উৎসবপ্রিয় বাঙালি শুধু পালাপার্বণে নয়, তার আনন্দের উৎস খোঁজে যে-কোনো অনুষ্ঠানেই। এমনকী কোনও কোনও ক্ষেত্রে অশীতিপর কিংবা নবতীপর পারিবারিক সদস্যদের মৃত্যুযণ্ত্রণা ভুলতেও। সেটা অবশ্য শুধু বাঙালির ক্ষেত্রেই নয়, সব জাতির মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। সেই সূত্রেই দীপান্বিতা অমাবস্যার আলোকমালা নিভে আসার পর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে প্রদীপ দানও একটি আনন্দের আচার। আর এই প্রদীপ দানের পরেই চণ্ডীস্তোত্র পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পরবর্তী আর-একটি হৈমন্তিক পার্বণ মা জগদ্ধাত্রীর আরাধনা।
শাস্ত্রে মা জগদ্ধাত্রী দুর্গার যে রূপ বর্ণনা করা আছে তা শ্রীজগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্রে মেলে। এই রূপ ব্যতীত অন্য কোনও কিছুই শাস্ত্রসম্মত জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নয়। জগদ্ধাত্রী দুর্গা তন্ত্রের দেবী। তন্ত্রমতে মা জগদ্ধাত্রীর রূপ এইভাবে বর্ণনা করা হয়েছে:
“সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।
চতুর্ভূজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্।
চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ ধার্য়ন্তিম্ চ দক্ষিণে।।
রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্।
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।
ত্রিবলীবলয়োপেতনাভিনালমৃণালিনীম্।।
ইষৎ সহাস্য বদনাং কাঞ্চনাভাং বরপ্রদাম ।
নবযৌবন সম্পন্নাম্ পীনোন্নত পয়োধরম্ ।।
করুণামৃত বষিন্যা পশ্যন্তি সাধকং দৃষা ।
রত্নদ্বীপে মহাদ্বীপে সিংহাসনসমন্বিতে।
প্রফুল্লকমলারূঢ়াং ধ্যায়েত্তাং ভবগেহিনীম্।।”
— বৃহৎতন্ত্রসার
এর অর্থ হল-মহাদেবী জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলংকারে ভূষিতা ও নাগরূপ যজ্ঞোপবীত(পৈতা)ধারিণী। দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ ও শার্ঙ্গ ধনু; দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র ও পঞ্চবাণ। রক্তবস্ত্রপরিহিতা সেই ভবসুন্দরী প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা। নারদাদি মুনিগণ তাঁর নিত্যসেবা করে থাকেন। তাঁর ত্রিবলিবলয়সমন্বিত নাভিমণ্ডল মৃণালবিশিষ্ট পদ্মের ন্যায়। দেবীর মুখমণ্ডলে হালকা হাসি, কাঞ্চনের আভা তার গাত্রদেশে। তিনি নবযৌবন-সম্পন্না ও তার স্তন পরিপূর্ণ ও সুউচ্চ। তিনি সাধকের প্রতি করুণা বর্ষণ করেন। সেই শিবপত্নী রত্নদ্বীপরূপ উচ্চ বেদিকায় স্থিত সিংহাসনে প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর উপবিষ্টা।
চন্দননগর, কৃষ্ণনগর-সহ বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সাড়ম্বরে পূজিত হন জগদ্ধাত্রী মাতা। আলোকসজ্জা, মণ্ডপসজ্জায় বাঙালির সব থেকে বড় উৎসব দুর্গোৎসবের থেকে কম যায় না সেইসব জগদ্ধাত্রী পুজোর আড়ম্বর। কোথাও কোথাও, বিশেষ করে চন্দননগরের অনেক জায়গায় সুবিশাল প্রতিমা দেখে অভ্যস্ত সকলেই। জয়রামবাটিতে মা-সারদার জন্মভিটের পুজোও খুব বিখ্যাত।
কলকাতাসহ হুগলি জেলার ভদ্রেশ্বরেও অনেক পুজো হয়। বাংলায় এই পুজো জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও জগদ্ধাত্রীর প্রথম পূজা বা উৎস কোথায়, কবে, কীভাবে, তা অনেকেরই অজ্ঞাত।
লোকইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, শান্তিপুর শহর ছাড়িয়ে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের এক প্রাচীন জনপদ ব্রহ্মশাসন। এক সময়ের ভাগীরথীর গতিপথ ছিল ওই জনপদের ওপর দিয়ে। কথিত আছে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের হাত ধরেই নদিয়ায় প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়। তারই পৌত্র গিরীশচন্দ্র রায় তার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত শান্তিপুরের হরিপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী ওই অঞ্চলে ১০৮ ঘর ব্রাহ্মণ পরিবারকে বসবাসের জন্য জায়গা দেন। আর তার থেকেই এই গ্রামের নাম হয় ‘ব্রহ্মশাসন’।
ইতিহাস বলছে ১৭১৫ থেকে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন নদীয়ারাজ রঘু রায়, তারপর ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার রাজা হন কৃষ্ণচন্দ্র রায়। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে তখন বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে পুজিতা হতেন দেবী দুর্গা— যিনি ‘রাজরাজেশ্বরী’ নামে পরিচিত। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদৌল্লার সঙ্গে যখন মীরজাফরের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিল, তখন রাজনৈতিক স্বার্থে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে মীরজাফরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীরজাফরকে সরিয়ে যখন বাংলার মসনদ দখল করেন তার জামাতা মীরকাশিম, তখন যে-কোনো কারণেই হোক তাঁর সঙ্গে বিরোধ বাঁধে নদীয়ারাজের। তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে নবাবি নজরানা ও কর দিতে অস্বীকার করলে মীরকাশিম রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দি করে বিহারের মুঙ্গের কারাগারে পাঠিয়ে দেন। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে জেল থেকে পালিয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র জলপথে কৃষ্ণনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বন্দি হওয়ার কারণে সেই বছর তিনি তাঁর আরাধ্যা দেবী দুর্গার পুজো করতে পারেননি। বিহার থেকে ফেরার পথে বর্তমানে নদীয়া জেলার রুকুনপুর অঞ্চলে তিনি দেখেন গঙ্গাবক্ষে দুর্গপ্রতিমা নিরঞ্জনের দৃশ্য দেখে তাঁর মন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
সেই রাতেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে পৌঁছে রাজা স্বপ্নাদেশ পান দেবীর। স্বপ্নে দেবী বলেন, দুর্গা আরাধনা করতে না পারায় কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি আদেশ দেন, আগামী শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী পূজার আয়োজন করতে হবে এবং সেই দেবী জগদ্ধাত্রী নামে পূজিতা হবেন। মোহিত রায় সম্পাদিত ‘নদীয়া কাহিনী’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, সেই সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপের কোনো ধারণা না থাকার কারণে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর হাত ধরেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে প্রথম দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো শুরু হয় মঙ্গলঘট পুজোর মাধ্যমে।
