ঠাকুর পরিবার বা পরিবারের সঙ্গে যুক্ত কোনও কোনও পুরুষ বিদেশিনীকে স্বদেশিনী করে তুলেছিলেন। আমার ভগিনীকল্প বন্ধুস্থানীয়া ড. চিত্রা দেব এর কিছু হদিশ আমাদের দিয়ে গেছেন। তাঁর কাছ ঋণ স্বীকার করে বাঙালিবাবুর বিলিতি বউ কহানিয়ার আসরটিকে একটুখানি জমাট করে তুলি।
অশ্বিনীকুমার ও ফেলিসিতা
রবীন্দ্রনাথের সহোদর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর আট মেয়ে তিন ছেলে। সবার বড় প্রতিভা। প্রতিভার মেজ ছেলে অশ্বিনীকুমার। অশ্বিনীকুমারের বাবা বিখ্যাত মানুষ— হরিপুরের চৌধুরি পরিবারের আশুতোষ চৌধুরি। অশ্বিনীকুমার ইতালি গিয়েছিলেন গবেষণার কাজে। রোমে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় মাদাম ল্যাপেস্কার। অশ্বিনীকুমারকে দেখে তাঁর চোখ ফেরানো দায়— এতই সুন্দর তিনি। ল্যাপেস্কার অন্য নাম ফেলিসিতা লোদেতি। উদয়শঙ্কর–খ্যাত আনা পাভলোভার ব্যালে–ট্রুপেও তিনি একসময় ছিলেন। নৃত্যকুশলা ফেলিসিতাকে দেখে অশ্বিনীকুমারও মোহিত। তিনি নিজে নাচ এবং গান ভালবাসেন শুধু নয়, দুটি বিষয়েই তাঁর বিপুল অধিকার। অতএব দুয়ে দুয়ে চার হতে সময় লাগেনি বেশি। দুটি চোখ দুটি মন যা হয় হোক না, চার চোখ দুটি মন এক হয়ে রোক্ না’। দু’জন দু’জনকে ভালবেসে ফেললেন গভীরভাবে। বোধকরি ফেলিসিতার প্রেমেই গভীরতা বেশি। আপন দেশ, পরিজন ছেড়ে, নাচের জীবনের বাহ্যিক চটক সব অস্বীকার করে ভিনদেশের বধূর অপরিচয়ের জীবনের হাতছানি তখন তাঁকে আকর্ষণ করে চলেছে গভীরভাবে। অতএব উভয় পক্ষের বাইরের বাধাগুলো সেই আকর্ষণে কোথায় ছিটকে গেল। তাঁর খ্রিস্টিয় ধর্মের বাধা–নিষেধ অতিক্রম করা সহজ ছিল না— ধর্মের একটা অস্পষ্ট বন্ধন তো থাকেই। কিন্তু আকাশের পাখি যে ধরা দিযেছেন। অতএব পোপের কাছে কাতর আবেদন তাঁদের যৌথজীবন যাপনে তাঁর অনুমতি এবং আশীর্বাদের জন্য। ধর্মের অনুশাসন এবং হৃদয়ের অনুরোধের মধ্যে পোপের মানবিক হৃদয় জয়ী হল। অতএব আর বাধা রইল না। দু’জনে বিধিমতে জোড় বাঁধলেন ১৯১৯সালে। তার পরে অশ্বিনকুমারের ঘরে ফেরা আর ফেলিসিতার ঘর বাঁধার পালা শুরু হল।
তিনি যে ব্যালোরিনা ছিলেন, এক বর্ণাঢ্য জীবনকে পিছনে ফেলে এসেছেন, সে কথা কখনও বুঝতে পারতাম না। বাংলা বলতেন, ঘোমটা দিতেন, শাড়ি তো পরতেনই এমনকী রান্নাঘরে গিয়ে ঝোলভাতও রাঁধতে পারতেন।
সব ছেড়ে যে আসতে পারে, সবাইকে সে আপন করে নিতে পারে। ভাষা, আচার–আচরণকে দ্রুত বদলে ফেলে ফেলিসিতা চৌধুরি পরিবারের নয়নের মণি। তিনি শাড়ি পরেন, ঘোমটা দেন— কে বলবে তাঁকে তিনি ভারতীয় বধূ নন। কখনও কি শূন্যতা এসে ঘিরে ধরে না তাঁর হৃদয়কে! কিন্তু তাকে তিনি পূর্ণ করেন তাঁর গান আর পিয়ানো দিয়ে। ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিককে তাঁর সাধনার স্থান করে নিয়েছেন। শাশুড়ি–মা প্রতিভা দেবী নিজে গানের জগতের লোক। ‘আনন্দসঙ্গীত পত্রিকা’ প্রকাশ করেছেন, সংগীত সংঘেরও তিনি সর্বেসর্বা। শাশুড়ির সেই ‘সঙ্গীত সংঘ’-এর যাবতীয় ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ফেলিসিতা। তাঁর সম্বন্ধে তাঁর ননদ— অশোকার পুত্রবধূ যা বলেছিলেন— চিত্রা তা তুলে দিয়েছেন– ‘তিনি যে ব্যালোরিনা ছিলেন, এক বর্ণাঢ্য জীবনকে পিছনে ফেলে এসেছেন, সে কথা কখনও বুঝতে পারতাম না। বাংলা বলতেন, ঘোমটা দিতেন, শাড়ি তো পরতেনই এমনকী রান্নাঘরে গিয়ে ঝোলভাতও রাঁধতে পারতেন। বাঙালি জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে গিয়েছিলেন, শুধু একবার তাঁর সঙ্গে একটা ইংরেজি ছবি দেখতে গিয়ে, ছবিটা প্রধানত ব্যালে নৃত্য নিয়ে ছিল, নৃত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ লক্ষ করেছিলাম।’
আমাদের আফশোস— যদি রবীন্দ্রনাথ এই বউটিকে কাছে পেতেন!
মোহনলাল ও মিলাডা
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজমেয়ে করুণা। করুণার বড়ছেলে মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯০৯–১৯৬৯), সুপরিচিত সাহিত্যিক রবীন্দ্রস্নেহধন্য মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র। মোহনলাল বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর ‘দক্ষিণের বারান্দা’ স্মৃতিকথার জন্য।
হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করে মোহনলাল লন্ডন চলে যান অ্যাকচুয়ারি পড়তে লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স–এ। ভাল লাগল না বিষয়টি। অমনি ছেড়ে দিয়ে সংখ্যাতত্ত্ব–স্ট্যাটিসটিকস্ নিয়ে পড়া শুরু করেন। পরিসংখ্যানবিদ হয়ে দেশে ফিরে কিছুদিন বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সে কাজ করে বরাহনগরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। কিন্তু ষাট বছরে অবসর নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।
বিদেশের মোহনলালের সঙ্গে তাঁর হবু স্ত্রী মিলাডার পরিচয়। সেটা ১৯৩৫ সাল। জমাটি শীতে জমে উঠেছে একটি সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। মোহনলাল এবং ঘটনাচক্রে মিলাডাও সেই সঙ্গীত–সন্ধ্যা উপভোগ করতে গেছেন। মোহনলাল ভারতীয় এবং মিলাডা চেকোস্লোভাকিয়ার কন্যা। পরিচয় হল দু‘জনের। মোহনলাল রবিঠাকুরের দেশের ছেলে এবং সেই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত জেনে মিলাডা সোৎসাহে বলে ফেললেন— রবীন্দ্রনাথের দুটি বই তিনি চেক অনুবাদের মাধ্যমে পড়ে ফেলেছেন –‘দি গার্ডেনার’ এবং ‘গীতাঞ্জলি’। ওই ‘ঠাকুরমশায়’ই যেন মিলিয়ে দিলেন বিশ্বের দুই প্রান্তের দুটি তৃষিত নর–নারীর হৃদয়কে। পরিচয়ের পর্ব পার হয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের পর্যায়ে। মিলাডাই বেশি উন্মুখ। কথায় কথায় বাড়ির লোকজনদের মিলাডা জানিয়ে দিলেন তাঁর নির্বাচিত পাত্র মোহনলালের কথা— তাকেই শুধু বিয়ে করবেন তিনি। মোহনলাল তাঁকে এতখানি মোহিত করেছেন শুনে তাঁদের পেটের ভিতর হাত–পা সেঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। বলে কী মেয়েটা! একটা অজানা ভারতীয়কে তাদের বাড়ির মেয়েটা বিয়ে করতে চায়? না, না, এটা হতেই পারে না। ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে তুই কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারবি না— ওরা খুব কনজারভেটিভ, রক্ষণশীল। এই মতলব ছেড়ে দে। মিলাডার তখন একটা আর্তি— মিলিয়ে দাও— তোমরা মোহনের সঙ্গে আমাকে মিলতে দাও।
চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। গুরুজন বলে কথা। তাঁরা একেবারে না করে দিলেন আর এঁরা তখুনি গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়েটি সেরে নিলেন। দুটি প্রাপ্তবয়স্ক নর–নারী। কিছু করার রইল না। এঁদের ভিতরে ঝড়, বিশ্বজুড়েও তখন ঘনায়মান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝঞ্ঝা। কিন্তু সেই দেশটাকে আক্রমণ করতে চলেছে জার্মানি। মিলাডাকে নিয়ে লন্ডনে এসে মোহনলাল ঠিক করলেন যত তাড়াতাড়ি পড়াশোনার পাট শেষ করে তাঁরা ভারতে ফিরে আসবেন। কিন্তু একসঙ্গে তাঁদের ভারতে ফেরা হল না। বিয়ের পর মিলাডা ব্রিটিশ ভারতের নাগরিক হয়েছেন। মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে হলে বিশেষ পারমিটের দরকার। দু’জনে লন্ডনে নাৎসিদের অফিসে গেলেন। দীর্ঘ তর্কাতর্কির পর স্বদেশে যাওয়ার অনুমতি পেলেন মিলাডা। মাত্র একমাসের জন্য বিশেষ ভিসা পেয়ে। মিলাডা লিখেছেন—
I said, ‘My mother is very ill, and if she cannot see me before I go to far off India, she is going to die. She will not be able to bear it.’
Then the officer-in-charge told me, ‘Are you sure she is going to die if you do not see her.’ I said, ‘Yes, I believe she would die if I do not see her before going to India.’
এবং আশঙ্কা সত্য করে মিলাডা দেশ ছেড়ে লন্ডনে আসার দু–দিন পরেই বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা। মিলাডা আর মা–বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেন না— অপেক্ষা করতে হল ভারতের স্বাধীনতা পাওয়া অবধি। ‘I never saw my mother after 1939. At the height of the war, my mother tried to get news of India–about me really– on the radio. Someone heard her listening, which was illegal, and reported her. She was arrested by the Nazis and taken to a concentration camp. She never returned.’ ভালবাসার চরম দায় মিলাডাকে বহন করতে হল মাকে চিরতরে হারিয়ে।
