বিদেশি রসনায় দেশীয় পক্ষী

প্রাথমিক পর্যায়ের বৃটিশ আমলে ভ্রাম্যমান রাজকর্মচারীদের নির্ভর করতে হত ক্যাম্প বা শিবিরের কাছাকাছি বসতিসম্পন্ন গ্রামগুলির ওপর৷ তরি‍-তরকারি, দুধ জোগাত হিন্দু অধিবাসীরা৷ আর ডিম, মুরগি বা নানাবিধ মাংসের জন্য ছিল মুসলমান পাড়া৷ পরে ডাকবাংলোগুলি তৈরি হওয়ার ফলে প্রত্যন্ত জায়গাগুলিতেও এগুলি অনায়াসে উপভোগ করা যেত৷ হয় চাপাটি নয়তো ভাতের সঙ্গে পাওয়া যেত মুরগির কারি, নয়তো রোস্ট৷ যদিও তৎকালীন অনেকেই দেশীয় মুরগিকে তাঁদের নিজের দেশের মুরগির তুলনায় অনেকটাই ছোট, মাংসহীন ও চর্বির অভাবে স্বাদহীন বলে মনে করেছেন৷ তবু রাজ আমলের অনেকেই তাঁদের রান্নার বইতে দেশীয় রাঁধুনীদের অশেষ প্রশংসা করে জানিয়েছেন যে স্বাদহীন ওই মুরগিগুলোর সাহায্যেই তারা তৈরি করত প্রশংসনীয় স্বাদের নানা মুখরোচক পদ৷ সেইরকম ভাবেই সকলের চিত্তজয়ী একটি পদ ছিল Country Captain৷ কীভাবে কেন এই নামটি রাখা হয়েছিল ঠিক জানা নেই৷ দেশীয় যা কিছু সবই তকমা পেয়েছিল Native বা Country৷ সম্ভবত যে প্রথম তিনটি পদ বানিয়েছিল সে ছিল সৈন্যাবাসে রাঁধুনিদের মধ্যে প্রধান৷ বিভিন্ন পদ্ধতিতে রান্না করার চল থাকলেও সহজ পন্থাটি ছিল মুরগি ছোট টুকরোয় কেটে নিয়ে রান্নার পাত্রে ২-৩ আউন্স ঘি দিয়ে পেঁয়াজগুলো আগে ভেজে নেওয়া৷ পেঁয়াজ ছেঁকে তুলে ওই ঘিতে ১/২ চামচ হলুদ ও ১/২ চামচ লঙ্কা বাটা ভেজে মুরগির টুকরো অল্প আঁচে‍ জলের ছিটে দিয়ে দিয়ে নরম না হওয়া পর্যন্ত ভেজে নিয়ে Serving Dish-এ ঢেলে দিয়ে ওপরে ভাজা পেঁয়াজ ছড়িয়ে দেওয়া৷

আরও বিস্তারিত উপকরণের সাহায্যে বেশি স্বাদু করার চেষ্টায় যে Country Captain পদটি তৈরি করা হ’ত, তার জন্য প্রয়োজন হ’ত বড় একটি মুরগি৷

