ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে টিপছাপ পড়ে ভাইফোঁটায়

উৎসবমাসের রাত পোহালো৷ বারোয়ারি মণ্ডপ থেকে দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী ঠাকরুণ, মা কালী সকলেই একে একে বিদায় নিয়েছেন৷ কন্যা বিদায়ের পরে কনকাঞ্জলির চালের মতো শিশিরদানা ছড়িয়ে পড়ল প্রকৃতির ঘাসের আঁচলে৷ কন্যা বিদায়ের ব্যথার দীর্ঘশ্বাসে দু-একটা করে ঝরে পড়তে শুরু করল গাছের মরচে ধরা পাতা৷ হেমন্তের নৈঃশব্দে নিজেকে গুটিয়ে নিল বিষণ্ণ প্রকৃতি মা৷ বিষাদভরা চোখ মুছল কুয়াশার চাদরে৷ মলিন হয়ে উঠল ধূসর প্রকৃতির মুখ৷ দীপাবলির শেষে উৎসবের আলো আচমকা যেন হেমন্তের মনখারাপের বাতিদানে আবছা হয়ে উঠল৷ হাওয়ার আর্দ্রতায় ফুটে উঠল বেদনার বলিরেখা৷

অনেক আনন্দ উপভোগের শেষে যেমন একটা অবশ্যম্ভাবী অবসাদ ঘিরে ধরে সবাইকে, তেমন করেই শরতের উৎসব শেষে হেমন্ত এসে অবসন্ন করে দেয় সবাইকে৷ জাগপ্রদীপের আলো নিভে গেল জমতে থাকে পিলসুজের নীচে ভুষোকালির পরত চোখে পড়ে৷ আশ্বিনের আলো ঝলমলে আনন্দের পরে আসে অবসাদের কার্তিক নেমে আসে মাঠের প’রে৷ জীবনের পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরে আলস্য৷ জীবনানন্দের কবিতার মতো৷ ‘… শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার – চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,/তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান… পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের এসেছে আহ্বান৷…’ মানে মাসাধিক কালের শারদ উৎসবের আঙিনা ছেড়ে আবার সকলে গৃহমুখী হতে চায়, নীড়ে ফেরা চড়াইয়ের মতো, গোলা ভরা মাঠের ধানের মতো৷ সেই আবহে উৎসবমাসের উপসংহার টানতে এসে পড়ে ভাতৃদ্বিতীয়ার তিথি৷ কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়াতে৷

কিছুদিন আগেই মা দুর্গা তাঁর সন্তানদের নিয়ে মর্ত্য থেকে বিদায় নিয়েছেন, মর্ত্যবাসীকে শিখিয়ে গিয়েছেন একচালার নিচে পারিবারিক যৌথবাসের একটা সৌহার্দ্য নজির৷ তারই রেশটুকু নিয়ে আবার আমরা লৌকিক উৎসব সাজাই ঘরের অন্দরে৷ এই ভ্রাতৃদ্বিতীয়াতে আবার জ্বালাই ঘিয়ের প্রদীপ, মাঠের শিশির তুলে এনে রাখি পাত্রে, হাতে তুলে নিই আশীবার্দী ধান-দুব্বো, চুয়া-চন্দনে ভরে রাখি মধুপর্কের বাটি৷ তবে এই আয়োজন কোনও দেবতার জন্য নয়, মানুষের জন্য৷ যেখানে আমরা উচ্চারণ করি মন্ত্র–‘…ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা/যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা…’৷

