মানুষ ভাবে এক, আর হয় এক। বেশির ভাগ লোকের জীবনে তা-ই হয়— রমানাথ চৌধুরীও তার ব্যতিক্রম নন। ইতিহাসের কৃতী ছাত্র ছিলেন, কিন্তু পেটের দায়ে নানা জায়গায় চাকরি করেছেন, যার কোনওটার সঙ্গেই ইতিহাসের কোনও সম্বন্ধ ছিল না।
রমানাথবাবুর শেষ চাকরি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফিল্ড অফিসারের। চাষি, মজুর বা ছোটখাটো ব্যবসায়ীর পিছনে পিছনে ধাওয়া করে লোন রিকভার করতে করতেই তাঁর অবসর নেওয়ার সময় এসে গেল। আর একমাস বাদেই তাঁর রিটায়ারমেন্ট— শেষ পোস্টিং মুর্শিদাবাদে। এও এক অদ্ভুত যোগাযোগ। এক ইতিহাস-পাগল লোকের কর্মজীবনের শেষ হবে এক ঐতিহাসিক জায়গায়। সান্ত্বনা পুরস্কার যেন। তবু ভাল— রমানাথবাবু ভাবেন।
একটা লোন রিকভারির ব্যাপারে শহর থেকে কিছু দূরে একটা জায়গায়— রমানাথবাবু যাচ্ছিলেন সাইকেলে। জায়গাটার নাম ‘খুনি হাভেলি’। কোনও জায়গার এমন অদ্ভুত নাম শোনেননি তিনি। ‘খুনি দরওয়াজা’ শুনেছেন, কিন্তু ‘খুনি হাবেলি’! এদিকে তাঁর প্রথম আসা, আসার আগে কৌতূহলবশে দু’একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন জায়গাটার সম্বন্ধে। সঠিকভাবে কেউ কিছু বলতে পারেনি। একটা হাবেলির নামেই নাকি জায়গাটার নাম, যে হাবেলিতে একই দিনে কোনও সময়ে একাধিক নারকীয় হত্যার বীভৎস ঘটনা ঘটেছিল। সেই থেকে কালক্রমে হাবেলিটির নাম হয়ে যায় ‘খুনি হাবেলি’ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটাও হয়ে যায় খুনি হাবেলি।
এই ঘটনা শোনা অবধি রমানাথবাবুর মাথায় ইতিহাসের পোকাগুলো নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। নিজের চোখে দেখার ইচ্ছা ক্রমশই তাঁর মনে দানা বাঁধতে লাগল। অফিসের কাজকর্ম শেষ করে স্থানীয় লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে খুঁজতে খুঁজতে রমানাথবাবু যখন খুনি হাবেলির সামনে এসে দাঁড়ালেন, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। রমানাথ বাক্যহারা। ঘনায়মান অন্ধকারে ঝোপঝাড় আগাছা আর ঝুপসি গাছপালার মাঝে প্রেতের মতো নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে হাড় পাঁজরা বেরিয়ে পড়েছে, অধিকাংশ জানলা দরজার পাল্লা হাট করে খোলা। দেওয়ালের ফাটলে ফাটলে মরণকামড় দিয়ে গজিয়ে উঠেছে অজস্র বট-অ্রশ্বত্থের চারা।
চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়েছিলেন তিনি— হাবেলির পিছন দিকে কখন যেন চুপিসারে চাঁদ উঠেছে। শিরশিরে হাওয়া বইছে, যে-গাছগুলো এতক্ষণ ঝিম মেরেছিল, হঠাৎ যেন প্রাণ পেয়ে নড়াচড়া শুরু করেছে। চারিদিকে ফিসফিস, সরসর আওয়াজ। খোলা দরজা-জানালাগুলো খুলছে বন্ধ হচ্ছে আপন মনে। এরই সঙ্গে বাদুড় আর চামচিকেদের ডানার ঝটপটানি; সবমিলে এক অদ্ভুত অলৌকিক ঐকতান গড়ে তুলেছে। তখনই যেন সহসা সম্বিত ফিরে পেলেন রমানাথবাবু— স্থির করলেন, যে-কোনও মূল্যে এই হাবেলিটি তাঁর চাই।