৪ আউন্স ঘি‍

৩টি বড় পেঁয়াজ, পাতলা করে কাটা

৫ কোয়া রসুন, থেঁতো করে নেওয়া

২ টেবিল চামচ বাটা তাজা আদা

১ চা চামচ বাটা হলুদ

২ চা চামচ গোলমরিচ গুঁড়ো

৩/৪ টেবিল চামচ সবুজ বা লাল কাঁচা লঙ্কা কুচি‍

২টি লবঙ্গ, থেঁতো করে নেওয়া

চিকেন স্টক বা জল

১/২টা লেবুর রস

স্বাদমতো নুন

১টা পেঁয়াজ গোল গোল খুব পাতলা করে কাটা

সাজাবার জন্য সবুজ ও লাল চেরা কাঁচালঙ্কা

মুরগি ভালো করে ধুয়ে ৮ টুকরোয় কেটে রাখতে হবে ও চর্বি ছাড়িয়ে নিতে হবে৷ রান্নার পাত্রে ঘি গলিয়ে টুকরোগুলো এপিঠ ওপিঠ পাল্টে পাল্টে লাল করে ভেজে নিয়ে তুলে রাখতে হবে৷ এবার ঘিয়ের মধ্যে পেঁয়াজ কুচিগুলো এবং রসুন ও আদা দিয়ে হালকা রং ধরলে তার মধ্যে লঙ্কা, হলুদ, গোলমরিচ ও লবঙ্গ দিয়ে ২/৩ মিনিট নাড়তে হবে৷ তারপর মুরগির টুকরোগুলো দিয়ে স্টক মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে‍ অন্ততঃ ২০ মিনিট মাংস সেদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রান্না করতে হবে৷ অল্প ঝোল থাকতে লেবুর রস ও নুন দিয়ে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে ফেলতে হবে৷ পরিবেশনের আগে Serving Dish-এ চেপে তার ওপর পেঁয়াজের গোল গোল পাতলা রিং ও চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে৷

Henrietta Harvey-এর বইতে Anglo-Indian Cookery at Home Morgee Curry রান্নার হদিশ পাই সেটা বানাতে লাগত–

১টা মাঝারি মুরগি পরিষ্কার করে ধুয়ে আড়াআড়ি করে ৩ খণ্ডে কেটে পা দুটি আলাদা করে রাখা

২ টেবিল চামচ ঘি বা মাখন

১টি বড় পেঁয়াজ কুচনো

৪/৫টি রসুনের কোয়া

১ টেবিল চামচ কারি পাউডার

১ কাপ ঘন নারকেলের দুধ

১ টেবিল চামচ তেঁতুলের ক্কাথ

১ চা-চামচ ভিনিগার অথবা লেবুর রস

স্বাদমতো নুন

রান্নার পাত্রে ঘি গরম করে পেঁয়াজ কুচিগুলি লাল করে ভেজে নিতে হবে৷ এবার তার মধ্যে রসুন ও কারি পাউডার মিশিয়ে সাঁতলানোর পর মুরগির টুকরোগুলো মিশিয়ে মিনিট ৫/৬ নাড়াচাড়া করতে হবে৷ এরপর দেড় কাপ জল মিশিয়ে নুন দিয়ে ঢাকা দিয়ে মাঝারি আঁচে ১৫ মিনিট সেদ্ধ করতে হবে৷ খেয়াল রাখতে হবে যাতে নীচে ধরে না যায়৷ ঢাকনা খুলে নারকেলের দুধ মিশিয়ে আরও ৫ মিনিট ফোটাতে হবে৷ ওপরে ঘি ভেসে উঠলে তেঁতুলের ক্কাথ ও ভিনিগার বা লেবুর রস দিয়ে ২ মিনিট পর নামিয়ে নিতে হবে৷

টমেটো দিয়ে মুরগি রান্নার একটি প্রণালি জানিয়েছেন Mrs. Franiji.

Chicken Curry with Tomatoes

৮ টুকরো করে‍ কেটে নেওয়া ১টি মাঝারি মাপের মুরগি‍

২ টেবিল চামচ ঘি‍

৪টি খোসা ছাড়ানো কুচোনো টমেটো

১টি ছোট পেঁয়াজ, কুচিয়ে কাটা

৬ কোয়া থেঁতো করা রসুন

১ কোয়া আদা, কুচিয়ে রাখা

৩-৪টি ঝাল শুকনো লঙ্কা বাটা

২ চামচ ধনে ও ১ চামচ জিরে একসঙ্গে বেটে রাখা

১টা ছোট ধনেপাতার আঁটি‍, ধুয়ে কুচিয়ে নেওয়া

১/২টি পাতিলেবুর রস

মুরগির টুকরোগুলোতে নুন মাখিয়ে ১ টেবিল চামচ ঘিতে হালকা ভাবে ভেজে তার মধ্যে টমেটো কুচি দিয়ে ঢাকা দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে৷ দরকার হলে অল্প জল দেওয়া যায়৷ অন্য একটা রান্নার পাত্রে (ছোট ফ্রাইং প্যানে‍) বাকি ঘি গরম করে পেঁয়াজকুচিগুলি লালচে হওয়া পর্যন্ত ভেজে তার মধ্যে রসুন, আদা, লঙ্কা ও ধনেজিরে বাটা আর ধনেপাতা কুচি দিয়ে কষিয়ে নিয়ে পরিবেশনের আগে লেবুর রস ছড়িয়ে দিতে হবে৷