এরপর ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৌত্র গিরিশচন্দ্র রায় যখন নদীয়ার অধিপতি হন, তখন তার রাজসভায় সভাপণ্ডিত পদ অলংকৃত করতেন চন্দ্রচূড় তর্কচূড়ামণি, ১০৮ ঘর ব্রাহ্মণদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি ব্রহ্মশাসন গ্রামে বসবাস করতেন গিরিশচন্দ্রের আমলে। সেই সময় ওই অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাগীরথীর তীরে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তন্ত্রসাধনা করতেন। কথিত আছে, তত দিনে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়েছে, কিন্তু দেবীর কোনো নির্দিষ্ট রূপ এবং পূজার পদ্ধতি বা মন্ত্র ছিল না। গিরিশচন্দ্রই চন্দ্রচূড়কে অনুরোধ করেন সাধনার মাধ্যমে দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপের সন্ধান এবং পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতি এবং মন্ত্রের অন্বেষণের। এর পরে ধ্যানে বসেন চন্দ্রচূড়। আর সাধনায় বসে একদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে দেবীর মৃন্ময়ী রূপের দর্শন পান তিনি, সেই দেবীর গ্রাত্রবর্ণ ছিল ব্রাহ্মমুহূর্তের রং অর্থাৎ ঊষাকালে সূর্যের রং এবং তিনি ছিলেন সিংহবাহিনী চতুর্ভূজা। কথিত আছে, সেই সাধনাতেই পুজোর পদ্ধতি এবং মন্ত্রের হদিশ পান চন্দ্রচূড়। এর পরে সেই পদ্ধতি মেনেই দেবীর সেই ঊষাবর্ণা মৃন্ময়ী রূপ সৃষ্টি করে তিনি ব্রহ্মশাসনে পুজো শুরু করেন। সম্ভবত ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে মহাআড়ম্বরের সঙ্গে দেবীর মৃন্ময়ী রূপের আরাধনা শুরু হয়। আর পরবর্তীকালে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই, এবং পরম্পরা মেনেই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে ব্রহ্মশাসন-সহ শান্তিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাটমন্দির থেকে শুরু করে পরবর্তীতে এই পুজো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে শান্তিপুর, চন্দননগর থেকে বাংলার এবং বাংলার বাইরে আপামর বাঙালি সমাজের কাছে।
অন্য একটি প্রবচনেও পূর্বোক্ত কাহিনি কথিত আছে যে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন এই বাংলায়। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, বাংলার নবাব আলিবর্দি খানকে রাজকর দিতে না পারায় কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। সালটা ১৭৫৪। পরে নবাবের কারাগার থেকে অবশেষে তিনি যখন মুক্ত হয়েছিলেন, তখন দুর্গোৎসব প্রায় শেষ। সেবার পুজোয় উপস্থিত থাকতে না পারায় ক্লান্ত বিষণ্ণ রাজা নৌকার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। জনশ্রুতি, সেখানেই কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেছিলেন যে এক রক্তবর্ণা চতুর্ভূজা কুমারী দেবী তাঁকে বলছেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে। ইতিহাস গবেষকদের মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক।
অতীতের মতো আজও কৃষ্ণনগরের সব সর্বজনীন প্রতিমা রাজবাড়ির সামনে দিয়ে শোভাযাত্রা করে বিসর্জনে যায়। আগে রাজপ্রাসাদ থেকে রানিরা সেই সব প্রতিমা দেখে প্রথম দ্বিতীয় নির্ধারণ করতেন। মিলত পুরষ্কারও।
তাই আজও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকেই সৃষ্টিশীলতায় জগদ্ধাত্রী পুজো যেন খুঁজে পেয়েছে তার খ্যাতি।
জগদ্ধাত্রী পুজোই কল্যাণকর, তিনিই শ্রেষ্ঠা। শাস্ত্র বলছে, একই দেবীর দুই রূপ। একজন দুর্গা, অন্য জন জগদ্ধাত্রী। দুর্গা পুজোর ঠিক এক মাস পরেই হয় জগদ্ধাত্রী পুজো। আশ্বিন মাসের শুক্লা অষ্টমীতে দেবী দুর্গার মূল পুজো আর কার্তিকের শুক্লা নবমীতে দেবী জগদ্ধাত্রীর।
নামেই বোঝা যায়, জগদ্ধাত্রী হলেন জগতের ধাত্রী। তিনিই জগৎ সভ্যতার পালিকা শক্তি। তিনি দেবী দুর্গারই আর এক রূপ। তাই জগদ্ধাত্রীর প্রণামমন্ত্রে তাঁকে ‘দুর্গা’ বলে স্তুতি করা হয়েছে। দুই দেবীই ত্রিনয়না ও সিংহবাহিনী। তবে দুর্গার মতো জগদ্ধাত্রী দশভূজা নন। তাঁর চার হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ থাকে। গলায় থাকে নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহের নীচে হাতি। এই হাতি আসলে করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হাতিরূপী অসুর।