যুদ্ধের সময় ঠাকুরবাড়ির প্রায় সকলেই গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। মিলাডা সেখানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ পেলেন, তবে তখন তাঁর শরীর ভাল ছিল না। তিন মাস সেখানে হাতের কাজ শিখলেন মিলাডা।
মোহনলাল চলে এসেছিলেন ভারতে মিলাডাকে ছেড়ে। শেষ অবধি চিত্রা দেব যেভাবে বর্ণনা করেছেন এই চলে আসা— তা উদ্ধার করে দিই—
‘ ভারতে মিলাডাকে একাই আসতে হয়েছিল, তাঁর নিজের শহর থেকে ত্রিয়েস্ত, সেখান থেকে মার্সেই, সেখান থেকে সর্বশেষ জাহাজে, সেটি ইউরোপ থেকে ভারতে আসছিল। ব্রিটিশ জাহাজ হলেও তার জানালাগুলি পর্যন্ত কাচে ঢাকা, আসন্ন যুদ্ধের আতঙ্কে কাঁপছিল সারা ইওরোপ। বোম্বেতে মিলাডার জন্য একটা উপহার অপেক্ষা করছিল। প্যাকেট খুলে তিনি পেলেন তাঁর স্বামীর উপহার, শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ এবং সুন্দর একজোড়া চটি জুতো। জাহাজে পরিচিত এক ভারতীয় মহিলার সাহায্যে ভারতীয় পোশাক পরেই ভারতের মাটিতে পা দিলেন মিলাডা। খুশিতে বিহ্বল হলেন মোহনলাল, দেওর শোভনলাল, বউদিদির হাতে তুলে দিলেন গোলাপের স্তবকের বদলে পদ্মকুঁড়ির গুচ্ছ। জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়ি তখন পূর্বগৌরব হারিয়েছে, তবু মেয়েরা এসে তাঁকে শাঁখ বাজিয়ে নববধূর মতো নিয়ে গেল। অবনীন্দ্রনাথ তখন ছবি আঁকছিলেন। তাঁকে দেখে বললেন, ‘I am sorry for the parents who have lost you forever.’ যুদ্ধের সময় ঠাকুরবাড়ির প্রায় সকলেই গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। মিলাডা সেখানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ পেলেন, তবে তখন তাঁর শরীর ভাল ছিল না। তিন মাস সেখানে হাতের কাজ শিখলেন মিলাডা। এখানেই তাঁর মনে আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহ জন্মায়, বসন্ত উৎসবের সময় কয়েকজন সাঁওতালকে দেখতে পান। কিন্তু নিজের প্রকৃত কর্মক্ষেত্রটি তিনি খুঁজে পেলেন আরও কয়েক বছর পরে।
মণিপুরের মহারাজকুমারী বিনোদিনী দেবীর সঙ্গে মিলাডার পরিচয় হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। সেই সূত্র ধরে তিনি মণিপুর বেড়াতে গিয়েছিলেন ইম্ফলে। তার পাশেই নাগারাজ্য। মিলাডা জানালেন, তিনি সেখানে যাবেন। ইনার লাইন পারমিট নিয়ে যেতে হল, মণিপুরি রাজকন্যার ব্যবস্থায়, ‘I entered Nagaland in a mail bus escorted by a convoy of 120 military trucks.’
নাগা পাহাড়ের নীলিমা মুগ্ধ করল মিলাডাকে, সেইসঙ্গে কৌতূহল তীব্র হল নাগাদের জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে। দ্বিতীয় যাত্রায় মিলাডা সৌভাগ্যবশত পরিচিত হলেন এক অঙ্গামি নাগা যুবক নিবিসা চাসির(Nivisa Chasie) সঙ্গে৷তিনি কোহিমা হাইস্কুলের শিক্ষক৷ তাঁর সাহায্যে মিলাডা নাগা সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন৷ ১৯৬৩ থেকে ১৯৮৮, পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিলাডা নাগাদের নিয়ে ভেবেছেন, পর্যবেক্ষণ করেছেন, নাগারাজ্যে প্রবেশের জন্য আঠারোবার পারমিট নিয়েছেন, বিভিন্ন নাগা সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের জীবনযাপন পদ্ধতি জানতে চেয়েছেন৷ অপর্যাপ্ত ভালবাসা পেয়েছেন তাঁদের কাছ থেকে, দেখেছেন তাঁদের শিল্পবোধ ও প্রতিভার সুচারু সঙ্গম৷ চেক ভাষায় মিলাডা প্রথমে নাগাদের নিয়ে একটি বই লেখেন৷ এরপরে ইংরাজি ভাষায়, ‘এ পিলগ্রিমেজ টু দি নাগাজ’ (১৯৮৪) ও ‘নাগা আর্ট’ (১৯৯৩)৷ নৃতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক দৃষ্টি নিয়ে নাগা সমাজকে ইতিপূর্বে কখনও দেখা হয়নি৷খুব ভালো ফোটো তুলতেন বলে মিলাডার বইদুটি দুর্লভ চিত্রসংগ্রহে পূর্ণ৷
কর্মক্ষেত্র হিসেবে মিলাডা বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষাক্ষেত্রকে৷সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সূচনাপর্ব থেকেই তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে, নার্সারি বিভাগটির সঙ্গে৷ বাকি সময়টুকু তিনি কাটাতেন লেখাপড়ার কাজ নিয়ে৷ চেক ভাষায় যেমন লিখেছেন ‘ইন দি ল্যান্ড অফ জুয়েল’, ‘পিকচার্স ফ্রম বেঙ্গল’, বাংলায় তেমনই রূপকথা সংগ্রহ প্রকাশ করেছেন ‘বারো মাসের বারো রাজা’৷ মোহনলালের সঙ্গে যুগ্মভাবে অনুবাদ করেছেন চেক ছোট গল্প ‘নীল চন্দ্রমল্লিকা’৷’
মোহনলালের মৃত্যুর পরে অনেকদিন মিলাডাকে একা থাকতে হল ভারতে৷ বৃহত্তর সংসারের বিচিত্রভার বহন করে মিলাডাও চলে গেলেন ইহসংসারে ভালবাসার মহিমা ঘোষণা করে৷
সন্দীপ ঠাকুর ও এইকো
পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের মেজ ছেলে প্রবোধেন্দুনাথ ঠাকুরের কথা আমরা অনেকেই জানি ‘কাদম্বরী’র অনুবাদক হিসেবে৷ অবন ঠাকুরের ওপর লেখা তাঁর একটি জীবনীও খুব পরিচিত৷ অবনীন্দ্রনাথের কাছেই তিনি ছবি আঁকতে শিখেছিলেন৷ তাঁরই বড় ছেলে সন্দীপ ঠাকুর৷ঠাকুর পরিবারে বিদেশি বউ যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে সন্দীপ ঠাকুরের স্ত্রী-ই একমাত্র জাপানি মহিলা৷ আমরা এইকো ঠাকুরের কথা বলছি৷
এইকো সেই সমাজের মেয়ে ছিলেন না, যে জাপানি সমাজ সম্পর্কে সন্দীপ লিখে গেছেন—‘জাপানি সমাজ যেন সুবিশাল অজগর, নারীজাতিকে পিষে নিংড়ে নিচ্ছে, স্বার্থসাধনের জন্য৷… অনেক জাপানি মহিলা অ-জাপানিকে বিয়ে করছেন,– প্রেম ভালবাসার জন্যে নয়, জাপানি পুরুষদের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে৷’
সন্দীপ নিজে একজন বড়মাপের শিল্পী৷ প্রায় ৫০ বছর ধরে জাপান থেকে রবীন্দ্রনাথের গানকে জনপ্রিয় করার বিষয়ে তাঁর নিরলস সাধনার কথা আমরা অনেকেই জানি না৷ অথচ তাঁকে জানার জন্যে তাঁর একটি জাপানি ভাষার বই আছে, বাংলায় সেটি অনুবাদ করেছেন সুধীর চন্দ মহাশয়৷