Dr. R. Riddel তাঁর বই Indian Domestic Cookery-তে Kubab Fowl নামে একটি রান্না শিখিয়েছেন৷ এটি তৈরি করতে লাগল—

১টি মাঝারি মুরগি পালক ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে রাখা

৪ চামচ ধনে বাটা

১ চা-চামচ আদা বাটা

২টি এলাচ থেঁতো করা

২টি লবঙ্গ গুঁড়ো করে নেওয়া

১ চা চামচ গুঁড়ো গোলমরিচ

সঙ্গে দেবার জন্য Basting Sauce, যা তৈরি করতে দরকার হত—

১টা মাঝারি পেঁয়াজের কুচি‍

১ চা-চামচ হলুদ

২ আউস ঘি বা মাখন

১ টেবিল চামচ ভাঙা কাঠবাদাম

১ টেবিল চামচ মনাক্কা

২ টেবিল চামচ ক্রিম

৪ আউন্স টক দই

মুরগি ধুয়ে মুছে ছুরি দিয়ে সারা গায়ে ফুটিয়ে দিতে হবে৷ তারপর আদা, ধনে, নুন, গোলমরিচ, লবঙ্গ-এলাচ একসঙ্গে মিশিয়ে তার এপিঠ ওপিঠ ভালোভাবে মাখিয়ে নিয়ে রান্নার পাত্রে ঘি গরম করে অল্প অল্প জলের ছিটে দিয়ে ভাজা ভাজা করে নিতে হবে৷

এরমধ্যে Basting Sauce তৈরি করতে হবে৷ মাখন অথবা ঘি’তে পেঁয়াজ কুচি ও হলুদ দিয়ে নরম করে ভাজতে হবে৷ পেঁয়াজ স্বচ্ছ হয়ে এলে কাঠবাদাম, মনাক্কা, ক্রিম ও দই মিশিয়ে আগুন থেকে পাত্রটি সরিয়ে নিতে হবে৷ মুরগি ভাজা হয়ে সুসিদ্ধ হয়ে এলে অর্ধেকটা সস ছড়িয়ে ১০ মিনিট ধরে কষিয়ে নিয়ে ১/৪ আরও সস দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে৷ পরিবেশনের আগে সবটা Serving Dish-এ ঢেলে দিয়ে বাকি সস ওপর থেকে ছড়িয়ে দিতে হবে৷

উত্তর ভারতীয় মুসলমান বাবুর্চিরা সেঁকা বা ঝলসানো হাড়শুদ্ধু মুরগির মাংসের পদ দিয়ে ব্রিটিশ খাদ্যরসিকদের রসনাতৃপ্তির উদ্যোগ নিয়েছিল৷ মশলা মাখিয়ে রাখা টুকরোতে কাঁটা বিঁধিয়ে‍ আগুনে ঝলসে অর তৈরি করতো নানা ধরনের কাবাব৷ যা আজও সমান মুখরোচক৷

তাদের তৈরি Hussainee Curry রান্নার পদ্ধতি পাই David Buston-এর Rajat the Table বইটিতে৷ এটা রান্না করতে দরকার হত—