বহু খোঁজের পর হাবেলির মালিকের দেখা পেলেন রমানাথ। মুর্শিদাবাদের পাট চুকিয়ে অনেকদিন ধরে ওঁরা কলকাতার বাসিন্দা। অনেক চেষ্টা করেও ওই হাবেলি বিক্রি করতে পারেননি মালিক সইফুদ্দিন শেখ। সুতরাং স্বেচ্ছায় রমানাথবাবু যখন হাবেলিটি কেনার প্রস্তাব দিলেন, শেখসাহেব এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। প্রায় জলের দামেই পেয়ে গেলেন জরাজীর্ণ হাবেলিটা। লোকে খুবই অবাক হল যখন শুনল, অবসর নেওয়ার পর স্থায়ীভাবে ওই খুনি হাবেলির বাসিন্দা হবেন রমানাথবাবু। সতীর্থদের, স্থানীয় লোকদের হাজার নিষেধ, হাজার ভয় দেখানোকে উপেক্ষা করে নিঃসন্তান বিপত্নীক রমানাথ তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় অটল রইলেন।
অবশেষে একদিন সত্যি সত্যিই অবসর নেওয়ার পরে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে খুনি হাবেলিতে এসে প্রবেশ করলেন রমানাথ। স্থানীয় লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, মাথায় নির্ঘাত গণ্ডগোল আছে, না হলে সাধ করে কেউ এই ভূতুড়ে বাড়িতে বাস করতে আসে?
দিনের বেলায় বেশির ভাগই কাটে লাইব্রেরিতে। পুরনো বই, ফটো অ্যালবাম নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তিনি। গভীর মনোযোগ দিয়ে বাংলা, ইংরেজি বইগুলো পড়েন তিনি। সংগ্রহের তালিকায় উর্দু বইও আছে। সন্ধ্যাবেলায় চারটে মশাল জ্বালিয়ে চার কোণে রেখে ওই দেওয়াল আয়নার সামনে দাঁড়ান রমানাথ। নিজের অদৃশ্য প্রতিকৃতির চারপাশ থেকে চারটে মশালের প্রতিফলিত আলো ঠিকরে পড়ে। আলো ঠিকরে পড়া হাজার কাঁচের টুকরো লাগানো আধভাঙা ঝাড়বাতিটাকে মুগ্ধ চোখে দেখেন রমানাথ। মনে হয়—এই হাবেলিতে যদি কোনও অস্থির, অতৃপ্ত আত্মা থাকে, তারা এই আলোকিত ঘর দেখে তৃপ্ত হবে। ইতিমধ্যে লাইব্রেরিতে পাওয়া একটি ডায়েরি থেকে উনি জানতে পারেন যে, এই হাবেলিতেই একদা একসঙ্গে পাঁচটি ভাইকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলেছিল।
কিন্তু নির্বিকার রমানাথ, হাবেলির মধ্যে বেছে বেছে নিজের জন্য একখানা ঘর পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছেন। বাকি ঘরগুলো যেমন ধুলো আর মাকড়সার জালে ভরা ছিল, তেমনই থাকল। শুধু আরও একটা ঘর উনি পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছেন, সেটা লাইব্রেরি ঘর। এই ঘরটা রমানাথবাবুর মহামূল্যবান আবিষ্কার। আলিবাবুর গুপ্তধনের মতো ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে এই লাইব্রেরিতে। কত রকমের বই আলমারিতে ঠাসা, জরাজীর্ণ পোকায় কাটা, ধূলিধূসরিত কিন্তু নানা রকমের অমূল্য সম্পদ। অনির্বার আকর্ষণ অনুভব করেন রমানাথ ওই কাচ-ভাঙা আলমারি, দেওয়ালে টাঙানো পুরনো অয়েল পেন্টিং-এর ওপর। রূপসী নারী, সুবেশ যুবক, হাসিমুখী শিশুদের ছবিতে সব ক’টি দেওয়াল সজ্জিত। একসময় যারা এই হাবেলির ঘরে ঘরে প্রাণময় হয়ে ঘুরে বেড়াত, আজ তারা ধুলোয় আকীর্ণ সোনালি ফ্রেমে বন্দি। স্বপ্নাবিষ্টের মতো ঘুরে বেড়ান রমানাথবাবু। মাঝরাতে আধো ঘুমের মাঝখানে, টর্চ হাতে যেন ঘোরের মধ্যে ঘুরে বেড়ান এ হাবেলির ঘরে ঘরে। ডাইনিং হলে বিশাল লম্বা টেবিলের দু’ধারে, গদি মোড়া সারি সারি চেয়ার হতশ্রী অবস্থায়। ভাঙা ঝাড়বাতি, মলিন ছিন্ন সোফাসেট, টর্চের আলোয় হঠাৎ হঠাৎ উচ্চকিত হয়ে ওঠে নানাধরনের মুখাবয়ব, ছবিতে বন্দি নারী-পুরুষের। রমানাথবাবুর মনে হয়, কী যেন বলতে চায় ওরা।
