‘সাজানো বাগান’ ফেলে চলে গেলেন ‘বাঞ্ছারাম’

হেমন্তের এক পাতাঝরা সকালে ‘সাজানো বাগান’ ফেলে রেখে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ‘বাঞ্ছারাম’ মনোজ মিত্র| তাঁর একাধিক প্রয়াণ সংবাদে ‘বাগান’ শব্দটির বারংবার ব্যবহার ক্লান্তিকর ঠেকতে পারে| মনে হতে পারে মনোজ মিত্রের সৃষ্টির ফসল কি কেবল ওই ‘সাজানো বাগান’টিতেই ফলেছে? আর সেই বাগানের সম্পত্তির মালিকানার সূত্রে একমাত্র ‘বাঞ্ছা’র টাইপকাস্টেই কি মনোজ মিত্রের অন্য সব পরিচয় ঢাকা পড়ে গিয়েছে?

বিষয়টা ঠিক তা নয়| আসলে মনোজ মিত্রের এই ‘সাজানো বাগান’ –এর রূপকে জীবনের এক গভীর দর্শন ধরা পড়েছে| Anna B Kunzwal –এর একটা ইংরেজি কবিতায় পড়েছিলাম –

“We all grow up in a garden called life

There are many inner and outer strifes

Every garden need sunshine and rain

In this garden you wiil find joy and pain…”

সত্যিই তো আমাদের জীবনটা একটা বাগানের মতো| যার বীজতলা প্রস্তুত করে আমরা স্বপ্নের বীজ বুনি, সময়ের সঙ্গে তা অংকুরিত হয়, আমাদের মননে তা পুষ্টি পায়, অভিজ্ঞতায় জলসিঞ্চিত হয়, প্রত্যাশার ডালপালা ছড়ায়| সে বাগান কখনও সুখের কিরণে ঝলমল করে, কখনও দুঃখের বৃষ্টিতে ভেজে| কখনও সে বাগানে আসে বিপর্যয়ের ঝড় আসে, কখনও ভুল ত্রুটির অবাঞ্ছিত আগাছা জন্মায়| এরই মধ্যে জীবনের বাগান সেজে ওঠে প্রাপ্তি-সাফল্যের ফুলে-ফলে, হাসি আনন্দের সতেজতায়| আবার কখনও হয়তো কালাতিপাতের ধূসরতায়| 

মনোজ মিত্রের ‘সাজানো বাগান’ এই চিরসত্যেরই একটি রূপক| তাঁর গোটা জীবনটাকেই তিনি সাজিয়েছেন অতি প্রিয় বাগানের মতো করে| কত রকমের চরিত্রাভিনয়ে ফুটিয়েছেন কত ফুল| গদ্যকার, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, রবীন্দ্রভারতীর নাট্য বিভাগের অধ্যাপক, নাট্য-প্রশিক্ষক, নাট্য-সংগঠক এমন কত শাখায় তাঁর প্রতিভা প্রসারিত হয়েছে|