লৌকিক মন্ত্রে আবার কীভাবে যম-যমুনার মতো স্বর্গের দেবতারা এসে পড়লেন, সে এক পৌরাণিক গল্প৷ যার উৎসে রয়েছে সূর্য এবং তাঁর পত্নী সংজ্ঞার দাম্পত্য জীবনের কাহিনি৷ সুখেই ছিলেন তাঁরা৷ একসময সূর্য পত্নী সংজ্ঞা জন্ম দিলেন যমজ সন্তান যম এবং যমুনা ওরফে যমীর৷ কিন্তু সন্তান জন্মদানের পরে সংজ্ঞা সূর্যের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রতিলিপি ছায়ার কাছে সন্তানদের রেখে সূর্যের কাছ থেকে অলক্ষে বিদায় নিল৷ সংজ্ঞারই প্রতিলিপি হওয়ায় ছায়াকে আলাদা করে চিনতে পারল না সূর্যও৷ কিন্তু ছায়ার কাছে মাতৃস্নেহ পেল না দু’ভাইবোন-যমুনা আর যম৷ শুধু তা-ই নয়, ছায়ার কারসাজিতে যমুনাকে বিয়ে দিয়ে স্বর্গ থেকে বিদেয় করা হল৷ এদিকে দীর্ঘদিন ধরে দিদি যমুনাকে দেখতে না পেয়ে মনখারাপ যমের৷ খুঁজতে খুঁজতে এক কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়াতে যমুনার দেখা পেল যম৷ ভাইকে পেয়ে খুশি যমুনা খুশি হয়ে যমুনা তার যথাবিহিত আপ্যায়ন করে৷মঙ্গলকামনায় ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয় যমুনা৷ অমরত্ব লাভ করে যম৷ আর সেই থেকে কার্তিক মাসের ওই বিশেষ তিথিটি ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে মর্ত্যধামে৷ ধরে নেওয়া হয় ওই বিশেষ দিনে ভাইয়ের কপালে দিদি ফোঁটা দিলে আয়ুবৃদ্ধি হয় ভাইয়ের৷

অন্য এক পুরাণ কথায় রয়েছে একসময় বলি রাজার হাতে পাতালে বন্দি হয় ভগবান বিষ্ণু৷ তাঁর বিহনে স্বর্গের দেবতারা পড়েলন বিপদে৷ তখন দেবতাদের অনুরোধে লক্ষ্মী বলি রাজাকে ভাই পাতালেন৷ এক কার্তিকা মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়াতে লক্ষ্মী ফোঁটা দিলেন বলি রাজাকে৷ ফোঁটা পেয়ে খুশি মনে বলি উপহার দিতে চাইলেন লক্ষ্মীকে৷ তিনিও বিষ্ণুর মুক্তি চেয়ে নিলেন উপহার হিসেবে৷ আর ওই তিথিটির সঙ্গে ভাই-বোনের ফোঁটা দেওয়ার উপাখ্যানটি জড়িয়ে রইল৷

অন্য একটি কাহিনি বলে, ধনত্রয়োদশীর পরের দিন চতুর্দশীতে কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেন৷ তারপরের দিন ফিরে আসেন দ্বারকায়৷কৃষ্ণ ফিরলে প্রতিপদের দিনে ভগিনী সুভদ্রা কৃষ্ণের কপালে পরিয়ে দেন জয়তিলক৷ মিষ্টান্ন খাওয়ান কৃষ্ণকে৷ সেই ঘটনাই ভাইফোঁটা হিসেবে পরিগণিত হয়৷

আবার চতুর্দশ শতাব্দীর পুঁথি অনুসারে জৈন ধর্মের অন্যতম প্রচারক মহাবীর বর্ধমানের মহাপ্রয়াণের পরে তাঁর অন্যতম সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন৷ সেই সময় তাঁর বোন অনসূয়া নিজের বাড়িতে নন্দীবর্ধনকে নিয়ে যান কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে৷ সেখানেই অনেক কাকুতি মিনতির পরে নন্দীবর্ধন বোনের হাতে খেয়ে নিজের অনশন ভঙ্গ করেন৷ এই কাহিনি সত্যি হলে মহাবীরের প্রয়াণ কাল (খ্রিষ্ট পূর্ব 527)বিবেচনা করে বলা যায়, ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়েছিল আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও আগে৷