দেবদেবীদের মধ্যে জগদ্ধাত্রীই সর্বশ্রেষ্ঠা। ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্ন্যাসী স্বামী নির্মলানন্দ মহারাজ তাঁর ‘দেবদেবী ও তাঁদের বাহন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কে? অগ্নি? বায়ু? বরুণ? চন্দ্র? না, অন্য কোন দেবতা? একদা প্রথমোক্ত দেবতাচতুষ্টয় ভ্রান্ত গর্ব্ববশতঃ নিজদিগকেই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং জগতের ঈশ্বর ব’লে সিদ্ধান্ত করেন। তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন— মহাশক্তিরূপিণী জগদ্ধাত্রীর শক্তিতেই তাঁরা শক্তিমান্।” এর পরে কিভাবে দেবী জগদ্ধাত্রী অহঙ্কারী দেবতাদের গর্ব চূর্ণ করেছিলেন সেই কাহিনিও লিখেছেন তিনি। একই সঙ্গে দেখিয়েছেন কেনোপনিষদের এক উপাখ্যানেও রয়েছে ইন্দ্রাদি দেবগণের অহঙ্কার চূর্ণ করার কাহিনি।
সেই কাহিনি অনুসারে, দশপ্রহরণধারিনী মহামায়ার হাতে মহিষাসুর বধের পরে দেবতারা খুব অহঙ্কারী হয়ে পড়েন। তাঁদের ধারণা, তাঁরা অস্ত্র দান করার জন্যই দেবী দুর্গা অসুরনাশ করতে পেরেছেন। মহামায়ার শক্তিকে তাঁরা অস্বীকার করতে চান। ভুলে যান মহাশক্তিরূপিণী জগদ্ধাত্রীর শক্তিতেই তাঁরা শক্তিমান। সেই অজ্ঞতাকে ভুল প্রমাণ করতে তিন কোটি সূর্যের সমষ্টিগত দীপ্তি নিয়ে আবির্ভূত হন জ্যোতির্ময়ী জগদ্ধাত্রী। একটি তৃণখণ্ড সামনে রেখে তিনি বায়ু ও অগ্নিকে স্থানচ্যুত বা দগ্ধীভূত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু কেউই তা পারেন না। বুঝতে পারেন, বৃথাই অহঙ্কার, একখণ্ড তৃণের শক্তিও তাঁদের নেই। বুঝতে পেরেই সকলে দেবী জগদ্ধাত্রীকে সকল শক্তির শ্রেষ্ঠ হিসেবে গ্রহণ করেন। দেবী তাঁর তেজোরাশি স্তিমিত করে এক অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলে সকলে দেখেন ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী জগদ্ধাত্রীর দর্শন পান। মঙ্গলময়ী মহাদেবীর সেই মূর্তি দেখে দেবগণ তাঁর স্তবে বসেন৷
জগদ্ধাত্রী যে দেবীশ্রেষ্ঠা তা শোনা যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণের মুখেও। তিনি বলেছেন, “জগদ্ধাত্রীরূপের মানে কী জান? যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন। তিনি না ধরলে জগৎ পড়ে যায়— নষ্ট হয়ে যায়। মনকরীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হয়।”
মদমত্ত হাতি, তার উপরে শক্তির প্রতীক সিংহ আর তার উপরে দেবী জগদ্ধাত্রী। স্বামী নির্মলানন্দ দেবী জগদ্ধাত্রীর মূর্তির বর্ণনা করে বলেছেন তিনিই মানুষের মত্ত মনকে বশ করতে পারেন। তিনি লিখেছেন, “আমাদের মন মত্ত হস্তীর ন্যায় সর্ব্বদা মদান্বিত। সে অস্থির, উন্মাদ। এই দুরন্ত মনকরীকে সদা উদ্যমশীল বিবেকসিংহের দ্বারা মর্দ্দন করতে হবে— মহাশক্তিরূপিণী দেবীর বশীভূত করতে হবে। মন বশীভূত হ’লেই অন্তরে চৈতন্যময়ী জগদ্ধাত্রীর মহাপ্রকাশ অনায়াসলভ্য হয়।”
শাস্ত্রকার, পুরাণকারদের বক্তব্য, সিংহারূঢ়া জগদ্ধাত্রী যাঁকে রক্ষা করেন তাঁর পতন নেই, বিনাশ নেই। মূলত কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতেই জগদ্ধাত্রী পুজো বিহিত। তবে অনেক জায়গাতেই সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিথিতে আলাদা আলাদা পুজো হয়। নবমী তিথিতে একসঙ্গে তিন তিথির পুজোও করা হয়।
“দয়া রূপে দয়া দৃষ্টে দয়ার্দ্রে দুঃখ মোচনি।
সর্ব্বাপত্তারিকে দুর্গে জগদ্ধাত্রী নমহস্তুতে।।”