নিজের শোওয়ার ঘরটা বড় প্রিয় হয়ে উঠেছে তাঁর। ওঁর ঘরেও একটা ঝাড়বাতি আছে। দেওয়াল-জোড়া আয়না, চার কোণে চারটে মশালদান। অদ্ভুত এই আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে দেখা যায় না, দেখা যায় পিছনে দাঁড়ানো অন্য লোককে। জামাই ঠকানো এই আয়না উনি দেখেছিলেন হাজারদুয়ারিতে। এ রকম আয়না তাহলে সেকালের ধনী লোকদের শখের বস্তু ছিল।
দিনের বেলায় বেশির ভাগই কাটে লাইব্রেরিতে। পুরনো বই, ফটো অ্যালবাম নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তিনি। গভীর মনোযোগ দিয়ে বাংলা, ইংরেজি বইগুলো পড়েন তিনি। সংগ্রহের তালিকায় উর্দু বইও আছে। সন্ধ্যাবেলায় চারটে মশাল জ্বালিয়ে চার কোণে রেখে ওই দেওয়াল আয়নার সামনে দাঁড়ান রমানাথ। নিজের অদৃশ্য প্রতিকৃতির চারপাশ থেকে চারটে মশালের প্রতিফলিত আলো ঠিকরে পড়ে। আলো ঠিকরে পড়া হাজার কাঁচের টুকরো লাগানো আধভাঙা ঝাড়বাতিটাকে মুগ্ধ চোখে দেখেন রমানাথ। মনে হয়—এই হাবেলিতে যদি কোনও অস্থির, অতৃপ্ত আত্মা থাকে, তারা এই আলোকিত ঘর দেখে তৃপ্ত হবে। ইতিমধ্যে লাইব্রেরিতে পাওয়া একটি ডায়েরি থেকে উনি জানতে পারেন যে, এই হাবেলিতেই একদা একসঙ্গে পাঁচটি ভাইকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলেছিল। সেই ষড়যন্ত্রের আগাম আভাস পেয়েই তাদের মধ্যেই কোনও একজন ডায়েরিতে মৃত্যুর আশঙ্কার কথা লিপিবদ্ধ করে গেছে। কিন্তু তারা কি সত্যিই খুন হয়েছিল? এর উত্তর পাওয়া যায় স্থানীয় লোকদের মুখে। কোনও এক নিষ্ঠুর লোভী ভাই শুধুমাত্র সম্পত্তির লোভে বাকি ভাইদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। কিন্তু কীভাবে, কেউ জানে না। অতগুলো লাশ কোথায় গুম করা হল, তারও কোনও প্রমাণ নেই। মশাল নিভিয়ে চিন্তিত রমানাথবাবু ভাবতে ভাবতে শুতে যান, একদিন এ রহস্য তিনিই উদ্ঘাটিত করবেন।
এমনই এক সন্ধ্যাবেলায়, যখন সব মশাল জ্বালানো শেষ, নিস্তব্ধ বিশাল ঘরে আয়নার সামনে রোজকার মতো দাঁড়িয়ে রমানাথ, পোড়া তেলের কটু গন্ধ আর মশালের কম্পমান শিখার মাঝখানে তাঁর মনে হল—তিনি আর একা নন, আরও কেউ আছে তাঁর সঙ্গে। বাতাসে অশরীরী উপস্থিতি আর খানদানি আতরের মৃদু সুবাস যেন তার জানান দিচ্ছে। বিহ্বল রমানাথবাবুর চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল আয়নায় এক প্রতিকৃতি। দীর্ঘ, গৌরবর্ণ, শেরওয়ানি-কুর্তা পরা এক পুরুষ, দীর্ঘ আঁখি পল্লবে বেদনার সুস্পষ্ট চিহ্ন। চমকে পিছন ফিরে তাকালেন রমানাথ, কেউ কোথাও নেই, শুধু অপার নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে মশালের চটপট আওয়াজ।