তবে ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার প্রেক্ষাপটে যে পৌরাণিক আখ্যানই থাকুক না কেন, এই লৌকিক অনুষ্ঠানে যে একজন ভাই এবং বোনের সমান অস্তিত্বের গুরুত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, একথা অনস্বীকার্য৷ ভাইফোঁটাকে বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ধরে নেওযয়া হলেও সারা ভারতেই এই উৎসব পালিত হয় ভিন্ন নামে৷ বাংলার ভাইফোঁটা পশ্চিম ভারতে ‘ভাইদুজ’ নামে পরিচিত৷ আবার মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটকে এই উৎসবের নাম ‘ভাইবিজ’৷ অন্যদিকে নেপাল এমনকী পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলেও এই অনুষ্ঠানকে সবাই ‘ভাইটিকা’ হিসেবে চেনে৷

শুধু নামেই নয়, ভাইফোঁটার তিথি নিয়েও এপার আর ওপার বাংলার মানুষজনের মধ্যে মতভেদ রয়েছে৷ ওপার বাংলার লোকেরা কৃষ্ণ-সুভদ্রার আখ্যান মেনে প্রতিপদেই ফোঁটা দেয় ভাইয়ের কপালে৷ এবার বাংলার মানুষদের কাছে যা দ্বিতীয়া তিথিতেও সারা হয়৷ তবে যে নামেই এই লোক উৎসবকে ডাকা হোক, যেদিনই পালন করা হোক, এটা যে একটা পারিবারিক বন্ধনের উপলক্ষ্য সেকথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই৷

তাই হয়তো এই উৎসব পালনে কোনও বাধা ছিল না ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী জোড়াসাঁকোর ঠাকুড়বাড়িতেও৷ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌত্তলিকতা বিরোধী ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও হিন্দু সমাজে প্রচলিত অন্নপ্রাশন, উপনয়ন এমনকী বিয়ের নানান অনুষ্ঠান— আইবুড়োভাত, গায়ে-হলুদ, স্ত্রী-আচার ইত্যাদি পালনে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না তাঁর৷ সেই সূত্রেই ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার মতো স্নেহ-সৌহার্দ্রের মঙ্গল অনুষ্ঠান পালন করা হত ঠাকুরবাড়িতে৷ তাই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ দাদাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ভাইফোঁটা পেয়েছেন তাঁর দিদিদের কাছ থেকে৷ রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর জীবদ্দশায় ভাইফোঁটা পেয়েছেন সৌদামিনী, সুকুমারী, শরতকুমারী, স্বর্ণকুমারী এবং বর্ণকুমারী – এই পাঁচ দিদির হাতে৷ সেইসব ঘটনার বিবরণ রয়েছে ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে৷

1876 সালে পনেরো বছরের রবীন্দ্রনাথ তাঁর চেয়ে দু’বছরের বড়ো দাদা সোমেন্দ্রনাথের সঙ্গে ভাইফোঁটা পেয়েছেন তাঁদের বড়দিদি সৌদামিনী দেবীর কাছ থেকে৷ এমনকী ভাইফোঁটা পাওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথ প্রণামী টাকা দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বড়দিদিকে৷ আর সেই সময় প্রণামীর টাকাটি জুগিয়েছেন রবির নতুন বৌঠান কাদম্বিনী দেবী৷ বছরখানেক আগে মাতৃহারা হওয়া রবির যাবতীয় দায়িত্বপালন, ইচ্ছে-অনিচ্ছের দায় যিনি মাতৃস্নেহে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন৷ ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার সময় নিজের মাসোহারা থেকে বালক-দেবর রবিকে তিনিই দিয়েছেন সৌদামিনী দেবীকে প্রণামী দেওয়ার সেই টাকা৷ এই ঘটনার সাক্ষ্য রয়েছে রবীন্দ্রভবনে রাখা ঠাকুরবাড়ির ‘ক্যাশ বহি’তে৷

