আলোক বিভূষিতা, রিক্ত যামিনীর অন্ধকারেই আসে চতুর্দশীর রাত| এই রাত বড় ভয়ংকর| মধুযামিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে| নখদংশনের রাত শেষ হয় অমাবস্যার শুভ মুহূর্তে|আসে দীপাবলী| সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রমালার আলোক কিরণে আঁধারের বুকে বেজে ওঠে নব দিগন্তের নতুন বার্তা| শুরু হয় দীপাবলী|
এই মুহুর্তে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে – তখন আমি ঘোর শ্মশানবাসী| মালভূমের পাহাড়ি ঠান্ডা আর শীতের রাত সেবারে রক্তাক্ত করেছিল দেওয়ালীকে| আসুরিক শক্তির কাছে হয়তো হার মানত প্রকৃতি| কিন্তু তা হল না|
সারা দিনমান শ্মশান চত্বর ঘুরে বেড়িয়ে মুর্দা খালাস করিয়ে যখন এক বোতল কাচি মদ নিয়ে বসলাম, তখন সে এল| সে আসত রোজই, শ্মশান অন্ধকার হলে – প্রকৃতি নিঝুম হয়ে এলে – সে আসত চটুল চরণে| পায়ে পায়ে প্রতিধ্বনি মেখে|
সে বলত জীবন আর মৃত্যুর গল্প| তার মুখগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসত হাড়ের মালা| কোটরগত দু’চোখ থেকে মৃত্যু দেখার বীভৎস আহ্বান|
একদিন গভীর রাতে সে এল, সুন্দরী ষোড়শীর বেশ ধরে| হাতে ধরা নয়-দশ বছরের এক নিষ্পাপ বালকের হাত| সবিনয়ে বলল – ‘গোঁসাই এসো, একে বলি চড়াই|’
ক্ষেপে উঠল আমার গোটা অন্তরাত্মা, মেয়েটি বলে কী!
সবিস্ময়ে শুধালাম তাকে – ‘কী বলছ তুমি? জানো না, এই অবোধ শিশুকে বলি দেওয়া ঘোরতর পাপ|’
অবাক চোখে সে বলল – ‘মারাংবুরুর দিব্যি, মারণ উচাটন শিখবে না?’
চিৎকার করে উঠে বললাম, ‘না, শক্তিরূপিণী জগজ্জননী মা আমার, বলি চায় না|পিশাচিনী মা আমার আলোকবর্তিনী|’
সেই শ্মশান চত্বর থেকে উন্মাদের মতো ছুটতে লাগলাম| চিৎকার করে বলতে লাগলাম – ‘মন্ত্রগুপ্তি চাই না|মায়ের ভয়ংকর আদেশও চাই না| শুধু চাই অবোধ শিশুদের মুখের নির্মল হাসি|’
সেই শ্মশান জীবনও নেই| বয়সের ভারে স্মৃতিও আজ প্রতারক| তবুও শরতের শেষ হয়ে যাওয়া মেঘের ভেলা দেখতে দেখতে সেই রাতের কথা আজও মনে পড়ে যায়| আনমনে একটা পেন্নাম ঠুকে দিই| কাকে জানি না! হয়তো মালভূমের সেই পাহাড়ি চড়াই থেকে উঠে আসা এক নির্মম দেওয়ালির রাতকে!