মনোজ মিত্রের জন্ম 1938 সালের 22 ডিসেম্বর| অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার সাতক্ষীরার ধূলিহর গ্রামে| ওখানেই তাঁর উত্তরজীবনের স্বপ্নবোনার জন্য মাটিছানার কাজটি শুরু হয়েছিল| ওই গ্রামে বিভিন্ন উপলক্ষে মঞ্চে নাটক-থিয়েটারের চল ছিল| মনোজ মিত্রের ঠাকুরদা অবশ্য থিয়েটারের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন| কিন্তু তিনি গ্রামের ইউনিয়ন বোর্ডের চেযারম্যান হওয়ায় তাঁর বাড়িতে থিয়েটারের সেট-সেটিং, দৃশ্যপট রাখা থাকত| সেসব দেখতে ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারের জন্য আকর্ষণ জন্মে গিয়েছিল মনোজ মিত্রের| ঠাকুমার কাছে শুনেছিলেন, খুলনায় তাঁদের গ্রামের বাড়ির কাছেই একটা বাগানে চালাঘর বেঁধে থাকত সাদা দাড়িওলা, এক ফকফকে বুড়ো| সারাদিন সে গাছপালা পাহারা দিত, তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করত| ছোটবেলার সেই বুড়োর চিত্রটাই পরে তাঁর লেখায় ‘বাঞ্ছারাম’ চরিত্রে ছায়া ফেলেছে| ছেলেবেলাতে বিজয়াদশমীর জলসায় তাঁদের গ্রামে মনোজ মিত্রের প্রথম মঞ্চে পা রাখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রোগের চিকিত্সা’ নাটকে, হারাধনের চরিত্রে| সেখানে একটি দৃশ্যে হারাধনের জামার নীচে তুলোর হাঁস রাখার কথা ছিল| পরিকল্পনামতো ওই দৃশ্যে যখন হারাধনের পেটে সাহেব পুলিশ খোঁচা মারবে, তখন পরিচালক হাঁসের ডাক ডেকে উঠবে| কিন্তু কিশোর মনোজ ভাবলেন, তুলোর হাঁসের বদলে যদি সত্যিকারের হাঁস নিয়ে মঞ্চে ওঠা যায়, তাহলে দশর্করা আরও বেশি মজা পাবেন| নির্ধারিত দৃশ্যে হারাধনের পেটে পুলিশ খোঁচা দিতেই পরিচালকের নকল হাঁসের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে নবাগত অভিনেতার জামার নীচে লুকিয়ে রাখা আসল হাঁসও ডেকে উঠল| সেদিন মঞ্চে হারাধনের অভিনয়ে দর্শকরাও অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন ঠিকই| কিন্তু কিশোর মনোজের জামার নীচে লুকনো হাঁসের নখের আঁচড়ে তার বুক পেটে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল| জীবনের প্রথম অভিনয়েই শরীরের রক্তক্ষরণ দিয়ে দর্শকদের অনাবিল আনন্দ দিতে চেয়েছিলেন মনোজ মিত্র| সারাজীবন ধরে মঞ্চে এই রিয়েলিস্টিক অভিনয়ই করে গিয়েছেন মনোজ মিত্র| এমনকী তাঁর লেখা নাটকের চরিত্রগুলিও প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সাফল্য-ব্যর্থতা, আনন্দ বেদনার ছাঁচে মূর্ত হয়েছে| প্রাত্যহিক অভিব্যক্তিতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে| ইতিহাস কিংবা পুরাণের গল্পের চরিত্রগুলি দেখেও কেমন যেন চেনা মানুষ বলে মনে হয়েছে| 

কৈশোর কাটতে না কাটতেই তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে হল দেশভাগের যন্ত্রণা| দেখলেন একদল মানুষ কীভাবে রাতারাতি ‘উদ্বাস্তু’তে পরিণত হয়ে যায়| 1950 সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে মনোজ মিত্রকেও শিকড় উপড়ে, তাঁর বাল্যের বাড়িঘর ছেড়ে হয়ে চলে আসতে হল এপার বাংলায়| সেইসব মানুষ ছিন্নমূল হয়ে এপারে এলেও তাঁদের সঙ্গে লেগে থাকা শিকড়ে লেগে রইল মাটি কামড়ে পড়ে থাকার অদম্য দৃঢ়তা, প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে থাকার অনিঃশেষ সজীবতা, আর মাথার উঁচু করে আকাশ দেখার সংকল্পের ঋজুতা| মনোজ মিত্রও তার উত্তরাধিকারী ছিলেন| এভাবেই তিনি কিশলয় থেকে পরিণত বৃক্ষের আকার নিচ্ছিলেন| ছেলেবেলায উদ্বাস্তু হয়ে শেকড় ছেঁড়ার ব্যথাকে উত্তরকালে তিনি একটু একটু জারিত করেছেন তাঁর সৃজনের আরকে| চড়া মেক-আপ-এর পরতে সেই শেকড় ছেঁড়া সেই যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখতে চাইলেও কখনও তা ধরা পড়েছে নাটকের মঞ্চে স্পটলাইটের আলো এসে মুখের ভাঁজে, চোখের তারায়|