আবার রবীন্দ্রনাথের বৃদ্ধবয়সে, 1939 সালে রবীন্দ্রনাথকে ভাইফোঁটা দেওয়ার সাধটি অপূর্ণ থেকে যায় বর্ণকুমারী দেবীর৷ পাঁচ দিদির মধ্যে তখন একমাত্র তিনিই জীবিত ছিলেন৷ সেবার ‘রবি’র যা যা প্রিয় তা নিয়ে ভাইফোঁটার দিনে জোড়াসাঁকোতে পৌঁছলেন ছোড়দিদি বর্ণকুমারী৷কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের আগেই রবীন্দ্রনাথ ফিরে গিয়েছেন শান্তিনিকেতনে৷হতাশ বর্ণকুমারী দেবী আক্ষেপ করে চিঠি লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে ছোটভাই রবির কাছে৷ সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন কবির প্রিয় জিনিসগুলিও৷ অভিমান করে চিঠিতে লিখেছিলেন কোনও প্রণামী যেন রবি না পাঠায়৷ ছোটদিদির চিঠি ও উপহার পেয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর খুশির কথা জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ একথাও জানিয়েছিলেন সেবছর ভাইফোঁটায় তাঁর দিদির প্রতিনিধিত্ব করছে নাতনি নন্দিনী, রথীন্দ্রনাথের পালিত কন্যা৷

ভাইফোঁটায় দিদি বর্ণকুমারী এবং ভাই রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ

 

তবে বর্ণকুমারী দেবীর ভাইফোঁটা দেওয়ার সেই অপূর্ণ সাধ মিটেছিল তার পরের বছরই৷ ঘটনাচক্রে সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যজীবনের শেষ ভাইফোঁটা৷ তখন রবীন্দ্রনাথ আশি আর বর্ণকুমারী দেবী চুরাশি৷ ঠাকুরবাড়ির অশীতিপর ভাই-বোনের এই ভাইফোঁটার দৃশ্যের বর্ণনা চোখে জল এনে দেবে আজও৷ 1940 সালের 29 সেপ্টেম্বর কালিম্পঙ থেকে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে স্ট্রেচারে শুইয়ে আনা হয়েছে কলকাতায় – রাখা হয়েছে জোড়াসাঁকোর পাথরের ঘরে, বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা তখনো ফেরেনি – এমন সময় পড়লো ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উৎসব৷ আগের বছর বর্ণকুমারী দেবী ছোটভাইকে ফোঁটা দিতে পারেন নি, কিন্তু এবার রোগশয্যায় বন্দি রবীন্দ্রনাথকে ফোঁটা দিতে এলেন তিনি৷আশি বছরের রবিকে ফোঁটা দিলেন চুরাশি বছরের ছোড়দি৷ প্রত্যক্ষদর্শী রাণী চন্দ তাঁর ‘গুরুদেব’ বইতে লিখছেন – ‘…সে এক অপূর্ব দৃশ্য৷ আজও ভাসে ছবি চোখের সামনে৷ গৌরবরণ একখানি শীর্ণ হাতের শীর্ণতর আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা দিলেন৷ দুজন দুপাশ থেকে ধরে রেখেছি বর্ণকুমারীদেবীকে৷ ফোঁটা কেটে তিনি বসেলন বিছানার পাশের চেয়ারে৷ ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন৷ তারপর শুরু হল বিশ্ববন্দিত ভাইকে বকুনির পালা৷ বর্ণকুমারী দেবীর ধারণা বৃদ্ধবয়সে কালিম্পঙ যাওয়ার জন্যই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রবি৷ নতুবা তাঁর যেন অসুস্থ হওয়ার কথা নয়৷ অবিবেচক ভাইকে বর্ণকুমারীদেবী মৃদু তিরস্কার করে বললেন, “দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনো৷ বুঝলে? ”

গুরুদেব আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ালেন, বললেন “না, কক্ষণো আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে৷”