এর পরের রাত্রে যথারীতি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রমানাথ ভাবছিলেন যে, হয়তো সবটাই তাঁর রহস্যপ্রিয় কল্পনাবিলাসী মনের কল্পনা, চক্ষুবিভ্রম; ভাবতে ভাবতে হঠাৎই সেই অশরীরী অনুভব আবার। বাতাসে ভেসে এল এক ঝলক অম্বুরি তামাকের মিঠে-কড়া সুবাস। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আয়নায় ভেসে উঠল আর একটি বিষাদভরা মুখ। মলমলের চুড়িদার ও লক্ষ্ণৌ চিকনের কাজ করা কুর্তা পরা, হাতে রুপো বাঁধানো ছড়ি-ধরা এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। এবার আর দেরি করলেন না রমানাথবাবু। গতকালের চেনা চেনা মুখ আর আজকের মুখ ওঁকে মনে করিয়ে দিয়েছে কোথায় দেখা এই পরিচিত মুখ। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে, বারান্দার বাদুড় চামচিকেদের হতচকিত করে রমানাথ লাইব্রেরিতে ঢুকলেন। টর্চের তীব্র আলোয় ঝলকে ঝলকে ধরা পড়তে লাগল দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমবন্দি ছবিগুলির এক একটি মুখ। অবশেষে টর্চ স্থির হল প্রথম দিনের দেখা সেই মুখে— নবাব শাহ জাফর, তারই পাশে নবাব মীর উল জাফরের ছবিতে এসে। বয়সের ব্যবধান তিন বছরের। এবার আর বুঝতে অসুবিধা হয় না তাঁর, মনে পড়ে যায় পাশাপাশি ছয় ভাইয়ের ছবি— এদেরই মধ্যে একজন খুনি, খুন করেছে বাকি পাঁচ ভাইকে! কী ভয়ানক!
সভয়ে দেখলেন রমানাথবাবু, দেওয়ালের গায়ে এক গুপ্ত দরজা— ধাক্কা মারতেই দরজাটা খুলে গেল, শতাব্দীর পুরনো পচা ভ্যাপসা গন্ধ এসে লাগল নাকে; মশাল হাতে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন, নীচে নেমে গেছে এক লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। এক হাতে মশাল অন্য হাতে সিঁড়ি ধরে নামতে লাগলেন রমানাথবাবু। বেশ অনেকটা নামার পর দেখলেন, সিঁড়িটা শেষ অবধি পৌঁছয়নি, অনেকটা আগেই ভেঙে গেছে। কোনও কিছু না ভেবেই এক লাফ দিলেন তিনি।
একে একে ছবিগুলি দেখতে থাকেন রমানাথ। হঠাৎ একটি ছবিতে টর্চের আলো পড়তেই মুখ থেকে একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল। ছবিতে এ কার মুখ দেখলেন তিনি! এ তো তাঁর নিজেরই মুখ! তাহলে কি কোনও এক জন্মে তিনি ছিলেন এই ছয় ভাইয়ের একজন? নিহত হয়েছিলেন নির্মমভাবে নিজের ভাইয়েরই হাতে? মাঝে আর ক’টা জন্ম হয়েছিল তাঁর? এই জন্যই নিয়তি কি তাঁকে দিয়ে এই হাবেলিটা কেনাল! মীরজাফরের বংশধর এরা, তারই মতো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, কোনও এক ভাই। আর ভাবতে পারেন না রমানাথবাবু।