দেড় ছটাক ঘি‍

২ বড় চামচ পেঁয়াজ বাটা

১/২ চা-চামচ রসুন বাটা

১/২ চা চামচ শুকনো লঙ্কা বাটা

১ চা-চামচ ধনে বাটা

১ চা-চামচ আদা বাটা

১ চামচ পোস্তদানা বাটা

৩টি Lemon grass ৩ ইঞ্চি মাপে কেটে নেওয়া

১ কাপ মাংস সেদ্ধ জল

১ টেবিল চামচ গোল করে কাটা আদার টুকরো

১টা পেঁয়াজ গোল গোল করে কাটা

মুরগির হাড় ছাড়িয়ে চৌকো করে কেটে নিয়ে পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা, ধনে, আদা, পোস্ত বাটা ও নুন দিয়ে মেখে রেখে দিতে হবে৷ তারপর বাঁশে‍র ৪ ইঞ্চি মাপের ৪টি সরু কাঠিতে প্রথমে মাংসের টুকরো, তারপর পরপর পেঁয়াজ, আদার পাতলা গোল টুকরো, এইভাবে একে একে গেঁথে‍ নিতে হবে৷ এবার রান্নার পাতে ঘি দিয়ে অল্প আঁছে‍ কাঠিগুলি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাজতে হবে৷ লালচে রং ধরলে ১০-১৫ মিনিট পর্যন্ত মাংস সেদ্ধ জল দিয়ে ফুটিয়ে ঘন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত রান্না করতে হবে৷

প্রাথমিক পর্যায়ে গৃহপালিত হাঁস-মুরগি-ভেড়া বা ছাগলের মাংস দিয়েই ব্রিটিশ সম্প্রদায়কে রসনা তৃপ্তির ব্যবস্থা করতে হত। তার বাইরে অন্য কোনও ধরনের পশুপাখির স্বাদ পেতে হলে শিকার করা ছাড়া উপায় ছিল না। শিকার করা পাখির মধ্যে তারা সবথেকে বেশি পছন্দ করত Quail বা বগেরী এবং তারপরেই snipe বা কাদাখোঁচা। ছোট পাখি বলে এগুলি আস্তে রোস্ট করে বা সেদ্ধ করে সস সহ খাওয়া হত।

মুরগি ছাড়াও হাঁসের খাওয়ার একটা প্রচলন ছিল বিশেষ ভাবে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মালাবার উপকূলে৷ বাংলার পুকুরগুলোর সংলগ্ন অঞ্চলেও হাঁস পালনের চল ছিল৷ প্রধানত হাসের ডিম খাওয়া হলেও এর মাংসও যথেষ্ট রুচিকর বলে মনে করা হত’৷ রাজ আমলের একটি বিশেষ মালাবারে প্রচলিত হাঁসের মাংসের duck curry রান্নার পদ্ধতি জানাচ্ছে৷ এই পদটি রান্না করতে দরকার হত–

১টি মাংসল হাঁস

৩টি বড় পেঁয়াজ মিহি করে কাটা

৬টি মাঝারি চামচ ধনে বাটা

৫টি শুকনো লঙ্কা বাটা

১/২ চা-চামচ সরষে দানা বাটা

১/২ চা-চামচ জিরে বাটা

১ ইঞ্চি পরিমাপের তাজা আদার টুকরো বাটা

১ ইঞ্চি পরিমাপের হলুদের টুকরো বাটা

১/২ কাপ তেঁতুলের ক্কাথ, ১টা লেবুর রস

১টা সম্পূর্ণ রসুন বাটা

৬টি কারিপাতা

১/২ চামচ করে দারচিনি, লবঙ্গ এবং গোলমরিচের মিশ্রিত গুঁড়ো

২ টেবিল চামচ ঘি‍

স্বাদমতো নুন

১টি নারকেল কুরিয়ে অর্ধেকটা থেকে দুধ বের করে নেওয়া

প্রথম হাঁসটা কেটে পরিষ্কার করে টুকরো করে নিতে হবে। তারপর একটা পাত্রে ঘি গলিয়ে পেঁয়াজ কুচি ও কারিপাতা ছেড়ে দিয়ে হালকা বাদামী করে ভেজে নিতে হবে। এবার হলুদ বাটা দিয়ে কাঁচা গন্ধ দূর হওয়া পর্যন্ত সাঁতলে একে একে লঙ্কা, ধনে, জিরে, সরষে বাটা আলাদা আলাদা মিশিয়ে কষিয়ে নিয়ে মাংসের টুকরো ছেড়ে দিতে হবে। ২-৩ মিনিট নাড়াচাড়া করে নারকেলের দুধ মিশিয়ে দিয়ে অল্প আঁচে ১ ঘণ্টা পাত্রটি ঢেকে সেদ্ধ করতে হবে। এবার ঢাকনা সরিয়ে নিয়ে নারকেল কোরা, তেঁতুল গোলা বা লেবুর রস ও নুন দিয়ে আরও ৫-৬ মিনিট রান্না করে Serving Dish-এ ঢেলে দিতে হবে। অনেক সময় এতে সজনে ডাঁটা বা আলুর টুকরোও দেওয়া হ’ত। সেক্ষেত্রে তরকারিগুলো নামাবার ১/২ ঘণ্টা আগে মাংসের মধ্যে দিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল।