স্কুলজীবন শেষ করে দশর্ন শাস্ত্র নিয়ে স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই মনোজ মিত্রের চোখের সামনে একটা বড় জগত খুলে গেল| একদিকে বিপিন মাস্টারমশাইয়ের মতো স্কটিশচার্চ কলেজের শিক্ষক| যিনি ছাত্রদের কলেজ থেকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন, তারপর নিজের পয়সায় রসগোল্লাও খেতে নিয়ে যেতেন| এই ধরনের মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গ পেয়ে মনোজ মিত্রের জীবনে সূর্যতোরণের আলো এসে পড়ল| অন্যদিকে কলেজের সহপাঠী বাদল সরকার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, অতনু সর্বাধিকারী প্রমুখ নাট্যপ্রেমীদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় সেই ছেলেবেলায় নাটকের নেশাটা চড়তে লাগল| নাট্যচর্চার সার-জল পড়তে লাগল ছেলেবেলার নিড়ানো মাটিতে| ছেঁড়া শেকড় গভীরে যেতে শুরু করল| এর মধ্যেই স্কটিশ থেকে 1958 সালে স্নাতক হওয়ার পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর এবং তারপরে গবেষণায় দিকে পা বাড়ানো| কিন্তু তার আগেই কলেজ জীবন থেকেই তো তাঁর মনের মধ্যে থাকা নাট্যপ্রেমের লতানো গাছটি উর্বর মাটি থেকে রসসঞ্চয় করে ভিন্নপেথ বাঁক নিতে চাইছে| চলার পথে পায়ে এসে পড়ছে ভিন্ন টান| 

1956-57 সালে পার্থপ্রতিম চৌধুরীর সুন্দরম নাট্যদলে যুক্ত হয়ে ম়ঞ্চে অভিনয় করছেন| 1958 সালে সুন্দরম –এর ব্যানারে পথের পাঁচালীর মঞ্চাভিনয়ে অপু’র চরিত্র পার্থপ্রতিম চৌধুরী, বন্ধু প্রণব-এর চরিত্রে মনোজ মিত্র| কিন্তু সুন্দরম দলের সিনেমার অনুসরণের ঘরানায় মন সায় দিচ্ছে না তরুণ মনোজ মিত্রের| 1959 সালে প্রথম লিখলেন ‘মৃত্যুর চোখে জল’ নাটকটি| নিজে অভিনয়ও করলেন বিভিন্ন মঞ্চে| একুশের তারুণ্য নিয়েই মেক-আপে, সংলাপে, অভিব্যক্তিতে এক বৃদ্ধের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুললেন মঞ্চে| ‘মৃত্যুর চোখে জল’ পরিবারের সকলের প্রায় পরিত্যক্ত সিঁড়ি ঘরের নীচে এককোণে আশ্রয় নেওয়া এক বৃদ্ধের গল্প| যিনি ভীষণভাবে বেঁচে থাকতে চান স্বার্থপরের মতোই|এমনকী একমাত্র নাতির মৃত্যুর পরেও কান্নাকাটি করেন না, পাছে হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে| পরিবারের সকলের কাছে অবাঞ্ছিত হলেও সেই বৃদ্ধের একমাত্র মনোবাঞ্ছা বহুদিন বেঁচে থাকা| একুশের যুবক মনোজ মিত্রের লেখা এই ‘মৃত্যুর চোখে জল’ পেয়েই উত্তরকালের ‘বাঞ্ছারাম’ অংকুরিত হতে থাকে হয়তো| তারপর থেকে তো মনোজ মিত্রের নাট্যচর্চার চিলতে বাগানে সমানে জল পড়তে আর পাতা নড়তে লাগল| গজিয়ে উঠতে থাকল কত গাছ|