সকলের হাসিতে ঘর ভরে উঠল৷ রোগশয্যায় মধ্যেও কবি তাঁক কৌতুকপ্রিয়তা হারাননি৷

এরপর এল বিদায়ের পালা৷ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন না রবীন্দ্রনাথ৷ অথচ প্রণাম করতে হবে দিদিকে৷ তাই বর্ণকুমারীদেবীই তাঁর পা দু’খানি তুলে ধরতে বললেন যাতে তিনি পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে পারেন৷ দিদি বললেন, “থাক এমনিতেই হবে, তোমাকে আর পেন্নাম করতে হবে না কষ্ট করে৷” বলে ভাইকে আরো আরো আদর করে আরও বুঝিয়ে দুপাশে দুজনের হাতে হাতের ভর রেখে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন…’

এমন একটা অবিস্মরণীয় ভাইফোঁটার দৃশ্য সেকালে ভাইফোঁটার উৎসবের সঙ্গে কতখানি আবেগ মিশে থাকত! বিশেষ করে ঠাকুরবাড়ির ভাইফোঁটার আয়োজনে ধান-দুব্বো, ফুল-ফল নিবেদনের প্রথা তো ছিলই না৷ শুধু ছিল আন্তরিকতার আবেদন যা লোকাচারের অনেক উর্দ্ধে৷

তবে রবীন্দ্রনাথ ভাইবোনের সম্পর্কের মধ্যে যে সততাকেও মূল্য দিতেন, তার প্রমাণ মেলে গল্পগুচ্ছ-এর ‘ভাইফোঁটা’ গল্পটিতে৷ বাংলার 1321 সালের ভাদ্র মাসে লেখা এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুদের কারবারে একেবারে ডুবতে বসা সত্যধন কেমন করে তাঁর একদা ভগ্মীসমা বাল্যের সহচরী মৃত্যুশয্যায় শায়িত অনসূয়ার সম্পত্তি এবং তাঁর প্রায় মৃত্যুর ডাক শোনা পুত্র সুবোধের অগাধ সম্পত্তি, কোম্পানির কাগজ, গহনার উইলের উত্তরাধিকারী হয়েও সেই সম্পত্তি আত্মস্মাত করতে পারেনি৷ এমনকী স্ত্রী এবং শুভানুধ্যায়ী প্রসন্নর হাজার অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও সেই সম্পত্তির কানাকড়িটুকুও নিয়ে নিজের ডুবন্ত সুদের কারবারকে বাঁচাতে চায়নি সে৷ পরিবর্তে সবকিছু বিক্রি করেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুবোধকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছে সত্যধন৷ রবীন্দ্রনাথের গল্পে এর নেপথ্যে ছিল এক ভাইফোঁটার সিল্যুয়েটে ভাইবোন সম্পর্কের মধ্যে নৈতিকতা, সততার সুতোয় বাঁধা পড়া এক আত্মিক বন্ধনের চিত্র৷ রক্তের সম্পর্কের কোনও আত্মীয়তা না থাকা সত্ত্বেও৷

তারই একটু চিত্র তুলে ধরা হল ভাইফোঁটা গল্পের খণ্ডাংশে৷ সত্যধনের কথায় – আমাকে দেখিয়া অনুর মুখের ওপর একটি শান্ত প্রসন্নতা ছড়াইয়া পড়িল৷ সে বলিল, “কাল রাত্রে আমার অসুখ যখন বাড়িয়াছিল তখন হইতে তোমার কথাই ভাবিতেছি৷ আমি জানি, আমার আর বেশি দিন নাই৷ পরশু ভাইফোঁটার দিন, সেদিন আমি তোমাকে শেষ ভাইফোঁটার উপহার দিয়া যাইব৷”

সেই ভাইফোঁটার দিনেই অনু তার পুত্র সুবোধের জন্য যা কিছু আগলিয়ে রেখেছিল, সেই সঙ্গে সুবোধকেও সত্যধনের হাতে তুলে দেয়৷ গল্পের সেই ক্লাইম্যাক্সের আগে সত্যধনকে ভাইফোঁটার শেষ আপ্যায়ন করেছিল অনসূয়া৷ সত্যধনের জবানীতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ভাইফোঁটার খাওয়া খাইলাম৷ আমার কপালে সেই মরণের যাত্রী দীর্ঘায়ু কামনার ফোঁটা পরাইয়া আমার পায়ের ধুলা লইল৷ আমি গোপনে চোখ মুছিলাম৷”