Henrietta Harvey Buffado নামে আর একটি রান্নার কথা লিখেছেন যেটা বাঁধাকপির সঙ্গে হাঁসের মাংস দিয়ে তৈরি করা হত। দক্ষিণের পণ্ডিচেরী অঞ্চল এর উৎসস্থল। Buffado কথাটি  Buffadh বা Poofadh রূপেও উচ্চারণ করা হত। এই পদটিকে একটি প্রখ্যাত ‘Indo-Briton’ মুখরোচক ও জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। এটি রান্না করার জন্য দরকার হত–

১টি মাঝারি মাপের পালক ও চামড়া এবং মাথা বাদ দেওয়া আস্ত হাঁস

১টি ছোট বাঁধাকপি ৪ টুকরো করা

১ চা-চামচ জাফরান, স্বাদমতো নুন

৪টি পেঁয়াজ মাঝারি টুকরোয় কাটা

৪-৬টা কাঁচালঙ্কা মাঝখান থেকে চিরে নেওয়া

৬ কোয়া রসুন, থেঁতো করা

১ কোয়া মাপের তাজা আদা বাটা

২ টেবিল চামচ ভিনিগার বা লেবুর রস

একটি ভারী রান্নার ছড়ানো পাত্রে দুই টেবিল চামচ ঘি গরম করে আগে বাঁধাকপির চারটি বড় টুকরো সাজিয়ে ওপর থেকে ১ পাঁইট (বা ৬০০ মিলি) জলে জাফরান গুলে ঢেলে তার মধ্যে হাঁসটা দিয়ে দিতে হবে। ফুটে উঠলে ভিনিগার বা লেবুর রস ছাড়া সব উপকরণ মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে ১ ঘণ্টা সেদ্ধ করতে হবে। পরিবেশনের আগে Serving dish-এ ঢেলে নিয়ে ওপরে ভিনিগার বা লেবুর রস ছড়িয়ে দিতে হবে।

ব্রিটিশরা যখন প্রথম ভারতে এসে পৌঁছল গ্রামাঞ্চলের জলা জায়গা ও সংলগ্ন বনভূমিতে অজস্র শিকারযোগ্য পশুপাখির মেলা দেখে তারা প্রবল উৎসাহিত বোধ করল। একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী জানিয়েছেন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের কোনও একটা সময় তাঁরা ৪ জন মিলে ৪ ঘণ্টায় ৩০০টি  snive বা কাদাখোঁচা পাখি শিকার করেছিলেন। এরপর ১৯২০ সালের এক বিবরণে জানতে পারা যায় সারাদিন শিকার করে ৮ জন মিলে ১০০০টি বুনোহাঁস হত্যা করেছিলেন। সেকালে Viceroy বা বড়লাট ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা শিকারযাত্রা গেলে তার বিশদ বিবরণ নথিবদ্ধ করার নিয়ম ছিল। শিকারের অভ্যাস প্রাদেশিক রাজা ও জমিদারদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। এই অভ্যাস প্রাচীনকাল থেকে ভারতের রাজবংশ তথা অভিজাত, রাজকর্মচারীদের বিনোদনের মধ্যেই গণ্য করা হত।