1960 সালে যখন তিনি ঠাঁইনাড়া হয়ে কলকাতা থেকে  রানিগঞ্জে চলে গেলেন অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে| কিন্তু পেশার মধ্যেও নাটকের নেশা তাঁকে ছেড়ে যায়নি| বরং কলেজের চাকরির অবসর সময়ের মধ্যে তিনি একের পর এক নাটক লিখে চললেন| চার বছর পরে কলকাতায় ফিরে প্রথমে বিকেসি এবং পরে নিউ আলিপুর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করলেন| সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল নাট্যরচনা, মঞ্চাভিনয়ের কাজ| শ্যামল ঘোষের গন্ধর্ব নাট্যপত্রে ‘মোরগের ডাক’ প্রশংসিত হল| ‘পরবাস’, ‘দম্পতি’, ‘কেনারাম বেচারাম’ সৃষ্টির ফুল ফুটতে লাগল বাগানের গাছে গাছে| 1972 সালে ‘চাক ভাঙা মধু’ সুন্দরবনের জীবনের আলেখ্যে আধারিত| ওই নাটক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর সুন্দরম দলের হয়ে মঞ্চস্থ হওয়ার কথা থাকলেও তখন ওই দলের পরিস্থিতি ছিল না প্রোডাকশান মঞ্চস্থ করার| অপর্ণা সেন আর মনোজ মিত্র ছাড়া ওই নাটকের বাকি কুশীলবরা সুন্দরম দলের ছন্নছাড়া অবস্থার জন্য অভিনয় করতে উত্সাহ পাচ্ছিলেন না নাটক করতে| কিন্তু ততদিনে ‘চাক ভাঙা মধু’j গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন অনেক বিদগ্ধ নাট্য জগতের মানুষ| সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী দুজনেই মঞ্চস্থ করার জন্য চাইছেন ‘চাক ভাঙা মধু’| শেষ পর্যন্ত বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় মনোজ মিত্রের লেখা ‘চাক ভাঙা মধু’ নাট্যকার হিসেবে তাঁকে খ্যাতির শিখরের দিকে নিয়ে যেতে লাগল| এরপর অবসন্ন প্রজাপতি, নীলা, ফেরা, তক্ষক, অশ্বত্থামা, সিরাজউদ্দৌল্লা, পাহাড়ি বিছে, ব্ল্যাক প্রিন্স – একাধারে নাটক লেখা এবং সেই সঙ্গে চরিত্রাভিনয় বাগান ভরে উঠতে লাগল নানার জাতের গাছে| কোনও অভিনয়ে বেদনার রক্তাভ দানা, কোনওটায় ক্রোধের ঝাঁঝ, কোনওটায় জিজ্ঞাসার কন্টকমুখ, কোথাও আবার খোসা কয়েক পরত নীচের রহস্য উন্মোচন| মনোজ মিত্রের অভিনয়ের ভিন্নধর্মী অভিব্যক্তিতে বোঝা গেল তিনি এক সমঝদার বাগানবিলাসী| নানান জাতের অভিনয়ের ফলন ফলাতে অভিজ্ঞ| 

এরই মধ্যে কিছুদিন ‘সুন্দরম’ দল থেকে বিদায় নিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘ঋতায়ন’ নামে নাট্যদল| কিন্তু 1976 পর্যন্ত আবার ফিরলেন ‘সুন্দরম’ -এ| সুন্দরম –এর অগোছালো ঘরসংসার নতুন করে সাজিয়ে তুললেন| নরক গুলজার নাটক মঞ্চস্থ হল| 1977 সালে এই নবকলেবরের ‘সুন্দরম’ নাট্যদলের ব্যানারে মনোজ মিত্রের লেখা সাজানো বাগান| বাংলার দর্শকদের কাছে সেটা এল এক অন্যধারার নাটক হয়ে| সেখানে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব রয়েছে, পরিবেশ সচেতনতা রয়েছে, সামাজিক, মনস্ত্বাত্তিক টানাপোড়েনকে বুনে দেওয়া হল একটা নিটোল গল্পের বুনোটে| হাস্যরসের জলঝারিতে ভিজিয়ে দেওয়া হল গম্ভীর বক্তব্যের শক্ত জমি| দশর্করা সেই মাটিতে জিরিয়ে আরাম পেলেন|