এর পরের দুটো রাত কেটেছে মোহগ্রস্ত রমানাথের একেবারে অঙ্কের হিসেবের মতো। পরপর আয়নায় ভেসে উঠেছে আরও দুটি মুখের মালিকের— একই সঙ্গে ছিল যারা সহোদর ভ্রাতা। আজ পঞ্চম রাত, অবিশ্বাস্য ভাবে ভেসে উঠবে নিজের মুখ, যে-আয়নায় নিজের মুখ দেখা যায় না— আজ অনিবার্য ভাবে তাতে দৃশ্যমান হবে—এই তাঁর স্থির বিশ্বাস। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন তিনি। উজ্জ্বল মশালের আলোতে স্থির নিঃশ্বাসে দেখছেন, কুয়াশার মতো একটা আস্তরণ পড়ল আয়নার কাচে। আস্তে আস্তে পরিষ্কার ফুটে উঠছে একটি মুখ— আর্তনাদ করে উঠলেন রমানাথ। হাবেলির কক্ষে কক্ষে দেওয়ালে দেওয়ালে সেই আর্তনাদ প্রতিহত হয়ে ফিরে ফিরে আসতে লাগল তাঁরই কাছে। একসঙ্গে বেশ ক’টা বাদুড় ডানা ঝটপট করে ঘর থেকে বাইরে পালাল। আয়নায় আজ যাকে দেখলেন, সে তো তাঁর মুখ নয়, অন্য মুখ! তাহলে খুনি কে? অসম্ভব, এ সবই চোখের ভুল, মনের কল্পনা। পাগলের মতো পাশ থেকে একটা ভারী পেতলের ফুলদানি সজোরে ছুড়লেন রমানাথ আয়নার গায়ে— চুরমার হয়ে গেল আয়নার কাচ। তাতেও ক্ষান্ত হলেন না, আয়নার ফ্রেম ধরে প্রাণপণে মারলেন এক টান। উপড়ে গেল আয়নাটা…
সভয়ে দেখলেন রমানাথবাবু, দেওয়ালের গায়ে এক গুপ্ত দরজা— ধাক্কা মারতেই দরজাটা খুলে গেল, শতাব্দীর পুরনো পচা ভ্যাপসা গন্ধ এসে লাগল নাকে; মশাল হাতে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন, নীচে নেমে গেছে এক লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। এক হাতে মশাল অন্য হাতে সিঁড়ি ধরে নামতে লাগলেন রমানাথবাবু। বেশ অনেকটা নামার পর দেখলেন, সিঁড়িটা শেষ অবধি পৌঁছয়নি, অনেকটা আগেই ভেঙে গেছে। কোনও কিছু না ভেবেই এক লাফ দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়িটা ওপরের অংশ থেকে খুলে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরিয়ে এল তাঁর গলা থেকে। এবার কিন্তু অন্য প্রতিধ্বনি শোনা গেল। একসঙ্গে অনেকগুলো গলা যেন হা হা করে অট্টহাসি হেসে উঠল। এদিকে মশালের তেল শেষ হয়ে এসেছে। আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে— ওপরের দরজা দেখা যাচ্ছে না। হয়তো কোনও দিন যাবেও না। প্রেতাবিষ্টের মতো এগিয়ে গেলেন রমানাথবাবু।
ওঁর মনে পড়েছে সেই বিশাল সিন্দুকটার কথা, যেটা এই মাটির তলার গুপ্ত কুঠুরিতে ছিল। হয়তো তার মধ্যে এখনও পড়ে আছে কিছু হিরে জহরত। বেশির ভাগটাই অবশ্য লোপাট হয়ে গিয়েছিল প্রায় দেড়শো বছর আগে। রমানাথবাবু আরও জানেন যে, এই বিশাল সিন্দুকের পিছনেই আছে ওঁর পাঁচ ভাইয়ের কঙ্কাল; নিজের হাতে এক এক করে তাদের যখন তিনি গুলি করেন, তখন তারা নিশ্চিন্ত মনে হিরে জহরতের হিসেব নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
মাটির তলার বিশাল ঘরটা ইতিমধ্যেই প্রেতের অট্টহাসিতে ভরে গেছে। প্রেতেরা প্রতিহিংসা নিতে ভোলেনি। কয়েক জন্ম পরেও লোভ দেখিয়ে ঠিক নিয়ে এসেছে মাটির নীচের এই ঘরে।
মশালের আলো দপদপ করে নিভে যাওয়ার আগে, লালচে ক্ষীণ আলোয় রমানাথবাবু দেখলেন—সিন্দুকের পিছন দিকটা অস্থিময় শীর্ণ আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরে ধীরে সুস্থে ঠেলেঠুলে উঠছে পাঁচটা কঙ্কাল— একই সঙ্গে!
অঙ্কন: সুমন্ত সেন
শনিবারের চিঠি, ৯ এপ্রিল, ২০১২