প্রাথমিক পর্যায়ে গৃহপালিত হাঁস-মুরগি-ভেড়া বা ছাগলের মাংস দিয়েই ব্রিটিশ সম্প্রদায়কে রসনা তৃপ্তির ব্যবস্থা করতে হত। তার বাইরে অন্য কোনও ধরনের পশুপাখির স্বাদ পেতে হলে শিকার করা ছাড়া উপায় ছিল না। শিকার করা পাখির মধ্যে তারা সবথেকে বেশি পছন্দ করত Quail বা বগেরী এবং তারপরেই snipe বা কাদাখোঁচা। ছোট পাখি বলে এগুলি আস্তে রোস্ট করে বা সেদ্ধ করে সস সহ খাওয়া হত। অনেক সময় তেল-মশলা-ভিনিগার ইত্যাদির মিশ্রণে (marinade) ভিজিয়ে রেখে মাখনে ভেজে খাওয়ার চল ছিল। এই রকমই দুটি রান্না পদের কথা তুলে ধরা যেতে পারে, যার একটি হল Braived Quail Curry এবং অন্যটি Wild Duck Curry।

৬ জনের জন্য Braised Quail Curry রান্না করার জন্য লাগত–

৬টি বড় বাগেরী পাখি

২-৩ টেবিল চামচ ঘি

১টা মাঝারি পেঁয়াজ পাতলা পাতলা গোল করে কাটা

২টি গাজর সরু লম্বা করে কাটা

১টি সেলেরির ডাঁটা টুকরো করে কাটা

২ চা-চামচ ময়দা

১ চা-চামচ কারি পাউডার

১ পাঁইট মাংস সেদ্ধ জল

৩ আউন্স (৭৫ মিলি) Madiera

পাখিগুলির পালক, চামড়া ও হাড় ছাড়িয়ে লম্বালম্বি কেটে নিতে হবে। ছড়ানো একটি পাত্রে ঘি গলিয়ে আস্তে আস্তে এপিঠ ওপিঠ হালকা বাদামি করে ভেজে নিতে হবে। অন্য একটি রান্নার পাত্রে ভাজা ঘি’টা ঢেলে তার মধ্যে পেঁয়াজ, গাজর আর সেলেরি দিয়ে খানিকক্ষণ সাঁতলে আগে ভেজে রাখা বগেরীগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।  এবার ময়দা ও কারি পাউডার দিয়ে নেড়েচেড়ে stock বা মাংস সেদ্ধ জল ঢেলে দিতে হবে। ফুটে উঠলে আঁচ কমিয়ে ১৫ মিনিট ধরে সেদ্ধ করে পরিবেশনের আগে Madiera মিশিয়ে আবার একবার ফুটিয়ে নিতে হবে।

Wild Duck Curry

৪ জনের জন্য তৈরি করতে দরকার হত

১টি বুনো হাঁস, পালক ও ছাল ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে ৮ টুকরো করা

২ আউন্স ঘি

১টি মাঝারি পেঁয়াজ কুচি করে কাটা

৩ কোয়া থেঁতো করা রসুন

২টি কাঁচালঙ্কা কুচি করেকাটা

২ টেবিল চামচ টমেটো বাটা

১ টেবিলচামচ কারি পাউডার

১ টেবিল চামচ ময়দা

৪ আউন্স নারকেলের ঘন দুধ

১/২ খানা পাতিলেবুর রস

স্বাদমতো নুন

একটি মোটা চাদরের রান্নার পাত্রে ঘি গলিয়ে নিয়ে তাতে মাংসের টুকরোগুলো হালকা বাদামি করে ভেজে নিতে হবে। তারপর সেগুলো অন্য একটা পাত্রে সরিয়ে রাখতে হবে। মাংস ভাজা ঘিতে এবার পেঁয়াজ, রসুন, লংকা, টমেটো এবং কারি পাউডার মিশিয়ে দু-তিন মিনিট সাঁতলে ময়দা ছড়িয়ে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর এর মধ্যে মাংসের টুকরো মিশিয়ে আট আউন্স (250 মিলি) জল ঢেলে ফুটে উঠলে ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে দেড় থেকে দুই ঘন্টা অথবা মাংস সেদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত বসিয়ে রাখতে হবে। পরিবেশনের ঠিক আগে নারকেলের গাঢ় দুধ, লেবুর রস ও নুন ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে।

Sripe বা কাদাখোঁচা পাখির মাংস অনেকের কাছে অতীব সুস্বাদু মনে হলেও কেউ কেউ তাতে কাদার গন্ধ পেতেন। তাই মাখন, ভিনিগার ও মশলা এবং রসুন মেখে ঝলসে বা রোস্ট করে অথবা সেঁকা পাউরুটির টুকরো সহকারে খাওয়ায় চল ছিল।