1979 সালে আকাদেমিতে সাজানো বাগান –এ মনোজ মিত্রের অভিনয় দেখে তপন সিংহ ওই নাটক চলচিত্রায়িত করার জন্য মনোজ মিত্রের কাছে প্রস্তাব দেন| তার আগে অবশ্য চিদানন্দ দাশগুপ্তের ‘বিলেত ফেরত’ সিনেমায় পরিবর্ত অভিনেতা হিসেবে এবং উতপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘ময়না তদন্ত’ সিনেমায় লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশান-এর দুনিয়ায় জমিতে পা রেখেছেন মনোজ মিত্র| কিন্তু তপন সিংহের পরিচালনায় 1980 সালে মুক্তি পাওয়া ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমায় তাঁর মঞ্চের সাজানো বাগান যেন সেলুলয়েডের চওড়া দ্যুতিতে একেবারে ঝলমল করে উঠল| এই সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র তিনি| এমনকী চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্বও মনোজ মিত্রের ওপরেই দিয়েছিলেন তপন সিংহ|  

বাসু চ্যাটার্জি, তপন সিংহ, সত্যজিত রায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তরুণ মজুমদারের মতো সমান্তরাল ধারার সিনেমার পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন মনোজ মিত্র| আবার অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, বীরেশ চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন চৌধুরী, প্রভাত রায়, হরনাথ চক্রবর্তীর মতো বাণিজ্যিক ছবির পরিচালকের ছবিতেও তিনি অনায়াসে অভিনয় করে গিয়েছেন| আসলে কোথাও টাইপকাস্ট হয়ে থাকতে চাননি তিনি| বারবার নিজের ফর্মকে ভেঙেছেন| বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘মোহনার দিকে’ যিনি গ্ল্যামারাস বৃদ্ধ বাঙালি সাহেব, তিনিই তপন সিংহের ‘আদালত ও একটি মেয়ে’তে দাপুটে পুলিশ অফিসার, অঞ্জন চৌধুরীর ‘শত্রু’তে খলনায়ক, কিংবা সত্যজিত রায়ের ‘গণশত্রু’তে ‘মাত্রা’ সচেতন সূত্রধর কিংবা ‘হুইল চেয়ার’-এ এক মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা এক প্রৌঢ় যিনি একসঙ্গে ভোগ এবং ত্যাগের মধ্যে মিলমিশ ঘটিয়ে দিতে পারেন| থিয়েটারের বেড়া ডিঙিয়ে সেলুলয়েডের বাগিচায় তিনি প্রবেশ করেছিলেন বেশ খানিকটা পরিণত বয়সেই| কিন্তু সেখানেও তাঁর ফুলে-ফলে ভরভরন্ত হয়ে উঠতে বিশেষ সময় লাগেনি| সিরিও কমিক অভিনেতা হিসেবে উতপল দত্তের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর নাম এসে পড়ে| টেলিভিশনে রাজা সেনের ধারাবাহিক আদর্শ হিন্দু হোটেল –এ হাজারি ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় তাঁকে এনে দিয়েছে পুরস্কার| বাংলা অভিনয় জগতে শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা হিসেবে একটা মহীরুহের ঝুরি নামিয়েছেন মনোজ মিত্র| তাঁর পরিচর্যার স্পর্শ যেখানেই পড়েছে, সেখানেই ফুটেছে ফুল, ধরেছে ফল, উর্বর হয়েছে মাটি| তাঁর অজস্র সৃজনে ভরিয়ে তোলা বাগান, তাঁর সাজানো বাগান|

কিছুদিন আগেই মনোজ মিত্র জানিয়েছিলেন অনেক কিছু করার ভাবনা রয়েছে এই সাজানো বাগান নিয়ে| কিন্তু সে ইচ্ছেপূরণ হল না, তার আগেই ছিয়াশি বছর বয়সে তিনি পাড়ি দিলেন মৃত্যুর দেশে| তারপরেও রয়ে গেল তাঁর সৃষ্টির ফুলে-ফলে ভরিয়ে তোলা, তৃণদলে-বৃক্ষতলে ছেয়ে যাওয়া তাঁর সাজানো বাগান| যে বাগানে মনোজ মিত্র জীবনের প্রতি চরম মোহে-মায়ায় উচ্চারণ করেছিলেন ‘এই জনমে আমার আর মরা হল না কত্তা, আমি মরতি পারব না…’| আচ্ছা, অমরত্ব পাওয়ার এই অলীক, অধরা মনোবাঞ্ছা কি ‘বাঞ্ছারাম’-এর একার? তা কি আমাদের সকলের নয়?