সন্দীপের স্বীকারোক্তি– ‘এক ছুটিতে টোকিও বেড়াতে গিয়ে তার সাথে আমার পরিচয়৷ সপ্তাহখানেক আলাপের পরই আমি বুঝলাম আমার জীবনসঙ্গিনীকে আমি খুঁজে পেয়েছি৷’ অর্থাৎ সন্দীপ একজন জীবনসঙ্গিনীকে খুঁজছিলেনই গানের ফাঁকে ফাঁকে৷ সেই খোঁজারই অবসান হল জাপানি মিষ্টি মেয়ে এইকোর সঙ্গে আলাপ হয়ে৷ তাকে পাওয়ার বাসনা সন্দীপ ব্যক্ত করলেন৷
কিন্তু এইকো তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি হতে পারেননি৷ তিনি অভিজাত পরিবারের মেয়ে বলে নয়, এখনও তিনি ছাত্রী৷ পড়াশোনা শেষ না করে আর একটা জীবনের কথা তিনি ভাবতে রাজি নন৷ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি ভাষা ও আমেরিকান সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন৷ সেটা শেষ হতে আরও প্রায় একটা বছর৷ কোর্টশিপ চলতেই থাকল এবং চলতে চলতে একটা বছর শেষ হয়ে গেল৷ এইকো বললেন— সন্দীপ আমি রেডি৷ বিয়েটা হয়ে যাক৷ এইকো সেই সমাজের মেয়ে ছিলেন না, যে জাপানি সমাজ সম্পর্কে সন্দীপ লিখে গেছেন–‘জাপানি সমাজ যেন সুবিশাল অজগর, নারীজাতিকে পিষে নিংড়ে নিচ্ছে, স্বার্থসাধনের জন্য৷… অনেক জাপানি মহিলা অ-জাপানিকে বিয়ে করছেন,– প্রেম ভালবাসার জন্যে নয়, জাপানি পুরুষদের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে৷’ এইকো এদের থেকে আলাদা৷ আলাদা বলেই এরই মধ্যে ভাবতে শুরু করেছিলেন প্রাচ্যদেশীয় আর একটা জাতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক আর মানসিক মেলবন্ধনের এই তো সুযোগ৷ একজন বিদেশিনী যখন ভারতীয় হতে চান–লক্ষ করেছি, আর একটা দেশকে ভালবাসার মতো উদারতা নিয়েই তাঁরা সব ছেড়ে ঘর বাঁধতে আসেন৷
এটা যদি সত্যি হতো, তাহলে কি এইকো জাপানি ভাষায় ভারত জাপান সংস্কৃতি নিয়ে পাঁচ পাঁচখানা বই লিখে উঠতে পারতেন! অধ্যাপনার ফাঁকে এই ভাবনাটাই তাঁর কাছে মুখ্যস্থান পেয়েছিল৷ বইগুলোর নাম সন্দীপ বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছেন– ‘গাধাকে মানুষ করা গেল না’, ‘দোল দোল দোলানি’, ‘ভারতের পাখি হিরামন’ ইত্যাদি৷ কত খুচরো প্রবন্ধ লিখেছেন ভারতকে নিয়ে৷ স্বামীকে ভালোবেসে গোটা দেশটাকেই আপন করা– এ তো ছোট অন্তঃকরণের বিষয় নয়৷ তাঁদের বড় মেয়ে মায়া বাবাকে একটি চিঠিতে না হলে লিখবেন কেন– ‘তুমি ও মা ভারতবর্ষকে আমার জীবনের অঙ্গ হিসেবে রাখতে প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিলে এবং তোমার মাতৃভূমির ঐতিহ্য আমার জীবনে অবশ্যই প্রভাব ফেলেছে৷ আমার এই ভারত-চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমি গর্বিত৷ আমার পুত্রকন্যাদেরও আমি আমার এই চিহ্নে চিহ্নিত করে যেতে পারব এটাই আশা৷’
এইকো তাঁর সন্তানদের বোঝাতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামী সন্দীপ তাঁর কাছে বড়, তবে স্বামীর দেশটা তার থেকেও আরও বড়৷
শনিবারের চিঠি, ডিসেম্বর, ২০১৩