রাজকর্মচারীরা শখ করে মযুর শিকার করলেও এর সাদা রঙের রসহীন শুষ্ক মাংস তাদের ততটা সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দক্ষিণভারতে (নীল) সরস্বতীর বাহন পূজ্য মযুরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধতার তালিকায় ছিল। ভারতের মধ্য ও উত্তরাংশের প্রাচীন রাজা রাজড়ার খাদ্যতালিকায় অবশ্য এটি মহার্ঘ হিসেবে মনে করা হত।

শিকার করা তিতির ও বালিহাঁস ইত্যাদিও ব্রিটিশদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল বলে জানা যায়। বাংলার পাহাড়ি জায়গায় ব্রিটিশদের প্রিয় টার্কির বিকল্প হিসেবে florikin পাখি খ্রিস্টমাসের সময়ে রান্নার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছিল। এর আনুষঙ্গিক হিসেবে পরিবেশিত হত মাথন ও গোলমরিচ ছড়ানো আলুসেদ্ধ, ডিম ও সার্ডিন (যা টিনে করে তাদের দেশ থেকে আমদানি করা হত)।

পাখির বাইরে ব্রিটিশরা যেসব যেসব পশু শিকার করে উপভোগ করতে ভালোবাসত, সেগুলি হল বুনোশুয়োর, খরগোশ, হরিণ ও নীলগাই। নানান ধরনের হরিণের মধ্যে চিতল হরিণ, কস্তুরি হরিণ ও সম্বর হরিণ ছিল বিশেষ পছন্দের। চিতলের মাংস ছিল সবচেয়ে সুস্বাদু। কস্তুরির মাংস ছাড়াও এর নাভির মধ্যে পাওয়া সুগন্ধির জন্য এটি বিশেষভাবে আদরণীয় ছিল। সম্বরের ক্ষেত্রে পরিমাণে বেশি পাওয়া গেলেও তুলনামূলকভাবে রুক্ষ ছিল।

জঙ্গলে শিকার করার পরই তাজা মাংসের স্বাদ নেওয়ার জন্য এদের সঙ্গে থাকত একটি বিশেষভাবে তৈরি shikaree sauce যা camp sauce নামেও পরিচিত ছিল।

shikaree sauce তৈরি করার জন্য লাগত—

আট আউন্স claret

আট আউন্স mushroom ketchup

একটা আস্ত পাতিলবেুর রস

এক চা চামচ শুকনো লংকা গুঁড়ো করে নেওয়া

এক টেবিল চামচ চিনি

একটা সসপ্যানে ঢিমে আঁচে সমস্ত উপকরণগুলো একসঙ্গে দিয়ে চিনি না গলে যাওয়া অবধি নাড়তে হবে। ক্যাম্প ফায়ারে পাখির ঝলসিয়ে এই sauce টি গরম করে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।

mushroom ketchup এর জন্য যা যা লাগবে

দু কেজি মাশরুম

আট আউন্স বা আড়াইশো গ্রাম নুন

দু চামচ গোলমরিচ

দু চামচ জায়ফল বা জয়িত্রী

এক চা চামচ allspice

এক চা চামচ লবঙ্গ

সামান্য brandy

মাশরুমগুলো না ধুয়ে ছোট ছোট টুকরোয় কেটে একটা মাটির পাত্রে বা বয়ামে নুন ছড়িয়ে রেখে দিতে হবে। বারো ঘন্টা পরে নেড়ে নিয়ে দেড়দিন ওইভাবেই রেখে দিতে হবে। তারপর খুব ঢিমে আঁচে তিরিশ মিনিট সেদ্ধ করে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে মাশরুমগুলো না চটকে ছেঁকে রসটা বের করে নিতে হবে। এরপর রসটা ফুটিয়ে অর্ধেক পরিমাণে কমিয়ে আনতে হবে। এবার আবার ছেঁকে নিয়ে brandy মিশিয়ে কাচের বোতলে ঢেলে মুখটা ছিপি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে।