চিত না হলেন, ততক্ষণ আমাদের সকলকেই অপেক্ষা করতে হয়েছিল।তবে সেই ওষুধ খেয়ে ভদ্রলোকের দেশে ফেরা পর্যন্ত আর কোন অসুবিধে হয়নি।

ওঁদের ডিপার্চার বা একটি দলে কমপক্ষে কুড়িজন যাত্রী থাকতেই হবে। আর বেশি হলে পঞ্চাশ। ছোট দলে ম্যানেজার থাকেন একজন আর বড় হলে দুজন। ওঁরা যে দেশে বেড়াতে নিয়ে যান সেই দেশেরই স্থানীয় গাইড ভাড়া করেন। এই প্রসঙ্গে  চারণ জানালেন, এখন এই লাইনে এত উজ্জ্বল আর মেধাবী যুবক যুবতীরা আসছেন যে তারা বিদেশ ভ্রমণে একটি আলাদা মাত্রা যোগ করে দেন।

আমাদের দেশে মুম্বইবাসী একজন মানুষ আছেন তাঁর নাম উমেশ ফেরোয়ানি। বেশ কয়েকটি গ্রন্থপ্রণেতা এই যুবকটির সার্ভিস নিতে ভারতীয় প্রায় প্রতিটি ভ্রমনসংস্থা যে কোনও মূল্যে তাঁকে পেতে মুখিয়ে থাকেন। এমনও দেখা যায় যে একটি দল নিয়ে তাঁর যেদিন দেশে ফেরার কথা তার আগের রাতে অন্য একজন গাইডের হাতে দলের দায়িত্ব দিয়ে তিনি নতুন দল নিয়ে পাড়ি জমান অন্য কোনও দেশে। তাঁর চমৎকার চেহারা এবং বাচনভঙ্গির জন্য তিনি বেশ কয়েকটি ফিল্মেও অভিনয় করেছেন।

চারণ জানিয়েছিলেন, ভ্রমণ সংস্থাগুলির মতে পর্যটকদের তিনটি শ্রেণী হয়। Inbound(যেসব বিদেশী পর্যটকরা আমাদের দেশে বেড়াতে আসছেন, থাকতে নয়), Outbound(আমরা যখন বিদেশে বেরিয়ে ফের ফিরে আসি দেশে) এবং Domestic(অন্তর্দেশীয় )

যে দেশের ইনবাউন্ড পর্যটকদের সংখ্যা যত বেশি সেই দেশের  জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে অবদান তত বেশি হয়। আমাদের দেশে কিন্তু ইনবাউন্ড পর্যটকদের আগমন খুবই কম। যে রাজ্যটির প্রতি বিদেশীদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ সেটির নাম কাশ্মীর। কিন্তু রাজনীতিগত কারণে তাঁরা দেশটিকে এড়িয়ে যান। যে ক’টি জায়গার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের জিডিপির ভান্ডার খানিকটা মজবুত হয়, সেগুলি হল, কেরালা (মূলত সমুদ্র সৈকতগুলির জন্য), গোয়া, আন্দামান, রাজস্থান, আগ্রা এবং অজন্তা। আর একটি জায়গা ধর্মীয় কারনে বেশ কিছু বিদেশী পর্যটক এখনো আসেন সেটি হল বুদ্ধগয়া। আর কলকাতার ‘মেঘদূতম ট্রাভেলস’ সদ্য শুরু করেছে দুর্গাপুজো দেখতে চাওয়া বিদেশীদের কলকাতা ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবসা।

আউটবাউন্ড ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে বিষয়টি দাঁড়ায় ঠিক বিপরীত।  অর্থাৎ আমরা দেশের টাকা দিয়ে আসছি বিদেশিদের কোষাগারে। আর সেই কারণে আপনাকে আমাকে দিতে হবে ২০% টিসিএস (tax collected at source) এবং তা আদায় করার অধিকার দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ট্যুর অপারেটরকেই।

সরকার সবচেয়ে খুশি হন যদি দেশের মানুষ দেশের মধ্যেই বেরিয়ে বেড়ান। তাতে পর্যটকদের ব্যাগ ভর্তি টাকা অনেকের হাতে পৌঁছতে সাহায্য হয় পরোক্ষভাবে।

তবে একটা বিষয়ে ভারতীয়রা ভয়ংকরভাবে রক্ষনশীল আজও। তা হল খাবার। ইয়োরোপে আমরা সব জায়গায় আমাদের ক্লায়েন্টদের ভারতীয় হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে যাই। যেখানে ভাত রুটি আর ডালের সঙ্গে থাকে চার পাঁচরকম নিরামিষ পদ। আর আমিষের পাত্র রাখা থাকে বেশ দূরে একটি বা দুটি আলাদা পাত্রে।

বিদেশ যাবার সময় চারণদের কোম্পানি দেয় টাকা। তিনটি সমান কিস্তিতে আদায় করেন। প্রথমটি যাত্রা আপনি যেদিন সুনিশ্চিত করলেন এবং নাম লেখালেন। এর পরের দুটি যথাক্রমে যাত্রার দুই মাস ও এক মাস আগে।  

আচ্ছা ধারে ভ্রমন হয় না? ধরুন আপনাকে বললাম দুজনে বিদেশ ঘুরে ফিরে আসি তারপর ঠিক টাকা মিটিয়ে দেব। আমার প্রশ্নের 

উত্তরে  হেসে বললেন, না তা এখনও হয় না। তবে গুরগাঁওয়ের একটি সংস্থা, নাম “সংকাশ” এই ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে। তারা তাদের ক্লায়েন্টদের ট্যাঁকের জোর ভালভাবে পরীক্ষা করে তাঁদের বেড়াতে যাওয়ার টাকাটা তুলে দেবেন ভ্রমন সংস্থার ফান্ডে। তা দেওয়া হবে ধার হিসেবেই এবং সমান মাসিক কিস্তিতে তা ফেরত দিতে হবে প্রাপককে। 

চারণদের বিদেশ যাওয়া দলে শতকরা আশি ভাগ বাঙালি এবং কুড়ি ভাগ অবাঙালি থাকে। সেই তথ্য জানিয়ে চারণ বলতে থাকেন—সিংহভাগ অবাঙালি বিদেশ যেতে আমাদের কাছেই আসেন এবং আমরা ওদের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী আইটেনারি তৈরি করে দিই।  ট্যুর শুরুর আগে কিন্তু বেশিরভাগই একথা বলে রাখেন বিদেশে তাঁরা ঘুরবেন ফিরবেন একেবারে নিজস্ব সময় ধরে এবং মর্জি নিয়ে। টাকাকড়ি এঁদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। আমরা দেখেছি কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে নানাভাবে বেলাগাম হয়ে ওঠেন আবার ফেরার প্লেন ওঠার আগেই নিজের চেনা খোলসে ঢুকে পড়েন।

আর মধ্যবিত্ত বাঙালি, যাঁরা শেষ জীবনে বিলেত দর্শনে যান?  

প্রথম বিদেশ যাওয়ার আনন্দে কোনও কোনও প্রবীণ একটু চপলমনা হয়ে ওঠেন। দীর্ঘশ্বাস সবসময়েই যে দুঃখ ভরা হবে, তা কিন্তু নয়। সুখে ভরা শ্বাসও অনেক সময় সুদীর্ঘ হতে পারে। কেউ কেউ উজ্জ্বল হাসি হেসে বলেন, সারাজীবন কষ্ট করে ছেলেমেয়ে মানুষ করেছি। তা তারাই জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। আপনারা আমাদের ঘুরিয়ে ওদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দেবেন। আবার এমন দম্পতিও এসেছেন দুঃখের শ্বাস ফেলে স্বগতোক্তির মতো করে বলেন, দুরদুর, টাকাকড়ি কারও জন্য রাখব না। দুজনে মিলে দেশ দেখে খরচা করে ফেলব। কষ্ট করে জমানো টাকা অন্যদের হাতে দিয়ে লাভ আছে কোনো? সামান্য কটি কথা, তবু ক্লায়েন্টদের বিষাদের ছোঁয়া আমাদের মনেও কালো মেঘ সঞ্চার করে।

তবে একটা বিষয়ে ভারতীয়রা ভয়ংকরভাবে রক্ষনশীল আজও। তা হল খাবার। ইয়োরোপে আমরা সব জায়গায় আমাদের ক্লায়েন্টদের ভারতীয় হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে যাই। যেখানে ভাত রুটি আর ডালের সঙ্গে থাকে চার পাঁচ রকম নিরামিষ পদ। আর আমিষের  পাত্র রাখা থাকে বেশ দূরে একটি বা দুটি আলাদা পাত্রে। এতেই বেশ চলছিল। কিন্তু দিন বদলাচ্ছে। হঠাৎ বাঙালি খেতে চাইল একটি ডিনার বা লাঞ্চে স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে। এখন তাই একটি দিন এইভাবে স্থানীয় কোনও বড় রেস্তোরায় আগাম ব্যবস্থা আমরা করে রাখি। কয়েক মাস আগে ভাগ্যের জেরে ছোটোখাটো একটি দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। 