সত্যধনের প্রতি ভগ্নীসমা অনুসূয়ার এই বিশ্বাস আর ভরসাকে একটা ভাইফোঁটার পটভূমিতে রেখে রবীন্দ্রনাথ এক ভাই বোনের সম্পর্ককে বুনে দিয়েছেন৷ যেখানে অনসূয়ার বিশ্বাসের কাছে সত্যধনের বৈষয়িক অর্থলিপ্সাও হার মেনেছে৷যদিও অনসূয়ার সম্পত্তিকে সত্যনিষ্ঠা দিয়ে আগলে রেখেও তার  পুত্র সুবোধকে মৃত্যুর হাত থেকে আগলাতে পারেনি সত্যধন৷

আসলে কখনও কখনও সবকিছুর পরেও আত্মসমর্পণ করতে হয় ভবিতব্যের কাছে, পারিপার্শ্বিক অসহায়তার কাছে৷

এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে আমাদের চারপাশে৷ আজকের প্রযুক্তির যুগে প্রবাসে থাকা ভাইকে ভিডিও কল করে সাগরের এপারে থাকা বোনের ভার্চুয়াল ফোঁটা এঁকে দেওয়া তো অতি সাধারণ ঘটনা৷ ব্যতিক্রমও রয়েছে,  যেখানে ভাইবোনের পারিবারিক সম্পর্কের সুতোটাই হয়তো ছিঁড়ে গিয়েছে৷ সেক্ষেত্রে একই শহরে বাস করা ভাই-বোনের মধ্যে পারস্পারিক দূরত্ব তৈরি হওয়ায় ভাইফোঁটার দিনে দিদির হাতের চুয়া-চন্দন হাতেই শুকিয়ে যায়৷ ভাইয়ের কপালে পড়ে না ফোঁটা৷অথবা ওই পতিতাপল্লীর কোনও বোন ফেলে আসা জীবনে কোনও ভাইয়ের উদ্দেশে অন্ধকার গলির অন্ধকারতম কোঠার দেওয়ালে ফোঁটা কাটে, চোখের জলে ভিজে৷ ভাই বোনের সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরলেও এই ভাইফোঁটার দিনে স্মৃতির দেওয়ালে ফোঁটা যে পড়ে ভাইয়ের কপালে তা মেনে নিয়েই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর ফোঁটা কবিতায় লিখেছেন— ভাই আমাকে বকুক ঝকুক/ দিক্গে যতই খোঁটা/যমের দুয়ারে কাঁটা দিচ্ছি/ভাইয়ের কপালে ফোঁটা/ভাইয়ের সঙ্গে আড়ি আমার/ভাইয়ের সঙ্গে ভাব/সেলাই করি তারই মাপে/রাজার কিংখাব|’

আবার এর উল্টো চিত্রও রয়েছে আমাদের সমাজে৷ যেখানে বৃদ্ধাবাসের ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে৷ কখনও কোনও সাফাইকর্মীকে বাড়িতে ডেকে ভাইফোঁটা দেন কোনও সহৃদয় দিদি৷ কখনও কখনও সেলিব্রিটিরা গণ ভাইফোঁটা দেন৷ আজকের প্রচারসর্বস্ব সোস্যাল মিডিয়ায় সেইসব চিত্র ভেসে আসে৷ ভাইফোঁটা উপলক্ষে দোকানে- রেস্তোরাঁর উপচে পড়া ভিড়ে ভাইফোঁটার সেই করপোরেট মূল্যায়ন হয় ঠিকই৷

কিন্তু এসবের মধ্যে আমরা কি মনে রাখি ভাইফোঁটা হল সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সিলমোহর দেওয়া? ভাইফোঁটার দিনে আমরা শুধু ভাইয়ের কপালেই ফোঁটা দিই না, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে স্বীকৃতি দিয়ে টিপছাপ দিই৷ যা মোছা যাবে না,  রয়ে যাবে আজীবন৷