—ঘটনাটি ঘটেছিল ইটলিতে। চারণ বলতে থাকেন, আমিই সেবার গ্রূপ নিয়ে ইটলি সফরে। মিলান শহর পরিক্রমা শেষে রাতে ডিনার খাওয়াতে নিয়ে গেছি একটি নামকরা রেস্তরাঁয়। আমাদের জন্য যে খাবার রাখা হয়েছিল তার একটি মেনু কার্ড আমার হাতে দেওয়া হয়েছিল। “রগু” নামের একটি অচেনা শব্দ ছাড়া বাকি পদগুলি আমার চেনা ছিল। তাই “রগু” নিয়ে আমি আর তেমন মাথা ঘামাইনি। কিন্তু যেই না বস্তুটি প্লেটে করে টেবিলে রাখতে শুরু করেছে অমনি “রগু” নামের অর্থ পরিষ্কার হয়ে যায়। কেননা খাবারটির সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচিতি ছিল। যা কিনা বানানো হয় বিফ অথবা পর্কের সাহায্যে। তড়িঘড়ি উঠে ম্যানেজারকে বলে সে যাত্রায় সামাল দিই আমি। তবে অতগুলি প্লেট “রগু”র দাম কিন্তু আমাকে মেটাতে হয়েছিল। 

আমাদের গতায়ু বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিদেশে গিয়ে যে কোনও ভারতীয় পর্যটক বিপদে পড়লে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবার জন্য যে নির্দেশ গিয়েছিলেন তা আজও প্রশংসিত এবং পালিত  হচ্ছে সকলের কাছে।

অনেকে বুকিংয়ের সময় বলেন, দু-সপ্তাহর জন্য বেড়াতে গিয়ে এতগুলো টাকার ইনসিওরেন্স করে লাভ কি? তখন তাঁদের সামনে অনেক ঘটনা তুলে ধরতে হয়। আমাদেরই অভিজ্ঞতা সেসব। যেমন একটি ঘটনার কথা বলি। দক্ষিন ভারতীয় ভদ্রলোক ছিলেন একজন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। উনি ছিলেন আমাদের আইসল্যান্ড সফর দলের একজন সদস্য, যেখানে সদস্যসংখ্যা ছিল ৫৬ জন। তবে তিনি নিজে যা ভালো বুঝবেন, তেমনটি করার মতো এক মানুষ। আইসল্যান্ড সফরে গেলে পাঁচটি পরিধেয়র কথা আমরা একেবারে ছবিসহ জানিয়ে দিই। সেগুলি হলো বিশেষ ধরনের টুপি, জ্যাকেট, ইনার, মোজা এবং স্পাইক লাগানো জুতো। যা ছাড়া বরফে হাঁটার ব্যাপারটা দুঃস্বপ্ন। কলকাতা শহরের বিশেষ দুএকটি দোকানের কোথাও আমরা বলে দিয়েছিলাম যেখানে সবগুলি এক ছাদের নিচে পাওয়া যায়। আমরা সফর শুরু করছিলাম রেগ্যাকিক শহর থেকে যা আইসল্যান্ডের রাজধানী। সকাল বেলায় বেরোবার আগে দেখলাম ওই দক্ষিণী ভদ্রলোক ছাড়া সবাই আমাদের কথামতো পোশাক পরে নিয়েছেন কিন্তু ওই ভদ্রলোকের পায়ে সেই স্পাইকওলা জুতো ছিল না। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে একটি ঝাঁঝ মিশিয়েই বলেছিলেন, আমারটা আমি বুঝে নেব। সেদিনই বিকেলবেলায় কোথাও একটি গ্লেসিয়ার দেখতে গিয়েছি।  চারপাশে পাঁজা পাঁজা বরফ। সকলে ধীরে সুস্থে হেঁটে বেড়াচ্ছেন হঠাৎ খবর এল, সেই ভদ্রলোক পা পিছলে পড়ে গিয়েছেন শানবাঁধানো মেঝের ওপর। ঠিক জুতো না পরার মাশুল দিলেন প্রথম দিনেই। সেদিন সেই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। ডাক্তাররা বললেন, কোমরের হাড় ভেঙেছে। অপারেশন তখুনি করতে হবে। ছাড়া পাবার কথা ডাক্তাররা বলতেই চাইলেন না। সে যাত্রায় তাঁর আঠেরো হাজার ইউরো খরচ হয়েছিল। আর আমাদের দু সপ্তাহ পর ফেরার দিনই ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি হাসপাতাল থেকে। হুইলচেয়ারে অতি সাবধানে তাকে প্লেনে বসানো হয়েছিল।  কপাল ভালো তাই ইনসিওরেন্স কোম্পানি হাসপাতালের পুরো বিল মিটিয়ে দিয়েছিল। এই ব্যাপারে একটি বিষয় জানিয়ে রাখি। আমাদের গতায়ু বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিদেশে গিয়ে যে কোনও ভারতীয় পর্যটক বিপদে পড়লে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবার জন্য যে নির্দেশ গিয়েছিলেন তা আজও প্রশংসিত এবং পালিত  হচ্ছে সকলের কাছে।

বিদেশ ভ্রমনের সময় আরেক ভয়াবহ ঘটনা পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলা বা চুরি যাওয়া। এমনটি হলে সেই পর্যটককে আমরা হোটেলেই ছেড়ে আসব এবং তিনি স্থানীয় ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন একটি অস্থায়ী পাসপোর্ট পেতে। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ সেই ট্যুরিস্টের ঠিকানা সঠিক কিনা বিস্তারিতভাবে তা জানার পরেই অস্থায়ী পাসপোর্ট ইস্যু করবেন।

খবরের কাগজে কেচ্ছা কাহিনি ছাপার ঢের আগে ওঁরা জানতে পারেন কোন রাজপুরুষ সঙ্গিনী নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন শিল্প আনতে।  এই সব যাত্রায় হয় সরকারি নয় রহস্যময় কেউ একজন গৌরী সেন হয়ে আসেন। ধরা পড়ার পর সরকারি এজেন্সি অনুসন্ধানকারীদের মুখোমুখিও বসতে হয় এবং তুলে  দিতে হয় যাবতীয় তথ্য প্রমাণ।  তাতে কাজ হলে মনটা খুশি খুশি লাগে।

জানাই আরেক ডাক্তারবাবুর কথা যিনি নিয়মিত নানা চ্যানেলে মুখ দেখান, ন্যায়নীতির কথা বলেন। কিন্তু তিনিই আবার পঞ্চাশ জন ডাক্তারের দল তৈরি করে চারণদের খবর দেন— বুকিং মানি পাঠাবার সবকিছু রেডি। বিনিময়ে তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে দিতে হবে নিখরচায় ভ্রমনের সুযোগ। বর্তমান ডামাডোলের বাজারে তিনি এখন সরে দাঁড়িয়েছেন। ওই কাজ দেখছেন তার স্ত্রী।

ব্যবসার জন্য সরাসরি ঘুষ দেননি জীবনেও। তবে তাঁর এক মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বন্ধুর খাতিরে এক ডাক্তারের চেম্বারে তার কোম্পানি প্রদত্ত আইকার্ডটি গলায় ঝুলিয়ে যেতে হয়েছিল যাতে তিনি সেই বন্ধুটির কোম্পানির ওষুধ লিখতে প্রত্যাখ্যান না করেন। ডাক্তারটি সব ওষুধ বিক্রেতার কাছে বাঁধা পড়ে আছেন এইভাবে, বিদেশে নিয়ে গেলেই প্রেসক্রিপশনে তোমার ওষুধের নাম লিখে দেব।

আড্ডা শেষে চারণ জানিয়েছিলেন, এত বছর এই ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে একটি জিনিস খুব বুঝলাম, রাইট ভাইদের তৈরি সেই “ফ্লায়ার” যত  দিন যাচ্ছে তত পৃথিবীকে ছোট করে আনছে। আর এই যে এত মানুষকে আমরা বিদেশ ঘুরিয়ে আনছি স্পষ্টাস্পষ্টি ভাবে এদের দুভাগে ভাগ করা যায়। এক দল যাঁরা সত্যই বিদেশের সৌন্দর্য  আকন্ঠ পান করে নিজেরা মৌতাত উপভোগ করতে চান নিরিবিলিতে। আর এক দল বিদেশ যান স্রেফ নাম কিনতে আর ফেসবুকে নতুন নতুন স্ট্যাটাস দিয়ে পরিচিত জনদের হিংসা বাড়াতে। এবং বিদেশ ভ্রমনের অভিজ্ঞতার কথা তারিয়ে তারিয়ে চারপাশের সকলকে রাষ্ট্র করতে।